পারিবারিক চিত্র (উপনিষদ)
সম্ভবত উপনিষদের যুগেও পারিবারিক কাঠামো একান্নাবতী বা প্রসারিত অবস্থায় রয়ে গিয়েছিল, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক অটুট ছিল। সন্তানের প্রতি স্নেহ ও পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধার প্রশংসা করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশিবার নারীর প্রতি উচ্চারিত আশীর্বাণী হ’ল : ‘এই নারী কখনো পুত্রের মৃত্যুতে রোদন করে না।’ নিজ বংশকে অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত রাখা আবশ্যিক দায়িত্বরূপে গণ্য হ’ত; দীর্ঘ বংশতালিকাগুলি এই মানসতার প্রমাণ বহন করে। মরণোন্মুখ পিতা তাঁর সমস্ত গুণাবলী, কীর্তি ও শরীর-মনের সব শক্তি পুত্রকে অর্পণ করে বংশকে অবিচ্ছিন্ন রেখে যাবার ব্যবস্থা করেন। পরিবারে নারীর স্থান পুরুষের তুলনায় হীন; বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৬ : ৪ : ২) দেখি যে, এই হীনতার যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য পরিকল্পিত, একটি প্রত্নকথার দাবি করা হয়েছে, স্রষ্টাই স্বয়ং নারীকে পুরুষের অপেক্ষা হীনতর অবস্থানে স্থাপিত করেছেন। অবশ্য ব্যতিক্রমী পরিপ্রেক্ষিতে নারীকে কখনো কখনো আধ্যাত্মিক আলোচনায় যোগদান করার অনুমতি দেওয়া হ’ত। তাই, গার্গী বিখ্যাত ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন; কিন্তু গার্গীর সূক্ষ্ম ও অন্তৰ্ভেদী প্রশ্নে বিরক্ত বোধ করে ঋষি তাকে শিরশেছদের ভয় দেখিয়ে কার্যোদ্ধার করলেন (বৃহদারণ্যক ৩ : ৬ : ১)। যাজ্ঞবল্ক্য অবশ্য পত্নী মৈত্ৰেয়ীকে আত্মজ্ঞান দান করেছিলেন, কারণ তিনি ধনসম্পত্তি প্ৰত্যাখ্যান করে ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভের জন্যেই প্রার্থনা জানিয়েছিলেন।
যজ্ঞানুষ্ঠান পরিচালনা করতে হলে উপনয়ন ও বেদজ্ঞান ছিল আবশ্যিক, কিন্তু এই উভয় অধিকার থেকেই সুপরিকল্পিতভাবে নারীকে বঞ্চিত করা হত; কারণ, কখনো কখনো আর্যের পত্নী ছিল অনাৰ্য-কন্যা অর্থাৎ সামাজিক বিচারে হীনতার, উপনয়ন ও বেদবিদ্যায় যে অনধিকারিণী। অনার্য নারীর গর্ভজাত পুত্র অবশ্য পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারত; ফলত, উপনয়ন লাভ করে যজ্ঞানুষ্ঠানে অধিকারী হতে তার পক্ষে কোনো বাধা ছিল না। উপনিষদে যজ্ঞানুষ্ঠান যেহেতু নূতন ধরনের অনুষ্ঠান-বর্জিত একটি বিমূর্তরূপ পরিগ্রহ করেছে, তাই নারীকে তার থেকে বঞ্চিত করার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট বিধির প্রয়োজন হয় নি। কিন্তু সাধারণভাবে নারী ব্ৰহ্মচর্চায় যোগ দিতে পারত না, গাগী ও মৈত্ৰেয়ী সর্বতোভাবেই ছিলেন ব্যতিক্রম। আর্য মাতা ও অনার্য পিতার পুত্ররা সম্ভবত মাতৃগোষ্ঠীর নাম বা পদবী লাভ করতেন (যেমন জাবাল)।
পত্নীরূপে নারী সম্পূর্ণ স্বামীর অধীন ছিল, পুরুষ তাকে শয্যাসঙ্গিনী করার জন্য নানাবিধ দান উৎকোচ রূপে অৰ্পণ করত। কোনো নারী অস্বীকার করলে তাকে লাঠি দিয়েও প্ৰহারের বিধান দিয়েছেন যাজ্ঞবল্ক্য। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৬ : ৪ : ৭) নারীকে দমন ও উপভোগ করার নানাবিধ উপায়ের কথাই এখানে আছে।