প্রেমকে আমরা একটি ত্রিকোণ-রূপে প্রকাশ করিতে পারি, উহার কোণগুলিই যেন উহার তিনটি অবিভাজ্য বৈশিষ্ট্যের প্রকাশক। তিনটি কোণ ব্যতীত একটি ত্রিকোণ বা ত্রিভুজ সম্ভব নয়, আর এই তিনটি লক্ষণ ব্যতীত প্রকৃত প্রেম সম্ভব নয়। প্রেম-রূপ এই ত্রিকোণের একটি কোণঃ প্রেমে কোন দর-কষাকষি বা কেনা-বেচার ভাব নাই। যেখানে কোন প্রতিদানের আশা থাকে, সেখানে প্রকৃত প্রেম সম্ভব নয়; সে- ক্ষেত্রে উহা কেবল দোকানদারিতে পরিণত হয়। যতদিন পর্যন্ত আমাদের ভগবানের প্রতি ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা ও আনুগত্য পালনের জন্য তাঁহার নিকট কোন-না-কোন অনুগ্রহ-প্রাপ্তির ভাব থাকে, ততদিন আমাদের হৃদয়ে প্রকৃত প্রেম থাকিতে পারে না। ভগবানের নিকট কিছু প্রাপ্তির আশায় যাহারা উপাসনা করে, তাহারা ঐ অনুগ্রহ-প্রাপ্তির আশা না থাকিলে তাঁহাকে উপাসনা করিবে না। ভক্ত ভগবানকে ভালবাসেন—তিনি প্রেমাস্পদ বলিয়া, প্রকৃত ভক্তের এই দিব্য ভাবাবেগের আর কোন হেতু নাই।
কথিত আছে, কোন সময়ে এক বনে এক রাজার সহিত জনৈক সাধুর সাক্ষাৎ হয়। তিনি সাধুর সহিত কিয়ৎক্ষণ আলাপ করিয়াই তাঁহার পবিত্রতা ও জ্ঞানের পরিচয় পাইয়া বড়ই সন্তুষ্ট হইলেন। পরিশেষে তাঁহাকে অনুরোধ করিতে লাগিলেন, ‘আমাকে কৃতার্থ করিবার জন্য আমার নিকট কিছু গ্রহণ করিতে হইবে।’ সাধু কিছু গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিলেন ও বলিলেন, ‘বনের ফল আমার প্রচুর আহার, পর্বত-নিঃসৃত পবিত্র সরিৎ আমার পর্যাপ্ত পানীয়, বৃক্ষত্বক্ আমার পর্যাপ্ত পরিধেয় এবং গিরিগুহা আমার যথেষ্ট বাসস্থান। কেন আমি তোমার বা অপরের নিকট কিছু লইব?’ রাজা বলিলেন, ‘আমাকে অনুগৃহীত করিবার জন্য আমার সহিত রাজধানীতে রাজপ্রসাদে চলুন এবং আমার নিকট হইতে কিছু গ্রহণ করুন।’ অনেক অনুনয়ের পর তিনি অবশেষে রাজার সহিত যাইতে স্বীকার করিলেন এবং তাঁহার সহিত প্রাসাদে গেলেন। দান করিবার পূর্বে রাজা পুনঃপুনঃ প্রার্থনা করিতে লাগিলেনঃ হে ভগবান্ আমাকে আরও সন্তান-সন্ততি দাও, আরও ধন দাও, আরও রাজ্য দাও, আমার শরীর নীরোগ কর, ইত্যাদি। রাজার প্রার্থনা শেষ হইবার পূর্বেই সাধু নীরবে ঘরের বাহিরে চলিয়া গেলেন। ইহা দেখিয়া রাজা হতবুদ্ধি হইয়া তাঁহার পশ্চাদ্গমন করিতে করিতে ডাকিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘প্রভু, আমার দান গ্রহণ না করিয়াই চলিয়া গেলেন?’ সাধু তাঁহার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘ভিক্ষুকের কাছে আমি ভিক্ষা করি না। তুমি নিজে তো একজন ভিক্ষুক; তুমি আবার কিভাবে আমাকে কিছু দিতে পার? আমি এত মূর্খ নই যে, ভিক্ষুকের নিকট দান গ্রহণ করিব। যাও আমার অনুসরণ করিও না।’
এই গল্পটিতে ধর্মরাজ্যে ভিক্ষুক আর ভগবানের প্রকৃত ভক্তদের ভিতর বেশ প্রভেদ দেখানো হইয়াছে। কোন বরলাভের জন্য, এমন কি মুক্তিলাভের জন্যও ভগবানের উপাসনা করা অধম উপাসনা। প্রেম কোন পুরস্কার চায় না, প্রেম সর্বদা প্রেমেরই জন্য। ভক্ত ভগবানকে ভালবাসেন, কারণ তিনি না ভালবাসিয়া থাকিতে পারেন না। দৃষ্টান্তঃ তুমি একটি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখিয়া উহা ভালবাসিয়া ফেলিলে; তুমি ঐ দৃশ্যের নিকট হইতে কোনরূপ অনুগ্রহ ভিক্ষা কর না, আর সেই দৃশ্যও তোমার নিকট কিছুই প্রার্থনা করে না; তথাপি উহা দর্শন করিয়া তোমার মনে আনন্দের উদয় হয়—উহা তোমার মনের অশান্তি দূর করিয়া দেয়, উহা তোমাকে শান্ত করিয়া দেয়, তোমাকে ক্ষণকালের জন্য একরূপ মর্ত্য স্বভাবের ঊর্ধ্বে লইয়া যায় এবং এক স্বর্গীয় আনন্দে মনকে শান্ত করিয়া দেয়। ইহাতে প্রকৃত প্রেমের ভাব, এবং এই বৈশিষ্ট্যই উক্ত ত্রিকোণাত্মক প্রেমের একটি কোণ। অতএব প্রেমের পরিবর্তে কিছু চাহিও না, সর্বদা দাতার আসন গ্রহণ কর। ভগবানকে তোমার প্রেম নিবেদন কর, পরিবর্তে তাঁহার নিকট কিছু চাহিও না।
প্রেমরূপ ত্রিকোণের দ্বিতীয় কোণঃ প্রেমে কোনরূপ ভয় নাই। যাহারা ভয়ে ভগবানকে ভালবাসে, তাহারা মনুষ্যাধম; তাহাদের মনুষ্যভাবই পূর্ণ বিকশিত হয় নাই। তাহারা শাস্তির ভয়ে ভগবানকে উপাসনা করে। তাহারা মনে করে ভগবান্ এক বিরাট পুরুষ, তাঁহার এক হস্তে দণ্ড, এক হস্তে চাবুক; তাঁহার আজ্ঞা পালন না করিলে তাহারা দণ্ডিত হইবে। ভগবানকে দণ্ডের ভয়ে উপাসনা করা অতি নিম্নশ্রেণীর উপাসনা। এইরূপ উপাসনাকে যদি উপাসনা বলিতে হয়, তবে উহা অতি অপরিণত ভাবেরই উপাসনা। যতদিন হৃদয়ে কোনরূপ ভয় থাকে, ততদিন সেখানে ভালবাসাও থাকিবে কি করিয়া? প্রেম স্বভাবতই সমুদয় ভয়কে জয় করিয়া ফেলে। কল্পনা কর, এক তরুণী জননী পথে চলিয়াছেন; একটি কুকুর ডাকিলেই তিনি ভয় পাইয়া তাড়াতাড়ি নিকটতম কোন গৃহে প্রবেশ করেন। কিন্তু যদি তাঁহার শিশু তাঁহার সঙ্গে থাকে এবং যদি একটি সিংহ শিশুটির উপর লাফাইয়া পড়ে, তখন সেই জননী কোথায় থাকিবেন?—সিংহের মুখে। শিশুটিকে বাঁচাইবার জন্য অবশ্যই তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করিবেন। ভালবাসা সর্ববিধ ভয়কে জয় করে। আমি জগৎ হইতে পৃথক্—এই প্রকার একটি স্বার্থপর ভাব হইতেই ভয় জন্মে। মনকে সঙ্কীর্ণ করিয়া আমি নিজেকে যত স্বার্থপর করিয়া ফেলিব, আমার ভয়ও সেই পরিমাণে বৃদ্ধি পাইবে। যদি কেহ মনে করে, সে কোন কাজের নয়, নিশ্চয়ই সে ভয়ে অভিভূত হইবে। আর নিজেকে যতই তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র বলিয়া না ভাবিবে, ততই তোমার ভয় কমিয়া যাইবে। যতদিন তোমার একবিন্দু ভয় আছে, ততদিন তোমার মধ্যে প্রেম থাকিতে পারে না। প্রেম ও ভয় দুইটি একত্র থাকিতে পারে না। যাঁহারা ভগবানকে ভালবাসেন, তাঁহারা কখনই তাঁহাকে ভয় করিবেন না। ‘ভগবানের নাম বৃথা লইও না’—এই আদেশ শুনিয়া প্রকৃত ভগবৎপ্রেমিক হাসিয়া উঠেন। প্রেমের ধর্মে ভগবন্নিন্দা কোথায়? যেরূপেই হউক, প্রভুর নাম যত লইতে পার, ততই মঙ্গল। প্রকৃত ভক্ত তাঁহাকে ভালবাসে, তাই তো তাঁহার নাম করে।
প্রেমরূপ ত্রিকোণের তৃতীয় কোণঃ প্রেমে প্রতিদ্বন্দ্বীর স্থান নাই। প্রেমিকের আর দ্বিতীয় ভালবাসার পাত্র থাকিবে না, কারণ প্রেমেই প্রেমিকের সর্বোচ্চ আদর্শ রূপায়িত। যতদিন না ভালবাসার পাত্র আমাদের সর্বোচ্চ আদর্শ হইয়া দাঁড়ায়, ততদিন প্রকৃত প্রেম সম্ভব নয়। হইতে পারে, অনেক স্থলে মানুষের ভালবাসা ভুল পথে চালিত হয়, অপাত্রে অর্পিত হয়, কিন্তু প্রেমিকের পক্ষে তাঁহার প্রেমাস্পদ সর্বদা তাহার সর্বোচ্চ আদর্শ। একজন হয়তো জঘন্যতম ব্যক্তিকে ভালবাসিতেছে, আর একজন—মহত্তম এক ব্যক্তিকে ভালবাসিতেছে, তা সত্ত্বেও উভয়ত্র নিজ আদর্শকেই ভালবাসা হইতেছে। প্রত্যেক ব্যক্তির উচ্চতম আদর্শকেই ‘ঈশ্বর’ বলা হয়। অজ্ঞ বা জ্ঞানী, সাধু বা পাপী, নর বা নারী, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত—সকলেরই উচ্চতম আদর্শ ঈশ্বর। সমুদয় সৌন্দর্য, মহত্ত্ব ও শক্তির উচ্চতম আদর্শসমূহ সমন্বিত করিলেই প্রেমময় ও প্রেমাস্পদ ভগবানের পূর্ণতম ভাব পাওয়া যায়।
এই আদর্শগুলি প্রত্যেক ব্যক্তির মনে কোন না কোনরূপে স্বভাবতই বর্তমান। উহারা যেন আমাদেরই মনের অঙ্গ বা অংশবিশেষ। মানবপ্রকৃতিতে যে সকল ক্রিয়ার বিকাশ দেখিতে পাওয়া যায়, ঐগুলি সবই আদর্শকে ব্যাবহারিক জীবনে পরিণত করিবার চেষ্টা। আমরা আমাদের চতুর্দিকে সমাজে যে নানাবিধ কর্মের প্রকাশ ও আন্দোলন দেখিতে পাই, তাহা ভিন্ন ভিন্ন আত্মার বিভিন্ন আদর্শকে কার্যে পরিণত করিবার চেষ্টার ফলমাত্র। ভিতরে যাহা আছে, তাহাই বাহিরে আসিবার চেষ্টা করিতেছে। মানবহৃদয়ে আদর্শের এই চিরপ্রবল প্রভাবেই একমাত্র প্রেরণাশক্তি, যাহা মানবজাতির মধ্যে সতত ক্রিয়াশীল। হইতে পারে, শত শত জন্মের পর, সহস্র সহস্র বৎসর চেষ্টার পর মানুষ বুঝিতে পারে—আমাদের অন্তরের আদর্শ আনুযায়ী বাহিরকে গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা বা বাহিরের অবস্থাসমূহের সহিত ভিতরের আদর্শকে সম্পূর্ণ খাপ খাওয়াইবার চেষ্টা বৃথা। এইটি বুঝিতে পারিলে সাধক বহির্জগতে নিজের আদর্শ প্রক্ষেপ করিবার চেষ্টা পরিত্যাগ করিয়া সেই উচ্চতম প্রেমের ভূমি হইতে আদর্শকেই আদর্শরূপে উপাসনা করে। সমুদয় নিম্নস্তরের আদর্শগুলি এই পূর্ণ আদর্শের অন্তর্গত।
সকলেই এই কথার সত্যতা স্বীকার করেন যে, কুরূপার মধ্যেও প্রেমিক হেলেনের সৌন্দর্য দেখিয়া থাকেন। বাহিরের লোক বলিতে পারে, প্রেম অপাত্রে প্রদত্ত হইতেছে, কিন্তু প্রেমিক কুরূপা দেখেন না, তিনি তাঁহার হেলেনকেই দেখিয়া থাকেন। সুন্দর বা কুৎসিত যাহাই হউক, প্রেমের আধার প্রকৃতপক্ষে যেন একটি কেন্দ্র, তাহার চারিদিকে আমাদের আদর্শগুলি রূপায়িত হয়। সাধারণতঃ মানুষ কিসের উপাসনা করে?—অবশ্য শ্রেষ্ঠ ভক্ত প্রেমিকের সর্বাবগ্রাহী পূর্ণ ভাবাদর্শ নয়। নরনারীগণ সাধারণতঃ নিজ নিজ অন্তরের আদর্শকেই উপাসনা করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ আদর্শকে বাহিরে আনিয়া তাহারই সম্মুখে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করে। তাই তো আমরা দেখিতে পাই, যাহারা নিজেরা নিষ্ঠুর ও রক্তপিপাসু, তাহারা এক রক্তপিপাসু ঈশ্বর কল্পনা করে, কারণ তাহারা কেবল নিজ নিজ ভাবের উচ্চতম আদর্শকেই ভালবাসিতে পারে। এই জন্যই সদ্ভাবাপন্ন ব্যক্তির ঈশ্বরের আদর্শ অতি উচ্চ, তাঁহার আদর্শ অপর ব্যক্তির আদর্শ হইতে অত্যন্ত পৃথক্।