০৭. পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছতে-পৌঁছতে

পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছতে-পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। এস পি সাহেব অফিসে নেই। দাশগুপ্ত তক্ষুনি ছুটিল তাঁর বাড়িতে। সেখানে গিয়েও এক দারুণ খারাপ খবর শুনল। এস পি সাহেব এইমাত্র লিটল আন্দামান রওনা হয়ে গেছেন।

দাশগুপ্ত হতাশ হয়ে মাটিতে বসে পড়ছিল, কিন্তু এস পি সাহেবের আদলি বলল, সাহেব এই মাত্র বেরিয়েছেন, এখনও বোধহয় জেটিতে গেলে তাঁকে ধরতে পারবেন।

দাশগুপ্ত আবার দৌড়ল জেটির দিকে। দূর থেকে দেখল, এসপি-র নিজস্ব মোটরবোট তখনও দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, কিন্তু যে-কোনও মুহুর্তে ছাড়বে। চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। সে চ্যাঁচাতে লাগল, দাঁড়াও, দাঁড়াও! পাইলট, বোট ছেড়ে না?

কোনও রকমে জেটিতে এসে সে লাফিয়ে মোটরবোটের মধ্যে গিয়ে পড়ল।

এস পি সাহেবের মোটরবোটটা শুধু তাঁর নিজস্ব ব্যবহারের জন্য। ভেতরে তাঁর বসবার জায়গাটা সিংহাসনের মতন, লাল ভেলভেট দিয়ে মোড়া। এস পি সাহেবের চেহারাটাও দারুণ। টকটকে ফস রঙ, বিশাল মোটা গোঁফ মিশে গেছে। তাঁর লম্বা জুলফির সঙ্গে। অনেকটা হরতনের গোলামের মতন মুখ। কোমরে চওড়া বেল্টে গোঁজা রিভলভার, পায়ে কালো জুতো চকচক করছে। তিনি পা ছড়িয়ে বসে চোখ বুজে ছিলেন।

দাশগুপ্ত ধড়াম করে লাফিয়ে পড়তেই তিনি চোখ মেলে। কটমট করে তাকালেন। হুংকার দিয়ে বললেন, এখানে লাফালাফি করছ, কেন? সাকসি দেখাতে এসেছ?

দাশগুপ্ত বলল, স্যার, সর্বনাশ হয়ে গেছে!

কিসের সর্বনাশ? তোমার তো রোজই একটা করে সর্বনাশ হয়।

না, স্যার! সেই যে মিঃ রায়চৌধুরী, যিনি ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টের চিঠি নিয়ে এসেছিলেন, তিনি জারোয়াদের জঙ্গলে নেমে গেছেন?

কী?

এস পি সাহেব এবার সোজা হয়ে বসলেন। এমনভাবে দাশগুপ্তর দিকে তাকালেন যেন ওকে একেবারে পুড়িয়ে ছাই করে দেবেন।

তুমি সঙ্গে ছিলে, তাও উনি নেমে গেলেন কী করে?

দাশগুপ্ত হাত জোড় করে বলল, স্যার, আমার দোষ নেই, আমি অনেক বারণ করেছিলুম, উনি কিছুতেই শুনলেন না। জোর করে নেমে গেলেন।

কতক্ষণ আগে?

প্ৰায় তিন ঘণ্টা আগে।

তাহলে দেখো গিয়ে, এতক্ষণে তাঁর মৃতদেহ সমুদ্রে ভাসছে। লোকটা কি পাগল না রাম-বোকা? লোকটা তো রোগা আর এক পা খোঁড়া, ওকে জোর করে আটকে রাখতে পারলে না?

স্যার, ওঁর কাছে রিভলভার আছে।

এস পি সাহেব। আবার আঁতকে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন, রিভলভার? কে দিয়েছে? কার হুকুমে রিভলভার নিয়ে গেছে?

জানি না। আগেই ওঁর কাছে ছিল।

ছি ছি ছি ছি! এখন যদি একটাও জারোয়াকে গুলি করে মারে, তা হলে আমাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে! জারোয়াদের মারা বারণ, তা জানো না?

তা তো জানি। কিন্তু উনি যে কথা শুনলেন না।

বাঘ-সিংহই শিকার করা বন্ধ হয়ে গেছে। আর উনি কি মানুষ-শিকারে গেছেন? ইচ্ছেমতন জারোয়াদের গুলি করে মারবেন?

উনি গেছেন সেই রহস্যের সন্ধানে।

চুলোয় যাক রহস্য! জারোয়ারা আপনমনে নিজেদের দ্বীপে আছে, কে ওনাকে বলেছে, সেখানে গিয়ে তাদের বিরক্ত করতে? রিভলভার থাকলেও উনি বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবেন না। নিজে তো মরবেনই, আমাদেরও চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে।

এখন কী উপায় হবে, স্যার?

যাও, শিগগির প্রীতম সিংকে খবর দাও!

মোটরবোটটা ইতিমধ্যে চলতে শুরু করেছিল। এস পি সাহেবের হুকুমে সেটা এসে আবার জেটিতে ভিড়ল। একজন গার্ড ছুটে গেল প্রীতম সিংকে ডেকে আনার জন্য।

প্রীতম সিং ছিলেন পুলিশের একজন ইন্সপেকটর। এখন রিটায়ার করে পোর্ট ব্লেয়ারেই বাড়ি বানিয়ে আছেন। একমাত্র এই প্ৰীতম সিং-ই কয়েকবার জারোয়াদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জারোয়াদের ভাষাও জানেন। জারোয়ারা অন্য সবাইকে দেখলেই মারতে আসে, শুধু প্রীতম সিংকে কিছু বলে না।

আন্দামানে আদিবাসীদের সংখ্যা খুব কমে যাচ্ছে বলে গভর্নমেন্ট নানাভাবে সাহায্য করে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে চান। পুলিশের লোক গিয়ে মাঝে-মাঝে ওদের দ্বীপে নানারকম খাবার রেখে আসে। ভাত, চিনি, গুঁড়ো দুধ, নানারকমের ফল। পুলিশেরা চলে যাবার খানিকক্ষণ পর জারোয়ারা এসে সেইসব নিয়ে যায়। তাদের জামা-কাপড় পরাবার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু জামা-কাপড় রেখে এলে তারা নেয় না, শুধু তারা পছন্দ করে লাল কাপড়। লাল কাপড় নিয়ে তারা কী করে কে জানে! জারোয়াদের কিন্তু খুব আত্মসম্মান-জ্ঞান আছে। তারা ঐ সব জিনিস এমনি-এমনি নেয় না। অবশ্য ঐ সব খাবার-দাবার আর লাল কাপড়ের বদলে টাকা-পয়সা তারা দিতে পারে না, কিন্তু অনেকখানি শুয়োর আর হরিণের মাংস ঐ জায়গায় রেখে যায় পুলিশদের জন্য।

প্রীতম সিং-এর দারুণ সাহস। একবার তিনি এক ঐ খাবারের বস্তার মধ্যে লুকিয়ে বসে ছিলেন একদম ন্যাংটো হয়ে। জারোয়ারা কাছে আসতেই তিনি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে হাত উঁচু করে দাঁড়ালেন। তার মানে তিনি আগেই দেখিয়ে দিলেন যে, তাঁর কাছে বন্দুক পিস্তল নেই, আর জারোয়াদের যেমন গায়ে পোশাক নেই, তেমনি তিনিও কোনও জামা-কাপড় পরেননি। জারোয়ারা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে। তাঁকে মারেনি।

তারপর থেকে আস্তে-আস্তে তাঁর সঙ্গে জারোয়াদের ভাব হয়ে যায়। তিনি নিজেই কয়েকবার খাবার নিয়ে গেছেন। এর পরে তিনি জামা-কাপড় পরে গেলেও জারোয়ারা তাঁকে অবিশ্বাস করেনি। এখন অবশ্য তিনি বুড়ো। এখন আর পুলিশের কেউ জারোয়াদের কাছে যেতে সাহস করে না। প্রীতম সিং এই কিছুদিন আগেও জারোয়াদের কাছে একবার গিয়েছিলেন। রঘুবীর সিং নামে একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার যখন এখানে ছবি তুলতে আসেন, তখন প্রীতম সিং-ই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন জারোয়াদের দ্বীপে। প্রীতম সিং সঙ্গে ছিলেন বলেই জারোয়ারা সেই ফটোগ্রাফারকে মারেনি।

একটু বাদেই প্রীতম সিং সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। দাড়ি, গোঁফ, চুল সব সাদা। কিন্তু এখনও খাঁকি প্যান্ট সার্ট পরতে ভালবাসেন। সব ঘটনা শুনে তিনি মাথা নেড়ে বললেন, খুবই চিন্তার কথা। ঐ সাহেবকে বাঁচানো খুবই শক্ত। যদি না এতক্ষণে মরে গিয়ে থাকেন?

দাশগুপ্ত বলল, ওঁর কাছে তো রিভলভার আছে। চট্‌ করে মারতে পারবে না।

প্ৰীতম সিং বললেন, আপনি জানেন না। জারোয়ারা একদম মরতে ভয় পায় না। একজনকে মারলে আমনি আর একজন এগিয়ে আসে। ওরা যদি চারদিক থেকে তীর-ধনুক নিয়ে এগিয়ে আসে, তাহলে উনি একা রিভলভার দিয়েই বা কী করবেন?

দাশগুপ্ত বলল, তবু এক্ষুনি আমাদের যাওয়া দরকার। একবার চেষ্টা করা উচিত অন্তত।

প্রীতম সিং বললেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান, অত ব্যস্ত হবেন না। বাঙালি ভদ্রলোক যদি এখনও সমুদ্রের ধারে লুকিয়ে থাকতে পারেন, তাহলে তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে একবার ঢুকে পড়লে আর উপায় নেই। জারোয়াদের সঙ্গে আমার ভাব হয়েছিল বটে, কিন্তু খাতির হয়নি। ওরা খুব কম কথা বলে। ওদের ভাষাতেই মোট তিরিশ-চল্লিশটার বেশি শব্দ নেই। ওরা আমাকে মাটিতে দাগ কেটে দেখিয়ে বলেছিল, আমি যেন তার ওপাশে কক্ষনো না। যাই! বনের ভেতরে আমাকে কোনওদিন যেতে দেয়নি। আমার মনে হয়, ওদের মধ্যে একজন এমন-কেউ আছে, যার খুব বুদ্ধি, তার কথাই ওরা মেনে চলে। একটা কিছু জিজ্ঞেস করলে ওরা সেদিন তার উত্তর না দিয়ে পরের বার দিত। আমি অনুরোধ করেছিলাম, একবার ওদের সারা দ্বীপটা ঘুরে দেখার জন্য। ঐ দ্বীপের ভেতরে তো সভ্য মানুষ কেউ যায়নি, ওখানে কী আছে, কেউ জানে না। কিন্তু পরের দিন এসে বলেছিল, না, যাওয়া চলবে না। সেদিনই মাটিতে দাগ কেটে সীমা টেনে দেয়।

দাশগুপ্ত বলল, আমার সঙ্গে পুলিশ নিয়ে যাব। আপনি শুধু ওদের বুঝিয়ে বলবেন যে, আমরা ওদের সঙ্গে শত্ৰুতা করতে আসিনি।

আমার সে-কথা। ওরা শুনবে না! এ রকম চেষ্টা কি আগে হয়নি? অনেকবার হয়েছে। কোনও লাভ হয়নি। একবার কী হয়েছিল শুনবেন?

প্রীতম সিং এস পি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার, আপনি তখন এখানে আসেননি। সে-সময় এস পি ছিলেন মিঃ ভার্মা। তাঁর কথামতন পুলিশরা ফাঁদ পেতে তিনজন জারোয়াকে ধরে ফেলে। জ্যান্ত অবস্থায়। তারপর তাদের হাত পা শিকলে বেঁধে নিয়ে আসা হল। পোর্ট ব্লেয়ারে এনে তাদের শিকল খুলে দিয়ে খুব আদর-যত্ন করা হল। খাওয়ানো হল ভাল-ভাল খাবার। হেলিকপটারে চাপিয়ে তাদের দ্বীপ আর অন্যসব দ্বীপ দেখিয়ে আনা হল। অথাৎ তাদের বোঝানো হল যে, আমরা তাদের শত্ৰু নই, আমরা তাদের মারতে চাই না-তাদের দ্বীপটাই শুধু পৃথিবী নয়-বাইরে আরও কত জায়গা আছে, কতরকম মানুষ আছে। তিনদিন বাদে তাদের ফিরিয়ে দিয়ে আসা হল তাদের দ্বীপে-যাতে তারা গিয়ে অন্যদের বলতে পারে যে, সভ্য লোকরা তাদের মারেনি, বরং আদর করেছে। এরপর কী হল বলতে পারেন?

এস পি সাহেব বললেন, হ্যাঁ, আমি শুনেছি ঘটনাটা। পরদিন দেখা গেল সেই তিনজন জারোয়ার মৃতদেহসমুদ্রে ভাসছে।

প্রীতম সিং বললেন, অন্য জারোয়ারা তাদের মেরে ফেলেছে। তারা মনে করে, সভ্য লোকদের ছোঁয়া লেগে ঐ তিনজন অপবিত্র হয়ে গেছে। তাহলেই বুঝুন, ওরা কতটা ঘেন্না করে আমাদের।

দাশগুপ্ত বলল, তবে কি আমরা কিছুই করব না। এখানে চুপ করে বসে থাকব?

এস পি বললেন, উনি একটা বয়স্ক লোক। নিজে যদি ইচ্ছে করে সেখানে যেতে চান, তাহলে নিজেই তার ঠালা বুঝবেন। আমাদের কী করার আছে?

তা বলে আমরা লোকটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করব না? আমার কাছে দিল্লি থেকে অর্ডার এসেছে, ওঁকে সবরকমভাবে সাহায্য করার। স্যার, এক্ষুনি চলুন পুলিশ ফোর্স নিয়ে।

এস পি সাহেব বললেন, তারপর জারোয়ারা যখন ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুড়বে, সেগুলো কি আমরা খেয়ে হজম করে ফেলব?

প্রীতম সিং বললেন, বনের মধ্যে ওরা কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। তাহলে লড়াই লেগে যাবে।

দাশগুপ্ত বলল, দরকার হলে আমাদের গুলি চালাতে হবেই, উপায় কী?

এস পি সাহেব বললেন, আমরা শুধু শুধু ওদের মারব? কেন, ঐ ভদ্রলোককে কে ওখানে যেতে বলেছিল? সারা পৃথিবীতে রটে যাবে যে, আমরা আমাদের আদিবাসীদের গুলি করে মারি।

প্রীতম সিং মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, বাঙালি ছাড়া এমন উদ্ভট শখ আর কারুর হয় না। জারোয়াদের গুলি করে মারা আমিও সমর্থনা করি না।

দাশগুপ্ত এস পি সাহেবের হাত জড়িয়ে ধরে বলল, স্যার, একটা কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে।

এস পি সাহেব বললেন, আমাকে তাহলে দিল্লিতে হোম সেক্রেটারির কাছে টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে। গভর্নমেন্টের হুকুম ছাড়া আমি কিছু করতে পারব না।

কিন্তু স্যার, দিল্লি থেকে হুকুম আসতে অন্তত একদিন লেগে যাবে।

এস পি সাহেব বললেন, একদিন অপেক্ষা করতেই হবে। এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

দাশগুপ্ত প্ৰায় কান্না-কান্না গলায় বলল, ওঁর সঙ্গে সেই ছোট ছেলেটিও আছে। হয়, হায়, এতক্ষণে ওদের কী হয়েছে, কি জানি।