কৃষ্ণের সহিত পার্থ মহাধনুর্দ্ধর।
হেনমতে চলিলেন সংগ্রাম ভিতর।।
মাদ্রী-পুত্রদ্বয় সহ বীর বৃকোদর।
নিরখিয়া কুরুবল বরিষরে শর।।
সারথি বিশোক নামে তারে ভীম পুছে।
আমার রথেতে দেখ কত অস্ত্র আছে।।
আজি রণে পড়িবে সকল কুরুগণ।
নতুবা আমারে মারিবেক দুর্য্যোধন।।
ভীমের বচনে তবে বিশোক দেখিল।
ষাটি সহস্রেক বাণ গণিয়া বলিল।।
দশ সহস্রেক বাণ বজ্রের সমান।
আর যত বাণ আছে কে করে গণন।।
অবশিষ্ট কত বাণ রথোপরি রহে।
বিশোক সারথি তবে ভীম প্রতি কহে।।
তবে ভীমসেন বীর প্রতিজ্ঞা করিল।
আজিকার রণেতে কৌরব হত হৈল।।
যতক্ষণ না আইসে কৃষ্ণ ধনঞ্জয়।
সুসজ্জা করহ রথ করিতে বিজয়।।
সহসা উত্তরদিকে হৈল কোলাহল।
ছাইল অর্জ্জুন-বাণ গগন-মণ্ডল।।
চতুরঙ্গ সেনা পড়ে অর্জ্জুনের বাণে।
সৌবল বলিল শুন রাজা দুর্য্যোধন।
হের দেখ সৈন্য ক্ষয় করিল অর্জ্জুন।।
আমি অগ্রসরি করি ভীমেরে সংহার।
মজিল কৌরব সৈন্য নাহিক নিস্তার।।
মহাবল সৌবল ভীমের প্রতি ধায়।
মহাযুদ্ধ ঘোরতর হইল তথায়।।
মারিলেক শক্তি ভীম সৌবলের মাথে।
সেই শক্তি সৌবল ধরিল বামহাতে।।
সেই শক্তি ফেলি মারে ভীমের উপরে।
বাহুবিন্ধি রথোপরে পাড়িল ভীমেরে।।
পুনঃ উঠি ভীমসেন বিন্ধিল সৌবলে।
মুর্চ্ছিত সৌবল রাজা পড়িল ভূতলে।।
রথ ফিরাইয়া নিল রথের সারথি।
ভঙ্গ দিল কুরুবল যত সেনাপতি।।
ভঙ্গ দিল আপনি নৃপতি দুর্য্যোধন।
সৈন্যগণ লন গিয়া কৃষ্ণের শরণ।।
যুঝিতে আইল কর্ণ দেখি সৈন্যভঙ্গ।
জ্বলন্ত অনল যেন দেখিতে তুরঙ্গ।।
পাণ্ডবের সৈন্য সব বরিষয়ে শর।
বেড়িয়া মারয়ে সব কর্ণ ধনুদ্ধর।।
সাত্যকিরে বিন্ধিল বিংশতি মহাশরে।
শিখণ্ডীরে দশ বাণ পঞ্চ বৃকোদরে।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন শত বাণ মারে বজ্র শরে।
সপ্তদশ বাণ মারে দ্রুপদকুমারে।।
সংশপ্তকে মারে সহদেব দশ শর।
সাত বাণ মারিল নকুল ধনুর্দ্ধর।।
ক্রমেতে বিন্ধিল ভীম ত্রিশ মহাশর।
সব শর নিবারিল কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
ক্রমেতে বিন্ধিল ভীম ত্রিশ মহাশর।
সব শর নিবারিল কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
হাসিয়া বিজয় ধনু লইলেক হাতে।
বাণাঘাতে সর্ব্ব সৈন্য যায় চতুর্ভিতে।।
সাত্যকির ধ্বজ কাটি কাটে শরাসন।
আর বাণ হৃদয়ে বিন্ধিল সেইক্ষণ।।
রথ শূণ্য হইলেন সাত্যকি তখন।
তিন বাণে সারথিরে করিল নিধন।।
নিমিষে বিমুখ কৈল সব ধনুর্দ্ধর।
ভীত হয়ে সৈন্য সব পলায় সত্বর।।
দূরে থাকি দেখেন অর্জ্জুন মহাবীর।
দেবাসুর যুদ্ধে যায় নির্ভয় শরীর।।
কৃষ্ণেরে বলেন মহাবীর ধনঞ্জয়।
হের দেখ কর্ণবীর যুঝয়ে নির্ভয়।।
ভাঙ্গিল পাণ্ডব দল সৈন্য দিল ভঙ্গ।
পলাইয়া যায় যেন আকুল তরঙ্গ।।
ঝাট রথ চালাও গোবিন্দ মহাবল।
সংগ্রামে মারিব আজি কৌরব সকল।।
হাসিয়া চালান রথ গোবিন্দ সারথি।
দূরে থাকি রণ দেখে কুরু নরপতি।।
কর্ণেরে বলিল তবে রাজা দুর্য্যোধন।
হের দেখ আসিতেছে নর নারয়ণ।।
ক্রোধভরে আইল অর্জ্জুন ধনুর্দ্ধর।
ইহা সম বীর নাহি সংগ্রাম ভিতর।।
সর্ব্ব সৈন্য আদেশিল কর্ণ মহামতি।
সবে মেলি মার আজি পার্থ মহামতি।।
অশ্বথামা দুঃশাসন বীর আদি করি।
অর্জ্জুনেরে বেড়িল যে কর্ণ আগুসারি।।
অর্জ্জুনের বাণে সব বিমুখ হইল।
হাতে অস্ত্র কর্ণবীর রণে প্রবেশিল।।
সাত্যকি বিন্ধিল বাণ কর্ণ বিদ্যমান।
কাটিয়া সকল সৈন্য করে খান খান।।
গদা লয়ে ভীমসেন করে মহারণ।
সহস্র সহস্র পড়ে গজ অগণন।।
তবে দুঃশাসন বীর বাছি মারে শর।
তিন বাণে বিন্ধিল ভীমের কলেবর।।
কাটিয়া হাতের ধনু রথের সারধি।
শরেতে জর্জ্জর হৈল ভীম মহামতি।।
মত্তগজ সব বীর গদা লয়ে হাতে।
যম সম আইলেন সংগ্রাম করিতে।।
গদা ফেলি মারিলেন দুঃশাসন শিরে।
দুঃশাসন পড়ে শত ধনুক অন্তরে।।
সারথ কবচ অশ্ব আর শরাসন।
গদার প্রহারে চূর্ণ কৈল সেইক্ষণ।।
রথেতে পড়িল যদি বীর দুঃশাসন।
পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা ভীম করিল স্মরণ।।
শীঘ্র গেল যথায় পড়িল দুঃশাসন।
রথ হৈতে লাফ দিয়া পড়ে সেইক্ষণ।।
দাণ্ডাইয়া দেখে যত কৌরব কুমার।
বাহু আস্ফালিয়া ভীম বলে বার বার।।
দুঃশাসন দুরাত্মার রক্ত করি পান।
কার শক্তি আজি এরে করে পরিত্রাণ।।
ক্রোধমনে ভীমসেন কহে উচ্চৈঃস্বরে।
ধরিল রাক্ষসমূর্ত্তি সংগ্রাম ভিতরে।।
অতিক্রোধে ভীমসেন সংগ্রামে অপার।
খড়গ লয়ে বিদারিল হৃদয় তাহার।।
বেগে রক্ত উঠে প্রস্রবণের সমান।
মহানন্দে ভীমসেন করে তাহা পান।।
করিয়া শোণিত পান কহে বৃকোদর।
অমৃত পানেতে যেন ভরিল উদর।।
মধু-ঘৃত-শর্করাতে নাহি পরিতোষ।
মায়ের দুগ্ধ্বেতে যত না হয় সন্তোষ।।
ততোধিক তৃপ্তি হয়, ঘুচে অবসাদ।
কি মধুর দুরাত্মার রুধিরের স্বাদ।।
দুর্য্যোধন কর্ণবীর দেখে বিদ্যমান।
ভীমসেন করে দুঃশাসন-রক্ত পান।।
রক্ত পিয়ে ভীমসেন সংগ্রাম ভিতরে।
রাক্ষস বলিয়া লোক পলাইল ডরে।।
দেখিয়া ধাইল বীর কর্ণ মহামতি।
ভীমের উপরে বাণ মারে শীঘ্রগতি।।
যুধামন্যু মহাবীর যুড়ি শর মারে।
চিত্রসেন মহাবীর পড়িল সমরে।।
দুঃখী হয়ে দুর্য্যোধন ভ্রাতার মরণে।
পাণ্ডব সৈন্যেতে তবে আইল আপনে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশী কহে কর্ণ পর্ব্বে মরে দুঃশাসন।।