শুভক্ষণ করিয়া চলেন তিন জন।
স্নাতক-বিপ্রের বেশ করিয়া ধারণ।।
পদ্মসর লঙ্ঘিল পর্ব্বত কালকূট।
গণ্ডকী শর্করাবর্ত্ত বিষম সঙ্কট।।
সরযূ অযোধ্যা আর নগর মিথিলা।
ভাগীরথী সরস্বতী যমুনা আইলা।।
পার হৈয়া পূর্ব্বমুখে যান তিন জনে।
মগধ রাজ্যেতে উত্তরিলা কত দিনে।।
চৈত্যরথ আদি করি পঞ্চ গোটা গিরি।
তাহার মধ্যেতে বৈসে গিরিব্রজ-পুরী।।
অনুপম দেশ সেই দেখিতে সুন্দর।
গো মহিষ ধন ধান্যে শোভিত নগর।।
ভীমার্জ্জুনে বলেন গোবিন্দ মহামতি।
এই পঞ্চ গিরি মধ্যে নগর বসতি।।
পঞ্চ পর্ব্বতের কথা শুন দুই জন।
শত্রু দেখি দ্বার রুদ্ধ হয় ততক্ষণ।।
আর এক আশ্চর্য্য আছয়ে দুয়ারেতে।
তিনগোটা ভেরী শব্দ করে আচম্বিতে।।
শত্রু দেখি ভেরী শব্দ করয়ে যখন।
সজাগ হইয়া সেনা করয়ে সাজন।।
দ্বারে আছে দুই নাগ শত্রু দেখি দংশে।
যার ভয়ে রিপু নাহি নগরে প্রবেশে।।
মহারথিগণ সব রক্ষা করে দ্বার।
ইহার উপায় এক করহ বিচার।।
অর্জ্জুন বলেন, ভৈরী রৈল মোর ভাগে।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, নিবারিল দুই নাগে।।
ভীম বলিলেন, মোর পর্ব্বতের ভার।
অন্য পথে যাব পুরে, না যাইব দ্বার।।
এইরূপ বিচারিয়া তবে তিন জন।
দ্বার ত্যাজি করিলেন গিরি আরোহণ।।
নাগের কারণে দেব কৃষ্ণ মহামতি।
খগপতি স্মরণ করেন শীঘ্রগতি।।
আইল ভুজঙ্গ-রিপু কৃষ্ণের স্মরণে।
এ তিন ভুবন কাঁপে যাহার গর্জ্জনে।।
ভয়েতে ভুজঙ্গ দুই প্রবেশে পাতালে।
কৃষ্ণেরে মেলানি মাগি খগপতি চলে।।
ভেরী হেতু অর্জ্জুন এড়িল শব্দভেদী।
এক অস্ত্রে তিন ভেরী ফেলিলেন ছেদি।।
চৈত্যগিরি পৃষ্ঠে ভীম কৈল আরোহণ।
রিপু দেখি গিরিবর করয়ে গর্জ্জন।।
গিরিশৃঙ্গ ধরি ভীম উপাড়িল করে।
আচল হইল গিরি মুষ্টির প্রহারে।।
পর্ব্বত লঙ্ঘিয়া কৈল নগরে প্রবেশ।
সুরপুর সম দেখি জরাসন্ধ-দেশ।।
হাট বাট নগর চত্বর মনোহরা।
নগর ভিতরে বৈসে বিবিধ পসরা।।
সুগন্ধি কুসুম মাল্য দেখি সুশোভন।
বলে লয়ে তিন জন করেন ভূষণ।।
পূর্ব্ব দ্বার লঙ্ঘিয়া গেলেন তিন জনা।
অন্তঃপুরে যাইতে ব্রাহ্মণে নাহি মানা।।
তিন দ্বার লঙ্ঘি তবে যান অন্তঃপুর।
যথা আছে মহীপাল জরাসন্ধ শূর।।
যজ্ঞ দীক্ষা লইয়াছে, যজ্ঞেতে তৎপর।
উপবাস-ব্রতী হয়ে আচে একেশ্বর।।
কেবল ব্রাহ্মণগণ আছে তথাকারে।
বিনা নিমন্ত্রণে অন্যে যাইতে না পারে।।
তিন দ্বিজ দেখি রাজা উঠি যোড় হাতে।
আগুসারি অভ্যর্থনা করে কত পথে।।
বসিবারে দিল দিব্য কনক আসন।
স্বস্তি স্বস্তি বলিয়া বৈসেন তিন জন।।
তিন জন মূর্ত্তি রাজা করে নিরীক্ষণ।
শাল বৃক্ষ কোঁড়া যেন অঙ্গের বরণ।।
আজানুলম্বিত ভুজ ভুজঙ্গ-আকার।
অস্ত্রচিহ্ন-লেখা আছে অঙ্গে সবাকার।।
ভূষণ বিবিধ মাল্য দেখিয়া রাজন।
নিন্দা করি বলিতে লাগিল ততক্ষণ।।
ব্রতী বিপ্র হৈয়া কেন হেন অনাচার।
সুগন্ধি চন্দন মাল্য অঙ্গে সবাকার।।
মুনিগণ কহে আর আমি জানি ভালে।
ব্রাহ্মণ কখন মাল্য নাহি পরে গলে।।
পরিধান বহুবিধ বিচিত্র বসন।
বিপ্রদেহে অস্ত্রচিহ্ন কিসের কারণ।।
সত্য কহ তোমরা, কে হও কোন্ জাতি।
কি হেতু আইলা বল আমার বসতি।।
দ্বিজ বিনা আসে হেথা নাহি অন্য জন।
চোর রূপে আসিয়াছ লয় মোর মন।।
চৈত্যগিরি শৃঙ্খ ভাঙ্গি বুঝি এলে প্রায়।
রাজদ্রোহ পাপ ভয় নাহিক তোমায়।।
কি হেতু আইলা কোন্ ভিক্ষা অনুসারে।
কোন্ বিধিমতে পূজা করি সবাকারে।।
এত শুনি বাসুদেব বলেন বচন।
গভীর নিনাদ যেন জলদ গর্জ্জন।।
পুস্পমাল্য সদা রাজা লক্ষ্মীর আশ্রয়।
লক্ষ্মীপ্রিয় কর্ম্মে বল কার বাঞ্জা নয়।।
দ্বারে না আইলে হেন বলিলে বচন।
শত্রুগৃহ-দ্বারে মোরা না যাই কখন।।
কোনরূপে শত্রুগৃহে পশি মহারাজ।
যেই হেতু আসিয়াছি করিব সে কাজ।।
জরাসন্ধ বলে, মম না হয় স্মরণ।
কবে শত্রু আমার তোমরা তিন জন।।
না হিংসিতে যেই জন হিংসা আসি করে।
তার সম পাপী নাহি সংসার ভিতরে।।
কারো হিংসা নাহি করি, আমি মনে জানি।
কিমতে তোমরা শত্রু, কহ দেখি শুনি।।
গোবিন্দ বলেন, তুমি কহ বিপরীত।
তোমার যতেক হিংসা জগতে বিদিত।।
পৃথিবীর রাজা সব বান্ধি আনি বলে।
পশুবৎ করি রাখিয়াছ বন্দিশালে।।
মহাদেব বলি দিবা শুনিনু শ্রবণে।
বল দেখি হেন কর্ম্ম করে কোন্ জনে।।
নাহি দেখি, নাহি শুনি হেন বিপরীত।
জ্ঞাতিগণে বলি দিবা, অধর্ম্ম চরিত।।
আপদভঞ্জন আদি ধর্ম্মের রক্ষণ।
জ্ঞাতি-হিংসা দেখিতে না পারি কদাচন।।
সেই হেতু আসিয়াছি দুষ্টের দমনে।
কতবার দেখিয়াছ, নাহি চিন কেনে।।
ত্রয়োবিংশ অক্ষৌহিণী অষ্টাদশ বার।
হারি পলাইলা সব করিলা সংহার।।
সেই কৃষ্ণ আমি বসুদেবের নন্দন।
পাণ্ডুপুত্র ভীমার্জ্জুন এই দুই জন।।
আপনার হিত যদি বাঞ্ছয় রাজন।
আমার বচনে রাজা ছাড় রাজগণ।।
নহে, যুদ্ধ কর রাজা আমার সংহতি।
দুই কর্ম্মে যেবা ইচ্ছা, হয় তব মতি।।
শ্রীকৃষ্ণের বচনে জ্বলিল জরাসন্ধ।
অমেষ বিশেষে গোবিন্দেরে বলে মন্দ।।
পূর্ব্বকথা বিস্মরণ হইল তোমার।
যুদ্ধে পলাইয়া গেলে শৃগাল আকার।।
পৃথিবী ছাড়িয়া গেলে সমুদ্র ভিতরে।
কভু নাহি শুনি পুনঃ এসেছ নগরে।।
এখন তোমাকে দেখি আপনার দেশে।
করিলে অদ্ভুত কর্ম্ম কেমন সাহসে।।
দর্প করি কহিলে ছাড়িতে রাজগণ।
কাহার শরীরে সহে এমত বচন।।
ভুজবলে বান্ধি আনিলাম রাজগণে।
সঙ্কল্প করেছি বলি দিব ত্রিলোচনে।।
পূর্ব্বকথা তব বুঝি নাহিক স্মরণ।
যাহ গোপসূত, লজ্জা নাহি কি কারণ।।
সংগ্রাম মাগিলা তার না বুঝি কারণ।
তোমা ছার সহিত যুঝিবে কোন্ জন।।
যেবা ভীমার্জ্জুন, দেখি অত্যল্প বয়স।
ইহাদের সহ যুদ্ধে হইবে অযশ।।
মারিলে পৌরুষ নাহি হারিলে অযশ।
পলাও বালকদ্বয়, না কর সাহস।।
গোপালের বলে বুঝি করিলা উদ্যম।
না জানহ জরাসন্ধ কৃতান্তের যম।।
এতেক বলিল যদি জরাসন্ধ কোপে।
ক্রোধে বৃকোদরের অধরোষ্ঠ কাঁপে।।
গোবিন্দ বলেন, মিথ্যা না কর বড়াই।
তোমার বিচারে তোমা সব কেহ নাই।।
সে কারণে হীনবল দেখি রাজগণে।
বলে ধরি মারিবারে চাহ অকারণে।।
তার অনুরূপ ফল পাইবা নিকটে।
দূর কর দর্প, আজি পড়িলা সঙ্কটে।।
না করিবা ইচ্ছা যদি আমা সনে রণ।
এ দোঁহার মধ্যে তব যারে লয় মন।।
বালক বলিয়া চিত্তে না করিহ তুমি।
ক্ষণেকে জানিবা আগে যাহ যুদ্ধভূমি।।
জরাসন্ধ বলে, যদি ইচ্ছিলে মরণ।
রণ-বাঞ্ছা করিলে, করিব আমি রণ।।
কিরূপে করিবা রণ, কহ দেখি শুনি।
এত শুনি তাহারে কহেন চক্রপাণি।।
বিধির নিয়ম এই ক্ষত্রধর্ম্মে লিখে।
সৈন্যে সৈন্যে রথে রথে অথবা এককে।।
সেমত করহ যুদ্ধ ইচ্ছা যার সনে।
যদাযুদ্ধ মল্লযুদ্ধ যাহা লয় মনে।।
শুনিয়া বলিছে বৃহদ্রথের কুমার।
ভুজবলে মহামত্ত করি অহঙ্কার।।
সহজে বালক এই বিশেষে অর্জ্জুন।
হীনবল সহ যুদ্ধ না করে নিপুণ।।
কোমল বালক প্রায় দেখি যে নয়নে।
কিছুমাত্র বৃকোদর, লয় মনে মনে।।
ভীমের সহিত আজি করিব সমর।
এত বলি উঠিল মগধ-দণ্ডধর।।
দুই গোটা গদা রাজা আনিল তখনি।
ভীমে দিল এক, এক লইল আপনি।।
নগর বাহিরে গেল রঙ্গভূমি যথা।
ধাইল নগর-লোক শুনি যুদ্ধকথা।।
কৌতুক দেখেন কৃষ্ণ থাকিয়া অন্তরে।
নৃপতি যুঝায় যেন মল্ল যুগলেরে।।
অপূর্ব্ব সংগ্রাম করে ভীম জরাসন্ধ।
বিস্তারে রচিয়া কহি যমকের ছন্দ।।
পুণ্যকথা ভারতের শুনিলে পবিত্র।
গোবিন্দের লীলারস পাণ্ডব-চরিত্র।।