আমাদের সর্বাপেক্ষা প্রয়োজন ধর্মবিষয়ক চিন্তা—আত্মা, ঈশ্বর এবং ধর্ম-সম্পর্কীয় যা কিছু কথা। আমরা বেদের সংহিতার কথা বলিব। সংহিতা-অর্থে স্তোত্র-সংগ্রহ—এগুলিই প্রাচীনতম আর্য-সাহিত্য; যথাযথভাবে বলিতে গেলে এগুলিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্য বলিতে হইবে। এগুলি অপেক্ষা প্রাচীনতর সাহিত্যের নিদর্শন ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত থাকিতে পারে, কিন্তু সেগুলিকে ঠিকঠিক গ্রন্থ বা সাহিত্য আখ্যা দেওয়া চলে না। সংগৃহীত গ্রন্থ-হিসাবে পৃথিবীতে এগুলি প্রাচীনতম এবং এগুলিতেই আর্যজাতির সর্বপ্রথম মনোভাব, আকাঙ্ক্ষা, রীতি-নীতি সম্বন্ধে যে-সব প্রশ্ন উঠিয়াছে, সে-সব চিত্রিত আছে। একেবারে প্রথমেই আমরা একটি অদ্ভুত ধারণা দেখিতে পাই। এই স্তোত্রসমূহ বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশে রচিত স্তুতিগান। দ্যুতিসম্পন্ন, তাই ‘দেবতা’। তাঁহারা সংখ্যায় অনেক—ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, পর্জন্য ইত্যাদি। আমরা একটির পর একটি বহুবিধ পৌরাণিক ও রূপক মূর্তি দেখিতে পাই। দৃষ্টান্তস্বরূপ বজ্রধর ইন্দ্র—মানুষের নিকট বারিবর্ষণে বিঘ্ন-উৎপাদনকারী সর্পকে আঘাত করিতেছেন। তারপর তিনি বজ্র-নিক্ষেপ করিলে সর্প নিহত হইল, অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। তাহাতে সন্তুষ্ট হইয়া মানুষেরা ইন্দ্রকে যজ্ঞাহুতি দ্বারা আরাধনা করিতেছে। তাহারা যজ্ঞকুণ্ডে অগ্নি স্থাপন করিয়া সেখানে পশু বধ করিতেছে, শলাকার উপরে উহা পক্ব করিয়া ইন্দ্রকে নিবেদন করিতেছে। তাহাদের একটি সর্বজনপ্রিয় ‘সোমলতা’ নামক ওষধি ছিল; উহা যে ঠিক কি, তাহা এখন আর কেহই জানে না, উহা একেবারে লোপ পাইয়াছে, কিন্তু গ্রন্থপাঠে আমরা জানিতে পারি, উহা নিষ্পেষণ করিলে দুগ্ধবৎ এক প্রকার রস বাহির হইত, রস গাঁজিয়া উঠিত; আরও জানা যায়, এই সোমরস মাদক দ্রব্য। ইহাও সেই আর্যেরা ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাগণের উদ্দেশে নিবেদন করিতেন এবং নিজেরাও পান করিতেন। কখনও কখনও তাঁহারা এবং দেবগণ একটু বেশী মাত্রাতেই পান করিতেন। ইন্দ্র কখনও কখনও সোমরস পান করিয়া মত্ত হইয়া পড়িতেন। ঐ গ্রন্থে এরূপও লেখা আছে এক সময়ে ইন্দ্র এত অধিক সোমরস পান করিয়াছিলেন যে, তিনি অসংলগ্ন কথা বলিতে লাগিলেন। বরুণদেবতারও একই গতি। তিনি আর একজন অতিশয় শক্তিশালী দেবতা এবং ইন্দ্রের মত তাঁহার উপাসকগণকে রক্ষা করেন; উপাসকগণও সোম আহুতি দিয়া তাঁহার স্তুতি করেন। রণদেবতা (মরুৎ) ও অপর দেবগণের ব্যাপারও এইরূপ। কিন্তু অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনী হইতে ইহার বিশেষত্ব এই যে, এই-সব দেবতার প্রত্যেকের চরিত্রে অনন্তের (অনন্ত শক্তির) ভাব রহিয়াছে। এই অনন্ত কখনও কখনও ভাবরূপে চিত্রিত, কখনও আদিত্যরূপে বর্ণিত, কখনও বা অন্যান্য দেবতাদের চরিত্রে আরোপিত। ইন্দ্রেরই কথা ধর। বেদের কোন কোন অংশে দেখিতে পাইবে, ইন্দ্র মানুষের মত শরীরধারী, অতীব শক্তিশালী, কখনও স্বর্ণ-নির্মিত-বর্মপরিহিত, কখনও বা উপাসকগণের নিকট অবতরণ করিয়া তাঁহাদের সহিত আহার ও বসবাস করিতেছেন, অসুরগণের সহিত যুদ্ধ করিতেছেন, সর্পকুলের ধ্বংস করিতেছেন ইত্যাদি। আবার একটি স্তোত্রে দেখিতে পাই, ইন্দ্রকে উচ্চ আসন দেওয়া হইয়াছে; তিনি সর্বশক্তিমান্, সর্বত্র বিদ্যমান এবং সর্বজীবের অন্তর্দ্রষ্টা। বরুণদেবতার সম্বন্ধে এইরূপ বলা হইয়াছে—ইনিও ইন্দ্রের মত অন্তরীক্ষের দেবতা ও বৃষ্টির অধিপতি। তারপর সহসা দেখিতে পাই, তিনি উচ্চাসনে উন্নীত; তাঁহাকে সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান্ প্রভৃতি বলা হইতেছে। আমি তোমাদের নিকট বরুণদেবের সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র যেরূপে বর্ণিত হইয়াছে, সেই সম্বন্ধে একটি স্তোত্র পাঠ করিব, তাহাতে তোমরা বুঝিতে পারিবে আমি কি বলিতেছি। ইংরেজীতেও কবিতাকারে ইহা অনূদিত হইয়াছে।
আমাদের কার্যচয় উচ্চ হ’তে দেখিবারে পান,
যেন অতি নিকটেই প্রভুদেব সর্বশক্তিমান্।
যদিও মানুষ রাখে কর্মচয় অতীব গোপন,
স্বর্গ হ’তে দেবগণ হেরিছেন সব অনুক্ষণ।
যে-কেহ দাঁড়ায়, নড়ে, গোপনেতে যায় স্থানান্তর,
সুনিভৃত কক্ষে পশে, দেবতার দৃষ্টি তার’পর।
উভয়ে মিলিয়া যেথা ষড়্যন্ত্র করে ভাবি মনে,
কেহ না হেরিছে দোঁহে, মিলিয়াছে অতি সঙ্গোপনে।
তৃতীয় বরুণদেব সেই স্থানে করি অবস্থান,
দুরভিসন্ধির কথা জ্ঞাত হন সর্বশক্তিমান্।
এই যে রয়েছে বিশ্ব—অধিপতি তিনি গো ইহার,
ওই যে হেরিছ নভঃ সুবিশাল সীমাহীন তাঁর।
রাজিছে তাঁহারই মাঝে অন্তহীন দুটি পারাবার,
তবু ক্ষুদ্র জলাশয় রচেছেন আগার তাঁহার।
বাঞ্ছা যার আছে মনে উঠিবারে উচ্চ গগনেতে,
বরুণের হস্তে তার অব্যাহতি নাই কোনমতে।
নভঃ হ’তে অবতরি চরগণ তাঁর নিরন্তর,
করিছে ভ্রমণ অতিদ্রুত সারা পৃথিবীর ’পর।
দূর দূরতম স্থানে লক্ষ্য তারা করিছে সতত,
পরীক্ষাকুশল নেত্র বিস্ফারিত করি শত শত।১০
অন্যান্য দেবতা সম্বন্ধেও এইরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হইতে পারে। তাঁহারা একের পর এক সেই একই অবস্থা লাভ করেন। প্রথমে তাঁহারা অন্যতম দেবতারূপে আরাধিত হন, কিন্তু তারপর সেই পরমসত্তারূপে গৃহীত হন, যাঁহাতে সমগ্র জগৎ অবস্থিত, যিনি প্রত্যেকের অন্তর্যামী ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাসনকর্তা। বরুণদেব সম্বন্ধে কিন্তু আর একটি ধারণা আছে। উহার অঙ্কুর মাত্র দেখা গিয়াছিল, কিন্তু আর্যগণ শীঘ্রই উহা দমন করিয়াছিলেন—উহা ‘ভীতির ধারণা’। অন্য একস্থলে দেখা যায়—তাঁহারা ভীত, তাঁহারা পাপ করিয়া বরুণের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। সেই ধারণাগুলি ভারতভূমিতে বাড়িতে দেওয়া হয় নাই, ইহার কারণ পরে বুঝিতে পারিবে। কিন্তু উহার বীজগুলি নষ্ট হয় নাই, অঙ্কুরিত হইবার চেষ্টা করিতেছিল—‘উহা ভয় ও পাপের ধারণা।’ তোমরা সকলেই জান যে, এই ধারণা ‘একেশ্বরবাদ’ নামে উল্লিখিত মতবাদের অন্তর্ভুক্ত। এই একেশ্বরবাদ একেবারে প্রথম দিকে ভারতে দেখা দিয়াছিল, দেখিতে পাই সংহিতার সর্বত্রই—উহার প্রথম ও সর্বপ্রাচীন অংশে এই একেশ্বরবাদের প্রভাব। কিন্তু আমরা দেখিতে পাইব, আর্যগণের পক্ষে ইহা পর্যাপ্ত হয় নাই, এবং হিন্দুদের বিশ্বাস, আর্যগণ উহাকে অতি প্রাথমিক ধারণাবোধে একপাশে ঠেলিয়া দেন এবং আরও অগ্রসর হইয়া চিন্তা করিতে থাকেন। অবশ্য বেদ সম্বন্ধে ইওরোপীয়দের সমালোচনা পাঠ করিয়া হিন্দুগণ হাস্য সংবরণ করিতে পারেন না। যাঁহারা (পাশ্চাত্য জাতিরা) মাতৃদুগ্ধপানের মত সগুণ-ঈশ্বরবাদকেই ঈশ্বরের সর্বোচ্চ ধারণা বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহারা যখন দেখিতে পান, যে-একেশ্বরবাদের ভাবে বেদের সংহিতাভাব পূর্ণ, সেই একেশ্বরবাদকে আর্যগণ অপ্রয়োজনীয় এবং দার্শনিক ও চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের অযোগ্য বলিয়া পরিত্যাগ করিতে এবং অধিকতর দার্শনিক যুক্তিপূর্ণ ও অতীন্দ্রিয় ভাব আয়ত্ত করিতে কঠোর আয়াস স্বীকার করিয়াছেন, তখন স্বভাবতই তাঁহারা ভারতীয় প্রাচীন দার্শনিকগণের ভাব অনুযায়ী চিন্তা করিতে সাহস করেন না।
যদিও ঈশ্বরের বর্ণনাকালে আর্যগণ বলিয়াছেন, ‘সমুদয় জগৎ তাঁহাতেই আশ্রিত’ এবং ‘তুমি সকল হৃদয়ের পালনকর্তা’, তথাপি একেশ্বরবাদ তাঁহাদের নিকট অত্যন্ত মানবভাবাপন্ন বলিয়া মনে হইয়াছিল। হিন্দুরা সর্ববিধ চিন্তাধারায় সাহসী—এত সাহসী যে, তাঁহাদের চিন্তায় এক-একটি স্ফুলিঙ্গ পাশ্চাত্যের তথাকথিত সাহসী মনীষীদের ভীতি উৎপাদন করে। হিন্দুদের পক্ষে ইহা একটি গৌরব ও কৃতিত্বের কথা। এই হিন্দু মনীষিগণের সম্বন্ধে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার যথার্থই বলিয়াছেন, ‘তাঁহারা এত উচ্চে উঠিয়াছেন যে, সেখানে তাঁহাদেরই ফুসফুস শ্বাস গ্রহণ করিতে পারে; অপর দার্শনিকগণের ফুসফুস সেখানে ফাটিয়া যাইত।’ এই সাহসী জাতি বরাবর যুক্তি অনুসরণ করিয়া চলিয়াছেন; যুক্তি তাঁহাদের কোথায় লইয়া যাইবে, ইহার জন্য কি মূল্য দিতে হইবে, সে-কথা আর্য দার্শনিকগণ ভাবেন নাই; ইহার ফলে তাঁহাদের অতি প্রিয় কুসংস্কারগুলি চূর্ণ হইয়া যাইতে, অথবা সমাজ তাঁহাদের সম্বন্ধে কি ভাবিবে বা বলিবে, সে-বিষয়ে তাঁহারা দিক্পাত করেন নাই, কিন্তু তাঁহারা যাহা সত্য ও যথার্থ বলিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তাহাই প্রচার করিয়াছেন।
প্রাচীন বৈদিক ঋষিগণের বিষয় আলোচনা করিবার পূর্বে আমরা প্রথমতঃ দু-একটি অতি আশ্চর্য বৈদিক দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিব। এই-সকল দেবতা একের পর এক গৃহীত হইয়া সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন, অবশেষে তাঁহারা প্রত্যেকে অনাদি অখণ্ড সগুণ ঈশ্বররূপ ধারণ করিয়াছেন; এই অভিনব ব্যাপারটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার এইরূপ উপাসনাতে হিন্দুধর্মের বিশেষত্ব দেখিয়া উহাকে Henotheism বা ‘দেবাধিদেব’ আখ্যা দিয়াছেন। উহার ব্যাখ্যার জন্য আমাদিগকে বহুদূরে যাইতে হইবে না, উহা ঋগ্বেদের মধ্যেই আছে। ঐ গ্রন্থের যে-স্থলে প্রত্যেক দেবতাকে ঐরূপ সর্বোচ্চ মহিমায় মণ্ডিত করিয়া উপাসনা করিবার কথা আছে, যে-স্থল হইতে আর একটু অগ্রসর হইলে আমরা তাহার অর্থও জানিতে পারি। এখন প্রশ্ন আসে—হিন্দুপুরাণসমূহ অন্যান্য ধর্মের পৌরাণিক আখ্যায়িকাগুলি হইতে এত পৃথক্, এত বিশিষ্ট কিরূপে হইল? ব্যাবিলনীয় বা গ্রীক পুরাণে দেখিতে পাওয়া যায়, দেবতা বিশেষকে উন্নীত করিবার প্রয়াস করা হইতেছে—পরে তিনি উচ্চাসন লাভ করিয়া সেখানে চির প্রতিষ্ঠিত হইলে অন্যান্য দেবতারা হতশ্রী হইলেন। সকল মোলোকের (Molochs) মধ্যে যিহোবা (Jehovah) শ্রেষ্ঠ হইলেন, অন্যান্য মোলোকগণ চিরতরে বিস্মৃত ও বিলীন হইলেন। তিনিই দেবাধিদেব ‘ঈশ্বর’ হইলেন। গ্রীক দেবতাদের সম্বন্ধেও এইরূপ বলা যাইতে পারে—জিউস (Zeus) অগ্রবর্তী হইলেন, উচ্চ উচ্চ পদবী প্রাপ্ত হইলেন, সমগ্র জগতের প্রভু হইলেন এবং অন্যান্য দেবগণ অতি ক্ষুদ্র দেবদূতরূপে পরিণত হইলেন। পরবর্তী কালেও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। বৌদ্ধ ও জৈনগণ তাঁহাদের একজন ধর্মপ্রচারককে ঈশ্বররূপে আরাধনা করিলেন এবং অন্যান্য দেবগণকে তাঁহার অধীন করিয়া দিলেন। ইহাই সর্বত্র অনুসৃত পদ্ধতি, কিন্তু এ-বিষয়ে হিন্দুধর্মে বিশেষত্ব ও ব্যতিক্রম দেখিতে পাই। প্রথম একজন দেবতা বন্দিত হইতেছেন, কিছুক্ষণের জন্য অন্যান্য দেবতারা তাঁহার আজ্ঞানুবর্তী বলা হইয়াছে।
আবার দেখা যায়, যাঁহার সম্বন্ধে বলা হইল যে, তিনি বরুণদেবের কৃপায় উচ্চাসন পাইয়াছেন, তিনিই পরবর্তী গ্রন্থে সর্বোচ্চ গৌরব লাভ করিলেন। এই দেবগণ যথাক্রমে প্রত্যেকেই সগুণ ঈশ্বররূপে বর্ণিত হইয়াছেন। ইহার ব্যাখ্যা ঐ পুস্তকেই আছে এবং ইহাই চমৎকার ব্যাখ্যা। যে মন্ত্রপ্রভাবে অতীত ভারতে একটি চিন্তাপ্রবাহ উঠিয়াছিল এবং যাহা ভবিষ্যতে সমগ্র ধর্মজগতে চিন্তার কেন্দ্রস্থানীয় হইয়া দাঁড়াইবে, সেই মন্ত্রটি এইঃ ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’—যাহা সত্য তাহা এক, জ্ঞানিগণ তাহাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করিয়াছেন। এই দেবতাদের বিষয়ে যেখানে যত স্তোত্র রচিত হইয়াছে, সর্বত্রই অনুভূত সত্তা এক—অনুভবকর্তার জন্যই যা কিছু বিভিন্নতা। স্তোত্র-রচয়িতা ঋষি ও কবিগণ বিভিন্ন ভাষায় এবং বিভিন্ন বাক্যে সেই একই সত্তার (ব্রহ্মের) স্তুতিগান করিয়াছেন—‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি।’ এই একটি মাত্র শ্রুতিবাক্য হইতে প্রভূত ফল ফলিয়াছে। সম্ভবতঃ তোমাদের কেহ কেহ ভাবিয়া বিস্মিত হইবে যে, ভারতবর্ষই একমাত্র দেশ, যেখানে ধর্মের জন্য কখনই কাহারও উপর নির্যাতন হয় নাই, যেখানে কোন ব্যক্তি কখনও তাহার ধর্মবিশ্বাসের জন্য উত্যক্ত হয় নাই; সেখানে আস্তিক, নাস্তিক, অদ্বৈতবাদী, দ্বৈতবাদী এবং একেশ্বরবাদী সকলেই আছেন এবং কখনও নির্যাতিত না হইয়া বসবাস করিতেছেন। সেখানে জড়বাদীদিগকেও ব্রাহ্মণ-পরিচালিত মন্দিরের সোপান হইতে দেবতাদের বিরুদ্ধে, এমন কি স্বয়ং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রচার করিতে দেওয়া হইয়াছে। জড়বাদী চার্বাকগণ দেশময় প্রচার করিয়াছে ঈশ্বর বিশ্বাস কুসংস্কার; এবং দেবতা, বেদ ও ধর্ম—পুরোহিতগণের স্বার্থসিদ্ধির জন্য উদ্ভাবিত কুসংস্কার মাত্র। তাহারা বিনা উৎপীড়নে এই-সব প্রচার করিয়াছে। এইরূপে বুদ্ধদেব হিন্দুগণের প্রত্যেক প্রাচীন ও পবিত্র বিষয় ধূলিসাৎ করিতে চেষ্টা করিয়াও অতি বৃদ্ধবয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। জৈনগণও এইরূপ করিয়াছেন—তাঁহারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব শুনিয়া বিদ্রূপ করিতেন। তাঁহারা বলিতেনঃ ঈশ্বর আছেন—ইহা কিরূপে সম্ভব? ইহা শুধু একটি কুসংস্কার। এইরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে। মুসলমান আক্রমণ-তরঙ্গ ভারতে আসিবার পূর্বে এদেশে ধর্মের জন্য নির্যাতন কী, তাহা কেহ কখনও জানিত না। যখন বিদেশীরা এই নির্যাতন হিন্দুদের উপর আরম্ভ করিল, তখনই হিন্দুদের এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা হইল; এবং এখনও ইহা একটি সর্বজনবিদিত সত্য যে, হিন্দুরা খ্রীষ্টানদের গীর্জা-নির্মাণে কত অধিক পরিমাণে এবং তৎপরতার সহিত সাহায্য করিয়াছে—কোথাও রক্তপাত হয় নাই। এমন কি ভারতবর্ষ হইতে যে-সকল হিন্দুধর্মবিরোধী ধর্ম উত্থিত হইয়াছিল, সেগুলিও কখনও নির্যাতিত হয় নাই। বৌদ্ধধর্মের কথা ধর—বৌদ্ধধর্ম কোন কোন বিষয়ে একটি শ্রেষ্ঠ ধর্ম; কিন্তু বৌদ্ধধর্মকে বেদান্ত বলিয়া মনে করা অর্থহীন। খ্রীষ্টধর্ম ও ‘স্যালভেশন আর্মি’র প্রভেদ সকলেই অনুভব করিতে পারেন। বৌদ্ধধর্মে মহান্ ও সুন্দর ভাব আছে, কিন্তু উহা এমন এক প্রকার মণ্ডলীর হস্তে পতিত হইয়াছিল, যাহারা ঐ ভাবসমূহ রক্ষা করিতে পারে নাই। দার্শনিকগণের হস্তের রত্নসমূহ জনসাধারণের হস্তে পড়িল এবং তাহারা দার্শনিক ভাবগুলি দখল করিয়া বসিল। তাহাদের ছিল অত্যধিক উৎসাহ, আর কয়েকটি আশ্চর্য আদর্শ, মহৎ জনহিতকর ভাবও ছিল; কিন্তু সর্বোপরি সর্ববিষয় নিরাপদ রাখিবার পক্ষে আরও কিছু প্রয়োজন—চিন্তা ও মনীষা। যেখানেই দেখিবে, উচ্চতম লোকহিতকর ভাবসমূহ শিক্ষাদীক্ষাহীন সাধারণ লোকের হাতে পড়িয়াছে, তাহার প্রথম ফল—অবনতি। কেবলমাত্র বিদ্যানুশীলন ও বিচারশক্তি সকল বস্তুকে সুরক্ষিত করে। তারপর এই বৌদ্ধধর্মই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম প্রচারশীল ধর্ম, তৎকালীন সমুদয় সভ্য জগতের সর্বত্র ইহা প্রবেশ করিয়াছিল, কিন্তু তাহার জন্য একটি বিন্দু রক্তপাত হয় নাই। আমরা পড়িয়াছি, কিরূপে চীনদেশে বৌদ্ধ প্রচারকগণ নির্যাতিত হন, এবং সহস্র সহস্র বৌদ্ধ ক্রমান্বয়ে দুই তিন জন সম্রাট্ কর্তৃক নিহত হন, কিন্তু তারপর যখন বৌদ্ধদের অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন হইল এবং একজন সম্রাট্ উৎপীড়নকারীদিগের উপর প্রতিশোধ লইবার নিমিত্ত প্রস্তাব করিলেন, তখন ভিক্ষুগণ তাঁহাকে নিবৃত্ত করিলেন। আমাদের এই সমুদয় তিতিক্ষার জন্য ঐ এক মন্ত্রের নিকটেই আমরা ঋণী। সেইজন্যই আমি উহা তোমাদিগকে স্মরণ করিতে বলিতেছি। যাঁহাকে সকলে ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ বলে—সেই সত্তা একই; ঋষিরা তাঁহাকে বহু নামে ডাকেন—‘একং সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি।’১১
এই স্তুতি কোন্ সময়ে রচিত হইয়াছিল তাহা কেহই জানেন না; আট হাজার বৎসর পূর্বেও হইতে পারে এবং আধুনিক সকল প্রতিবাদ সত্ত্বেও ইহার প্রণয়নকাল ৯০০০ বৎসর প্রাচীনও হইতে পারে।
ধর্মবিষয়ক এই অনুধ্যানগুলির একটিও আধুনিক কালের নয়, তথাপি রচনাকালে এগুলি যেমন জীবন্ত ছিল, এখনও সেইরূপ; এখন বরং অধিকতর সজীব হইয়া উঠিয়াছে, কারণ প্রাচীনতম কালে মানবজাতি আধুনিক কালের মত এত ‘সভ্য’ ছিল না; এতটুকু মতের পার্থক্যের জন্য সে তখনও তাহার ভ্রাতার গলা কাটিতে শিখে নাই বা রক্তস্রোতে ধরাতল প্লাবিত করে নাই অথবা নিজ প্রতিবেশীর প্রতি পিশাচের মত ব্যবহার করে নাই। তখন মানুষ মনুষ্যত্বের নামে সমুদয় মানবজাতির ধ্বংস সাধন করিতে শিখে নাই।
সেইজন্যই ‘একং সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি’—এই মহাবাণী আজও আমাদের নিকট অতিশয় সজীব, ততোধিক মহান্, শক্তি ও জীবন-প্রদ এবং যে-কালে এগুলি লিখিত হইয়াছিল, সে-সময় অপেক্ষা অধিকতর নবীনরূপে প্রতিভাত হইতেছে। এখনও আমাদের শিখিতে হইবে যে, সকল প্রকার ধর্ম—হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রীষ্টান—যে-কোন নামেই অভিহিত হউক না, সকলে একই ঈশ্বরের উপাসনা করে এবং যে এগুলির একটিকে ঘৃণা করে, সে তাহার নিজের ভগবানকেই ঘৃণা করে।
তাঁহারা এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হইলেন। কিন্তু পূর্বে যেমন বলিয়াছি—এই প্রাচীন একেশ্বরবাদ হিন্দু চিত্তকে সন্তুষ্ট করিতে পারে নাই; কারণ আধ্যাত্মিক রাজ্যে ইহা অধিক দূর অগ্রসর হইতে অসমর্থ; ইহার দ্বারা দৃশ্য জগতের ব্যাখ্যা হয় না—পৃথিবীর একচ্ছত্র শাসনকর্তা দ্বারা পৃথিবীর ব্যাখ্যা হয় না।
বিশ্বের একজন নিয়ন্তা দ্বারা কখনই বিশ্বের ব্যাখ্যা হয় না, বিশেষতঃ বিশ্বের বাহিরে অবস্থিত নিয়ন্তার দ্বারা ইহার সম্ভাবনা তো আরও কম। তিনি আমাদের নৈতিক গুরু হইতে পারেন—জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ-শক্তিসম্পন্ন হইতে পারেন, কিন্তু তাহা তো বিশ্বের ব্যাখ্যা নয়।
তাই প্রথম প্রশ্ন উঠিতেছে—বিরাট প্রশ্ন উঠিতেছে!
‘এই বিশ্ব কোথা হইতে আসিল, কেমন করিয়া আসিল এবং কিরূপেই বা অবস্থান করিতেছে?’১২ এই প্রশ্ন-সমাধানের একটি বিশিষ্ট রূপ গঠনের জন্য বহু স্তোত্র লিখিত হইয়াছে। কিন্তু এই স্তোত্রে যেরূপ অপূর্ব কাব্যের সহিত উহা প্রকাশিত হইয়াছে, এরূপ আর কোথাও দেখা যায় নাঃ
নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ।
কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নভঃ কিমাসীদ্গহনং গভীরম্॥
ন মৃত্যুরাসীদমৃতং ন তর্হি ন রাত্র্যা অহ্ন আসীৎ প্রকেতঃ।
আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধান্যন্ন পরঃ কিঞ্চনাস॥১৩
যখন অসৎ ছিল না, সৎও ছিল না, যখন অন্তরীক্ষ ছিল না, যখন কিছুই ছিল না, কোন্ বস্তু সকলকে আবৃত করিয়া রাখিয়াছিল, কিসে সব বিশ্রাম করিতেছিল? তখন মৃত্যু ছিল না, অমৃত ছিল না, দিবারাত্রির বিভাগ ছিল না। অনুবাদে মূলের কাব্যমাধুরী বহুলাংশে নষ্ট হইয়া যায়—‘তখন মৃত্যু ছিল না, অমৃত ছিল না, দিবারাত্রির বিভাগ ছিল না!’ সংস্কৃত ভাষার প্রত্যেক ধ্বনিটি যেন সুরময়! তখন সেই ‘এক (ঈশ্বর) অবরুদ্ধ-প্রাণে নিজেতেই অবস্থান করিতেছিলেন, তিনি ছাড়া আর কিছুই ছিল না’—এই ভাবটি উত্তমরূপে ধারণা করা উচিত যে, ঈশ্বর অবরুদ্ধ-প্রাণ (গতিহীন)-রূপে অবস্থান করিতেছিলেন; কারণ অতঃপর আমরা দেখিব, কিভাবে পরবর্তী কালে এই ভাব হইতেই সৃষ্টিতত্ত্ব অঙ্কুরিত হইয়াছে। হিন্দু দার্শনিকগণ সমগ্র বিশ্বকে একটি স্পন্দনসমষ্টি—একপ্রকার গতি মনে করিতেন, সর্বত্রই শক্তি-প্রবাহ। এই গতি সমষ্টি একটা সময়ে স্থির হইতে থাকে এবং সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর অবস্থায় গমন করে এবং কিছুকালের জন্য সেই অবস্থায় স্থিতি করে। এই স্তোত্রে ঐ অবস্থার কথাই বর্ণিত হইয়াছে—এই জগৎ স্পন্দনহীন হইয়া নিশ্চল অবস্থায় ছিল। যখন এই সৃষ্টির সূচনা হইল, তখন উহা স্পন্দিত হইতে আরম্ভ করিল এবং উহা হইতে জগৎ বাহির হইয়া আসিল। সেই পুরুষের নিঃশ্বাস—শান্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ—ইহার বাহিরে আর কিছু নাই।
প্রথম একমাত্র অন্ধকারই ছিল। তোমাদের মধ্যে যাহারা ভারতবর্ষে অথবা অন্য কোন গ্রীষ্মমণ্ডলের দেশে গিয়া মৌসুমী-বায়ু-চালিত মেঘ-বিস্তার দেখিয়াছ, তাহারাই এই বাক্যের গাম্ভীর্য বুঝিতে পারিবে। আমাদের মনে আছে, তিনজন কবি এই দৃশ্য বর্ণনা করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। মিল্টন বলিয়াছেন, ‘সেখানে আলোক নাই, বরং অন্ধকার দৃশ্যমান।’ কালিদাস বলেন, ‘সূচিভেদ্য অন্ধকার।’ কিন্তু কেহই এই বৈদিক বর্ণনার নিকটবর্তী হইতে পারেন নাই—‘অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকার লুকান ছিল।’ সর্ববস্তু দহ্যমান, মর্মরিত—শুষ্ক, সমগ্র সৃষ্টি যেন ভস্মীভূত হইয়া যাইতেছে, এবং এইভাবে কয়েকদিন কাটিবার পর একদিন সায়াহ্নে দিক্চক্রবালের একপ্রান্তে একখণ্ড মেঘ দেখা দিল, এবং আধ ঘণ্টার মধ্যেই মেঘে পৃথিবী ছাইয়া গেল, মেঘের উপর মেঘ, থরে থরে মেঘ—তারপর প্রবল ধারায় উহা যেন ফাটিয়া পড়িল, প্লাবন শুরু হইল।
এখানে সৃষ্টির কারণরূপে ইচ্ছাই বর্ণিত হইয়াছে। প্রথমে যাহা ছিল, তাহা যেন ইচ্ছারূপে পরিণত হইল এবং ক্রমে তাহা হইতেই বাসনার প্রকাশ। এইটি আমাদের বিশেষরূপে স্মরণ রাখা উচিত, কারণ এই বাসনাই আমাদের যাহা কিছু প্রত্যক্ষের কারণরূপে কথিত হইয়াছে। এই ইচ্ছার ধারণাই বৌদ্ধ ও বেদান্ত চিন্তাপদ্ধতির ভিত্তিস্বরূপ এবং পরবর্তীকালে জার্মান দর্শনে প্রবিষ্ট হইয়া শোপেনহাওয়ারের দর্শনের ভিত্তিস্বরূপ হইয়াছে। এইখানেই আমরা প্রথম পাইঃ
ব্যক্ত মনেতে উপ্ত সে বীজ—সে কোন্ প্রভাতে দূর জাগিয়া উঠিল ইচ্ছা প্রথম—বাসনার অঙ্কুর!
কবি-কল্পনা জ্ঞানের সহায়ে খুঁজিল হৃদয়-মাঝে,
দেখিল সেথায় সৎ ও অসৎ—বাঁধনে জড়ায়ে রাজে।১৪
ইহা এক নূতন প্রকারের অভিব্যক্তি; কবি এই বলিয়া শেষ করিলেন, ‘তিনিও বোধ হয় জানেন না, সেই অধ্যক্ষও সৃষ্টির কারণ জানেন না।’১৫ আমরা এই সূক্তে দেখিতে পাই—ইহার কাব্যমাধুরী ছাড়া বিশ্বরচনা সম্বন্ধে প্রশ্নটি এক নির্দিষ্ট আকার ধারণ করিয়াছে। এবং এই-সব ঋষিদের মন এমন একটি অবস্থায় উপনীত হইয়াছে যে, তাঁহারা আর সাধারণ উত্তরে সন্তুষ্ট নন। আমরা এখানে দেখিতে পাই যে, তাঁহারা ‘পরম ব্যোমে অধিষ্ঠিত এই জগতের অধ্যক্ষ একজন শাসনকর্তায়’ সন্তুষ্ট নন। এই বিশ্ব কিরূপে আবির্ভূত হইল—এই বিষয়টি আরও অনেক সূক্তে আছে এবং আমরা পূর্বে যেমন দেখিয়াছি যে, তাঁহারা একজন ব্যক্তিবিশেষকে এই বিশ্বের অধ্যক্ষরূপে খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, এবং ইহার নিমিত্ত এক-একটি দেবতাকে গ্রহণ করিয়া তাঁহাদিগকে সেই ঈশ্বরের আসনে বসাইতেছিলেন, ঠিক তেমনি এই স্তরে আসিয়া দেখিব, বিভিন্ন স্তোত্রে কোন একটি তত্ত্বকে গ্রহণপূর্বক অনন্তরূপে বর্ধিত করিয়া তাহাকেই নিখিল বিশ্বের কারণ বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে; এমন কোন একটি বিশিষ্ট তত্ত্বকে এই জগতের আধার-রূপে গ্রহণ করা হইতেছে—যাহাতে এই বিশ্বের স্থিতি এবং যাহা এই বিশ্বরূপে পরিণত হইয়াছে। নানা আদর্শ সম্বন্ধে এই রীতি অনুসৃত হইল। প্রাণ বা জীবনী-শক্তি সম্বন্ধেও তাঁহারা এই রীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন। তাঁহারা এই প্রাণতত্ত্বকে এমনভাবে বর্ধিত করিতে লাগিলেন যে, ঐ প্রাণশক্তি এক বিশ্বব্যাপী অনন্ত তত্ত্বে পরিণত হইল। এই প্রাণশক্তি সকলকে ধারণ করিতেছে—কেবল মনুষ্য-শরীরকে নয়, এই প্রাণশক্তি সূর্য ও চন্দ্রেরও আলো—ইহাই সবকিছুকে স্পন্দিত করিতেছে। ইহাই বিশ্বের প্রেরণাশক্তি।
সমস্যার সমাধানে এই-সকল চেষ্টা অতীব সুন্দর—অতিশয় কাব্যমধুর। তাহাদের মধ্যে কতকগুলি, যেমন ‘তিনিই সুন্দরী ঊষার আগমনবার্তা ঘোষণা করেন’ প্রভৃতি তাঁহারা যেভাবে চিত্রিত করিয়াছেন, তাহা বাস্তবিকই অপূর্ব গীতিময়।
এই যে ‘ইচ্ছা’, যাহা আমরা এই মাত্র পড়িলাম, যাহা সৃষ্টির আদিবীজরূপে উত্থিত হইয়াছিল, উহাকে তাঁহারা এমন ভাবে বিস্তৃত করিতে লাগিলেন যে, উহাই শেষ পর্যন্ত এক বিশ্বজনীন ঈশ্বরতত্ত্বে পরিণত হইল। কিন্তু এই ধারণাগুলির কোনটিই তাঁহাদের সন্তুষ্ট করিতে পারিল না।
এই ধারণা ক্রমে মহিমান্বিত হইয়া শেষে এক বিরাট ব্যক্তিত্বে ঘনীভূত হইল।
‘তিনি সৃষ্টির অগ্রে ছিলেন, তিনি সব কিছুর অধীশ্বর, তিনি বিশ্বকে ধরিয়া আছেন, তিনি জীবের স্রষ্টা, তিনি বলবিধাতা, সকল দেবতা যাঁহাকে উপাসনা করেন, জীবন ও মৃত্যু যাঁহার ছায়া—তাঁহাকে ছাড়া আর কোন্ দেবতাকে আমরা উপাসনা করিব? তুষারমৌলি হিমালয় যাঁহার মহিমা ঘোষণা করিতেছে, সমুদ্র তাহার সমগ্র জলরাশির সহিত যাঁহার মহিমা ঘোষণা করিতেছে’—এইভাবে তাঁহার বর্ণনা করিতেছেন।১৬ কিন্তু এই মাত্র আমি বলিয়াছি যে, এই সমস্ত ধারণাও তাঁহাদিগকে সন্তুষ্ট করিতে পারে নাই। অবশেষে (বেদে) আমরা এক অদ্ভুত ধারণা দেখিতে পাই। (ঐ যুগে) আর্যমানবের মন বহিঃপ্রকৃতি হইতে এতদিন ঐ প্রশ্নের (কে সেই সর্বজ্ঞ একমাত্র স্রষ্টা?) উত্তর অনুসন্ধান করিতেছিল। তাঁহারা সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাশি প্রভৃতি সর্ববস্তুর কারণ জিজ্ঞাসা করিয়া সাধ্যানুযায়ী তাহার সমাধানও করিয়াছিলেন। সমগ্র বিশ্ব তাঁহাদের শুধু এইটুকু শিখাইল—বিশ্বের নিয়ন্তা এক সগুণ ঈশ্বর আছেন। বহিঃপ্রকৃতি ইহা অপেক্ষা আর কিছু অধিক শিখাইতে পারে না। সংক্ষেপে বহিঃপ্রকৃতি হইতে আমরা মাত্র একজন বিশ্ব-স্থপতির অস্তিত্ব ধারণা করিতে পারি। এই ধারণা রচনাকৌশলবাদ (Design Theory) বলিয়া অভিহিত হইয়াছে। আমরা সকলেই জানি, এইরূপ মীমাংসা খুব বেশী যুক্তিসঙ্গত নয়; এই মতবাদ কতকটা ছেলেমানুষী, তথাপি বহির্জগতের কারণানুসন্ধান দ্বারা এইটুকু মাত্র আমরা জানিতে পারি যে, এই জগতের একজন নির্মাতা প্রয়োজন। কিন্তু ইহাদ্বারা আদৌ জগতের ব্যাখ্যা হইল না। এই জগতের উপাদান তো ঈশ্বরের আগেও ছিল এবং তাঁহার এই-সব উপাদানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ইহাতে এক ভীষণ আপত্তি উঠিবে যে, তিনি তাহা হইলে এই উপাদানের দ্বারা সীমাবদ্ধ। গৃহনির্মাতা উপাদান ব্যতিরেকে গৃহ নির্মাণ করিতে পারেন না। অতএব তিনি উপাদান দ্বারা সীমাবদ্ধ হইলেন; উপাদানের দ্বারা যতটুকু সম্ভব, ততটুকু মাত্র তিনি সৃষ্টি করিতে পারেন। সেইজন্য রচনাকৌশলবাদের ঈশ্বর একজন স্থপতি মাত্র এবং সেই বিশ্বস্থপতি সসীম; উপাদানের দ্বারা তিনি সীমাবদ্ধ—একেবারেই স্বাধীন নন। এই পর্যন্ত তাঁহারা ইতঃপূর্বেই আবিষ্কার করিয়াছিলেন এবং বহু মানবচিত্ত এইখানেই বিশ্রাম করিতে পারে। অন্যান্য দেশের চিন্তাক্ষেত্রে এইরূপই ঘটিয়াছিল; মনুষ্যমন উহাতে তৃপ্ত হইতে পারে নাই; চিন্তাশীল, অবধারণশীল চিত্ত আরও অধিক দূর অগ্রসর হইতে চাহিল; যদিও যাহারা পশ্চাদ্বর্তী তাহারা উহাই ধরিয়া রহিল এবং অগ্রবর্তীদের আর অগ্রসর হইতে দিল না। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, এই হিন্দু ঋষিরা আঘাত খাইয়া দমিবার পাত্র ছিলেন না; তাঁহারা ইহার সমাধান চাহিলেন এবং এখন আমরা দেখিতেছি যে, তাঁহারা বাহ্যকে ত্যাগ করিয়া অন্তরে প্রবিষ্ট হইতেছেন।
প্রথমেই তাঁহাদের মনে এই সত্য ধরা পড়িয়াছিল যে, চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা বহির্জগৎ প্রত্যক্ষ করি না বা আধ্যাত্মিক তত্ত্ব সম্বন্ধেও কিছু জানিতে পারি না; তাঁহাদের প্রথম চেষ্টা সেইজন্য আমাদের শারীরিক এবং মানসিক অক্ষমতা নির্দেশ করা, ইহা আমরা ক্রমে দেখিতে পাইব। একজন ঋষি বলিলেন, ‘তুমি এই বিশ্বের কারণ জান না; তোমার ও আমার মধ্যে এক বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হইয়াছে—কেন? তুমি ইন্দ্রিয়পর বিষয় সম্বন্ধে কথা বলিতেছ, এবং বিষয় ও ধর্মের আনুষ্ঠানিক ব্যাপারে সন্তুষ্ট রহিয়াছ, পক্ষান্তরে আমি ইন্দ্রিয়াতীত পুরুষকে জানিয়াছি।’
আমি যে আধ্যাত্মিক প্রগতির অনুসরণ করিবার চেষ্টা করিতেছি, তাহার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের অপর দিক্—যাহার সহিত আমার প্রতিপাদ্য বিষয়ের কোন সম্বন্ধ নাই এবং যেজন্য আমি উহা বিশদরূপে উপস্থাপিত করিতে ইচ্ছুক নই—সেই আনুষ্ঠানিক ধর্মের বৃদ্ধির সম্বন্ধে এখানে কিছু বলিব। যদি আধ্যাত্মিক ধারণার প্রগতি সমান্তরে (Arithmetical Progression) বর্ধিত হয়, তাহা হইলে আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রগতি সমগুণিতান্তর (Geometrical Progression) বেগে বর্ধিত হইয়াছে—প্রাচীন কুসংস্কার এক বিরাট আনুষ্ঠানিক ব্যাপারে পরিণত হইয়াছে; ইহা ধীরে ধীরে বিরাট আকার ধারণ করিয়া হিন্দুর জীবনীশক্তিকে নিজের চাপে প্রায় ধ্বংস করিয়া দিয়াছে; ইহা এখনও সেখানে বর্তমান; ইহা আমাদিগকে কঠোরভাবে ধরিয়া রাখিয়াছে এবং আমাদের জীবনীশক্তির মজ্জায় মজ্জায় প্রবিষ্ট হইয়া জন্ম হইতে আমাদিগকে ক্রীতদাসে পরিণত করিয়াছে। তথাপি সেই প্রাচীনকাল হইতেই আমরা দেখিতে পাই, অনুষ্ঠানের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধও চলিতেছে। ইহার বিরুদ্ধে যে একটি আপত্তি উঠিয়াছিল, তাহা এই—ক্রিয়াকাণ্ডে প্রীতি, নির্দিষ্ট সময়ে পরিচ্ছদ ধারণ, নির্দিষ্ট উপায়ে খাওয়া-দাওয়া—ধর্মের এই-সব বাহ্য ঘটা ও মূক নাট্যাভিনয়গুলি হইল বহিরঙ্গ ধর্ম; ইহা কেবল মানুষের ইন্দ্রিয়কে তৃপ্ত করে, মানুষকে ইন্দ্রিয়ের অতীত প্রদেশে যাইতে দেয় না; আমাদের এবং প্রত্যেক মনুষ্যের পক্ষে আধ্যাত্মিক জগতে অগ্রসর হওয়ার পথে ইহা প্রচণ্ড বাধা।
পারতপক্ষে আমরা যদি বা আধ্যাত্মিক বিষয় শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি, তাহাও ইন্দ্রিয়ের উপযোগী হওয়া চাই; একজন মানুষ কয়েকদিন ধরিয়া দর্শন, ঈশ্বর, অতীন্দ্রিয় বস্তু সম্বন্ধে শ্রবণ করার পর জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা বেশ, এতে কত টাকা পাওয়া যেতে পারে? ইন্দ্রিয়ের সম্ভোগ এতে কতটুকু হয়?’ সম্ভোগ বলিতে ইহারা মাত্র ইন্দ্রিয়সুখই বুঝে—ইহা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের ঋষিরা বলিতেছেন, ‘ইন্দ্রিয়তৃপ্তিই আমাদের ও সত্যের মধ্যে এক আবরণ বিস্তার করিয়া রাখিয়াছে।’ ক্রিয়াকাণ্ডে আনন্দ, ইন্দ্রিয়ে তৃপ্তি এবং বিভিন্ন মতবাদ আমাদের ও সত্যের মধ্যে এক আবরণ টানিয়া দিয়াছে। এই বিষয়টি আধ্যাত্মিক রাজ্যের আর এক বিরাট সীমা-নির্দেশ। আমরা শেষ পর্যন্ত এই আদর্শেরই অনুসরণ করিব এবং দেখিতে পাইব, ইহা কিরূপে বর্ধিত হইয়া বেদান্তের সেই অদ্ভুত মায়াবাদে পরিসমাপ্ত হইয়াছে—এই মায়ার অবগুণ্ঠনই বেদান্তের যথার্থ ব্যাখ্যা—সত্য চিরকালই সমভাবে বিদ্যমান, কেবল মায়া তাহার অবগুণ্ঠনের দ্বারা তাহাকে আবরিত করিয়া রাখিয়াছে।
এইভাবে আমরা দেখিতে পাইতেছি যে, প্রাচীন চিন্তাশীল আর্যেরা এক নূতন প্রসঙ্গ আরম্ভ করিয়াছেন। তাঁহারা আবিষ্কার করিলেন, বহির্জগতের অনুসন্ধানের দ্বারা এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাইবে না। অনন্তকাল ধরিয়া বহির্জগতে অনুসন্ধান করিলেও সেখান হইতে এ প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া যাইবে না। এইজন্য তাঁহারা অপর পদ্ধতি অবলম্বন করিলেন এবং তদনুসারে জানিলেন যে, এই ইন্দ্রিয়-সুখের বাসনা, ক্রিয়াকাণ্ডের প্রতি আসক্তি, বাহ্য বিষয়ই ব্যক্তির সহিত সত্যের মিলনের মধ্যে এক ব্যবধান টানিয়া দিয়াছে, যাহা কোন ক্রিয়াকাণ্ডের দ্বারা অপসারিত হইবার নয়। তাঁহারা তাঁহাদের মনোজগতে আশ্রয় লইলেন এবং নিজেদেরই মধ্যে সেই সত্যকে আবিষ্কার করিবার জন্য মনকে বিশ্লেষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা বহির্জগতে ব্যর্থ হইয়া যখন অন্তর্জগতে প্রবেশ করিলেন, তখনই ইহা প্রকৃত বেদান্তদর্শনে পরিণত হইল; এখান হইতেই বেদান্তদর্শনের আরম্ভ এবং ইহাই বেদান্তের ভিত্তি-প্রস্তর। আমরা যতই অগ্রসর হইব, ততই বুঝিতে পারিব, এই দর্শনের সকল অনুসন্ধান অন্তর্দেশে। দেখা যায়—একেবারে প্রথম হইতেই তাঁহারা ঘোষণা করিতেছেন, ‘কোন ধর্মবিশেষে সত্যের অনুসন্ধান করিও না; সকল রহস্যের রহস্য, সকল জ্ঞানের কেন্দ্র, সকল অস্তিত্বের খনি—এই মানবাত্মায় অনুসন্ধান কর। যাহা এখানে নাই, তাহা সেখানেও নাই।’ ক্রমে তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন, যাহা বাহ্য তাহা অন্তরের বড়জোর একটা মলিন প্রতিবিম্ব মাত্র। আমরা দেখিতে পাইব, তাঁহারা কেমন করিয়া জগৎ হইতে পৃথক্ এবং শাসক ঈশ্বরের প্রাচীন ধারণাকে প্রথম বহির্দেশ হইতে অন্তরে স্থাপন করিয়াছেন। এই ভগবান্ জগতের বাহিরে নন, অন্তরে; এবং পরে সেখান হইতে তাঁহাকে লইয়া আসিয়া তাঁহারা নিজেদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। তিনি এখানে—এই মানব-হৃদয়ে আছেন—তিনি আমাদের আত্মার আত্মা, আমাদের অন্তর্যামী সত্যস্বরূপ।
বেদান্ত-দর্শনের কর্মপ্রণালী যথাযথভাবে আয়ত্ত করিতে হইলে কতকগুলি মহৎ ধারণা পূর্বে বুঝিতে হইবে। ক্যাণ্ট ও হেগেলের দর্শন আমরা যেভাবে বুঝি, বেদান্ত সেই ভাবের কোন দর্শনশাস্ত্র নয়। ইহা কোন গ্রন্থ-বিশেষ বা কোন একজন ব্যক্তিবিশেষের লেখা নয়। বেদান্ত হইতেছে—বিভিন্ন কালে রচিত গ্রন্থসমষ্টি। কখনও কখনও দেখা যায়, ইহার একখানিতেই পঞ্চাশটি বিষয়ের সন্নিবেশ। অপর বিষয়গুলি যথাযথভাবে সজ্জিতও নয়; মাত্র চিন্তাগুলির উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। আমরা দেখিতে পাই নানা বিজাতীয় বিষয়ের মধ্যে এক অদ্ভুত তত্ত্ব সন্নিবিষ্ট। কিন্তু একটা বিষয় খুব প্রণিধানযোগ্য যে, উপনিষদের এই আদর্শগুলি চির-প্রগতিশীল। ঋষিগণের মনের কার্যাবলী যেমন যেমন চলিয়াছে, তাঁহারাও সেই প্রাচীন অসম্পূর্ণ ভাষায় উহা তেমনি তেমনি আঁকিয়াছেন। প্রথম ধারণাগুলি অতি স্থূল, ক্রমে সেগুলি সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর ধারণায় পরিণত হইয়া বেদান্তের শেষ সীমায় উপস্থিত হইয়াছে এবং পরে এই শেষ সিদ্ধান্ত এক দার্শনিক আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে। যেমন প্রথম আমরা দেখিতে পাই—দ্যোতন-স্বভাব দেবতার অনুসন্ধান, তারপর আদি জগৎ-কারণের অন্বেষণ এবং সেই সত্য একই অনুসন্ধানের ফলে আর একটি অধিকতর স্পষ্ট দার্শনিক আখ্যা প্রাপ্ত হইতেছে, সকল পদার্থের একত্ব—‘যাঁহাকে জানিলে সকলই জানা হয়।’