বাড়িটা ইউ শেপের। দুপাশের দুই বাহুতে তিনখানা তিনখানা করে মোট ছখানা ঘর। ইউ-এর তৃতীয় বাহুটি বনবিশ্রামাগারের ডাইনিং হল। খাবার টেবলটি রীতিমতো প্রকাণ্ড, সেখানে স্বচ্ছন্দে জনা কুড়ি লোক আহারে বসতে পারে।
ডাইনিং হলের পিছনে কিচেন। বড় বড় দুখানা উনুন আছে রান্নাঘরে। জ্বালানি হিসেবে শুধু কাঠই ব্যবহার হয়। সরু মোটা বেঁটে লম্বা নানান মাপের শুকনো ডালপালা রান্নাঘরে মজুত।
রান্নাবান্না করে বনবিশ্রামাগারের চৌকিদার। সারগিয়া। ষাটের কাছাকাছি বয়স। কপালে বলিরেখা এসে গেলেও তার শরীরটি বেশ শক্তপোক্ত। কোনও কাজেই সে না বলে না, সর্বক্ষণই তার মুখে হাসি লেগে আছে।
অল্প সময়ের মধ্যেই টুপুরের সঙ্গে আলাপ জমে গেছে সারগিয়ার। বাংলা বুঝতে পারে সারগিয়া, ভাঙা ভাঙা বলতেও পারে। এই বাংলোয় সে প্রায় চল্লিশ বছর চাকরি করছে। এখানে যারা বেড়াতে আসে তাদের বেশিরভাগই বাঙালি, ভ্রমণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেবলেই সারগিয়া মোটামুটি ভাষাটা রপ্ত করে নিয়েছে।
দুপুরে আজ খাওয়ার আয়োজন অতি সংক্ষিপ্ত। খিচুড়ি, ডিমভাজা, আলুভাজা আর ঘি। সারগিয়া চালে-ডালে খিচুড়ি বসিয়ে দিল, তারপর বাঁক কাঁধে চলল টুপুরদের স্নানের জল। আনতে।
টুপুর আর বুমবুম সারগিয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিল। খেটো ধুতি পরা সারগিয়ার গা খালি, বুকে পিঠে অজস্র কাটাছেড়ার দাগ।
টুপুর প্রশ্ন করল, তোমার গায়ে ওগুলো কীসের দাগ, সারগিয়াদাদা?
ভালুক আঁচড়ে দিয়েছে। সারগিয়ার নিরুত্তাপ উত্তর, অনেক সাল আগে। আমার উমর তখন তেইশ-চব্বিশ হবে। জঙ্গলে কাঠ আনতে গিয়েছিলাম, অচানক মহুয়া গাছের পেছন থেকে ভালুকটা এসে গায়ে লাফিয়ে পড়ল। তখন আমার শরীরে তাকত অনেক বেশি ছিল, খুব লড়াই হল ভালুকের সঙ্গে। ভালুক ভি ছাড়বে না, হামি ভি নেই ছোড়ুঙ্গা…. আধা ঘণ্টা পর ভালুক পালিয়ে গেল। তখন আমার গা দিয়ে খুন ঝরছে। চাইবাসায় নিয়ে যেতে হয়েছিল আমাকে, এক মাস হাসপাতালে ছিলাম।
তার মানে তুমি শেষ পর্যন্ত জিতেছিলে সেদিন?
জঙ্গলে জিত হার নেই দিদি। সেদিন ভালুকটা মাতাল ছিল, বহুত মহুয়া খেয়েছিল ব্যাটা। নেশায় না থাকলে ওই ভালুক তো সেদিন আমায় চিরে খতম করে দিত।
বুমবুম অবিশ্বাসের স্বরে বলল, যাহ্, ভালুক আবার নেশা করে নাকি?
করে বইকী খোকাবাবু! ভালুক আদমি সে ভি জাদা নেশা করে।
খোকাবাবু বলে ডাকলে বুমবুম ভীষণ বিরক্ত হয়। পলকে তার মুখ হাঁড়ি। আর কথা বলছে না, গোঁজ হয়ে হাঁটছে। একটা লাঠি কুড়িয়ে নিল মাটি থেকে, সপাং সপাং লাঠি চালাচ্ছে হাওয়ায়।
ঢাল বেয়ে নামতেই রাস্তার ধারে এক ক্ষীণ জলধারা। রাস্তা থেকে খানিকটা নিচুতে পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে প্রায় নিঃশব্দে। জলটার রং কালচে।
বেড়ালের মতো ক্ষিপ্ৰ পায়ে জলধারার কাছে নেমে গেল সারগিয়া। টিনে জল ভরছে।
বিট অফিসারের ঘরের দিক থেকে হঠাৎ একটা ছেলেকে আসতে দেখা গেল। টুপুরের থেকে কিছুটা বড়ই হবে। কালকুলো হাট্টাকাট্টা চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, প্যান্ট শার্ট পরা, হাতে বাজারের থলি।
টুপুরদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল ছেলেটা। দুর্বোধ্য ভাষায় সারগিয়াকে কী যেন বলছে। সারগিয়াও চেঁচিয়ে উত্তর দিল, আঙুল দেখাচ্ছে ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা দৌড়ল রেস্টহাউসের দিকে।
সারগিয়া জল নিয়ে উঠে আসতেই টুপুর বলল, ও কে গো?
আমার ছেলে। সুমায়া!
ও। এই তা হলে সুমায়া? ও নাকি খুব জঙ্গল চেনে?
হাঁ খোকি। বিলকুল আমার মতো হয়েছে। দিনরাত জঙ্গলে ঘুরছে।
টুপুরকে খুকি বলাতে বুমবুম মহা খুশি। তিড়িং বিড়িং লাফাচ্ছে, ছোট ছোট পাথর কুড়িয়ে ছুড়ছে জলে।
টুপুর জিজ্ঞেস করল, তোমার বুঝি ওই একটাই ছেলে?
আমার তিন লেড়কা, তিন লেড়কি। বাঁক ঝাধে দুলে দুলে হাঁটছে সারগিয়া। হাঁটতে হাঁটতেই নিজের কথা শোনাচ্ছে, আমার বড় মেয়ের শাদি হয়েছে নোয়ামুন্ডিতে। মেজোর করঞ্জিয়ায়। আর ছোট বেটির কিরিবুরু। বড়া দুই লেড়কা ভি কিরিবুরুতে আছে। মাইনে কাজ করে। ওরা পড়ালিখা ভি জানে। স্কুল পাশ করেছে। স্রেফ এই সুমায়াই পড়াই করল না। জামদার বোর্ডিং-এ রেখে এলাম, পালিয়ে এল। জঙ্গল ছেড়ে ও এক দিন থাকতে পারে না।
টুপুর বলল, খুব খ্যাপা আছে তো!
জংলি আছে। সারগিয়ার স্বরে হালকা বিরক্তি, থাক, জঙ্গলেই থাকুক। দো সাল বাদ আমার রিটারমিন, তখন ও আমাদের বুড়াবুড়ির দেখভাল করবে। রেঞ্জারসাব বলেছেন, থলকোবাদের চৌকিদারের পোস্টের জন্য সুমায়াকে রেকমিন্ড করবেন।
ভালই তো। সাহেবের রেকমেন্ডেশনে চাকরিটা হয়ে গেলে সুমায়ার পাকাপাকি হিল্লে হয়ে যাবে।
তা হবে। তবে তার আগে আমি ওর ডানা ছেঁটে দেব দিদি। শাদি দিয়ে দেব সুমায়ার। ইস সালই। লেড়কি ভি দেখা আছে।
টুপুর হেসে গড়িয়ে পড়ল, ওইটুকু ছেলের বিয়ে দেবে কী?
ছোট কোথায়? পন্দরা বরস পুরে গেছে। আমার তো শাদি হয়েছিল তেরো বছর বয়সে।
কথায় কথায় রেস্টহাউসে পৌঁছে গেছে টুপুররা। বাথরুমে জল দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল সারগিয়া, টুপুর আর বুমবুম এসে দাঁড়াল রেস্টহাউসের চাতালটায়। সেখানে এখন সুমায়াকে ঘিরে ছোট্ট জটলা।
পার্থ জেরা করছে সুমায়াকে, তুমি তা হলে বলছ জন্তুজানোয়ার দেখা যাবে?
সুমায়া বলল, হাঁ সাব।
আগে যারা ছিল তারা যে বলে গেল কিছু চোখে পড়েনি?
ওঁরা তো ঘর ছেড়ে বেরোতেনই না সাব। সারাদিন বসে বসে তাস খেলতেন। স্রেফ দুপুরবেলায় এক দো ঘণ্টার জন্য ঘুমাতেন, ব্যস। বেশি দূর ভি যেতেন না। জাদা সে জাদা সাত আট কিলোমিটার। ইতনা নজদিক কোন জানোয়ার মিলবে? বহুত ডরপুক থে উয়োলোগ। পাগলা হাতির খবর শুনে তো রুমসে নিকালনা বিলকুল বন্ধ কর দিয়ে থে।
টুপুর তো হাঁ। ভদ্রলোক তো ডাহা মিথ্যেবাদী। উহুঁ, মিথ্যেবাদী নয়, চালবাজ। এমন ভান করলেন, যেন গোটা জঙ্গলটা চরকি মেরে বেড়িয়েছেন। শুধু কথাবার্তা শুনেই কোনও লোক সম্পর্কে ধারণা করা যে কী কঠিন।
পার্থ বলল, তার মানে তুমি বলছ জন্তু দেখতে গেলে আমাদের ভোরে বা সন্ধেবেলায় বেরোতে হবে?
হাঁ সাব। এমনি টাইমে হরিণ ছাড়া কিছু মিলবে না। আলো যখন কম থাকে, তখনই জানোয়ার জাদা দেখা যায়। রাতে বেরোতে পারলে তো সবচেয়ে ভাল।
সহেলি আঁতকে উঠলেন, না, না, রাত্তিরে বেরোতে হবে না। সাপখোপ আছে, কোন দিক থেকে বাঘ ভালুক গায়ে লাফিয়ে পড়বে ঠিক নেই…
টুপুর বলল, আমরা তো জিপে থাকব মা।
ওই পাগলা হাতিটা এসে গেলে? সে তো জিপ নিয়ে ফুটবল খেলবে!
সুমায়া তাড়াতাড়ি বলে উঠল, হাতি যেদিকে আছে, রাতে সেদিকে যাব কেন মাজি?
তুমি বুঝি জেনে বসে আছ ওই হাতি কোথায় থাকবে?
আমি বুঝতে পারি মা-জি। জানোয়ার যেমন আদমির গন্ধ পায়, আমিও তেমনই জানোয়ারের গন্ধ পাই।
বলো কী হে! পার্থর চোখ বড় বড়, তুমি কি টারজান? একমাত্র টারজানই তো বাঘ, সিংহ, হাতি, গন্ডারের গন্ধ পেত জানতাম।
সুমায়া কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না। জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, নেই সাব, সচ্ বাত। আমি বুঝতে পারি। আমিই তো পাগলা হাতিকে প্রথম দেখেছি।
আচ্ছা? অবনী সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন। কোথায় দেখলে?
তিরিলপোসির বাংলো থেকে আরও দো কিলোমিটার আগে। ওখান দিয়ে সালাই যাওয়ার একটা রাস্তা আছে, ওই রাস্তায় দাঁড়িয়ে জোরে জোরে ডাকছিল। খুন বেরোচ্ছিল হাতির শুড় দিয়ে। বুড়া হাতি, ভাল করে চলতে ভি পারছিল না।
তারপর?
আমিই তে গিয়ে রেঞ্জারসাবকে খবর দিলাম।
তুমি বুঝলে কী করে পাগল হয়ে গেছে?
পাগল না হলে হাতি কক্ষনও দল ছাড়ে না। দল যখন ওকে ছেড়ে দিয়েছে, তার মানেই ও দল থেকে বাতিল। পাগলা হাতি। আর বুড়া হাতি, ইয়ে দোনোকো দলমে জাগাহ্ নেহি। ও এখন একা একাই ঘুরবে, আর চারদিকে ক্ষতি করে বেড়াবে। গাঁয়ে ঢুকে আদমিকে পিষে দেবে।
তেমন কিছু করেছে নাকি?
আভি তক তো করেনি। যাতে কিছু না করতে পারে এইজন্যই তো আমি রেঞ্জ অফিসে খবর করে দিলাম। ওরা এখন টিম পাঠাবে, হাতিটাকে পাকড়াও করবে।
পাগলা হাতিকে ধরে কী করা হবে?
হাতির তো গোলি লেগে গেছে সাব। গোলি বার করতে হবে না?
তুমি দেখেছ গুলি লেগেছে?
হাঁ সাব। জখম দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
কত কাছ থেকে দেখেছ তুমি?
দশ বারা হাত।
অবনীর বিশ্বাস হল না। বললেন, অত কাছে গেলে, আর হাতি তোমায় কিছু বলল না?
হাতির তখন বহুত দর্দ হচ্ছিল সাব। ব্যথায় ছটফট করছিল। আমাকে নজর করেনি। জখম একদম টাটকা, এক দো দিন কা অন্দর লেগেছে গোলি।
মিতিন চুপচাপ সব শুনছিল এতক্ষণ। হঠাৎ প্রশ্ন জুড়ল, তুমি কবে দেখেছ হাতিটাকে?
পরশু। পরশুই খবর করে দিলাম।
কিন্তু গুলিটা করল কে?
কৌন জানে! হোগা কোই শয়তান। এসেছে কোথাও থেকে। এ জঙ্গলে কত দিক থেকেই তো ঢোকা যায়। গুয়াসে, মনোহরপুরসে…ওড়িশাসে ভি আসতে পারে।
সারগিয়া বেরিয়ে এসে হাঁক পাড়ছে, এই সুমায়া, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গপ করলেই হবে? বাবুদের পিনে কা পানি কে আনবে?
আসর ভেঙে গেল। সুমায়া কাজ করতে ছুটেছে।
টুপুররাও পায়ে পায়ে যে যার নিজের ঘরে।
থলকোবাদের রেস্টহাউসটি তেমন দেখনবাহার নয় বটে, তবে ঘরগুলো মোটামুটি চলনসই। প্রতি ঘরেই দুখানা করে চৌকি পাতা! চৌকির ওপর বিছানাও বেশ পরিচ্ছন্ন। চেয়ার-টেবল, আলমারি, আয়নাও আছে ঘরে। লাগোয়া একখানা অ্যান্টিরুমও। বাথরুমও নেহাত ফ্যালনা নয়, বাথরুমের জানলা দিয়েও দিব্যি জঙ্গলের শোভা দেখা যায়।
টুপুর স্নানটান সেরে মিতিন পার্থদের ঘরে এল। এ ঘরটা একেবারে প্রান্তে। জানলার বাইরেই জঙ্গল। দুপুরবেলাতেও জঙ্গলে বেশ অন্ধকার, চোখ পড়লে গা ছমছম করে ওঠে। কী নিঝুম! এই ঘরটাই টুপুরের বেশি পছন্দ ছিল, মিতিনমাসিও এ-ঘরেই তাদের থাকতে বলেছিল। কিন্তু সহেলি কিছুতেই রাজি হননি। রাতদুপুরে জানলায় যদি ভালুক এসে দাড়ায়!
পাৰ্থ স্নানে গেছে। মিতিন চুল আঁচড়াচ্ছিল। টুপুরকে বলল, মশার ধূপগুলো মনে করে ঘরে নিয়ে যা। দুপুরবেলাতেই জ্বালিয়ে দেওয়া ভাল।
খুব মশা আছে কি? কামড়াচ্ছে না তো।
জানলার জাল দেখে বুঝতে পারছি না? মশারিগুলোই বা বিছানায় দিয়ে গেছে কেন? বিনা কারণে? জঙ্গলের মশা কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস। বিশেষ করে সারান্ডার আর সিমলিপালের। মুকুলবাবু ট্রেনে সাবধান করে দিয়েছিলেন, মনে নেই?
সত্যি ম্যালেরিয়া হয়?
যে-সে ম্যালেরিয়া নয়। ফরেস্ট ম্যালেরিয়া। ফ্যালসিফেরাম জীবাণু থেকেই হয়। খুব খারাপ ধরনের অসুখ। বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে ব্রেন অ্যাটাক করে, ঘাড় স্টিফ হয়ে যায়, এবং তারপরে অক্কা। তোর মাকে আবার গল্প করিস না, শুনলে তোর মা আরও নার্ভাস হয়ে যাবে।
সে আর বলতে। টুপুর মুচকি হাসল। চোখ চালিয়ে দেখছে ঘরখানাকে বলল, পোকামাকড়ও কম নেই!
জঙ্গলে পোকামাকড় থাকবে না? মিতিন চুলে বিনুনি করতে করতে বলল, তোর সুমায়া ছেলেটাকে কেমন লাগল রে?
সুমায়া নয়, বলো টারজান। ব্ল্যাক টারজান। টুপুর খিলখিল হেসে উঠল, জানো, এ বছরই ব্ল্যাক টারজানের বিয়ে হবে!
মিতিন মোটেই অবাক হল না। বলল, তাই বুঝি?
হ্যাঁ গো। বউও নাকি ফিট। ভাবো একবার, পনেরো বছরের একটা ছেলে বিয়ে করতে চলেছে!
বাল্যবিবাহ তো সর্বত্রই চলছে এখনও। আমাদের ওয়েস্ট বেঙ্গলেও কত গ্রামে হয়। আর এরা তো উপজাতি, বাল্যবিবাহটাই তো এদের রেওয়াজ। তাও তো সুমায়া বয়সের তুলনায় অনেক সাব্যস্ত…
সুমায়ারা কী উপজাতি?
হ্যাঁ। সারান্ডা রেঞ্জে হো উপজাতিই বেশি। ইনফ্যাক্ট, সারান্ডা নামটাই হো উপজাতির ভাষা থেকে এসেছে। সারান্ডা মানে কী জানিস? সাতশো পাহাড়ের দেশ।
এখানে সাতশো পাহাড় আছে?
এডজ্যাক্ট নাম্বারটা নাও মিলতে পারে। ছশো নব্বইও হতে পারে, সাতশো দশও হতে পারে। মোটামুটি সাতশোর কাছাকাছি।…তবে পঞ্চাশ একশো বছর পরে পাহাড়ের সংখ্যা অনেক কমে যাবে।
কেন?
দেখলি না, কীভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে? বিশ-তিরিশ বছর পরে কিরিবুরু অদৃশ্য হয়ে যাবে। মেঘাতুবুরুও। তখন লোহার খোঁজে আবার একটা বুরু কাটা শুরু। যন্ত্রপাতিরও উন্নতি হচ্ছে দিন দিন, এর পর পাহাড় সাফ করতে সময় লাগবে আরও কম।
ইস, পাহাড়গুলো প্লেন হয়ে গেলে কী বিশ্রী লাগবে, না মিতিনমাসি?
কী করা যাবে! সভ্যতার অভিশাপ।
টুপুরের মনটা একটু ভার হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ বুমবুমের চিৎকারে চমকে উঠল, টুপুরদিদি, জলদি আয়। অ্যানিম্যাল!
বুমবুমের ডাকের উৎসটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল মিতিন টুপুরের। তার পরেই দুজনে দৌড়েছে। প্রত্যেকটা ঘরের পিছনেই একটা করে দরজা আছে, টুপুর আগে লক্ষ করেনি। দরজার পরেই সিঁড়ি, ধাপগুলো সোজা নেমে গেছে জঙ্গলে। ওই দরজা দিয়েই কখন বেরিয়ে গেছে বুমবুম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে আছে এক শালগাছের নীচে।
মিতিন ধমকে উঠল, কী করছ? ওখানে কেন গেছ? উঠে এসো।
বুমবুমের গম্ভীর জবাব, আমি অ্যানিম্যাল দেখছি।
কোথায় অ্যানিম্যাল?
ওই তো। টাইগারের আন্টি।
একজোড়া বেড়ালবাচ্চা খেলা করছে গাছের তলায়। মিতিন বকবে কী, ছেলের কথা শুনে হেসে খুন। হাসতে হাসতে বলল, সত্যি সত্যি যখন আন্টির নেফিউ চলে আসবে, তখন টেরটি পাবে।
আমায় বাঘ খাবেই না।
কেন?
তুমিই তো বলল, আমি পেকে ঝুনো নারকেল। বাঘ কি নারকেল খায়?
এবার আর হাসল না মিতিন। ছেলেকে হিড়হিড় করে তুলে এনেছে ওপরে। ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিল।
পাৰ্থ স্নান সেরে পাজামা পাঞ্জাবি পরে নিয়েছে। মিতিনকে বলল, দ্যাখো, সাদা পোশাক চলবে তো?
জঙ্গলে উজ্জ্বল রঙের জামাকাপড় পরতে পই পই করে নিষেধ করেছে মিতিন। সবুজ চলতে পারে। ঘিয়ে ঘিয়েও চলবে, কিন্তু লাল, হলুদ, মেরুন, কটকটে নীল একদম নয়। চড়া রং বুনো প্রাণীরা মোটেই পছন্দ করে না।
মিতিন ভুরু কুঁচকে বলল, সাদাও না পরলেই পারতে। সাদা রংও চোখে লাগে। যাকগে, এটা মন্দের ভাল।
পার্থ বলল, আমি কিন্তু এখন সিগারেটও কম খাচ্ছি।
রেস্টহাউসের ঘরে বসে দুচারটে খেতে পারো। কিন্তু জঙ্গলে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে যাওয়া চলবে না। মনে রেখো, সিগারেটের আগুন আর ধোঁয়া, দুটোই জীবজন্তুদের কাছে অসহ্য।
পার্থ হেসে বলল, ওফ টুপুর, তোর মাসির নাম প্রজ্ঞাপারমিতা না হয়ে জ্ঞানদাসুন্দরী হওয়া উচিত ছিল। সারাক্ষণ যা জ্ঞান দেয়!।
প্রজ্ঞাপারমিতাও জ্ঞানের দেবী স্যার। হিন্দুদের নয়, বৌদ্ধদের। মিতিন কটাস করে পার্থকে চিমটি কাটল, চলো , এবার তো তোমার পেটপুজোর পালা।
সারগিয়ার রান্নার হাত মন্দ নয়। ধনে জিরের গুঁড়ো ছড়িয়ে একটা অন্যরকম স্বাদ করেছে খিচুড়ির। সকলেরই পেট চুঁই চুঁই, থালায় পড়তে না পড়তেই খিচুড়ি সাবাড়। অবনী যে অবনী, তিনিও আজ এক হাতা চেয়ে নিলেন।
রাতের মেনুও বলে দেওয়া হল সারগিয়াকে। রুটি, বেগুনভাজা, ডিমের ডালনা আর স্যালাড। শুধু বুমবুম রুটি খায় না, তার জন্যএকটু ভাত।
নজরুলের জন্য ডাইনিং হলের পাশের একটা ঘর খুলে দিয়েছে সারগিয়া। নজরুলও খেলেন টুপুরদের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কি এখন বেরোবেন?
মিতিন বলল, কাছেপিঠে ঘুরব। আপনি রেস্ট নিন। বিকেল সন্ধেয় বেরোলে আপনাকে ডেকে নেব।
অবনী আঁচাতে আঁচাতে ঘোষণা করলেন, আমি এখন একটা লম্বা ঘুম দেব। তোমরা জঙ্গলে যাও, জাহান্নমে যাও, কেউ আমাকে ডাকবে না।
সহেলিও ক্লান্ত। ইয়া ইয়া হাই তুলছেন। বললেন, যাই বাবা, আমিও একটু গড়িয়ে নিই। সারগিয়া চা করলে আমায় ডেকে দিস।
পার্থরও শোয়ার বাসনা ছিল। মিতিন টুপুর বেরোচ্ছে দেখে সেও সঙ্গী হয়েছে। আর বুমবুম তো এক পায়ে খাড়া, সুমায়ার কাঁধে উঠে পড়ল।
খুব দূরে গেল না টুপুররা। বিট অফিসারের ঘরের সামনের রাস্তাটা চলে গেছে জঙ্গল অভিমুখে, সেই পথ ধরেই হাঁটছে। একটু এগোতেই চতুর্দিক সুনসান। অসম্ভব নিস্তব্ধ। হঠাৎ হঠাৎ হাওয়া উঠছে জঙ্গলে, চারদিকে তখন শব্দ বাজছে বুমবুম। বাতাস থেমে গেলেই আবার সেই নৈঃশব্দ। শাল-সেগুনের তলা যথারীতি সাদা হয়ে আছে ফুলে। মৃদু সুরভি ছড়িয়ে বনময়। তবে ওই গন্ধকেও যেন ছাপিয়ে যায় অরণ্যের ঘ্রাণ।
একপাশে জঙ্গল উঁচু হয়ে গেছে ক্ৰমশ। প্রতি মুহূর্তে মনে হয় এই বুঝি কোনও হিংস্ৰ জন্তু ঝাপিয়ে পড়ল গায়ে।
টুপুরের গা শিরশির করছিল। জঙ্গল ধরে খানিক হেঁটে ফিরল তারা। ডাইনে ঘুরে অন্য একটা পথ বেয়ে উঠছে ওপরে।
বন দফতরের কম্পাউন্ডের মধ্যেই দু-তিনটে ভাঙাচোরা বাড়ি। পরিত্যক্ত।
মিতিন সুমায়াকে জিজ্ঞেস করল, এ বাড়িগুলো কীসের গো?
সুমায়া বলল, বহুত দিন পহেলে এগুলোই ছিল ফরেস্ট বাংলো। তখন আপনাদের ওই রেস্টহাউস ছিল না।
আর পাশে কাটাতার ঘেরা সুন্দর মতো বাড়িটা?
ওটা অফিসারদের ইনিসপেকশান বাংলো দিদি। ভি আই পি-রা এসে ওখানে থাকে।
মিতিনদের রেস্টহাউস থেকেই দেখা যাচ্ছিল বাড়িটা। তফাত খুব বেশি নয়, বড়জোর তিরিশ-চল্লিশ গজ। সামনে একটা কাঠের গেট, মিতিন গেট ঠেলে ঢুকল ভেতরে। সামনে গিয়ে ভাল করে দেখল বাড়িটাকে। খাঁটি ব্রিটিশ প্যাটার্নের বাংলো। উঁচু সিলিং, চওড়া বারান্দা, সার সার ঘর। সবকটা ঘরই তালাবন্ধ।
পার্থ টুপুররাও গেছে পিছন পিছন। পার্থ একটা দরজা ফাঁক করে দেখল ভেতরটা। বলল, ওয়াও! কী দারুণ অ্যারেঞ্জমেন্ট। ডানলো পিলোর বেড, সোফা, ড্রেসিংটেবিল, ফায়ার প্লেস, মাথার ওপর ফ্যান…
টুপুর বলল, ফ্যান এল কোত্থেকে? এখানে তো কারেন্ট নেই?
সুমায়া বলল, জেনারেটার আছে। সাবলোগ এলে চালানো হয়।
কোন ভি আই পি আসে এখানে?
ডি-এফ-ও আসেন, ডিএম আসেন, মিনিস্টারলোগ ভি আসেন।
বাংলোর সামনে সুন্দর লন। মিতিন লনে চলে গিয়েছিল, চেঁচিয়ে ডাকছে, এই, শিগগিরই আয়।
মিতিনের পাশে গিয়ে পাৰ্থ, টুপুর, বুমবুম তিনজনই হতচকিত। লন যেখানে শেষ, সেখান থেকে খাড়া নেমে গেছে জঙ্গল। সামনেই কী অপূর্ব দৃশ্য। অরণ্য যে এত সুন্দর হতে পারে, টুপুরের কল্পনাতেও ছিল না। নিবিড় অরণ্যে সবুজের কতরকম বাহার। গাঢ় সবুজ, ফিকে সবুজ, কালচে সবুজ…. তার মধ্যেই কোথাও লাল রং ছড়িয়ে আছে, কোথাও কমলা। দেখে মনে হয়, বনে যেন আগুন লেগেছে।
বিস্ময়ে সকলে বাকরুদ্ধ।
পার্থ অস্ফুটে বলল, ক্যামেরা লোড করা আছে, নিয়ে আসব?
মিতিন বলল, দরকার নেই। এমন ছবি চোখের ফিলমেই ধরা থাক।
মিনিটখানেক পর হঠাৎই সুমায়ার উত্তেজিত স্বর, শুনছেন দিদি? শুনতে পাচ্ছেন?
মিতিন চমকে তাকাল, কী?
ভাল করে শুনুন, হাতিটা ডাকছে।
কই? কোথায়?
হুউউই যে। জঙ্গলের উত্তর-পশ্চিম কোনায় আঙুল দেখাল সুমায়া, পাগলা হাতি আরও নজদিক চলে এসেছে দিদি। তিরিলপোসিসে ভি ইধার। কোরাঙ্গার আশপাশ।… ও কি থলকোবাদের দিকেই আসছে?
বুমবুম খামচে ধরল মিতিনকে, মা, চলো বাড়ি যাই।
টুপুর কানখাড়া করে হাতির ডাক শোনার চেষ্টা করছিল। কই, বৃংহণ তো শোনা যায় না!