প্রথমবার স্পেসশিপে ঢোকার সময় যেরকম ভয়–ভয় করছিল এবার তাদের সেরকম ভয় লাগল না। প্রাণীগুলো আগে দেখেছে সেটি একটি কারণ, তাদেরকে বঁটা দিয়ে বের করার সময় তাদের একটুও ব্যথা না দিয়ে স্পেসশিপের ভিতর থেকে পাহাড়ের নিচে নামিয়ে দিয়েছে সেটি আরেকটি কারণ, তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে শাহনাজ যেরকম কল্পনা করেছিল তার সাথে হুবহু মিলে যাওয়ার ব্যাপারটি। শাহনাজের কল্পনা মহাজাগতিক প্রাণী খুব মধুর স্বভাবের, কাজেই এই প্রাণীগুলোও নিশ্চয়ই মধুর স্বভাবেরই হবে এ ব্যাপারে শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলুর মনে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই।
স্পেসশিপের সেই অদৃশ্য পরদা ভেদ করে ভিতরে ঢুকেই এবারে শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু হাসাহাসি করার চেষ্টা করতে শুরু করল। প্রাণীগুলো নিশ্চয়ই তাদের দেখছে, কাজেই তাদের খুঁজে বের করার কোনো দরকার নেই। শাহনাজ বলল, বুঝলি ডাবলু, আমাদের ক্লাসে। একটা মেয়ে পড়ে, তার নাম মীনা–সবাই তাকে ডাকে মিনমিনে মীনা। কেন বল দেখি?
কেন?
সবসময় মিনমিন করে কথা বলে তো, তাই। একদিন স্কুলে আমাদের নববর্ষের অনুষ্ঠান হচ্ছে, তাই সবাই গান শিখছি। একটা গান ছিল রবীন্দ্রনাথের। গানের কথাটা এইরকম : বল দাও মোরে বল দাও, সেই গানটা শুনে মিনমিনে মীনা কী বলে জানিস?
কী?
বলে, কবি রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই ফুটবল খেলার সময় এই গানটা লিখেছিলেন! রাইট আউটে খেলছিলেন, গোলপোস্টের কাছাকাছি গিয়ে সেন্টার ফরোয়ার্ডকে বলেছিলেন, বল দাও মোরে বল দাও আমি গোল দেই। শাহনাজ কথা শেষ করেই হি হি করে হাসতে লাগল।
ক্যাপ্টেন ডাবলুকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, ভুরু কুঁচকে বলল, ফুটবল কেন? ক্রিকেটও তো হতে পারত!
শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, তোর যেরকম বুদ্ধি, তাতে ক্রিকেটও হতে পারত?
কেন শুধু ফুটবল না হয়ে ক্রিকেটও হতে পারত সেটা নিয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা তর্ক শুরু করে দিচ্ছিল, শাহনাজ তাকে ধমক দিয়ে থামাল। বলল, তুই থাম আরেকটা গল্প বলি, শোন। আমরা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ইতিহাস ক্লাসে স্যার শেরশাহের জীবনী পড়াচ্ছেন। স্যার বললেন, শেরশাহ প্রথমে ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করলেন। ঝিনু মস্তান তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন স্যার, তার আগে ঘোড়ারা ডাকতে পারত না?
শাহনাজের কথা শেষ হতেই দুজনেই হি হি করে হেসে উঠল। হাসি থামার পর শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, তুই কোনো গল্প জানিস না?
ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, বলল, জানি।
বল, শুনি।
এ্যা, এই গল্পটা খুব হাসির। একদিন একটা মানুষ গেছে চিড়িয়াখানাতে, ক্যাপ্টেন ডাবলুকে একটু বিভ্রান্ত দেখায়, মাথা নেড়ে বলল, না, চিড়িয়াখানা না, মিউজিয়ামে। সেই মিউজিয়ামে গিয়ে–ইয়ে–মানুষটা– ক্যাপ্টেন ডাবলু আবার থেমে যায়। তারপর আমতা আমতা করে বলে, না, আসলে চিড়িয়াখানাতেই গেছে। সেখানে মানুষটা কী একটা জানি করেছে–বানরের সাথে। আমার ঠিক মনে নাই, বানরটা তখন কী জানি করেছে সেটা এত হাসির–হি হি হি– ক্যাপ্টেন ডাবলু হি হি করে হাসতেই থাকে।
এইটা তোর হাসির গল্প?
হ্যাঁ। আমার পুরো গল্পটা মনে নাই, কিন্তু খুব হাসির ঘটনা। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে
শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে। এবারে আমি বলি শোন। এক ট্রাক ড্রাইভার অ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হল কেমন করে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, সে বলল, আমি ট্রাক চালিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি রাস্তা দিয়ে সামনে থেকে একটা গাড়ি আসছে–আমি তখন তাকে সাইড দিলাম। আরো খানিকদূর গিয়েছি তখন দেখি একটা ব্রিজ আসছে, সেটাকেও সাইড দিলাম। তারপর আর কিছু মনে নাই।
গল্প শেষ হওয়ার আগেই শাহনাজ নিজেই হি হি করে হাসতে থাকে। ক্যাপ্টেন ডাবলুও গল্প শুনে হোক আর শাহনাজের হাসি দেখেই হোক, জোরে জোরে হাসতে শুরু করে।
দুজনে হাসতে হাসতে আরো কিছুদূর এগিয়ে যায়, মহাজাগতিক প্রাণীগুলোকে এখনো দেখা যাচ্ছে না। না–দেখা গেলে নাই, শাহনাজ ঠিক করেছে তারা দুজন হাসতে হাসতে স্পেসশিপে ঘুরে বেড়াবে। ক্যাপ্টেন ডাবলুর অনেক জ্ঞান থাকতে পারে কিন্তু হাসির গল্প বলায় একেবারে যাচ্ছেতাই, কাজেই মনে হচ্ছে শাহনকেই চেষ্টা করে যেতে হবে। সে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে জিজ্ঞেস করল, ডাবলু তুই নাপিতের গল্পটা জানিস?
নাপিতের গল্প? না।
একদিন একজন লোক নাপিতের কাছে চুল কাটাচ্ছে। সে দেখল তার পায়ের কাছে একটা কুকুর খুব শান্তভাবে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা নাপিতকে জিজ্ঞেস করল, এইটা বুঝি খুব পোষা কুকুর, ভাই এ রকম শান্তভাবে বসে আছে? নাপিত বলল, আসলে আমি যখন কারো চুল কাটি তখন এইভাবে ধৈর্য ধরে শান্তভাবে বসে থাকে। চুল কাটতে কাটতে হঠাৎ যখন কানের লতিটাও কেটে ফেলি তখন সেগুলো খুব শখ করে খায়।
গল্প শুনে ক্যাপ্টেন ডাবলু এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠে শাহনাজের দিকে তাকাল, তারপর হি হি করে হাসতে রু করল।
শাহনাজ হাসি থামিয়ে বলল, বুঝলি ডাবলু আমাদের পাশের বাসায় বাচ্চা একটা ছেলে থাকে, নাম রুবেল, তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছি–রুবেল, তুমি কী পড়? সে বলল, হাফপ্যান্ট পরি! আমি হাসি চেপে জিজ্ঞেস করলাম, না মানে কোথায় পড়? সে শার্ট তুলে দেখিয়ে বলল, এই যে নাভির ওপরে!
ক্যাপ্টেন ডাবলু হি হি করে হাসতে হাসতে হঠাৎ করে থেমে গেল। শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, কী হল?
ক্যাপ্টেন ডাবলু চোখের কোনা দিয়ে সামনে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখ!
শাহনাজ তাকিয়ে দেখে চারটা মহাজাগতিক প্রাণী চুপচাপ দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শাহনাজ মুখ হাসি–হাসি রেখে চাপা গলায় বলল, ডাবলু মুখ হাসি হাসি রাখ। আর হাসতে চেষ্টা কর।
ক্যাপ্টেন ডাবলু হাসার চেষ্টা করে বিদ্ঘুটে একরকম শব্দ করল। শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে মহাজাগতিক প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, আগের বার তোমরা ছিলে দুই জন, এখন দেখছি চার জন! এইভাবে বাড়তে থাকলে কিছুক্ষণেই তো আর এখানে জায়গা হবে না।
মহাজাগতিক প্রাণীগুলো কোনো শব্দ করল না। শাহনাজ দুই পা এগিয়ে বলল, তোমাদের সাথে যখন দেখা হয়েই গেল, একটা গল্প শোনাই। দেখি শুনে তোমাদের কেমন লাগে! কী বলিস ডাবলু?
ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নেড়ে বলল, হ্যা আপু বল।
দুই জন মাতাল রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এক জনের হাতে একটা টর্চলাইট, সে লাইটটা জ্বালিয়ে আলো আকাশের দিকে ফেলে বলল, তুই এটা বেয়ে উপরে উঠতে পারবি? অন্য মাতালটা আলোটার দিকে একনজর তাকিয়ে বলল, তুই আমাকে বেকুব পেয়েছিস? আমি উঠতে শুরু করি আর তুই টর্চলাইট নিভিয়ে দিবি। পড়ে আমি কোমরটা ভাঙি আর কি!
ক্যাপ্টেন ডাবলু হি হি করে হেসে উঠতেই চারটা মহাজাগতিক প্রাণীই চমকে উঠে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল। শাহনাজ দেখতে পেল পিটপিট করে চার জনেই চোখের পাতা ফেলছে।
পছন্দ হয়েছে তোমাদের গল্পটা?
মহাজাগতিক প্রাণীগুলো এবারে ঘুরে শাহনাজের দিকে তাকাল, এই প্রথমবার প্রাণীগুলোর ভিতরে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, আগেরবার কোনোরকম প্রতিক্রিয়াই ছিল না! শাহনাজ একটু উৎসাহ পেয়ে বলল, তোমাদের তা হলে আরেকটা গল্প বলি একজন মহিলা গেছে ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারকে বলল, আমার স্বামীর ধারণা সে রেফ্রিজারেটর। কী করি ডাক্তার সাহেব? ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনার স্বামী যদি মনে করে সে রেফ্রিজারেটর সেটা তার সমস্যা আপনার তাতে কী? মহিলা বললেন, সে মুখ হাঁ করে ঘুমায় আর ভিতরে বাতি জ্বলতে থাকে, সেই আলোতে আমি ঘুমাতে পারি না।
গল্প শুনে প্রথমে ক্যাপ্টেন ডাবলু এবং তার সাথে সাথে শাহনাজও খিলখিল করে হেসে উঠল, হাসতে হাসতে বলল, গল্পটা মজার না?
মহাকাশের প্রাণীগুলো এবারে নিজেদের দিকে তাকাল এবং মনে হল নিজেরা নিজেরা কিছু একটা নিয়ে আলোচনা শুরু করল। শাহনাজ খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থেকে, গলা নামিয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে বলল, মনে হচ্ছে কাজ হচ্ছে। কী বলিস?
হ্যা শাহনাপু। থেমো না। আরেকটা বল।
শাহনাজ কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, তোমাদের আরেকটা গল্প বলি শোন। একদিন একটা পাগল একটা ডোবার কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে, পাঁচ পাঁচ পাঁচ। একজন লোক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি পাঁচ পাঁচ বলে চিৎকার করছ কেন? পাগলটা বলল, তুমি কাছে আস তোমাকে দেখাই। লোকটা পাগলের কাছে যেতেই পাগলটা ধাক্কা দিয়ে তাকে ডোবার মাঝে ফেলে দিয়ে চিৎকার করতে থাকল, ছয় ছয় ছয়।
গল্প শেষ করার আগেই শাহনাজ নিজেই খিলখিল করে হাসতে থাকে, আর তার দেখাদেখি ক্যাপ্টেন ডাবলুও নিজের হাতে কিল দিয়ে হাসা শুরু করে। আর কী আশ্চর্য! হঠাৎ করে মনে হল মহাজাগতিক প্রাণী চারটিও খিকখিক করে হেসে উঠেছে। মহাজাগতিক প্রাণী চারটির একটি হঠাৎ করে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে একেবারে পরিষ্কার বাংলায় বলল, বিচিত্র।
সাথে সাথে অন্য তিনটি মহাজাগতিক প্রাণীও মাথা নেড়ে বলল, বিচিত্র।
শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু একসাথে চমকে ওঠে। কী আশ্চর্য! মহাজাগতিক প্রাণীগুলো কথা বলছে। শাহনাজ চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, কী বিচিত্র?
হাসি। তোমাদের হাসি।
কেন? বিচিত্র কেন?
এটি একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, জটিল, দুর্লভ, বিমূর্ত এবং ব্যাখ্যার অতীত প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটি আমরা অন্য কোনো প্রাণীর মাঝে দেখি নি।
তোমরা মানে আপনারা হাসেন না?
তোমরা আমাদের তুমি–তুমি করে বলতে পার।
তোমরা হাস না?
না, আমরা হাসি না।
কী আশ্চর্য! শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, তোমরা কখনো কিছু নিয়ে হাস নাই? তোমাদের কোনো বন্ধু কোনোদিন তোমাদের সামনে কলার ছিলকায় আছাড় খেয়ে পড়ে নাই?
না। মহাজাগতিক প্রাণী গম্ভীর গলায় বলল, প্রকৃতপক্ষে আমরা তোমাদের মতো প্রাণী নই। আমাদের আলাদা অস্তিত্ব নেই।
কী বলছ, তোমাদের আলাদা অস্তিত্ব নেই? এই যে তোমরা আলাদা আলাদা চার জন?
এটি আমাদের একটি রূপ। তোমাদের সুবিধের জন্য। আসলে আমরা এক এবং অভিন্ন।
গুল মারছ। শাহনাজ মুখ শক্ত করে বলল, আমাদের ছোট পেয়ে তোমরা আমাদের গুল মারছ!
গুল? প্রাণীটি দ্রুত কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে বলল, গুল কীভাবে মারে?
গুল মারা কী জান না? শাহনাজ হি হি করে হেসে বলল, গুল মারা হচ্ছে মিথ্যা কথা বলা। অর্থাৎ একটা জিনিস করে যদি অন্য জিনিস বল তা হলে সেটাকে বলে গুল মারা।
বিচিত্র। অত্যন্ত বিচিত্র।
কী জিনিস বিচিত্র?
গুল মারা। কেন একটি তথ্যকে অন্য একটি তথ্য দিয়ে পরিবর্তন করা হবে? কেন গুল মারা হবে?
শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, গুল মারতে হয়। বেঁচে থাকতে হলে অনেক সময় গুল মারতে হয়। তাই নারে ডাবলু?
ডাবলু এতক্ষণ শাহনাজ এবং মহাজাগতিক প্রাণীর মাঝে যে কথাবার্তা হচ্ছে সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, নিজে থেকে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিল না। শাহনাজের প্রশ্ন শুনে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। হ্যাঁ। মাঝে মাঝে গুল মারতে হয়। কয়দিন আগে বাসায় আমার ল্যাবরেটরিতে একটা বিশাল বিস্ফোরণ হল, সবকিছু ভেঙেচুরে একাকার। আম্মার কাছে তখন আমার গুল মারতে হল। না হলে অবস্থা একেবারে ডেঞ্জারাসিন হয়ে যেত।
মহাজাগতিক চারটি প্রাণীই পুতুলের মতো মাথা নাড়তে লাগল, তাদের মাঝে একটা ফোঁস করে একটা শব্দ করে বলল, বিচিত্র, অত্যন্ত বিচিত্র।
শাহনাজ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তোমরা বলতে চাইছ তোমরা কখনো একজন আরেকজনের কাছে গুল মার নি?
আমি বলেছি আমাদের আলাদা অস্তিত্ব নেই। সব মিলিয়ে আমাদের একটি অস্তিত্ব। এক এবং অভিন্ন।
এই যে তোমরা চার জন আছ– শাহনাজের কথা শেষ হবার আগেই দেখা গেল চার জনের জায়গায় আটটি মহাজাগতিক প্রাণী বসে আছে!
কী আশ্চর্য! শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু একসাথে চিৎকার করে উঠলকীভাবে করলে এটা?
শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, একেবারে ম্যাজিকের মতো। টিভিতে দেখালে লোকজন অবাক হয়ে যাবে!
একটি প্রাণী বলল, আমি তোমাদেরকে বলেছি, আমরা এক এবং অভিন্ন। তোমাদের জন্য এই রূপটি নিয়েছি। আমরা ইচ্ছে করলে অনেকগুলো হতে পারি। আবার ইচ্ছে করলে একটি হয়ে যেতে পারি।
হও দেখি।
শাহনাজের কথা শেষ হবার আগেই আটটি প্রাণী অদৃশ্য হয়ে মাত্র একটি প্রাণী রয়ে গেল–একেবারে ম্যাজিকের মতো। শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু আবার অবাক হয়ে চিৎকার করে উঠল।
মহাজাগতিক প্রাণীটি বলল, এখন বিশ্বাস করেছ?
শাহনাজ বলল, এখনো পুরোপুরি করি নাই।
কেন পুরোপুরি কর নি?
এইটা কীভাবে সম্ভব যে সবাই মিলে একটা প্রাণী? তা হলে কীভাবে সবাই মিলে গল্পগুজব করবে, হাসিঠাট্টা করবে? নিজের সাথে নিজে কি হাসিতামাশা করতে পারে?।
প্রাণীটি ফোঁস করে একটা শব্দ করে বলল, আমরা ভিন্ন ধরনের প্রাণী, তোমাদের মতো নই। সেই জন্য তোমাদের অনেক কিছু আমাদের কাছে অজানা।
শাহনাজ হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নড়ে বলল, কিন্তু তোমরা যদি হাসতেই না পার তা হলে বেঁচে থেকে কী লাভ?
প্রাণীটি মাথা নেড়ে বলল, আমরা ঠিক করেছি পৃথিবী থেকে আমরা হাসি নামক প্রক্রিয়াটি আমাদের সাথে নিয়ে যাব।
হাসি কি একটা জিনিস যে তোমরা সেটা পকেটে ভরে নিয়ে যাবে?
প্রাণীটা গম্ভীর গলায় বলল, যে জিনিস ধরা–ছোঁয়া যায় না–সেই জিনিসও নেওয়া যায়। আমরা নিতে পারি তবে সে ব্যাপারে তোমাদের একটু সাহায্যের প্রয়োজন হবে।
শাহনাজ একগাল হেসে বলল, সাহায্য করতে পারি, কিন্তু এক শর্তে।
কী শর্তে?
আমার ভাই ইমতিয়াজকে তোমরা ধরে এনেছ, তাকে ছেড়ে দিতে হবে।
প্রাণীটা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, ঠিক আছে, ছেড়ে দেব।
শাহনাজ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, শাহনাপু, আমরা আরো একটা কাজ করতে পারি।
কী কাজ?
আমরা ওদেরকে কেমন করে গুল মারতে হয় সেটাও শিখিয়ে দিতে পারি! একসাথে দুটি জিনিস শিখে যাবে। হাসি এবং গুল মারা।
শাহনাজ ভুরু কুঁচকে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকাল, বলল, কিন্তু সেটা কি ভালো হবে? হাসি তো ভালো জিনিস, কিন্তু গুল মারা তো ভালো না।
ক্যাপ্টেন ডাবলু একগাল হেসে বলল, শিখতে তো দোষ নাই। ব্যবহার না করলেই হল। তাই না?
মহাজাগতিক প্রাণী মাথা নাড়ল, বলল, ভালো খারাপ এই ব্যাপারগুলো তোমাদের। আমরা যেহেতু এক এবং অভিন্ন, আমাদের কাছে ভালো এবং খারাপ বলে কিছু নেই।
শাহনাজ মাথা নাড়ল, বলল, তোমাদের কথা শুনে আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। এক এবং অভিন্ন। ভালো–খারাপ নেই। আমি–তুমি নেই। আলাদা অস্তিত্ব নেই শুনে মনে হচ্ছে ভাইয়ার পোষ্ট মডার্ন কবিতার লাইন। এসব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে বল, আমাদের কী করতে হবে।
মহাজাগতিক প্রাণী বলল, আমরা অত্যন্ত খাঁটি হাসির কিছু প্রক্রিয়ার সকল তথ্য সগ্রহ করতে চাই।
ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা চুলকে বলল, হাসাহাসির ঘটনাটা ভিডিও করবে?
না। হাসির প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রত্যেকের মস্তিষ্কের নিউরন এবং তার সিনাপ্সের সংযোগটি কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে সেটি সংরক্ষণ করব।
ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুখ হা হয়ে গেল, বলল, সেটি কী করে সম্ভব? মস্তিষ্কের ভিতরে তোমরা কীভাবে ঢুকবে?
আমরা পারি।
কীভাবে পার!
স্থান এবং সময়ের মাঝে একটা সম্পর্ক আছে। তোমাদের একজন বিজ্ঞানী সেটা প্রথম অনুভব করেছিলেন–।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন?
সবাইকে একটি নাম দেওয়ার এই প্রবণতায় আমরা এখনো অভ্যস্ত হই নি। সেই বিজ্ঞানীর বড় বড় চুল এবং বড় বড় গোঁফ ছিল।
ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন!
যাই হোক, আমরা সময়কে ব্যবহার করে স্থানকে সংকুচিত করতে পারি, আবার স্থানকে ব্যবহার করে সময়কে সংকুচিত করতে পারি।
শাহনাজ বিভ্রান্ত মুখে বলল, তার মানে কী?
ক্যাপ্টেন ডাবলু চোখ বড় বড় করে বলল, বুঝতে পারছ না শাহনাপু? স্থান মানে হচ্ছে স্পেস! এরা স্পেস ছোট করে ফেলতে পারে! মনে কর এরা তোমার ব্রেনের ভিতরে ঢুকতে চায় তখন তারা একটা বিশেষ রকম ভাসমান গাড়ি তৈরি করল। তারপর সেই গাড়িটা যে জায়গায় আছে সেই জায়গাটাই ছোট করে ফেলল, গাড়িটা তখন এত ছোট হল যে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হবে–সেটা তখন তোমার ব্রেনে ঢুকে যাবে, তুমি টেরও পাবে না! ক্যাপ্টেন ডাবলু মহাজাগতিক প্রাণীর দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না?
মহাজাগতিক প্রাণী একটু ইতস্তত করে বলল, মূল ব্যাপারটি খুব পরোক্ষভাবে অনেকটা এ রকম, তবে স্থান এবং সময়ের যোগাযোগ–সূত্রে প্রতিঘাত যোজনের সম্পর্কটি বিশেষণ করতে হয়। চতুর্মাত্রিক জগতে অনিয়মিত অবস্থান নিয়ন্ত্রণের একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া আছে। শক্তি ক্ষয় এবং শক্তি সৃষ্টির একটি অপবলয় রয়েছে, সেটি নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি রয়েছে–সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটি অনুধাবন করার মতো যথেষ্ট নিউরন তোমাদের মস্তিষ্কে নেই। তোমরা প্রয়োজনীয় সিনান্স সংযোগ করতে পারবে না।
শাহনাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী বলছে কিছুই তো বুঝতে পারলাম না।
ডাবলু বলল, সেটাই বলেছে–যে আমরা বুঝতে পারব না।
না বুঝলে নাই। মোরব্বা স্যারের কেমিস্ট্রিই বুঝতে পারি না, আর শক্তির অপবলয়! ভাগ্যিস ভাইয়া ধারেকাছে নাই, থাকলে এই কটমটে শব্দগুলো দিয়ে একটা পোস্ট মডার্ন কবিতা লিখে ফেলত।
কিন্তু কীভাবে করে জানা থাকলে খারাপ হত না
থাক বাবা, এত জেনে কাজ নেই। শাহনাজ মহাজাগতিক প্রাণীর দিকে তাকিয়ে বলল, এখন বল আমাদের কী করতে হবে?
অত্যন্ত খাঁটি একটি হাসির প্রয়োজনীয় পরিবেশের সকল তথ্য সংরক্ষণে সাহায্য করতে হবে।
ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, হাসি আবার খাঁটি আর ভেজাল হয় কেমন করে?
হবে না কেন? তুই যখন কিছু না–বুঝে হাসিস সেটা হচ্ছে ভেজাল হাসি। আমি যখন হাসি সেটা খাঁটি।
মহাজাগতিক প্রাণী বলল, খাঁটি একটা হাসির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে কী করতে হবে?
শাহনাজের হঠাৎ সোমার কথা মনে পড়ল এবং সাথে সাথে তার মুখ ম্লান হয়ে আসে। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর করে হাসতে পারে তার সোন্স আপু এবং এর হাসি থেকে খাঁটি হাসি পৃথিবীতে আর নেই। কিন্তু সেই সোমা আপু এখন হাসপাতালে আটকা পড়ে আছে, তাকে তো আর এখানে আনা যাবে না।
মহাজাগতিক প্রাণীটি বলল, সোমার হাসি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে কোনো সমস্যা নেই।
শাহনাজ চমকে উঠে মহাজাগতিক প্রাণীটির দিকে তাকাল, তুমি কেমন করে সোমা আপুর কথা জান?
তোমরা ভুলে যাচ্ছ, আমরা অন্য ধরনের প্রাণী। তথ্য বিনিময় করার জন্য আমরা সরাসরি তোমার মস্তিষ্কের নিউরনের সিনান্স সংযোগ লক্ষ করতে পারি। তোমরা যেটা বল সেটা যেরকম আমরা বুঝতে পারি, ঠিক সেরকম যেটা চিন্তা কর সেইটাও আমরা বুঝতে পারি। আমরা ইচ্ছা করলে সরাসরি তোমাদের মস্তিষ্কেও কথা বলতে পারি কিন্তু তোমরা অভ্যস্ত নও বলে বলছি না।
ক্যাপ্টেন ডাবলু নাক দিয়ে বাতাস বের করে বলল, পিকুইলাইটিস।
কী বললি?
মহাজাগতিক প্রাণী বলল, সে বলছে ব্যাপারটি খুব বিচিত্র।
ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, এখন আমি বুঝতে পারছি তোমরা কেন সবুজ রঙের এবং তোমাদের চোখ কেন এত বড় বড় এবং টানা টানা, তোমাদের হাতে কেন তিনটা করে আঙুল–আর শাহনাপু তাদের না–দেখেই কেমন করে সেটা বলে দিল।
শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, কেমন করে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু শাহনাজের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এ রকম কল্পনা করেছিলে, এরা তোমার চিন্তাটা দেখে ফেলে নিজেরা সেরকম আকার নিয়েছে। সে মহাজাগতিক প্রাণীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তাই না?
মহাজাগতিক প্রাণী বলল, তুমি যথার্থ অনুমান করেছ। আমরা এমন একটি আকৃতি নিতে চেয়েছিলাম যেটি দেখে তোমরা অস্বস্তি না পাও। সেটি আমরা তোমাদের একজনের মস্তিষ্ক থেকে গ্রহণ করেছি।
ক্যাপ্টেন ডাবলু ঠোঁট সুচালো করে বলল, পিকুইলাইটিস! ভেরি ভেরি পিকুইলাইটিস!
শাহনাজ মহাজাগতিক প্রাণীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সোমা আপুর কথা কী জানি বলছিলে?
আমরা বলেছিলাম
আমরা কোথায়? তুমি তো এখন একা।
আমি এবং আমাদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আমরা এক ও অভিন্ন। আমাদের ভিন্ন সত্তা নেই–
শাহনাজ মাথা চেপে ধরে বলল, অনেক হয়েছে, আর ওসব নিয়ে বকবক কোরো না, আমার মাথা ধরে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সোমা আপুকে নিয়ে তুমি কী যেন বলছিলে?
বলছিলাম যে সোমার হাসি সংক্রান্ত তথ্য সগ্রহ করতে কোনো সমস্যা নেই।
কীভাবে সগ্রহ করবে?
আমরা স্থান এবং সময়কে নিয়ন্ত্রণ করি। আমরা যে কোনো স্থানে যেতে পারি।
শাহনাজ আনন্দে চিৎকার করে বলল, তা হলে আমরা সোমা আপুর কাছে যেতে পারব?
সে যদি এই গ্যালাক্সিতে থাকে তা হলে পারব?
শাহনাজ হি হি করে হাসতে গিয়ে থেমে গেল।। তার আবার মনে পড়েছে সোমা আপুর শরীর ভালো নয়। মুখ কালো করে বলল কিন্তু সোমা আপু কি হাসবে? তার তো শরীর ভালো না!
মানুষের শরীরে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে, তাই শরীর ভালো না–থাকা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তোলা যেতে পারে।
শাহনাজ আবার চিৎকার করে উঠল, তার মানে তোমরা সোমা আপুকে ভালো করে তুলতে পারবে? তোমাদের কাছে ভালো ডাক্তার আছে?
ডাক্তার? মহাজাগতিক প্রাণী মাথা নেড়ে বলল, একেকজনকে একেক বিষয়ে অভিজ্ঞ করে তোলার এই প্রবণতার সাথে আমরা পরিচিত নই। আমরা এক ও অভিন্ন, আমাদের জীবন্ত সত্তা–
ব্যস ব্যস ব্যস শাহনাজ বাধা দিয়ে বলল, অনেক হয়েছে, আবার এক ও অভিন্ন। সত্তা নিয়ে বক্তৃতা শুরু করে দিও না। তুমি ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাবে, না ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে চিকিৎসা করাবে সেটা তোমার ব্যাপার। সোমা আপু ভালো হলেই হল।
তা হলে আমরা কি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি?
হ্যাঁ। চল যাই, দেরি করে লাভ নেই।
মহাজাগতিক প্রাণী বলল, তুমি পূর্বশর্ত হিসেবে যে মানুষটিকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিলে তাকে কি এখন ছেড়ে দেব? তাকে কি আমরা সাথে নিয়ে নেব?
না, না, না– শাহনাজ মাথা নেড়ে বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? সাথে নিলে উপায় আছে? ঠিক তোমরা যাবার সময় তাকে ছেড়ে দিও। তার আগে না।
ঠিক আছে।
শাহনাজ হঠাৎ ঘুরে মহাজাগতিক প্রাণীর দিকে তাকাল, বলল, আচ্ছা তোমরা কি একটা জিনিস করতে পারবে?
শাহনাজ কথাটি বলার আগেই মহাজাগতিক প্রাণী মাথা নাড়ল, বলল, পারব।
শাহনাজ ভুরু কুঁচকে বলল, আমি কী বলতে যাচ্ছি তুমি বুঝেছ?
হ্যাঁ। তুমি বলতে চাইছ তোমার ভাইয়ের আকার পরিবর্তন করে দিতে।
শাহনাজ মাথা নেড়ে বলল, হ্যা ছোট সাইজ করে একটা হোমিওপ্যাথিকের শিশিতে ভরে দিবে! আমি আমার জ্যামিতি–বক্সে রেখে দিব। তার খুব বিখ্যাত হওয়ার শখ এক ধাক্কায় বিখ্যাত হয়ে যাবে!
শাহনাজ হি হি করে হাসতে শুরু করে। এটা মোটামুটি খাঁটি আনন্দের হাসি, মহাজাগতিক প্রাণী তথ্য সংরক্ষণ করছে কি না কে জানে!