আমার মনে আছে আমাদের বাসার চিলেকোঠায় মিঠুন কতো সহজে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা থেকে লকলকে জিবের মতোন প্লাজমা বের করে ফেলেছিল, তাই আমি ভেবেছিলাম সে বুঝি খুব সহজেই বিজ্ঞান মেলায় সেটা করতে পারবে। কিন্তু বেশ অবাক হলাম যখন দেখলাম তার প্রজেক্টটা দাড় করাতে অনেক সময় লাগল। আগের রাত একেবারে বারোটা পর্যন্ত কাজ করতে হলো। পরের দিন সকালেও তার কাজ করতে হল, শেষ পর্যন্ত যখন বিজ্ঞান মেলায় সেটা দেখার জন্যে রেডি হল আমি সেটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এর ভেতরে পুরান টিভির যন্ত্রপাতি, কম্পিউটারের ড্রাইভের চুম্বক, প্রিন্টারের রোলার, এলার্ম ক্লাকের মোটর–এক কথায় এমন কোনো যন্ত্র নেই যেটা সেখানে নেই। আমি অবাক হয়ে বললাম, “আরে! এটা কী তৈরী করেছিস? এতো যন্ত্রপাতি কেন?” মিঠুন গলা নামিয়ে বলল, “এইখানে যা আছে তার বেশিরভাগ ভূয়া।”
“ভূয়া?”
“হ্যাঁ। এইগুলো লাগিয়ে দিয়েছি যেন কেউ আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে।”
“আসল ব্যাপার?”
“হ্যাঁ, আমি সবাইকে বোঝাব খুব হাই ভোল্টেজ দিয়ে পাজমা তৈরী হয়।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম “বুঝতে পারলাম। তুই কাউকেই আসল জিনিসটা বলতে চাস না?”
“না! আসল জিনিসটা জানলে কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে!”
সকালবেলা মিঠুনের জটিল যন্ত্র নিয়ে আমরা বিজ্ঞান মেলায় হাজির হলাম। টেবিলের উপর রেখে একবার সেটা পরীক্ষা করে দেখা হল। সুইচ টেপা মাত্রই এটা তো শব্দ করতে লাগল। মিঠুন সাবধানে নবটা ঘুরিয়ে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার দুই পাশে ভোল্টেজটা বাড়ানো মাত্রই হঠাৎ ছোট বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হলো আর শিশিটার ছোট মুখ থেকে একটা আগুনের তৈরী সাপের মতো বিশাল একটা শিখা হিস হিস করে বের হয়ে এল। আবছা নীল রংয়ের এই সাপটা দুলতে থাকে। দুলতে দুলতে জীবন্ত প্রাণীর মতো পাজমার তৈরী এই সাপটা ছাদটাকে আঘাত করতে থাকে। ছাদ থেকে পোড়া প্যালেস্তারা ঝুরঝুর করে নিচে পড়তে থাকে আর পুরো টেবিলটা থর থর করে কাঁপতে থাকে। প্লাজমাটার একটা আশ্চর্য শব্দ হয় আর সাথে সাথে সারাঘর বিচিত্র একটা ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে গেল। সবকিছু ঠিক ঠিক কাজ করছে দেখার পর মিঠুন তার নবটা ঘুরিয়ে ভোল্টেজ কমিয়ে আনতেই প্লাজমার জ্বলন্ত শিখাটা সাথে সাথে সর সর করে শিশির ভেতরে ঢুকে গেল।
এই বিচিত্র ব্যাপারটা দেখার জন্যে মুহূর্তের মাঝে চারপাশে ভীড় জমে গেল। লোকজন ছেলে-পিলে অবাক হয়ে বলল, “কী এটা কী?”
মিঠুন বলল, “হাইপ্রেশার প্লাজমা জেনারেটর।”
তার অর্থ কী কেউ বুঝতে পারল না কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল,বলল, “দেখাও। আবার দেখাও।”
মিঠুন একটু ইতস্তত করল,বলল, “সবাইকে তাহলে দূরে সরে যেতে হবে। এটা অনেক পাওয়ারফুল–হঠাৎ করে কারো গায়ে লেগে গেলে বিপদ হবে।”
আমরা কয়েকজন মিলে সবাইকে ঠেলে একটু দূরে সরিয়ে দিলাম। মিঠুন আবার সুইচ অন করে ভোল্টেজের নটা ঘুরাতে থাকে, প্রথমে একটু ভেতা শব্দ শোনা গেল হঠাৎ ছোট একটা বিস্ফোরণের মত শব্দ করে সাপের মত লকলকে একটা পাজমার শিখা বের হয়ে আসে। সেটা জীবন্ত প্রাণীর মত কিলবিল করে লড়তে থাকে। আশেপাশে একটা বিচিত্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। যারা ভীড় করে দাঁড়িয়েছিল তারা বিস্ময়ের এবং ভয়ের শব্দ করে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
কয়েক সেকেন্ড দেখিয়েই মিঠুন তার হাইপ্রেশার প্লাজমা বন্ধ করে দিল। সবাই তখন ভীড় করে যন্ত্রটা দেখতে এল এবং আমার মনে হলো মিঠুন নানারকম ভূয়া যন্ত্রপাতি দিয়ে যন্ত্রটাকে জটিল করে বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছে। যদি সবাই দেখত ছোট একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশি থেকে এই ভয়ঙ্কর প্লাজমী বের হয়ে আসছে তাহলে তারা নিশ্চয়ই এতো চমৎকৃত হত না।
মিঠুনের হাই-প্রেশার প্লাজমা দেখার জন্যে মানুষ ভীড় করতে থাকে। তাকে একটু পরে পরে সেটা দেখাতে হয়। আমি গলা নামিয়ে বললাম, “এতবার দেখাস না, হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলে বিপদ হবে। বিচারকদের আগে ভালো করে দেখিয়ে নে।”
মিঠুন ফিসফিস করে বলল, “দেখানো নিয়ে সমস্যা নাই। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“কিন্তু বোঝাব কেমন করে? ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার কথা তো বলা যাবে না–”
আমি মিঠুনকে সাহস দিলাম “বোঝাবুঝির কী আছে? জিনিসটা দেখবে। দেখলেই তো হলো।”
মিঠুনকে তারপরেও কেমন যেন নার্ভাস দেখাল। সে কেন নার্ভাস ছিল সেটা আমি একটু পরেই বুঝতে পারলাম। বিচারকেরা সবার প্রজেক্ট দেখতে দেখতে এগিয়ে আসছেন, তারা এর মাঝেই মিঠুনের হাই-প্রেশার প্লাজমা প্রজেক্টের খবর পেয়েছেন তাই ছোটখাটো প্রজেক্টে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি মিঠুনের কাছে চলে এলেন।
বিচারকদের দলে তিনজন মানুষ, একজন একটু কম বয়সী অন্য দুইজন মাঝবয়সী, তাদের চুলে পাক ধরেছে, চোখে চশমা। দুজনেই ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, তাদের সাথে আরো উৎসাহী লোকজন আছে, আমি দেখলাম অক্সব্রীজ স্কুলের সায়েন্স টিচারও পিছন পিছন এসেছেন। মাঝবয়সী একজন প্রফেসর গম্ভীর গলায় বললেন, “এটা কী?”
মিঠুন কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “হাই-প্রেশার পাজমা।”
“হাই-প্রেশার?”
“আসলে সবাই লো প্রেশারে প্লাজমা তৈরী করে। এটা যেহেতু এটমস্কিয়ারিক প্রেশারে তৈরী হয়েছে সে জন্যে বলছি হাই-প্রেশার। আসলে বলা উচিত ছিল এটমস্ফিয়ারিক পাজমা।”
মাঝবয়সী প্রফেসর বললেন, “সমস্যা নাই। নামে কী আসে যায়? দেখাও এটা কী করে।”
মিঠুন কঁপা হাতে সুইচ অন করে নবটা ঘোরালো, সাথে সাথে ছোট একটা বিস্ফোরণের মত শব্দ করে লকলক করে প্রাজমাটা বের হয়ে হিসহিস শব্দ করে জীবন্ত একটা প্রাণীর মত ছাদকে স্পর্শ করল। প্লাজমা থেকে নীলাভ আলোটা সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে আর বিচারকেরা ভয় পেয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলেন। তারা হতভম্বের মত সেটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। একজন চাপা গলায় বললেন, “ও মাই গড!”
আরেকজন বললেন, “এটা কীভাবে সম্ভব?”
প্রথমজন মিঠুনকে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা তু-তুমি বানিয়েছ?”
“আমি একা না। আমরা বন্ধুরা মিলে বানিয়েছি।”
আমি একটু নড়ে চড়ে দাঁড়ালাম, চুল ঠিক করলাম, ছোট করে কাশলাম যেন সবাই বুঝতে পারে মিঠুন যেসব বন্ধুর কথা বলেছে আমি তাদের একজন।
কমবয়সী বিচারক জিজ্ঞেস করল, “এটা কীভাবে কাজ করে?”
মিঠুন বলল, “হাইভোল্টেজ দিয়ে বাতাসকে আয়োনাইজ করে ফেলি।”
“কত হাইভোল্টেজ দাও?”
“পুরান টেলিভিশনের ফ্লাই হুইল ব্যবহার করেছি–তার মানে কয়েক হাজার ভোল্ট।”
মধ্যবয়স্ক প্রফেসর বললেন, “কয়েক হাজার ভোল্টে এরকম প্লাজমা তৈরী হয় না।”
মিঠুন একটু ঢোক গিলে বলল, “শুধু হাই ভোল্টেজ দিই না স্যার আরো কিছু ব্যবস্থা করেছি।”
“কী করেছ?”
“প্রথমে একটা ফিলামেন্ট বেরিয়াম অক্সাইড দিয়ে কোট করেছি (মিথ্যা কথা), সেটাকে স্যার কারেন্ট দিয়ে গরম করি (ভূয়া তথ্য), ফিলামেন্ট গরম হলে ইলেকট্রন এমিট করে (তথ্যটা সত্যি হতে পারে
এখানে করা হয় নাই, সেই ইলেকট্রন কাছাকাছি বাতাসকে আয়োনাইজ করে (সম্ভব কিনা কে বলবে?), তখন একটা হীটার বাতাসকে প্রি-হিট করে (পরিষ্কার মিথ্যা কথা), একটা ফ্যান সেই বাতাসকে ব্লো করে ছোট একটা ফ্যান আছে শুধু সাউন্ড এফেক্টের জন্যে, প্রিহিটি বাতাস অনেকগুলো হাইভোল্টেজ গ্রীড়ের ভিতর দিয়ে যায় (ভূয়া ভূয়া চরম ভূয়া) তখন পাজমাটা তৈরী হয়।”
মিঠুন কোনো প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ না দিয়ে টানা কথা বলে গেল, আমি মিঠুনের এরকম বৈজ্ঞানিক ভূয়া কথা বলার ক্ষমতা দেখে চমৎকৃত হলাম। ভেবেছিলাম এরকম বৈজ্ঞানিক কথা শুনে বিচারক তিনজন বুঝি সন্তুষ্ট হবে, কিন্তু মাঝবয়সী প্রফেসরদের একজন পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলেন না। মাথা চুলকে বললেন, “তুমি যেভাবে বলেছ সেভাবে তো এরকম ভায়োলেন্ট প্লাজমা হবার কথা। ছোটখাটো স্পার্ক হতে পারে কিন্তু তাই বলে ছয়সাতফুট লম্বা এরকম বিশাল প্লাজমা তাও এটমস্ফিয়ারিক প্রেসারে ইম্পসিবল।”
মিঠুন বলল, “কিন্তু স্যার, আপনি তো দেখছেন— এটা হচ্ছে! আপনার চোখের সামনে হচ্ছে। যদি সম্ভব হত তাহলে পুরোটা খুলে দেখাতাম স্যার?”
বিচারকরা মাথা চুলকালেন। মিঠুন বলল, “শুধু একটা জিনিস বলতে ভুলে গেছি।”
“কী জিনিস?”
“বাতাসটাকে যে চেম্বারে প্রিহিট করি সেই চেম্বারের ভিতরে একটা জিনিসের প্রলেপ দিয়েছি। মনে হয় সেই জিনিসটার জন্যে এত সহজে বাতাসের অনু পরমাণু আয়োনাইজ করা হয়।”
তিনজনই এবার আগ্রহী হল, “কী জিনিস”
“অনেক ট্রায়াল এন্ড এরর করে বের করেছি স্যার। এর মাঝে ঠিক কী আছে পরিষ্কার করে জানি না। যদি এটমিক মাস প্রেকটাম এনালাইজার থাকত বলতে পারতাম।”
মাঝ বয়সী প্রফেসর বললেন, “ভেরি স্ট্রেঞ্জ।”
অন্যজন বললেন, “কিন্তু নিজের চোখে দেখছি। অবিশ্বাস করি কী করে?”
প্রথমজন বললেন, “এটা অবশ্যি খুবই বিপজ্জনক। এই প্লাজমা নড়তে চড়তে গিয়ে যদি কারো শরীরে লাগে তাহলে মেজর একসিডেন্ট হবে।”
মিঠুন বলল, “আপনারা দেখার পর বন্ধ করে রাখব স্যার।”
“সেটাই ভালো।”
তারপর তারা তাদের হাতে লেখা কাগজটাতে প্রজেক্টের মার্কস লিখে হুঁটিতে শুরু করল। কতো দিয়েছে দেখার জন্য আমি ইতি উতি চেষ্টা করলাম, লাভ হল না। তারা যখন হাঁটছে আমি পিছু পিছু গেলাম, শুনলাম একজন আরেকজনকে বলছে, “আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।”
অন্যজন বলল, “আমি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছি। শুধু মাত্র এনার্জী কনজারভেশানের কথা ধর–এটমস্ফিয়ারিক প্রেশারে এ রকম ভায়োলেন্ট একটা প্লাজমা তৈরী করতে কী পরিমাণ এনার্জী লাগবে কল্পনা করতে পার? সেই এনাজটা কোথা থেকে আসছে? পুরান টেলিভিশনের ফ্লাই ব্যাক সেটা দিতে পারে? অসম্ভব!”
“তাহলে?”
“সেটাই তো সমস্যা! এই বাচ্চা এটা তৈরি করল কেমন করে?”
তবে বাচ্চাটা কিন্তু জানে। তার কথাবার্তা বাচ্চাদের মত না, বড় মানুষের মত। সায়েন্স ফেয়ারটা শেষ হলে বাচ্চাটার যন্ত্রটাকে নিয়ে বসতে হবে। কীভাবে কাজ করে দেখতে হবে।”
“হ্যাঁ। আমার কেন জানি মনে হয়—”
“কী মনে হয়?”
“বাচ্চাটা যেটুকু বলেছে তার বাইরেও কিছু একটা আছে। সে আমাদের পুরোটুকু বলেনি।”
“তোমার তাই ধারণা?”
“হ্যাঁ। বাচ্চাটা তো বোকা না, সে সবকিছু জানে। সে যে আমাকে বলেনি তারও নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে।”
“কী কারণ?”
প্রফেসর মানুষটি তখন গলা নামিয়ে কথা বলতে লাগল, তাই আমি আর তাদের কথাগুলো শুনতে পেলাম না। যেটুকু শুনেছি সেটাই যথেষ্ট। আমি প্রায় দৌড়ে মিঠুনের কাছে এলাম। তার হাই প্রেশার জমা ঘিরে শত শত মানুষ গিজ গিজ করছে। সবাই দেখতে চাইছে। বগা, গুললু, ঝুম্পা মিলে সবাইকে ঠেলে সরিয়ে জায়গা করে দিচ্ছে আর মিঠুন তখন তার যন্ত্র চালু করছে। বিস্ফোরণের মত শব্দ করে লকলকে প্ৰাজমা ছাদ পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। কাছাকাছি অক্সব্রীজ স্কুলের প্রজেক্টের সামনে কেউ নেই, তারা গালে হাত দিয়ে শুকনো মুখে বসে আছে।
আমি মিঠুনের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “মিঠুন—”
“কী হয়েছে?”
“বিচারক প্রফেসররা টের পেয়ে গেছে “কী টের পেয়েছে?”
“এখানে আসলে অন্য কিছু আছে, তুই তাদের পুরোটা বলিসনি। গোপন করেছিস।”
মিঠুন আমার কথা শুনে অবাক হল না, বলল, “টের পেতেই পারে। যে কোনো মানুষ যদি একটুখানি বিজ্ঞান জানে তাহলেই টের পেয়ে যাবে।”
আমি ফিসফিস করে বললাম, “সায়েন্স ফেয়ার শেষ হবার পর তারা যন্ত্রটা আবার দেখতে আসবে।”
“আসুক।” মিঠুন বলল, “আমি ততক্ষণে এটা খুলে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাটাকে সরিয়ে দিব।”
বিচারকরা সবগুলো প্রজেক্ট দেখার পরই সায়েন্স ফেয়ার শেষ হয়ে গেল। সবাই নিজেদের যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিচ্ছে, তখন মিঠুনও সাবধানে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চটাকে খুলে তার পকেটে ভরে নিল। সেই জায়গায় সে আরেকটা ছোট বোতল রেখে দিল। বোতলটা একেবারে খালি রাখলে কেমন দেখায়? কী রাখা যায় সেটা নিয়ে যখন চিন্তা করছে তখন আমি আমার মুখের ভিতর থেকে চিউয়িং গামটা বের করে মিঠুনকে দিলাম। “নে। এটা রেখে দে।”
মিঠুন এক সেকেন্ডের জন্যে হকচকিয়ে গেল তারপর বলল, “ঠিক আছে, দে! বোতলটার মাঝে রেখে দে।”
আমি তখন বোতলটার মাঝে চিউয়িং গামটা রেখে দিলাম।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েরা মুখ কালো করে বসে থাকল। দর্শকদের ভেতর থেকে কেউ কেউ চাপা স্বরে হঠাৎ করে “হাম্বা” করে ডেকে উঠছিল সেটা শুনে তাদের মুখ আরো কালো হয়ে উঠল। হাই প্রেশার প্লাজমা প্রজেক্টটাকে যখন জুনিয়র গ্রুপের চ্যাম্পিওন ঘোষণা করা হল তখন কেউ অবাক হল না। আমরা তখন যেভাবে গর্জন করে উঠলাম সেটা এই শহরের মানুষ অনেকদিন মনে রাখবে। পুরস্কার নেওয়ার জন্যে মিঠুনের সাথে সাথে আমরাও স্টেজে উঠে গেলাম, পুরস্কারটা হাতে নেবার পর আমরা যেভাবে চেচামেচি করলাম সেটা দেখে সবাই বুঝতে পারল আমরা এর আগে জীবনেও কোনোদিন কোনো পুরস্কার পাইনি পুরস্কার পাবার পর কী করতে হয় সেটা আমাদেরকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি।
যখন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হচ্ছে তখন বিচারকদের একজন প্রফেসর দর্শক সারি থেকে উঠে গেলেন। আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম সেই প্রফেসর হল ঘরের দিকে যাচ্ছেন। সেখানে কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন বুঝতে আমার কোনো সমস্যা হল না। সেদিন বিকালে হাই প্রেশার প্লাজমা যন্ত্রটা খুলে নেয়ার সময় আমরা দেখলাম সেখানে ছোট বোতলটা আছে কিন্তু তার ভেতরকার চিবিয়ে ছাতু করে রাখা চিউয়িংগামটা নাই।
আমাদের মহব্বতজান স্কুলের ইতিহাসে কখনো এসেম্বলী হয় না, কখনো জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। পরের দিন এসেম্বলী হল, এমন কী ভুল সুরে কয়েকজন জাতীয় সংগীত পর্যন্ত গেয়ে ফেলল। তারপর আমাদের হেড স্যার কাঁপা গলায় বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, “আমার ফ্রিয় ছেলে মেয়েরা (স্যার প্রিয় উচ্চারণ করতে পারেন না। তোমরা সবাই শুনছ আমাদের হাজী মহব্বতজান উচ্চ বিদ্যালয় বিজ্ঞান মেলায় চ্যাম্পিওন হইছে। আমরা চিৎকার করলাম লাফালাফি করলাম। আলহাজ মহব্বত জান স্যারের নেতৃত্বে এই ইস্কুল শুধু এই শহরের মইধ্যে না এই দেশের মইধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ইস্কুল হয়া যাইব। (কথাটা পুরাপুরি মিথ্যা কিন্তু তারপরেও আমরা আবার একটু চিৎকার করলাম।) যখন কেলাশ এইটের ছেলে মেয়েরা আমার কাছে আইসা বলল তারা সায়েন্স ফেয়ারে যোগ দিতে চায় আমি সাথে সাথে সেই অনুমতি দিছি। (কত বড় বানোয়াট কথা!) শুধু অনুমতি না, আমি তাগো রিচার্সের জন্যে (শব্দটা নিশ্চয়ই রিসার্চ কিন্তু হেড স্যার রিসার্চ বলতে পারেন না, বলেন রিচার্স দশ হাজার টাকা পর্যন্ত দিছি। (আমরা আবার চিৎকার করলাম কেলাশ এইটের ছেলে মেয়েরা এই দশ হাজার টাকার মর্যাদা রাখছে, তারা পুরস্কার আনছে। এই স্কুলের সুনাম অক্ষুন্ন রাখছে।…”
হেড স্যার অনেকক্ষণ ভ্যাদর ভ্যাদর করলেন। আমরা সবাই সহ্য করলাম। বক্তৃতার শেষে স্যার পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষে একদিনের ছুটি ঘোষণা দিলেন।