০৭. প্রতারক ইন্দ্র
চন্দ্রবংশের রাজা আয়ুর পুত্র রাজি, মহাবীর, মহা পরাক্রমশালী, রণজয়ী শাসক।
সে সময় দেবতা ও অসুরদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকত। বহুদিন ধরে চলেছে এক বিশাল লড়াই, কোন মতে শেষ নেই তার। জয় কিংবা পরাজয় যে কোন একটা হলেই শান্তি। কিন্তু সব সময় যুদ্ধ লেগে থাকলে কখনই শান্তি আসবে না। উভয় পক্ষই চিন্তিত, একটা কিছু উপায়ে যুদ্ধ শেষ করতে হবে। উভয় পক্ষই চলল পিতামহ ব্রহ্মার কাছে। অদিতির পুত্র দেবতা, আর দিতির পুত্রেরা দানব, সকলেই কিন্তু প্রজাপতি কাশ্যপের পুত্র। অর্থাৎ তারা বৈমাত্রেয় ভাই। তবুও সকল সময় দ্বন্দ্ব উপস্থিত, যুদ্ধ লেগেই আছে। একটা মীমাংসার দরকার, তারা বললে সব ব্রহ্মাকে।
ব্রহ্মা বললেন, এ যুদ্ধের নিষ্পত্তি করতে পারে একমাত্র রাজা রজি, যার দলের হয়ে সে লড়বে তারই জয় হবে। কাজেই তোমরা তার কাছে গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য বল।
ব্রহ্মার কথা শুনে দানবেরা ছুটল সবার আগে, গিয়ে সব কথা বলল। রাজি বলল–ঠিক আছে, আমি তোমাদের দলে যোগ দেব। কিন্তু তোমরা জয়লাভ করলে আমার লাভ কী? জয়ী হয়ে কি দেবে তোমরা আমাকে? দানবেরা বলল–তুমি যা চাইবে তাই দেব।
তখন রাজি বললে–যুদ্ধে জয়লাভ করে আমি তোমাদের ওপর আধিপত্য করব। আমার কথা মতই চলবে তোমরা, অন্যথা করা চলবে না। এই আমার শর্ত, দেখ যদি মেনে নিতে পারো।
রাজির কথা শুনে দানবেরা সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল–না, এমন শর্ত আমরা কখনই মেনে নেব না। আমাদের রাজা প্রহ্লাদ, তার কথামতই আমরা চলব। তাকে আমরা সব সময় মান্য করি। তার সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখব। তবে আমাদের হয়ে আপনি লড়াই করে যুদ্ধে জয়লাভ করলে, আমরা অবশ্যই যথা-যোগ্য সম্মান দেব আপনাকে।
রাজি বলল– না তা হবে না, আধিপত্য আমার চাই-ই। তোমরা যখন তা মেনে নেবে না, তাহলে যাও আমাকে আর বিরক্ত কর না।
হার মানতে রাজি আছি তবু অন্যের বশ্যতা কিছুতেই স্বীকার করব না–এই কথা বলে দানবেরা চলে গেল।
এবার এলেন দেবতাগণ ইন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে। একই ভাবে নিবেদন করলেন– রাজা রাজির কাছে। বললেন– হে রাজন, আপনি আমাদের সাহায্য করুন। যুদ্ধে পরাজিত করুন দানবদের, ওদের সঙ্গে আমরা পেরে উঠছি না। পিতামহ ব্রহ্মার কথামত আমরা এসেছি আপনাদের কাছে। আপনি আমাদের সহায় হোন।
রাজি বললেন–আমি আপনাদের সাহায্য করব কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভ হলে আমার কি লাভ হবে? ইন্দ্র বললেন– আপনার যা মনের ইচ্ছা আমার কাছে প্রকাশ করুন। অবশ্যই তা পূরণ করব।
রাজি বললেন–আমি বেশি কিছু চাইব না। কেবল একটা জিনিস, সেটা হল ইন্দ্ৰত্ব, আমি দেবরাজ্যের সিংহাসনে বসতে চাই, পারবে কি দিতে?
রাজির অভিলাষ শুনে সকল দেবতা নির্বাক হয়ে গেলেন। একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছেন। কিন্তু ইন্দ্র কোনো চিন্তা-ভাবনা না করেই বললেন–আমি রাজা, আপনি আমাদের হয়ে প্রাণ সংশয় করে লড়াই করবেন, আর আমরা আপনাকে এটুকু দিতে পারব না সে কি হয়? আপনার ইচ্ছা পূরণ হবে। রাজির আর কিছু বলার নেই। রওনা হলেন যুদ্ধের সাজে। শুরু হল আবার দেবা-সুরের ভীষণ যুদ্ধ। কিন্তু বেশিক্ষণ চলল না সেই যুদ্ধ। দানবপক্ষের বহু হতাহত হল রাজির অস্ত্রের আঘাতে। পিতামহ তো আগে থেকেই বলে রেখেছেন–যুদ্ধে জয়লাভ হবে রাজি আমাদের পক্ষে থাকলে।
জয় হল দেবতাদের। যে কয়েকজন অসুর বেঁচেছিল প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচল। আর পিছন ফিরে তাকাল না। দেবতারা জয়োল্লাস করে উঠলেন।
এবার পূর্ব শর্ত মত রাজি হবেন দেবরাজ, এলেন ইন্দ্র রাজির কাছে। সাষ্টাঙ্গে পড়লেন তার পায়ের কাছে।
আপনি আমাদের জীবনদাতা, কাজেই আপনি আমাদের পিতা। আপনি অবশ্যই পিতার কর্ম করলেন, অসুরদের যুদ্ধে হারিয়ে। আপনি শুধু পিতা নন, ভয়ত্রাতাও, কি ভীষণ মহাভয় থেকে আমাদের রক্ষা করলেন। আপনি আমাদের সকল অমঙ্গল দূর করলেন। এখন আপনি আশীর্বাদ করুন–যেন আমরা আপনার সম্মান যথাযথভাবে রাখতে পারি।
ইন্দ্রের এমন বিনীত কথা শুনে রাজি বুঝতে পারলেন ইন্দ্রের ইচ্ছে কী। কৌশল করে তার প্রতিশ্রুতি পালন এড়িয়ে যেতে চায়। কি আর করবেন তিনি? ইন্দ্র সিংহাসন না ছেড়ে কেবল কথায় যেভাবে পিতা, জন্মদাতা, ভয়ত্রাতা প্রভৃতি বলে সম্মান দেখালেন, তার উপর আর কি বলবেন? বাধ্য হয়েই নিজেকে সামলে নিলেন রাজি, দেবরাজ আর হতে পারলেন না।
ইন্দ্রের বাজিমাত হল, মনে মনে তাই ভারি উল্লাস। কথার জাদুতেই এই মহান কার্য সাধিত হল। এখন কে হটাবে তাঁকে? যথা পূর্ব তথা পরং আগে যেমন ছিলেন তেমনিই রয়ে যাবেন দেবরাজের সিংহাসন। আগের থেকে আরও নিশ্চিন্ত। দানবরা পলাতক, রাজি বশীভূত কথার কৌশলে, সকল অশান্তি দূর হয়েছে। কাজেই এবার শুধু ভোগবিলাসে মেতে উঠলেন দেবতাগণ।
দেবর্ষি নারদের কোনো কিছুই অজানা নেই। তিনি মনে মনে ভাবলেন–দেবতাদের রাজা হয়ে ইন্দ্র এত বড় অন্যায় করল। তার একটু সাজা হওয়া দরকার। তাই তিনি চললেন রাজির পুত্রদের কাছে। গিয়ে বললেন– তোমরা মহারাজ রাজির পুত্র বলে আমার মনে হয় না। যদি হতে, তাহলে এমন ব্যবহার তোমাদের হত না। তোমরা বীর নামে পরিচিত, কিন্তু আমার তা মনে হচ্ছে না।
দেবর্ষি নারদের কথা শুনে রাজির পুত্ররা তো অবাক, আমরা কি এমন দোষ করলাম যে, নারদ ঠাকুর আমাদেরকে এমন হেয় প্রতিপন্ন করছেন?
তারা বলল—হে দেবর্ষি, আমরা আপনার কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারছি না। আপনি দয়া করে সরল করে বলুন যা আপনি বলতে চান। আমাদের মনে হচ্ছে আপনি অযথা আমাদেরকে অপমান করেছেন।
দেবর্ষি বললেন–আচ্ছা, তোমরা কি বলতে পার দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে তোমাদের সম্পর্ক কি?
রাজির পুত্রগণ বলল–তিনি আমাদের দাদা হন।
দেবর্ষি বললেন–দাদা মানে কী রকম দাদা? নিজের দাদা তো? না পাতানো দাদা। তোমাদের বাবাকে ইন্দ্ৰত্ব দেবে বলে অঙ্গীকার করে দানবদের সঙ্গে লড়াই করিয়ে নিয়ে জয়ী হলেন দেবতারা। তারপর কৌশল করে ইন্দ্র তোমার বাবার কাছে এসে বলল, আপনি আমাদের রক্ষাকর্তা পিতার মতো। তাই আমরা তোমার পুত্র, সকল পুত্রকে রক্ষা করা পিতার কর্তব্য। আপনি পিতার কাজই করেছেন। এইভাবে নানা কথার জাল বুনে তোমাদের পিতাকে তোষামোদ করে দেব সিংহাসনের দাবি থেকে বঞ্চিত করেছেন। এখন তোমাদের বাবা আর কেমন করে স্বর্গের সিংহাসনে বসতে যাবেন? এইভাবে ইন্দ্র তোমাদের বাবার সঙ্গে নেমক হারামের কাছ করেছে। আমার মনে হয় তার প্রতিশোধ নেওয়া দরকার। এভাবে প্রতারণা করে যারা, তাদের বরদাস্ত করা দুর্বলতার লক্ষণ। তোমরা সেই রাজির পুত্র মহা বলবান বলে গর্ব কর, এই কি তার নমুনা? তাই এমন দুবৃত্তদের এখনও ক্ষমা করে বসে আছ।
দেবর্ষি নারদের কথা যতই শোনে রাজির পুত্রদের মাথা ততই গরম হয়ে ওঠে। তারা চিন্তা করল। দেবর্ষি নারদ ঠিক কথাই বলেছেন। ঐ অকৃতজ্ঞ দেবতাদের সাজা দেওয়া উচিত। ইন্দ্র যদি তাদের প্রকৃত দাদা হত তাহলে আপদে বিপদে সাহায্য করত। কই কখনও তো আসে নি এদিকে। না, আর অপেক্ষা না করে স্বর্গ আক্রমণ করাই উচিত।
এইভাবে যখন তারা চিন্তা করছে, নারদ ঠাকুর বুঝলেন, তার ঔষধ কাজে লেগেছে, এখন সরে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
তারপর রাজির পুত্ররা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে মহাক্রোধে স্বর্গ আক্রমণ করল,প্রতিরোধ করতে এলেন দেবগণ। রাজিসম বল ধরে পুত্রগণ, তারা দেবেদের দিল মহা মহা মার। মার খেয়ে দেবতারা রণক্ষেত্র ছেড়ে পালালেন। তারপর দেবগুরু বৃহস্পতি এসে রাজির পুত্রদের অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে স্বর্গ সিংহাসন ইন্দ্রকে ফিরিয়ে দিলেন। প্রতারণার ফল পেলেন ইন্দ্র।