তবে ধৌম্য কহে, শুন অন্বিকা-নন্দন।
কহিব অপূর্ব্ব কথা, করহ শ্রবণ।।
আদি দৈত্য হিরণ্যকশিপু হিরণ্যাক্ষ।
মহাবলী প্রতাপে পাবক-সমকক্ষ।।
দিতির গর্ভেতে জাত কশ্যপ-ঔরসে।
জগতের মধ্যে দুষ্ট হইল বিশেষে।।
হিরণ্যকশিপু পুত্র বিখ্যাত জগতে।
সর্ব্ব শাস্ত্র বিচক্ষণ প্রহ্লাদ নামেতে।।
তার পুত্র বিরোচন বিখ্যাত ভুবন।
যারে বিড়ম্বিল আসি অদিতি নন্দন।।
ব্রাহ্মণরূপেতে আসি দান মাগি নিল।
সেইক্ষণে বিরোচন নিজ অঙ্গ দিল।।
ব্রাহ্মণের হেতু ত্যজে আপনার প্রাণ।
তাহার নন্দন হৈল বলি মতিমান।।
প্রতাপে প্রচণ্ড বলি, দেবের দুর্জ্জয়।
বাহুবলে স্বর্গ মর্ত্ত্য করিলেক জয়।।
জানিলেক শুক্র-গুরু স্থানে উপদেশে।
ছল করি দেবরাজ বাপেরে বিনাশে।।
পিতৃবৈরী হয় ইন্দ্র, শুনিয়া শ্রবণে।
সেইক্ষণে ডাকি আজ্ঞা দিল দৈত্যগণে।।
চতুরঙ্গ সৈন্য সহ সাজিল ত্বরিত।
ইন্দ্রের নগরে গিয়া হৈল উপনীত।।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে পুরিল গগন।
দৈত্য-সৈন্য ব্যাপিলেক ইন্দ্রের ভব।।
শুনি দেবরাজ ক্রোধে লয়ে সৈন্যচয়।
বলির সহিত রণ করিল প্রলয়।।
দোঁহে বলবন্ত, দোঁহে সংগ্রামে প্রচণ্ড।
নানা অস্ত্র বৃষ্টি করে যেন যমদণ্ড।।
শেল শূল শক্তি জাঠি ভুসুণ্ডী মুদগর।
পরশু পট্টিশ গদা বিশাল তোমর।।
রুদ্র পশুপতি নানারূপ সব বাণ।
ইন্দ্রজাল ব্রহ্মজাল অস্ত্র খরশান।।
শিলীমুখ সূচীমুখ রুদ্রমুখ ক্ষুর।
পরস্পরে দুই জন বরিষে প্রচুর।।
যেন প্রলয়ের কালে মজাইতে সৃষ্টি।
দেবতা অসুরগণ করে বাণবৃষ্টি।।
বলিরে চাহিয়া ইন্দ্র বলে ক্রোধমন।
মোর হস্তে আজি তোর হইবে নিধন।।
এই দেখ অস্ত্র মোর ঘোর দরশন।
ইহার প্রহারে তোরে করিব নিধন।।
এত বলি ইন্দ্র অস্ত্র যুড়িল ধনুকে।
ক্ষণে অগ্নিবৃষ্টি হয় ধনুকের মুখে।।
শূণ্যেতে আইসে অস্ত্র উল্কার সমান।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণে বলি করে দুইখান।।
অস্ত্র ব্যর্থ দেখি ইন্দ্র মনে পেয়ে লাজ।
শক্তি অস্ত্র হানে তার হৃদয়ের মাঝ।।
দুই বাণে বলি তাহা করে দুই খণ্ড।
বাহুবলে মায়াবলে বিন্ধিল প্রচণ্ড।।
সেই অস্ত্রাঘাতে ইন্দ্র হইল মূর্চ্ছিত।
মাতলি বাহুড়ি রথ পলায় ত্বরিত।।
কতক্ষণে দেবরাজ হন সচেতন।
মাতলিরে নিন্দা করি বলিল বচন।।
সম্মুখ সংগ্রাম মধ্যে বাহুড়িলি রথ।
পলাইয়া গেলি যেন নাহি দেখি পথ।।
মাতলি বলিল, মোরে নিন্দ অকারণ।
অবধান কর এই শাস্ত্র নিরূপণ।।
রথী মূর্চ্ছা দেখি রথ বাহুড়ে সারথি।
যুদ্ধশাস্ত্রে যোদ্ধাগণ কহে হেন নীতি।।
ইন্দ্র বলে, শীঘ্র তুমি বাহুড়াহ রথ।
বলিরে দেখাব আমি শমনের পথ।।
আজ্ঞামাত্রে রথ পুনঃ চালায় মাতলি।
হাতেতে পরিঘ নিল ইন্দ্র মহাবলী।।
পরিঘ এড়িল ইন্দ্র উপরে বলির।
মুকুট কুণ্ডল সহ কাটিলেন শির।।
রথ হৈতে ভুমে পড়ে বলি মহাবীর।
রুধিরে আবৃত তার সমস্ত শরীর।।
হাহাকার শব্দ করে যত সৈন্যগণ।
পলাইল সকলে, না রহে একজন।।
তবে দৈত্য সমবেত হয়ে কত জনে।
কান্ধে করি বলিরাজে নিল সেইক্ষণে।।
ক্ষীরসিন্ধু তীরে গেল সবে শুক্রস্থান।
মন্ত্রবলে শুক্র তারে দিল প্রাণদান।।
গুরুর প্রসাদে বলি পাইল জীবন।
বিধিমতে করে বলি গুরু আরাধন।।
গুরু আরাধিয়া বলি পায় দিব্যবর।
করিলেক শিক্ষা ব্রহ্ম-মন্ত্র ষড়ক্ষর।।
মহামন্ত্র পেয়ে তবে বিচারিল মনে।
অমর অজেয় আমি হব ত্রিভুবনে।।
এতেক ভাবিয়া বলি সত্বরে চলিল।
হিমালয় গিরিপরে তপ আরম্ভিল।।
করিল কঠোর তপ লোকে ভয়ঙ্কর।
পবন ভক্ষিয়া রহে সহস্র বৎসর।।
তপে তুষ্ট হয়ে বিধি অর্পিবারে বর।
আসিলেন বলি পাশে হংসের উপর।।
ডাকিয়া বলিরে কন দেব প্রজাপতি।
তপঃসিন্ধ হৈলে তুমি, শুন দৈত্যপতি।।
তোমার তপেতে তুষ্ট হইলাম আমি।
যেই বর মনে লয়, মাগি লহ তুমি।।
যদি বা দুষ্কর হয় সংসার ভিতর।
অঙ্গীকার করিলাম, দিব সেই বর।।
শুনিয়া কহিল বলি করিয়া প্রণতি।
বর দিবে যদি মোরে সৃষ্টি অধিপতি।।
অজেয় অমর হই ভুবন মণ্ডলে।
ত্রিভুবন রহে যেন মোর করতলে।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালেতে আছে যত জন।
কারো হাতে নাহি হবে আমার মরণ।।
মনোমত বর দিয়া যান প্রজাপতি।
তপোযোগ করি বলি করিল আরতি।।
শুভকাল সমুদিত ক্রমে হৈল তার।
সসৈন্যে সাজিয়া বলি গেল পুনর্ব্বার।।
ইন্দ্রের সহিত পুনঃ আরম্ভিল রণ।
দোঁহাকার রণকথা না হয় বর্ণন।।
গুরু আরাধিয়া বলি মহাবল ধরে।
যুদ্ধে পরাভব করে অদিতি-কুমারে।।
পবন শমন রুদ্র বরুণ তপন।
ইত্যাদি তেত্রিশ কোটি যত দেবগণ।।
যুদ্ধে পরাভব বলি করিল সবারে।
পলাইয়া দেবগণ গেল স্থানান্তরে।।
দেবের সকল কর্ম্ম লইল অসুরে।
নররূপে দেবগণ ভ্রমে মহীপরে।।
শুক্র গুরু আসি তবে উপদেশ দিল।
শত অশ্বমেধ বলি আরম্ভ করিল।।
মহাযজ্ঞ আরম্ভিল দৈত্যের ঈশ্বর।
নররূপে ভূমে রহে অমর নিকর।।
অদিতি পুত্রের দুঃখ হৃদয়ে চিন্তিল।
দেবের দেবত্ব জিনি বলি দৈত্য নিল।।
পুনরপি কোন রূপে নিজ রাজ্য পায়।
চিন্তিল অদিতি তবে না দেখি উপায়।।
মহাভারতের কথা সুধার লহরী।
সাধুগণ নিরন্তর শুনে কর্ণ ভরি।।