বিয়াস খুব বড় নদী। হিমাচল প্রদেশের রোটাং পাস থেকে এর উৎপত্তি। ইচ্ছে করলে সে পর্যন্ত গিয়েও দেখে আসা যায়। পাহাড়ি খাত ধরে ঝরনার মতো নেমে এসেছে অনেকখানি। মানালি, কুলু, মাণ্ডি শহরগুলোর ধারে-ধারে ঝরনার বদলে নদী-নদী ভাব, তাও শীতকালে জলের বদলে পাথরই দেখা যায় বেশি।
বিয়াস নামটির তাৎপর্য এখন অনেকটা বদলে গেছে। এখন অনেকের ধারণা, মহাভারতের স্রষ্টা ব্যাসদেবের নাম থেকেই এই নদীর নাম। পৌরাণিক কাহিনিটি অবশ্য অন্য। সেকালের মুনি-ঋষিদের নানারকমের তেজ এবং নারীঘটিত কীর্তির কথা আছে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত, গভীর এবং নিষ্কলঙ্ক ছিলেন বশিষ্ঠ। সেই নিরীহ ঋষিরও একশোটি পুত্রকে হত্যা করে কল্মষপাদ রাক্ষস। নিদারুণ শোকে বশিষ্ঠ ঋষি প্রাণ বিসর্জনের সংকল্প নিয়েছিলেন। হঠাৎ লাফ দিলেন উঁচু পাহাড় থেকে, কিন্তু তাতেও তাঁর পুণ্য শরীর অক্ষত রয়ে গেল। তবু সংকল্প থেকে বিরত হলেন না বশিষ্ঠ, শক্ত দড়িতে নিজের হাত-পা বেঁধে ঝাঁপ দিলেন তাঁর আশ্রমের সামনের নদীতে। কিন্তু স্বয়ং প্রকৃতি এই মহাত্মার মৃত্যু চান না, তাই নদীর স্রোতে আপনাআপনি তাঁর বন্ধন খুলে গেল। বশিষ্ঠ আবার উদ্বুদ্ধ হলেন বেঁচে থাকার মন্ত্রে। এই নদী তাঁকে শাপমুক্ত করেছে বলে, তিনি এর নাম দিলেন বিপাশা। সেই বিপাশা এখন বিয়াস। অবশ্য ব্যাসদেবের সঙ্গেও এই নদীর সংস্রব আছে, এর তীরেই নাকি ছিল ব্যাসদেবের আশ্রম। রোটাং পাসে যেখানে এই নদীর উৎস, সেই জায়গাটির নাম বিয়াসকুণ্ড।
কুলু-মানালির সৌন্দর্য বিখ্যাত এবং সেই খ্যাতির টানেও সারা বছরই বড় ভিড়। এমনকী শীতকালেও পর্যটকদের স্রোত অব্যাহত। যারা কুড়ি বছর আগে মানালি গেছে, তারা এখন ওই জায়গায় গেলে চিনতেই পারবে না। যেমন স্বাতী পারেনি। আগেরবার এসে কোথায় ছিল, সে জায়গাটা খুঁজেই পায় না, আমাদের কাছে যা বর্ণনা দিয়েছিল, তা মেলে না কিছুই। ফাঁকা জায়গা একটুও নেই, হোটেলে-হোটেলে ধূল পরিমাণ। কীসব বড়-বড় হোটেল, দেখলে তাক লেগে যায়। কাশ্মীর উপত্যকায় অশান্তি এবং নিরাপত্তার অভাবের জন্য এখন ভ্রমণকারীরা দল বেঁধে আসে কুলু-মানালিতে। মধুর অভাবে গুড় যেমন। তা মধুর চেয়েও নতুন ওঠা ঝোলা গুড় কম সুস্বাদু নয়। কাশ্মীরের মতো বড়-বড় হ্রদ এখানে নেই, অত উচ্চ গিরিচূড়াও নেই, কিন্তু কুলু-মানালিতে যেন হিমালয়ের বুকের ওপর বসে থাকার মতো অনুভূতি হয়। কাশ্মীরের সঙ্গে এ জায়গায় তুলনা টানা ঠিক নয়, দুটি জায়গা দুরকম, নিজস্বভাবে আকর্ষণীয়।
আমরা ঠিক করেছিলাম নিরিবিলিতে একটা ছোট্ট জায়গায় থাকব। যে জায়গার নাম ট্যুরিস্ট ম্যাপে নেই, যেখানে কন্ডাক্টেড ট্যুর যায় না, যেটা তীর্থস্থান নয়। মাণ্ডির ডিভিশনাল কমিশনার সুদৃপ্ত রায় আমার বন্ধু ভাস্করের ভাগনে, সে-ই সুপারিশ করল, আপনারা কসোল-এ যান।
প্রথমে বুঝতে পারিনি। কসৌলি তো বিখ্যাত জায়গা। ধরমপুর থেকে যেতে হয়। সেখানে পাবলিক স্কুল আছে, হাসপাতাল আছে, হিমালয় প্রেমিকদের অবশ্য দ্রষ্টব্য একটি স্থান। সেখানে তো ভিড় লেগে থাকবেই। তা ছাড়া, কসৌলি এখান থেকে অনেক দূরে।
সুদৃপ্ত হেসে বুঝিয়ে দিল, কসৌলি নয়, কসৌল, এর নাম বিশেষ কেউ জানে না, আমাদের রুচি বুঝেই সে বলেছে, সেখানে একটিমাত্র হোটেল ও কিছু গেস্টহাউস আছে। কোনওরকম উত্তেজনা নেই, আওয়াজ নেই। সুদৃপ্তর ব্যবস্থাপনায় পরদিন সকালেই আমরা রওনা দিলাম সেদিকে।
মাণ্ডি থেকে কুলু-মানালির দিকে একটিই মাত্র পথ। বিপাশা নদীর পাশে পাশে। কখনও নদীর এপারে, কখনও ওপারে। মাঝে-মাঝে যেমন ছোট ছোট উপনদী-শাখানদী আছে, সেইরকম ছোট-ছোট রাস্তাও বেরিয়ে গেছে এদিকে-ওদিকে। কুলু পৌঁছনোর আগেই আমরা সেরকম একটা পথে বেঁকে গেলাম ডানদিকে।
মাঝে-মাঝে রাস্তাটি বেশ সরু, রোমাঞ্চকর বলা যেতে পারে, হঠাৎ দুদিক থেকে দুটি গাড়ি এসে পড়লে বুক দুরুদুরু করে। এইসব রাস্তায় বাস উলটে পড়ার দৃশ্য একবার না একবার চোখে পড়বেই।
এই রাস্তার পাশে পাশেও একটি নদী। নাম জানা গেল, পার্বতী। বেশ সরল, সুন্দর নাম। চওড়া বেশি নয়, তাই জলের তোড় টের পাওয়া যায়।
কসৌল-এ পৌঁছবার আগে রাস্তায় যেসব মানুষজন দেখা গেল, তাদের মধ্যে বিদেশিই বেশি। পরে শুনেছিলাম, যে-কোনও কারণেই হোক, ইতালিয়ানদের কাছে এই ক্ষুদ্রস্থানটি বেশ জনপ্রিয়।
হোটেলটিতে পৌঁছে আমরা আশ্বস্ত হলাম।
পুরো হোটেলটিতে আমরা ছাড়া আর লোকই নেই বলতে গেলে। এটা হোটেলের মালিকের পক্ষে দুঃখের বিষয় হলেও আমাদের বেশ ভালো লাগল। একটু পরেই জানা গেল, এত যে সাহেব-মেম আসে, তারা সাধারণত হোটেলে ওঠে না, তারা দু-তিন মাসের জন্য গ্রামের মধ্যে বাড়ি ভাড়া নেয়, নিজেরা রান্না করে খায়। সেই জন্যই অনেক সুন্দর-সুন্দর কটেজ তৈরি হয়েছে এ অঞ্চলে।
আমরা মোট চারজন, কিন্তু আমাদের তিনটি ঘর লাগে। স্বামী-স্ত্রীর একটি, পয়সা বাঁচানো গেলেও ভাস্কর ও অসীম কিছুতেই এক ঘর শুতে রাজি নয়। অসীমের ধারণা, ভাস্করের খুব জোরে নাক ডাকে, তাই এক ঘরে থাকলে সে রাতে ঘুমোতে পারবে না। ভাস্করের জোরে নাক ডাকে ঠিকই, যেমন আমারও রীতিমতো নাসিকা গর্জন হয়, সেটা স্বাতীর সহ্য হয়ে গেছে, কিন্তু অসীমের নিজেরও যে নাক ডাকে, তা সে জানে না। বিয়ে তো করল না, না-হলে তার স্ত্রীই জানিয়ে দিত।
পাশাপাশি তিনটি ঘর পাওয়া গেল সহজেই। ডাকলেই বেয়ারারা ছুটে আসে, অন্য কোনও কাজ নেই তো। হোটেলটার চারদিকে যেন ঘিরে আছে পাহাড়, কয়েকটি চূড়া বরফমণ্ডিত। পাহাড়গুলির গায়ে নিবিড় জঙ্গল। আর হোটেলের পিছন দিকে, অদূরে পার্বতী নদী।
নদীর ধারে-ধারে আপেল বাগান। এই অঞ্চলের আপেল বিখ্যাত। আপেল আর পর্যটন, এই দুটি কারণে এখানকার মানুষদের দারিদ্র্য বেশ কম।
সন্ধেবেলা আড্ডা হয় ভাস্করের ঘরে। ফেব্রুয়ারি মাস, দিনের বেলাতেই বেশ শীত, সূর্যাস্তের পর বাইরে বেরোতেই ভয় করে। ভাস্কর আর অসীম তিন যুগ ধরে আছে, লন্ডন ও প্যারিসে, কিন্তু ঘরের মধ্যে বসেও ভাস্করের বেশি শীত করে। গায়ে জড়িয়েছে চাদর, পায়ের কাছে জ্বলন্ত হিটার। সেই তুলনায় অসীমের শীতবোধ কম।
যখন আমরা একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাই, ভাস্কর অনেক কিছু গুছিয়ে নিয়ে আসে। প্রচুর কাজুবাদাম, নানারকম বিস্কুট, চানাচুর, এমনকী জোয়ান-এলাচ মেশানো মশলা পর্যন্ত। নানাবিধ উত্তম পানীয় তো থাকবেই, এবং অবশ্যই অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট ডজন-ডজন। জীবনের আর সবক্ষেত্রে ভাস্করের স্বভাব এলোমেলো ও ভুলোমনা, শুধু ভ্রমণের ব্যাপারেই তার পরিকল্পনা নিখুঁত।
প্রথমে চা দিয়ে শুরু হয়, তারপর কড়া পানীয়, আড্ডার ঝোঁকে রাত গভীর হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে একমাত্র স্বাতীই আগে দুবার কুলু-মানালি ঘুরে গেছে, অনেকদিন আগে অবশ্য, সেই জন্য এবারে এদিকে আসার ব্যাপারে তার প্রাথমিক আপত্তি ছিল। কিন্তু কসৌল তার পছন্দ হয়ে গেল। এখানকার নিস্তব্ধতা, আবার পাহাড়ের গভীর উপস্থিতি। দুটি মিলিয়ে বিচিত্র অনুভূতি হয়।
ভাস্কর ঘুমকাতুরে, জাগে অনেক দেরিতে। স্বাতী উঠে পড়লেও তার বাইরে বেরোবার জন্য প্রস্তুত হতে সময় লাগে। অসীমের স্বভাবে কৌতূহলবৃত্তি প্রবল, যে-কোনও নতুন জায়গায় গিয়ে সে চতুর্দিকে ঘুরে দেখে নিতে চায়। তা ছাড়া তার ফটোগ্রাফির ঝোঁক, ক্যামেরার ব্যাগ তার কাঁধে ঝোলানো থাকে সব সময়, তাতে তিন-চার রকম ক্যামেরা, পাঁচ-ছ’রকম লেন্স। সকাল সকাল অসীম বেরিয়ে পড়তেই আমি হলাম তার সঙ্গী।
আপেল বাগানের একেকজন মালিকের সীমানা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, তাই প্রথমে নদীর পারে পৌঁছবার রাস্তাটা খুঁজে পাই না। হোটেলের সামনের রাস্তাটা চলে গেছে মণিকরণের দিকে। সেটা ধরে খানিকটা এগোতেই একটা সরু পথ চোখে পড়ল নদীর দিকে। পথ মানে বড়-বড় পাথর ফেলা, যেতে হয় ডিঙিয়ে। আমাদের বাংলা-বিহারে যে-কোনও লোকালয়ের নদীর ধারে সকালবেলা না যাওয়াই ভালো, গেলে অনেক পুরুষের বসে থাকা উন্মুক্ত পশ্চাৎ-দৃশ্য দেখতে হয়। এখানে কেউ নদীকে সেভাবে ব্যবহার করে না। তা ছাড়া এই শীতে বরফ-গলা নদীর জল ছোঁবে কে?
উঁচুর দিক থেকে নেমে আসছে পার্বতী নদী, ধাপে ধাপে, তাই তার স্রোতে মৃদু কুলুকুলু ধ্বনি আছে। মাঝে-মাঝে ভেসে আসছে ভাঙা ডালপালা। নামের জন্যই নদীটিকে মনে হয় সুন্দরী রমণী, সে যেন আপনমনে গান গাইতে-গাইতে চলেছে।
জলের মধ্যে একটি আধো-ডোবা পাথরে একটি ফড়িং একেকবার বসছে আর উড়ে যাচ্ছে। ঠিক মুহূর্তে ফড়িংটিকে ধরবার জন্য ক্যামেরা তাক করে আছে অসীম, মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে। ভালো ছবি তুলতে ধৈর্য লাগে। আন্তর্জাতিক দুয়েকটি প্রতিযোগিতাতেও অসীম তার ছবি পাঠায়। ফড়িং-মাকড়সা-গুবরে পোকা, এইসবের ছবিই নাকি বেশি পুরস্কারযোগ্য। আমার অত ধৈর্য নেই। আমি ফড়িংকে ছেড়ে দেখতে থাকি নদীর ওপারের বনরাজি। মনে হয়, হঠাৎ যেন ওর মধ্য থেকে হরিণ বেরিয়ে আসবে। আমি সুন্দরবনে গিয়ে কখনও বাঘ দেখিনি, কিন্তু ভোরবেলা লঞ্চের ছাদ থেকে দেখেছি জঙ্গলের প্রান্তে এক পাল হরিণ।
জঙ্গলের ওপাশে পাহাড়ের চূড়া, প্রথম সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে বরফ। স্বর্ণকিরীট একেই বলা যায়। অসীমকে বললাম, এই পাহাড়ের ছবি তুলবে না? দ্যাখো, দ্যাখো–
মনঃসংযোগ নষ্ট হওয়ায় বিরক্তভাবে ভুরু কুঁচকে বলল, ওতে নতুনত্ব কী আছে?
পাহাড়ের তুলনায় একটি ফড়িং-এর ওড়াউড়িতে কী এমন নতুনত্ব থাকতে পারে, তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। বুঝলে তো আমিও ফটোগ্রাফার হতাম।
একটু পরে অসীম বললে, চলো, নদীটার ধার দিয়ে দিয়ে খানিকটা এগোই।
বেশি দূর যাওয়া গেল না অবশ্য। নদীর কিনারে কোনও রাস্তাই নেই, অনবরত পাথর ডিঙোতে হয়, কোথাও ডিঙোনোও যায় না। পার্বতী নিরিবিলিতে থাকতে চায়।
দুপুরবেলা আমরা এগোলাম পাকা রাস্তা ধরে, গাড়ি নিয়ে। কিছু দূরেই মণিকরণ, একটি তীর্থক্ষেত্র। হিন্দু এবং শিখ, দুই ধর্মেরই তীর্থ বলে সারা বছরই এখানে জনসমাগম লেগে থাকে।
মণিকরণের কাছাকাছি এসে পার্বতী নদীর এমন একটা রূপ চোখে পড়ে, যায় তুলনা পাওয়া ভার। নদীর জল থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
এদিককার কোনও পাহাড়ের হিমবাহ থেকেই এই নদীর উৎপত্তি। বরফ-গলা জল নিশ্চিত ঠান্ডা হওয়ার কথা। কিন্তু এই অঞ্চলে যত্রতত্র উষ্ণপ্রস্রবণ। নদীর ধার ঘেঁষেও কোথাও-কোথাও মাটি খুঁড়ে উষ্ণপ্রস্রবণ বেরিয়ে আসছে, সে জল এমনই গরম যে নদীকেও তপ্ত করে তুলেছে।
একদিকে গাড়ি রেখে, একটা কাঠের সেতু পেরিয়ে মণিকরণে যেতে হয়। সেতুর নীচে দেখি, এক জায়গায় পার্বতী নদী টগবগ করে ফুটছে। এরকম দৃশ্য আমি আগে কখনও দেখিনি।
গুরু নানক নাকি মণিকরণে এসেছিলেন, তাই শিখদের কাছে এই স্থানটি খুব পবিত্র। একটা প্রকাণ্ড ধর্মশালা রয়েছে। আর সব উষ্ণপ্রস্রবণকেই হিন্দুরা তীর্থস্থান মনে করে। একটি বড় রামমন্দির আছে, আরও অনেক মন্দির। কয়েক জায়গায় প্রকৃতির গরম জলে স্নান করার ব্যবস্থা।
অনেক শেতাঙ্গ সেখানে দিব্যি কালো মানুষদের সঙ্গে স্নান করছে। কয়েকটি হোটেলেও ওইরকম স্নানের ব্যবস্থা আছে, হোটেলের বাথরুমে উষ্ণপ্রস্রবণের জল।
তীর্থস্থান মানেই প্রচুর টুকিটাকি জিনিসপত্রের দোকান, আর রেস্টুরেন্ট। এক জায়গায় দেখি, বাংলায় লেখা, ‘বউদির দোকান’। সেখানে নিশ্চিত ভাত-মাছের ঝোল পাওয়া যায়। আমি প্রবাসে গিয়ে বাঙালি খাওয়া একেবারে পছন্দ করি না। নিত্যি তিরিশ দিন বাড়িতে যা খাচ্ছি, প্রবাসে বেড়াতে গিয়ে তা খাব কেন? প্যারিসে আমাদের এক বাঙালি বন্ধুর স্ত্রী ফরাসিনী। তাঁদের বাড়িতে গেলেই বন্ধুর স্ত্রী আমাদের ভাত-ডাল-তরকারি খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর অপটু হাতের রান্না ডাল-তরকারির চেয়ে ফরাসি খাদ্যদ্রব্য পেলে যে আমরা অনেক বেশি প্রীত হতাম, তা তাঁকে বোঝানো যায় না।
মণিকরণ একটি উপত্যকার মধ্যে। চতুর্দিকের দৃশ্য ভারী মনোরম। ভাস্কর বলল, আগে এই জায়গাটা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর ছিল, এখন এত বাড়ি-ঘর উঠে ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকত, আমি এখানে এত বাড়ি বানানো নিষিদ্ধ করে দিতাম।
অসীম বলল, ওটাই তো এ দেশের দোষ। কেউ কিছু চিন্তা করে না, সুন্দর জায়গাকে সুন্দর রাখতে জানে না।
অসীম ও ভাস্কর দুজনেই বিদেশে থাকে, ওদের পাসপোর্টও ভারতীয় নয়, কিন্তু অসীম এ দেশের নিন্দে শুরু করলেই ভাস্কর তার বিপক্ষে চলে যায়। স্বাতীও তখন ভাস্করের সঙ্গে যোগ দিয়ে অসীমকে বকাবকি শুরু করে। আমি অধিকাংশ সময়েই নিরপেক্ষ শ্রোতা।
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর স্বাতী বলল, এখানে একদিন থেকে গেলে হয় না?
তৎক্ষণাৎ আমরা তিনজন পুরুষ একমত হয়ে জানালাম যে, না, তা হতেই পারে না। ভিড়ের জায়গায় থাকব না ঠিক করেই এসেছি, এর চেয়ে কমোল অনেক ভালো।
আমি মন্দির-মসজিদ-গির্জা বাইরে থেকেই দেখা পছন্দ করি। স্বাতী ভেতরেও যেতে চায়। এখানকার মন্দিরগুলিতে ভাস্কর্য-স্থাপত্যের কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, তাই কাছে গিয়েও দেখার মতো কিছু নয়। কিন্তু স্বাতী দুয়েকটি মন্দিরের ভেতরে যাবেই ঠিক করেছে। ভাস্কর শিভালরি দেখিয়ে সঙ্গ দেয় স্বাতীকে।
অসীম ছবি তোলার জন্য বিষয় খুঁজতে চলে যায়, এদিক ওদিক। আমি বসে ওদের জন্য অপেক্ষা করি একটি চায়ের দোকানের বেঞ্চে।
চা অত্যন্ত বিস্বাদ, দুধে ফোঁটানো, বেশি চিনি। কম চিনির ব্যাপারটা এরা বোঝেই না। আজকাল ট্রেনের চা-ওলারাও আগে থেকে মিষ্টি মিশিয়ে রাখে, তাতে বাইরে চা খাওয়ার আনন্দটাই চলে গেছে। মাটির ভাঁড়ও নেই, সেই সোঁদা গন্ধ মেশানো চায়ের জন্য মন কেমন করে।
সিগারেট টানতে টানতে উলটোদিকের বাড়ির দেওয়ালে একটা বড় পোস্টার চোখে পড়ল। মাঝখানে একটি যুবকের ছবি, তার তলায় লেখা, দশ হাজার ডলার পুরস্কার।
উঠে গিয়ে ইংরিজিতে লেখা পোস্টারটি ভালো করে পড়লাম।
খুব মর্মস্পর্শী ব্যাপার। কানাডার এক মহিলা সেই পোস্টারটি লাগিয়ে গেছেন। ছবিটি তাঁর একমাত্র ছেলের, সে নিরুদ্দেশ। দু-মাস আগে সেই ছেলেটি এই মণিকরণ থেকে তার মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিল, তারপর থেকে আর তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। ভদ্রমহিলা নিজে এখানে এসেছিলেন খোঁজ করার জন্য। এই পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে পোস্টার লাগিয়ে গেছেন অনেক জায়গায়।
ফিরে এসে দোকানদারটিকে জিগ্যেস করলাম, ওই নিরুদ্দিষ্ট ছেলেটির বিষয়ে কিছু জানেন নাকি?
দোকানদারটি বললেন, ওই বিদেশি যুবকটিকে তিনি চিনতেন। মণিকরণে থেকেছে অনেকদিন। এই দোকানে চা খেতেও আসত। একদিন সে পার্বতী নদীর উৎস সন্ধান করতে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে একা চলে গিয়েছিল পাহাড়ে। আর ফিরে আসেনি। পাহাড়ের পর পাহাড়, কোথায় সে হারিয়ে গেছে, কী করে আর জানা যাবে!
আমি পার্বতী নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম।
যুবকটি কি শেষ পর্যন্ত পার্বতীর উৎসমুখে পৌঁছতে পেরেছিল? কত দূর থেকে এসেছিল সে, একা-একা কেন গেল ওই দুর্গম পাহাড়ে।
সে বোধহয় এই নদীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। নদী তাকে বুকে টেনে নিয়েছে?