৬১*
[ডাঃ নাঞ্জুণ্ড রাওকে লিখিত]
খেতড়ি, রাজপুতানা
২৭ এপ্রিল, ১৮৯৩
প্রিয় ডাক্তার,
এইমাত্র আপনার পত্র পাইলাম। অযোগ্য হইলেও আমার প্রতি আপনার প্রীতির জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিবেন। বালাজী বেচারার পুত্রের মৃত্যু-সংবাদে বড়ই দুঃখিত হইলাম। ‘প্রভুই দিয়া থাকেন, আবার প্রভুই গ্রহণ করেন—প্রভুর নাম ধন্য হউক।’ আমরা কেবল জানি, কিছুই নষ্ট হয় না বা হইতে পারে না। আমাদিগকে সম্পূর্ণ শান্তভাবে তাঁহার নিকট হইতে যাহাই আসুক না কেন, মাথা পাতিয়া লইতে হইবে। সেনাপতি যদি তাঁহার অধীন সৈন্যকে কামানের মুখে যাইতে বলেন, তাহাতে তাহার অভিযোগ করিবার বা ঐ আদেশ পালন করিতে এতটুকু ইতস্ততঃ করিবার অধিকার নাই। বালাজীকে প্রভু এই শোকে সান্ত্বনা দান করুন, আর এই শোক যেন তাহাকে সেই পরম করুণাময়ী জননীর বক্ষের নিকট হইতে নিকটে লইয়া যায়।
মান্দ্রাজ হইতে জাহাজে উঠিবার প্রস্তাব সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, উহা এক্ষণে আর হইবার যো নাই, কারণ আমি পূর্বেই বোম্বাই হইতে উঠিবার বন্দোবস্ত করিয়াছি। ভট্টাচার্য মহাশয়কে বলিবেন, রাজা৩০ অথবা আমার গুরুভাইগণ আমার সংকল্পে বাধা দিবেন, তাহার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। রাজাজীর তো আমার প্রতি অগাধ ভালবাসা।
একটা কথা—চেটির উত্তরটি মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। আমি বেশ ভাল আছি। দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি বোম্বাই রওনা হইতেছি।
সেই সর্বশুভবিধাতা আপনাদের সকলের ঐহিক ও পারত্রিক মঙ্গল বিধান করুন, ইহাই সচ্চিদানন্দের নিরন্তর প্রার্থনা।
পুঃ—আমি জগমোহনকে আপনার নমস্কার জানাইয়াছি। তিনিও আমাকে বলিতেছেন, আপনাকে তাঁহার প্রতিনমস্কার জানাইতে।
৬২*
[শ্রীযুক্ত বালাজী রাওকে লিখিত]
১৮৯৩
প্রিয় বালাজী,
‘আমরা মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হই উলঙ্গ অবস্থায়, ইহলোক হইতে বিদায় হইবার সময় যাইও উলঙ্গ অবস্থায়; প্রভু দিয়াছিলেন, তিনিই আবার গ্রহণ করিলেন; প্রভুর নাম ধন্য হউক!’ যখন সেই প্রাচীন য়াহুদী-বংশসম্ভূত মহাত্মা—মনুষ্যের অদৃষ্টচক্রে যতদূর দুঃখ-কষ্ট আসিতে পারে, তাহার চূড়ান্ত ভোগ করিতেছিলেন, তখন তাঁহার মুখ দিয়া ঐ বাণী নির্গত হইয়াছিল, আর তিনি মিথ্যা বলেন নাই। তাঁহার এই বাণীর মধ্যেই জীবনের গূঢ় রহস্য নিহিত। সমুদ্রের উপরিভাগে উত্তালতরঙ্গমালা নৃত্য করিতে পারে, প্রবল ঝটিকা গর্জন করিতে পারে, কিন্তু উহার গভীরতম প্রদেশে অনন্ত স্থিরতা, অনন্ত শান্তি, অনন্ত আনন্দ বিরাজমান। ‘শোকার্তেরা ধন্য, কারণ তাহারা সান্ত্বনা পাইবে’; কারণ ঐ মহাবিপদের দিনে, যখন পিতামাতার কাতর ক্রন্দনে উদাসীন করাল কালের পেষণে হৃদয় বিদীর্ণ হইতে থাকে, যখন গভীর দুঃখ ও নিরাশায় পৃথিবী অন্ধকার বোধ হয়, তখনই আমাদের অন্তরের চক্ষু উন্মীলিত হয়। যখন দুঃখ বিপদ নৈরাশ্যের ঘনান্ধকারে চারিদিক একেবারে আচ্ছন্ন বোধ হয়, তখনই যেন সেই নিবিড় অন্ধকারের মধ্য হইতে হঠাৎ জ্যোতিঃ ফুটিয়া উঠে, স্বপ্ন যেন ভাঙিয়া যায়, আর তখন আমরা প্রকৃতির মহান্ রহস্য সেই অনন্ত সত্তাকে দিব্যচক্ষে দেখিতে থাকি।
যখন জীবনভার এত দুর্বহ হয় যে, তাহাতে অনেক ক্ষুদ্রকায় তরী ডুবাইয়া দিতে পারে, তখনই প্রতিভাবান্ বীরহৃদয় ব্যক্তি সেই অনন্ত পূর্ণ নিত্যানন্দময় সত্তামাত্রস্বরূপকে দেখে, যে অনন্ত পুরুষ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে অভিহিত ও পূজিত; তখনই যে শৃঙ্খল তাহাকে এই দুঃখময় কারায় আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা যেন ক্ষণকালের জন্য ভাঙিয়া যায়। তখন সেই বন্ধনমুক্ত আত্মা ক্রমাগত উচ্চ হইতে উচ্চতর ভূমিতে আরোহণ করিয়া শেষে সেই প্রভুর সিংহাসনে সমীপবর্তী হয়, ‘যেখানে অত্যাচারীর উৎপীড়ন সহ্য করিতে হয় না, যেখানে পরিশ্রান্ত ব্যক্তি বিশ্রাম লাভ করে।’
ভ্রাতঃ! দিবারাত্র তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিতে ভুলিও না; দিবারাত্র বলিতে ভুলিও না, ‘তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক।’
‘কেন’ প্রশ্নে আমাদের নাই অধিকার।
কাজ কর, করে মর—এই হয় সার॥
হে প্রভো! তোমার নাম—তোমার পবিত্র নাম ধন্য হউক এবং তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক। হে প্রভো! আমরা জানি যে, আমাদিগকে তোমার ইচ্ছার অধীনে চলিতে হইবে—জানি প্রভো, মায়ের হাতেই মার খাইতেছি; কিন্তু মন বুঝিলেও প্রাণ যে বুঝে না! হে প্রেমময় পিতঃ! তুমি যে একান্ত আত্মসমর্পণ শিক্ষা দিতেছ, হৃদয়ের জ্বালা তো তাহা করিতে দিতেছে না।
হে প্রভো! তুমি তোমার চক্ষের সমক্ষে তোমার সব আত্মীয়স্বজনকে মরিতে দেখিয়াছিলে এবং শান্তচিত্তে বক্ষে হস্তার্পণ করিয়া নিশ্চিন্তভাবে বসিয়াছিলে; তুমি আমাদিগকে বল দাও। এস প্রভো, এস হে আচার্যচূড়ামণি! তুমি আমাদিগকে শিখাইয়াছ; সৈনিককে কেবল আজ্ঞা পালন করিতে হইবে, তাহার কথা কহিবার অধিকার নাই। এস প্রভো, এস হে পার্থসারথি! অর্জুনকে তুমি যেমন একসময় শিখাইয়াছিলে যে, তোমার শরণ লওয়াই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য, তেমনি, আমাকেও শিখাও—যেন প্রাচীনকালের মহাপুরুষগণের সহিত আমিও দৃঢ়তা ও শরণাগতির সহিত বলিতে পারি ‘ওঁ শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু’। প্রভু আপনার হৃদয়ে শান্তি দিন, ইহাই দিবারাত্র সচ্চিদানন্দের প্রার্থনা ।
৬৩*
খেতড়ি
২৮ এপ্রিল, ১৮৯৩
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,২৫
ইচ্ছা ছিল যে, এখানে আসার পথে নাড়িয়াদে আপনার ওখানে যাব, এবং আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করব। কিন্তু কয়েকটি ঘটনাতে বাধা পড়ল, তার মধ্যে প্রধান এই যে, আপনি ওখানে ছিলেন না—হ্যামলেটের ভূমিকা বাদ দিয়ে ‘হ্যামলেট’ অভিনয় করা হাস্যকর ব্যাপার মাত্র! আর আমার নিশ্চিত জানা আছে যে, আপনি দিন-কয়েকের মধ্যেই নাড়িয়াদে ফিরবেন। অধিকন্তু আমি দিন-বিশেকের মধ্যেই যখন বোম্বে যাচ্ছি, তখন আপনার ওখানে যাওয়াটা পেছিয়া দেওয়াই উচিত মনে করলাম।
খেতড়ির রাজাজী আমায় দেখবার জন্য বিশেষ আগ্রহান্বিত হয়েছিলেন এবং তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীকে মান্দ্রাজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন; সুতরাং আমাকে খেতড়ি আসতেই হল। কিন্তু গরম অসহ্য; অতএব আমি শীঘ্রই পালাচ্ছি।
ভাল কথা, আমার প্রায় সকল দক্ষিণী রাজার সঙ্গেই আলাপ হয়েছে, আর বহু জায়গায় বহু অদ্ভুত দৃশ্যও দেখেছি। আবার দেখা হলে সে-সব সবিশেষ বলব। আমি জানি আপনি আমায় খুবই ভালবাসেন এবং আপনার ওখানে না যাওয়ার অপরাধ নেবেন না। যা হোক, কিছুদিনের মধ্যেই আসছি।
আর এক কথা। এখন কি জুনাগড়ে আপনার কাছে সিংহের বাচ্চা আছে? রাজার জন্য একটি কি আমায় ধার দিতে পারেন? এর বদলে আপনার পছন্দ হলে তিনি রাজপুতানার কোন জানোয়ার আপনাকে দিতে পারেন।
ট্রেনে রতিলাল ভাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি ঠিক সেই সুন্দর অমায়িক মানুষটিই আছেন। আর দেওয়ানজী সাহেব, আপনার জন্য কি আর প্রার্থনা করব? করুণাময় জগৎপিতার এতগুলি পুত্রকন্যার সেবায় নিরত থেকে আপনার যে পবিত্র জীবন সকলের প্রশংসা ও সম্মান অর্জন করেছে, তার শেষভাগে ভগবান্ আপনার সর্বস্ব হোন। ওম্
আপনার স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৬৪*
বোম্বে
২২ মে, ১৮৯৩
দেওয়ানজী সাহেব,
কয়েকদিন হয় বোম্বে পৌঁছিয়াছি। আবার দুই-চার দিনের মধ্যে এখান হইতে বাহির হইব। আপনার যে বেনিয়া বন্ধুটির নিকট আমার থাকিবার স্থানের জন্য লিখিয়াছিলেন, পত্রযোগে তিনি জানাইয়াছেন যে, পূর্ব হইতেই তাঁহার বাটী অতিথি-অভ্যাগতে ভর্তি এবং তন্মধ্যে অনেকে আবার অসুস্থ; সুতরাং আমার জন্য স্থানসঙ্কুলান হওয়া সেখানে সম্ভব নয়—সেজন্য তিনি দুঃখিত। তবে আমরা বেশ একটি সুন্দর ও খোলা জায়গা পাইয়াছি। … খেতড়ির মহারাজার প্রাইভেট সেক্রেটারী ও আমি বর্তমানে একত্র আছি। আমার প্রতি তাঁহার ভালবাসা ও সহৃদয়তার জন্য আমি যে কত কৃতজ্ঞ, তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারি না। রাজপুতানার জনসাধারণ যে শ্রেণীর লোককে ‘তাজিমি সর্দার’ বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকে এবং যাঁহাদের অভ্যর্থনার জন্য স্বয়ং রাজাকেও আসন ত্যাগ করিয়া উঠিতে হয়, ইনি সেই সর্দারশ্রেণীর লোক। অথচ ইনি এত অনাড়ম্বর এবং এমনভাবে আমার সেবা করেন যে, আমি সময় সময় অত্যন্ত লজ্জা বোধ করি। …
এই ব্যাবহারিক জগতে এরূপ ঘটনা প্রায়ই ঘটিতে দেখা যায় যে, যাঁহারা খুব সৎলোক তাঁহারাও নানাপ্রকার দুঃখ ও কষ্টের মধ্যে পতিত হন। ইহার রহস্য দুর্জ্ঞেয় হইতে পারে, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই যে, এ জগতের সব কিছুই মূলতঃ সৎ—উপরের তরঙ্গমালা যে-রূপই হউক, তাহার অন্তরালে, গভীরতম প্রদেশে প্রেম ও সৌন্দর্যের এক অনন্ত বিস্তৃত স্তর বিরাজিত। যতক্ষণ সেই স্তরে আমরা পৌঁছিতে না পারি, ততক্ষণই অশান্তি; কিন্তু যদি একবার শান্তিমণ্ডলে পৌঁছানো যায়, তবে ঝঞ্ঝার গর্জন ও বায়ুর তর্জন যতই হউক—পাষাণ-ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত গৃহ তাহাতে কিছুমাত্র কম্পিত হয় না।
আর আমি এ কথা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি যে, আপনার ন্যায় পবিত্র ও নিঃস্বার্থ ব্যক্তি, যাঁহার সমগ্র জীবন অপরের কল্যাণসাধনেই নিযুক্ত হইয়াছে, তিনি—গীতামুখে শ্রীভগবান্ যাহাকে ‘ব্রাহ্মী স্থিতি’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন—সেই দৃঢ় ভূমিতে অবশ্যই স্থিতি লাভ করিয়াছেন।
যে আঘাত আপনি পাইয়াছেন, তাহা আপনাকে তাঁহার সমীপবর্তী করুক—যিনি ইহলোকে এবং পরলোকে একমাত্র প্রেমের আস্পদ। আর তাহা হইলেই তিনি যে সর্বকালে সব কিছুর ভিতর অধিষ্ঠিত এবং যাহা কিছু আছে, যাহা কিছু হারাইয়া গিয়াছে, সব কিছু আপনি তাঁহাতেই উপলব্ধি করুন।
আপনার স্নেহের
বিবেকানন্দ
৬৫*
খেতড়ি
মে, ১৮৯৩
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনি পত্র লেখার পূর্বে আমার পত্র নিশ্চয়ই পৌঁছায়নি। আপনার পত্র পড়ে যুগপৎ হর্ষ ও বিষাদ হল। হর্ষ এ জন্য যে, আপনার ন্যায় হৃদয়বান্ শক্তিমান্ ও পদমর্যাদাশালী একজনের স্নেহলাভের সৌভাগ্য আমার ঘটেছে; আর বিষাদ এ জন্য যে, আমার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আপনার আগাগোড়াই ভুল ধারণা হয়েছে। আপনি বিশ্বাস করুন যে, আমি আপনাকে পিতার ন্যায় ভালবাসি ও শ্রদ্ধা করি এবং আপনার ও আপনার পরিবারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অসীম। সত্য কথা এইঃ আপনার হয়তো স্মরণ আছে যে, আগে থেকেই আমার চিকাগো যাবার অভিলাষ ছিল; এমন সময় মান্দ্রাজের লোকেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এবং মহীশূর ও রামনাদের মহারাজার সাহায্যে আমাকে পাঠাবার সব রকম আয়োজন করে ফেলল। আপনার আরও স্মরণ থাকতে পারে যে, খেতড়ির রাজা ও আমার মধ্যে প্রগাঢ় প্রেম বিদ্যমান। তাই কথাচ্ছলে তাঁকে লিখেছিলাম যে, আমি আমেরিকায় চলে যাচ্ছি। এখন খেতড়ির রাজা মনে করলেন যে, যাবার পূর্বে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাবই; আরও বিশেষ কারণ এই যে, ভগবান্ তাঁকে সিংহাসনের একটি উত্তরাধিকারী দিয়াছেন এবং সেজন্য এখানে খুব আমোদ আহ্লাদ চলেছে। অধিকন্তু আমার আসা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হবার জন্য তিনি তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীকে অত দূর মান্দ্রাজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আসতে আমাকে হতই। ইতোমধ্যে নাড়িয়াদে আপনার ভাইকে টেলিগ্রাম করে জানতে চাইলাম যে, আপনি সেখানে আছেন কি না; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উত্তর পেলাম না। এদিকে বেচারা প্রাইভেট সেক্রেটারীর মান্দ্রাজ যাতায়াতে খুবই কষ্ট হয়েছিল, আর তার নজর ছিল শুধু একটা জিনিষের দিকে—জলসার আগে আমরা খেতড়ি না পৌঁছালে রাজা খুব দুঃখিত হবেন; তাই সে তখনি জয়পুরের টিকেট কিনে ফেলে। পথে রতিলালের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় এবং তিনি আমাকে জানালেন যে, আমার টেলিগ্রাম পৌঁছেছিল, যথাকালে উত্তরও দেওয়া হয়েছিল, আর শ্রীযুক্ত বিহারীদাস আমার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। এখন আপনিই বিচার করুন; কারণ এ যাবৎ আপনি সর্বদা সুবিচার করাকেই নিজের কর্তব্যরূপে গ্রহণ করেছেন। আমি এ বিষয়ে কী করতে পারতাম, আর কী করা উচিত ছিল? আমি পথে নেমে পড়লে খেতড়ির উৎসবে যথাসময়ে যোগ দিতে পারতাম না এবং আমার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ভুল ধারণার সৃষ্টি হত। কিন্তু আমি আপনার ও আপনার ভায়ের ভালবাসা জানি; তা-ছাড়া আমার এও জানা ছিল যে, চিকাগো যাবার পথে আমাকে দিন কয়েকের মধ্যেই বোম্বে যেতে হবে। ভেবেছিলাম যে, আপনার ওখানে যাওয়াটা আমার ফেরার পথের জন্য মুলতবী রেখে দেওয়াই উত্তম হবে। আপনি যে মনে করছেন আপনার ভাইরা আমার দেখাশোনা না করায় আমি অপমানিত হয়েছি—এটা আপনার একটা অভিনব আবিষ্কার বটে! আমি তো এ কথা স্বপ্নেও ভাবিনি; অথবা আপনি হয়তো মানুষের মনের কথা জানার বিদ্যা শিখে ফেলেছেন—ভগবান্ জানেন! ঠাট্টা ছেড়ে দিলেও দেওয়ানজী সাহেব, আমার কৌতুকপরায়ণতা ও দুষ্টামি আগের মতই আছে; কিন্তু আপনাকে আমি ঠিক বলছি যে, জুনাগড়ে আমায় যেরূপ দেখেছিলেন আমি এখনও সেই সরল বালকই আছি এবং আপনার প্রতি আমার ভালবাসাও পূর্ববৎই আছে—বরং শতগুণ বর্ধিত হয়েছে; কারণ আপনার ও দক্ষিণদেশের প্রায় সকল দেওয়ানের মধ্যে মনে মনে তুলনা করার সুযোগ আমি পেয়েছি এবং ভগবান্ জানেন, আমি দক্ষিণদেশের প্রত্যেক রাজদরবারে শতমুখে আপনার কিরূপ প্রশংসা করেছি। অবশ্য আমি জানি যে, আপনার সদ্গুণরাশি ধারণা করতে আমি অতি অযোগ্য। এতেও যদি ব্যাপারটার যথেষ্ট ব্যাখ্যা না হয়ে থাকে, তবে আপনাকে অনুনয় করছি যে, আপনি আমাকে পিতার ন্যায় ক্ষমা করুন; আমি আপনার ন্যায় উপকারীর প্রতি কখনও অকৃতজ্ঞ হয়েছি—এই ধারণার কবলে পড়ে আমি যেন উৎপীড়িত না হই। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
পুঃ—আপনার ভায়ের মনে যে ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছে, তা দূর করবার ভার আপনার ওপর দিচ্ছি। আমি যদি স্বয়ং শয়তানও হই, তবু তাঁদের দয়া ও আমার প্রতি বহু প্রকার উপকারের কথা আমি ভুলতে পারি না।
অপর যে দুজন স্বামীজী গতবারে জুনাগড়ে আপনার নিকট গিয়েছিলেন, তাঁদের সম্বন্ধে বক্তব্য এই যে, তাঁরা আমার গুরুভাই এবং তাঁদের একজন আমাদের নেতা। তাঁদের সঙ্গে তিন বৎসর পরে দেখা হয় এবং আমরা সকলে আবু পর্যন্ত একসঙ্গে এসে ওখানেই ওঁদের ছেড়ে এসেছি। আপনার অভিলাষ হলে বোম্বে যাবার পথে আমি তাঁদের নাড়িয়াদে নিয়ে যেতে পারি। ভগবান্ আপনার ও আপনার পরিবারের সকলের মঙ্গল করুন।
বি
৬৬
[শ্রীমতী ইন্দুমতী মিত্রকে লিখিত]
বোম্বে
২৪ মে, ১৮৯৩
কল্যাণীয়াসু,
মা, তোমার ও হরিপদ বাবাজীর পত্র পাইয়া পরম আহ্লাদিত হইলাম। সর্বদা পত্র লিখিতে পারি নাই বলিয়া দুঃখিত হইও না। সর্বদা শ্রীহরির নিকট তোমাদের কল্যাণ প্রার্থনা করিতেছি। বেলগাঁওয়ে এক্ষণে যাইতে পারি না, কারণ ৩১ তারিখে এখান হইতে আমেরিকায় রওনা হইবার সকল বন্দোবস্ত হইয়া গিয়াছে। আমেরিকা ও ইওরোপ পরিভ্রমণ করিয়া আসিয়া প্রভুর ইচ্ছায় পুনরায় তোমাদের দর্শন করিব। সর্বদা শ্রীকৃষ্ণে আত্মসমর্পণ করিবে। সর্বদা মনে রাখিবে যে, প্রভুর হস্তে আমরা পুত্তলিকামাত্র। সর্বদা পবিত্র থাকিবে। কায়মনোবাক্যেও যেন অপবিত্র না হও এবং সদা যথাসাধ্য পরোপকার করিতে চেষ্টা করিবে। মনে রাখিও, কায়মনোবাক্যে পতিসেবা করা স্ত্রীলোকের প্রধান ধর্ম। নিত্য যথাশক্তি গীতাপাঠ করিও। তুমি ইন্দুমতী ‘দাসী’ কেন লিখিয়াছ? ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ‘দেব’ ও ‘দেবী’ লিখিবে, বৈশ্য ও শূদ্রেরা ‘দাস’ ও ‘দাসী’ লিখিবে। অপিচ জাতি ইত্যাদি আধুনিক ব্রাহ্মণ-মহাত্মারা করিয়াছেন। কে কাহার দাস? সকলেই হরির দাস, অতএব আপনাপন গোত্রনাম অর্থাৎ পতির নামের শেষভাগ বলা উচিত, এই প্রাচীন বৈদিক প্রথা, যথা—ইন্দুমতী মিত্র ইত্যাদি। আর কি লিখিব মা, সর্বদা জানিবে যে, আমি নিরন্তর তোমাদের কল্যাণ প্রার্থনা করিতেছি। প্রভুর নিকট প্রার্থনা করি, তুমি শীঘ্রই পুত্রবতী হও। আমেরিকা হইতে সেখানকার আশ্চর্যবিবরণপূর্ণ পত্র আমি মধ্যে মধ্যে তোমায় লিখিব। এক্ষণে আমি বোম্বেতে আছি। ৩১ তারিখ পর্যন্ত থাকিব। খেতড়ি মহারাজার প্রাইভেট সেক্রেটারী আমায় জাহাজে তুলিয়া দিতে আসিয়াছেন। কিমধিকমিতি—
আশীর্বাদক
সচ্চিদানন্দ
৬৭*
ওরিয়েণ্টাল হোটেল
ইয়োকোহামা
১০ জুলাই, ১৮৯৩
প্রিয় আলাসিঙ্গা, বালাজী, জি. জি. ও অন্যান্য মান্দ্রাজী বন্ধুগণ,
আমার গতিবিধি সম্বন্ধে তোমাদের সর্বদা খবর দেওয়া আমার উচিত ছিল, আমি তা করিনি, সেজন্য আমায় ক্ষমা করবে। এরূপ দীর্ঘ ভ্রমণে প্রত্যহই বিশেষ ব্যস্ত হয়ে থাকতে হয়। বিশেষতঃ আমার তো কখনও নানা জিনিষপত্র সঙ্গে নিয়ে ঘোরা অভ্যাস ছিল না। এখন এই সব যা সঙ্গে নিতে হয়েছে, তার তত্ত্বাবধানেই আমার সব শক্তি খরচ হচ্ছে। বাস্তবিক, এ এক বিষম ঝঞ্ঝাট!
বম্বাই ছেড়ে এক সপ্তাহের মধ্যে কলম্বো পৌঁছলাম। জাহাজ প্রায় সারাদিন বন্দরে ছিল। এই সুযোগ আমি নেমে শহর দেখতে গেলাম। গাড়ী করে কলম্বোর রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলাম। সেখানকার কেবল বুদ্ধ-ভগবানের মন্দিরটির কথা আমার স্মরণ আছে; তথায় বুদ্ধদেবের এক বৃহৎ পরিনির্বাণ-মূর্তি শয়ান অবস্থায় রয়েছে। মন্দিরের পুরোহিতগণের সহিত আলাপ করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাঁরা সিংহলী ভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষা জানেন না বলে আমাকে আলাপের চেষ্টা ত্যাগ করতে হল। ওখান থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে সিংহলের মধ্যদেশে অবস্থিত কাণ্ডি শহর সিংহলী বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্র, কিন্তু আমার সেখানে যাবার সময় ছিল না। এখানকার গৃহস্থ বৌদ্ধগণ—কি পুরুষ কি স্ত্রী—সকলেই মৎস্যমাংস-ভোজী, কেবল পুরোহিতগণ নিরামিষাশী। সিংহলীদের পরিচ্ছদ ও চেহারা তোমাদের মান্দ্রাজীদেরই মত। তাদের ভাষা সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না; তবে উচ্চারণ শুনে বোধ হয়, উহা তোমাদের তামিলের অনুরূপ।
পরে জাহাজ পিনাঙে লাগল; উহা মালয় উপদ্বীপে সমুদ্রের উপরে একটি ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ড মাত্র। উহা খুব ক্ষুদ্র শহর বটে, কিন্তু অন্যান্য সুনির্মিত নগরীর ন্যায় খুব পরিষ্কার-ঝরিষ্কার। মালয়বাসিগণ সবই মুসলমান। প্রাচীনকালে এরা ছিল সওদাগরি জাহাজসমূহের বিশেষ ভীতির কারণ—বিখ্যাত জলদস্যু। কিন্তু এখনকার বুরুজওয়ালা যুদ্ধজাহাজের প্রকাণ্ড কামানের চোটে মালয়বাসিগণ অপেক্ষাকৃত কম হাঙ্গামার কাজ করতে বাধ্য হয়েছে।
পিনাং থেকে সিঙ্গাপুর চললাম। পথে দূর হতে উচ্চশৈল-সমন্বিত সুমাত্রা দেখতে পেলাম; আর কাপ্তেন আমাকে প্রাচীনকালে জলদস্যুগণের কয়েকটি আড্ডা অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখাতে লাগলেন। সিঙ্গাপুর প্রণালী-উপনিবেশের (Straits Settlement) রাজধানী। এখানে একটি সুন্দর উদ্ভিদ্-উদ্যান আছে, তথায় অনেক জাতীয় ভাল ভাল ‘পাম’ সংগৃহীত। ‘ভ্রমণকারীর পাম’ (Traveller’s Palm) নামক সুন্দর তালবৃন্তবৎ পাম এখানে অপর্যাপ্ত জন্মায়, আর ‘রুটিফল’ (bread fruits) বৃক্ষ তো এখানে সর্বত্র। মান্দ্রাজে যেমন আম অপর্যাপ্ত, এখানে তেমন বিখ্যাত ম্যাঙ্গোষ্টিন অপর্যাপ্ত, তবে আমের সঙ্গে আর কিসের তুলনা হতে পারে? এখানকার লোকে মান্দ্রাজীদের অর্ধেক কালোও হবে না, যদিও এ স্থান মান্দ্রাজ অপেক্ষা বিষুবরেখার নিকটবর্তী। এখানে একটি সুন্দর যাদুঘরও (Museum) আছে। এখানে পানদোষ ও লাম্পট্য বেশী মাত্রায় বিরাজমান, এটাই এখানকার ইওরোপীয় ঔপনিবেশিকগণের যেন প্রথম কর্তব্য। আর প্রত্যেক বন্দরেই জাহাজের প্রায় অর্ধেক নাবিক নেমে এরূপ স্থানের অন্বেষণ করে, যেখানে সুরা ও সঙ্গীতের প্রভাবে নরক রাজত্ব করে। থাক সে কথা।
তারপর হংকং। সিঙ্গাপুর মালয় উপদ্বীপের অন্তর্গত হলেও সেখান থেকেই মনে হয় যেন চীনে এসেছি—চীনের ভাব সেখানে এতই প্রবল। সকল মজুরের কাজ, সকল ব্যবসা-বাণিজ্য বোধ হয় তাদেরই হাতে। আর হংকং তো খাঁটি চীন; যাই জাহাজ কিনারায় নোঙর করে, অমনি শত শত চীনে নৌকা এসে ডাঙায় নিয়ে যাবার জন্য তোমায় ঘিরে ফেলবে। এই নৌকাগুলো একটু নূতন রকমের—প্রত্যেকটিতে দুটি করে হাল। মাঝিরা সপরিবারে নৌকাতেই বাস করে। প্রায়ই দেখা যায়, মাঝিরা স্ত্রীই হালে বসে থাকে, একটি হাল দু হাত দিয়ে ও অপর হাল এক পা দিয়ে চালায়। আর দেখা যায় যে, শতকরা নব্বই জনের পিঠে একটি কচি ছেলে এরূপভাবে একটি থলির মত জিনিষ দিয়ে বাঁধা থাকে, যাতে সে হাত-পা অনায়াসে খেলাতে পারে। চীনে-খোকা কেমন মায়ের পিঠে সম্পূর্ণ শান্তভাবে ঝুলে আছে, আর ওদিকে মা—কখনও তাঁর সব শক্তি প্রয়োগ করে নৌকা চালাচ্ছেন, কখনও ভারী ভারী বোঝা ঠেলছেন, অথবা অদ্ভুত তৎপরতার সঙ্গে এক নৌকা থেকে অপর নৌকায় লাফিয়ে যাচ্ছেন—এ এক বড় মজার দৃশ্য! আর এত নৌকা ও ষ্টীম-লঞ্চ ভীড় করে ক্রমাগত আসছে যাচ্ছে যে, প্রতিমুহূর্তে চীনে-খোকার টিকি-সমেত ছোট মাথাটি একেবারে গুঁড়ো হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে; খোকার কিন্তু সে দিকে খেয়ালই নেই। তার পক্ষে এই মহাব্যস্ত কর্মজীবনের কোন আকর্ষণ নাই। তার পাগলের মত ব্যস্ত মা মাঝে মাঝে তাকে দু-এক খানা চালের পিঠে দিচ্ছেন, সে ততক্ষণ তার গঠনতন্ত্র (anatomy) জেনেই সন্তুষ্ট।
চীনে-খোকা একটি রীতিমত দার্শনিক। যখন ভারতীয় শিশু হামাগুড়ি দিতেও অক্ষম, এমন বয়সে সে স্থিরভাবে কাজ করতে যায়। সে বিশেষরূপেই প্রয়োজনীয়তার দর্শন শিখেছে। চীন ও ভারতবাসী যে ‘মমিতে’ পরিণতপ্রায় এক প্রাণহীন সভ্যতার স্তরে আটকে পড়েছে, অতি দারিদ্র্যই তার অন্যতম কারণ। সাধারণ হিন্দু বা চীনবাসীর পক্ষে তার প্রাত্যহিক অভাব এতই ভয়ানক যে, তাকে আর কিছু ভাববার অবসর দেয় না।
হংকং অতি সুন্দর শহর—পাহাড়ের ঢালুর উপর নির্মিত; পাহাড়ের উপরেও অনেক বড়লোক বাস করে; ইহা শহর অপেক্ষা অনেক ঠাণ্ডা। পাহাড়ের উপরে প্রায় খাড়াভাবে ট্রাম-লাইন গিয়েছে; তারের দড়ির সংযোগে এবং বাষ্পীয় বলে ট্রামগুলি উপরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।
আমরা হংকঙে তিন দিন ছিলাম। সেখানে থেকে ক্যাণ্টন দেখতে গিয়েছিলাম, হংকং থেকে একটি নদী ধরে ৮০ মাইল উজিয়ে ক্যাণ্টনে যেতে হয়। নদীটি এত চওড়া যে, খুব বড় বড় জাহাজ পর্যন্ত যেতে পারে। অনেকগুলো চীনে জাহাজ হংকং ও ক্যাণ্টনের মধ্যে যাতায়াত করে। আমরা বিকেলে একখানি জাহাজে চড়ে পরদিন প্রাতে ক্যাণ্টনে পৌঁছলাম। প্রাণের স্ফূর্তি ও কর্মব্যস্ততা মিলে এখানে কি হইচই! নৌকার ভীড়ই বা কি! জল যেন ছেয়ে ফেলেছে! এ শুধু মাল ও যাত্রী নিয়ে যাবার নৌকা নয়, হাজার হাজার নৌকা রয়েছে গৃহের মত বাসোপযোগী। তাদের মধ্যে অনেকগুলো অতি সুন্দর, অতি বৃহৎ। বাস্তবিক সেগুলো দুতলা তেতলা বাড়ীর মত, চারিদিকে বারাণ্ডা রয়েছে, মধ্যে দিয়ে রাস্তা গেছে; কিন্তু সব জলে ভাসছে!!
আমরা যেখানে নামলাম, সেই জায়গাটুকু চীন গভর্ণমেণ্ট বৈদেশিকদের বাস করবার জন্য দিয়েছেন; এর চতুর্দিকে, নদীর উভয় পার্শ্বে অনেক মাইল জুড়ে এই বৃহৎ শহর অবস্থিত—এখানে অগণিত মানুষ বাস করছে, জীবন-সংগ্রামে একজন আর একজনকে ঠেলে ফেলে চলেছে—প্রাণপণে জীবন-সংগ্রামে জয়ী হবার চেষ্টা করছে। মহা কলরব—মহা ব্যস্ততা! কিন্তু এখানকার অধিবাসিসংখ্যা যতই হোক, এখানকার কর্মপ্রবণতা যতই হোক, এর মত ময়লা শহর আমি দেখিনি। তবে ভারতবর্ষের কোন শহরকে যে হিসেবে আবর্জনাপূর্ণ বলে, সে হিসেবে বলছি না, চীনেরা তো এতটুকু ময়লা পর্যন্ত বৃথা নষ্ট হতে দেয় না; চীনেদের গা থেকে যে বিষম দুর্গন্ধ বেরোয়, তার কথাই বলছি, তারা যেন ব্রত নিয়েছে, কখনও স্নান করবে না।
প্রত্যেক বাড়ীখানি এক একখানি দোকান—লোকেরা উপরাতলায় বাস করে। রাস্তাগুলো এত সরু যে, চলতে গেলেই দুধারের দোকান যেন গায়ে লাগে। দশ পা চলতে না চলতে মাংসের দোকান দেখতে পাবে; এমন দোকানও আছে, যেখানে কুকুর-বেড়ালের মাংস বিক্রয় হয়। অবশ্য খুব গরীবেরাই কুকুর-বেড়াল খায়।
আর্যাবর্তনিবাসিনী হিন্দু মহিলাদের যেমন পর্দা আছে, তাদের যেমন কেউ কখনও দেখতে পায় না, চীনা মহিলাদেরও তদ্রূপ। অবশ্য শ্রমজীবী স্ত্রীলোকেরা লোকের সামনে বেরোয়। এদের মধ্যেও দেখা যায়, এক একটি স্ত্রীলোকের পা তোমাদের ছোট খোকার পায়ের চেয়ে ছোট; তারা হেঁটে বেড়াচ্ছে ঠিক বলা যায় না. খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে থপ থপ করে চলছে।
আমি কতকগুলি চীনে মন্দির দেখতে গেলাম। ক্যাণ্টনে যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ মন্দিরটি আছে, তা প্রথম বৌদ্ধ সম্রাট্ এবং সর্বপ্রথম ৫০০ জন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর স্মরণার্থে উৎসর্গীকৃত। অবশ্য স্বয়ং বুদ্ধদেব প্রধান মূর্তি; তাঁর নীচেই সম্রাট্ বসেছেন, আর দুধারে শিষ্যগণের মূর্তি—সব মূর্তিগুলিই কাঠে সুন্দররূপে খোদিত।
ক্যাণ্টন হতে আমি হংকঙে ফিরলাম। সেখান থেকে জাপানে গেলাম। নাগাসাকি বন্দরে প্রথমেই কিছুক্ষণের জন্য আমাদের জাহাজ লাগল। আমরা কয়েক ঘণ্টার জন্য জাহাজ থেকে নেমে শহরের মধ্যে গাড়ী করে বেড়ালাম। চীনের সহিত কি প্রভেদ! পৃথিবীর মধ্যে যত পরিষ্কার জাত আছে, জাপানীরা তাদের অন্যতম। এদের সবই কেমন পরিষ্কার! রাস্তাগুলো প্রায় সবই চওড়া সিধে ও বরাবর সমানভাবে বাঁধানো। খাঁচার মত এদের ছোট ছোট দিব্যি বাড়ীগুলো, প্রায় প্রতি শহর ও পল্লীর পশ্চাতে অবস্থিত চিড়গাছে ঢাকা চিরহরিৎ ছোট ছোট পাহাড়গুলো, বেঁটে সুন্দরকায় অদ্ভুত-বেশধারী জাপ, তাদের প্রত্যেক চালচলন অঙ্গভঙ্গী হাবভাব—সবই ছবির মত। জাপান ‘সৌন্দর্যভূমি’। প্রায় প্রত্যেক বাড়ীর পেছনে এক-একখানি বাগান আছে—তা জাপানী ফ্যাশনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুল্মতৃণাচ্ছাদিত ভূমিখণ্ড, ছোট ছোট কৃত্রিম জলপ্রণালী এবং পাথরের সাঁকো দিয়ে ভালরূপে সাজান।
নাগাসাকি থেকে কোবি গেলাম। কোবি গিয়ে জাহাজ ছেড়ে দিলাম, স্থলপথে ইয়োকোহামায় এলাম—জাপানের মধ্যবর্তী প্রদেশসমূহ দেখবার জন্য। আমি জাপানের মধ্যপ্রদেশে তিনটি বড় বড় শহর দেখেছি। ওসাকা—এখানে নানা শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত হয়; কিয়োটা—প্রাচীন রাজধানী; টোকিও—বর্তমান রাজধানী; টোকিও কলিকাতার প্রায় দ্বিগুণ হবে। লোকসংখ্যাও প্রায় কলিকাতার দ্বিগুণ।
ছাড়পত্র ছাড়া বিদেশীকে জাপানের ভিতরে ভ্রমণ করতে দেয় না।
দেখে বোধ হয়—জাপানীরা বর্তমানকালে কি প্রয়োজন, তা বুঝেছে; তারা সম্পূর্ণরূপে জাগরিত হয়েছে। ওদের সম্পূর্ণরূপে শিক্ষিত ও সুনিয়ন্ত্রিত স্থল-সৈন্য আছে। ওদের যে কামান আছে, তা ওদেরই একজন কর্মচারী আবিষ্কার করেছেন। সকলেই বলে, উহা কোন জাতির কামানের চেয়ে কম নয়। আর তারা তাদের নৌবলও ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে। আমি একজন জাপানী স্থপতি-নির্মিত প্রায় এক মাইল লম্বা সকটি সুড়ঙ্গ (tunnel) দেখেছি।
এদের দেশলাই-এর কারখানা একটা দেখবার জিনিষ। এদের যে-কোন জিনিষের অভাব, তাই নিজের দেশে করবার চেষ্টা করছে। জাপানীদের নিজেদের একটি ষ্টীমার লাইনের জাহাজ চীন ও জাপানের মধ্যে যাতায়াত করে; আর এরা শীঘ্রই বোম্বাই ও ইয়োকোহামার মধ্যে জাহাজ চালাবে, মতলব করছে।
আমি এদের অনেকগুলি মন্দির দেখলাম। প্রত্যেক মন্দির কতকগুলি সংস্কৃত মন্ত্র প্রাচীন বাঙলা অক্ষরে লেখা আছে। মন্দিরে পুরোহিতদের মধ্যে অল্প কয়েকজন সংস্কৃত বোঝে। কিন্তু এরা বেশ বুদ্ধিমান্। বর্তমানকালে সর্বত্রই যে একটা উন্নতির জন্য প্রবল তৃষ্ণা দেখা যায়, তা পুরোহিতদের মধ্যেও প্রবেশ করেছে। জাপানীদের সম্বন্ধে আমার মনে কত কথা উদিত হচ্ছে, তা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠির মধ্যে প্রকাশ করে বলতে পারি না। তবে এইটুকু বলতে পারি যে, আমাদের দেশের যুবকেরা দলে দলে প্রতি বৎসর চীন ও জাপানে যাক। জাপানে যাওয়া আবার বিশেষ দরকার; জাপানীদের কাছে ভারত এখনও সর্বপ্রকার উচ্চ ও মহৎ পদার্থের স্বপ্নরাজ্যস্বরূপ।
আর তোমরা কি করছ? সারা জীবন কেবল বাজে বকছ। এস, এদের দেখে যাও, তারপর যাও—গিয়ে লজ্জায় মুখ লুকাও গে। ভারতের যেন জরাজীর্ণ অবস্থা হয়ে ভীমরতি ধরছে! তোমরা—দেশ ছেড়ে বাইরে গেলে তোমাদের জাত যায়!! এই হাজার বছরের ক্রমবর্ধমান জমাট কুসংস্কারের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বসে আছ, হাজার বছর ধরে খাদ্যাখাদ্যের শুদ্ধাশুদ্ধতা বিচার করে শক্তিক্ষয় করছ! পৌরোহিত্যরূপ আহাম্মকির গভীর ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাচ্ছ! শত শত যুগের অবিরাম সামাজিক অত্যাচারে তোমাদের সব মনুষ্যত্বটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে—তোমরা কী বল দেখি? আর তোমরা এখন করছই বা কি? আহাম্মক, তোমরা বই হাতে করে সমুদ্রের ধারে পায়চারি করছ! ইওরোপীয় মস্তিস্কপ্রসূত কোন তত্ত্বের এক কণামাত্র—তাও খাঁটি জিনিষ নয়—সেই চিন্তার বদহজম খানিকটা ক্রমাগত আওড়াচ্ছ, আর তোমাদের প্রাণমন সেই ৩০৲ টাকার কেরানিগিরির দিকে পড়ে রয়েছে; না হয় খুব জোর একটা দুষ্ট উকিল হবার মতলব করছ। ইহাই ভারতীয় যুবকগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা। আবার প্রত্যেক ছাত্রের আশেপাশে একপাল ছেলে—তাঁর বংশধরগণ—‘বাবা, খাবার দাও, খাবার দাও’ করে উচ্চ চীৎকার তুলেছে!! বলি, সমুদ্রে কি জলের অভাব হয়েছে যে, তোমাদের বই, গাউন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা প্রভৃতি সমেত তোমাদের ডুবিয়ে ফেলতে পারে না?
এস, মানুষ হও। প্রথমে দুষ্ট পুরুতগুলোকে দূর করে দাও। কারণ এই মস্তিষ্কহীন লোকগুলো কখনও শুধরোবে না। তাদের হৃদয়ের কখনও প্রসার হবে না। শত শত শতাব্দীর কুসংস্কার ও অত্যাচারের ফলে তাদের উদ্ভব; আগে তাদের নির্মূল কর। এস, মানুষ হও। নিজেদের সংকীর্ণ গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে গিয়ে দেখ, সব জাতি কেমন উন্নতির পথে চলেছে। তোমরা কি মানুষকে ভালবাসো? তোমরা কি দেশকে ভালবাসো? তা হলে এস, আমরা ভাল হবার জন্য—উন্নত হবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি। পেছনে চেও না—অতি প্রিয় আত্মীয়স্বজন কাঁদুক; পেছনে চেও না, সামনে এগিয়ে যাও।
ভারতমাতা অন্ততঃ সহস্র যুবক বলি চান। মনে রেখো—মানুষ চাই, পশু নয়। প্রভু তোমাদের এই বাঁধাধরা সভ্যতা ভাঙবার জন্য ইংরেজ গভর্ণমেণ্টকে প্রেরণ করেছেন, আর মান্দ্রাজের লোকই ইংরেজদের ভারতে বসবার প্রধান সহায় হয়। এখন জিজ্ঞাসা করি, সমাজের এই নূতন অবস্থা আনবার জন্য সর্বান্তঃকরণে প্রাণপণ যত্ন করবে, মান্দ্রাজ এমন কতকগুলি নিঃস্বার্থ যুবক দিতে কি প্রস্তুত—যারা দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হবে, তাদের ক্ষুধার্তমুখে অন্ন দান করবে, সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করবে, আর তোমাদের পূর্বপুরুষগণের অত্যাচার যারা পশুপদবীতে উপনীত হয়েছে, তাদের মানুষ করবার জন্য আমরণ চেষ্টা করবে?
… কুক কোম্পানী, চিকাগো—এই ঠিকানায় আমাকে পত্র লিখবে।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—ধীর, নিস্তব্ধ অথচ দৃঢ়ভাবে কাজ করতে হবে। খবরের কাগজে হুজুক করা নয়। সর্বদা মনে রাখবে, নামযশ আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
বি
৬৮*
ব্রিজি মেডোজ
মেটকাফ, মাসাচুসেটস
২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
কাল তোমার পত্র পাইলাম। তুমি বোধ হয় এত দিনে জাপান হইতে [লেখা] আমার পত্র পাইয়াছ। জাপান হইতে আমি বঙ্কুবরে৩১ (Vancouver) পৌঁছিলাম। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরাংশ দিয়া আমাকে যাইতে হইয়াছিল। খুব শীত ছিল। গরম কাপড়ের অভাবে বড় কষ্ট পাইতে হইয়াছিল। যাহা হউক, কোনরূপে বঙ্কুবরে পৌঁছিয়া তথা হইতে কানাডা দিয়া চিকাগোয় পৌঁছিলাম। তথায় আন্দাজ বার দিন রহিলাম। এখানে প্রায় প্রতিদিনই মেলা দেখিতে যাইতাম। সে এক বিরাট ব্যাপার। অন্ততঃ দশ দিন না ঘুরিলে সমুদয় দেখা অসম্ভব। বরদা রাও যে মহিলাটির সঙ্গে আমার আলাপ করাইয়া দিয়াছিলেন, তিনি ও তাঁহার স্বামী চিকাগো সমাজের মহা গণামান্য ব্যক্তি। তাঁহারা আমার প্রতি খুব সদ্ব্যবহার করিয়াছিলেন। কিন্তু এখানকার লোকে বিদেশীকে খুব যত্ন করিয়া থাকে, কেবল অপরকে তামাসা দেখাইবার জন্য; অর্থসাহায্য করিবার সময় প্রায় সকলেই হাত গুটাইয়া লয়। এবার এখানে বড় দুর্বৎসর, ব্যবসায়ে সকলেরই ক্ষতি হইতেছে, সুতরাং আমি চিকাগোয় অধিক দিন রহিলাম না। চিকাগো হইতে আমি বষ্টনে আসিলাম। লালুভাই বষ্টন পর্যন্ত আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনিও আমার প্রতি খুব সহৃদয় ব্যবহার করিয়াছিলেন। …
এখানে আমার খরচ ভয়ানক হইতেছে। তোমার স্মরণ আছে তুমি আমায় ১৭০ পাউণ্ড নোট ও নগদ ৯ পাউণ্ড দিয়াছিলেন। এখন দাঁড়াইয়াছে ১৩০ পাউণ্ড। গড়ে আমার এক পাউণ্ড করিয়া প্রত্যহ খরচ পড়িতেছে। এখানে একটা চুরুটের দামই আমাদের দেশের আট আনা। আমেরিকানরা এত ধনী যে, তাহারা জলের মত টাকা খরচ করে, আর তাহারা আইন করিয়া সব জিনিষের মূল্য এত বেশী রাখিয়াছে যে, জগতের অপর কোন জাতি যেন কোনমতে এ দেশে ঘেঁষিতে না পারে। সাধারণ কুলি গড়ে প্রতিদিন ৯৲।১০৲ টাকা করিয়া রোজগার করে ও উহা খরচ করিয়া থাকে। এখানে আসিবার পূর্বে যে-সব সোনার স্বপন দেখিতাম, তাহা ভাঙিয়াছে। এক্ষণে অসম্ভবের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে হইতেছে। শত শত বার মনে হইয়াছে, এ দেশ হইতে চলিয়া যাই; কিন্তু আবার মনে হয়, আমি একগুঁয়ে দানা, আর আমি ভগবানের নিকট আদেশ পাইয়াছি। আমি কোন পথ দেখিতে পাইতেছি না, কিন্তু তাঁহার চক্ষু তো সব দেখিতেছে। মরি বাঁচি, উদ্দেশ্য ছাড়িতেছি না।
তুমি অনুগ্রহপূর্বক থিওজফিষ্টদের সম্বন্ধে আমাকে যে সাবধান করিয়াছ, তাহা ছেলেমানুষি বলিয়া বোধ হয়। এ গোঁড়া খ্রীষ্টানের দেশ—এখানে কেহ উহাদের খোঁজ খবর রাখে না বলিলেই হয়। এখনও পর্যন্ত কোন থিওজফিষ্টের সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই, আর দু-এক বার অপরকে—কথাপ্রসঙ্গে উহাদের বিষয় অতিশয় ঘৃণার সহিত উল্লেখ করিতে শুনিয়াছি। আমেরিকানরা উহাদিগকে জুয়াচোর বলিয়া মনে করে।
আমি এক্ষণে বষ্টনের এক গ্রামে এক বৃদ্ধা মহিলার অতিথিরূপে বাস করিতেছি। ইঁহার সহিত রেলগাড়ীতে হঠাৎ আলাপ হয়। তিনি আমাকে নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহার নিকট রাখিয়াছেন। এখানে থাকায় আমার এই সুবিধা হইয়াছে যে, প্রত্যহ এক পাউণ্ড করিয়া যে খরচ হইতেছিল, তাহা বাঁচিয়া যাইতেছে; আর তাঁহার লাভ এই যে, তিনি তাঁহার বন্ধুগণকে নিমন্ত্রণ করিয়া ভারতাগত এক অদ্ভুত জীব দেখাইতেছেন!!! এ সব যন্ত্রণা সহ্য করিতে হইবেই। আমাকে এখন অনাহার, শীত, অদ্ভুত পোষাকের দরুন রাস্তার লোকের বিদ্রূপ—এইগুলির সহিত যুদ্ধ করিয়া চলিতে হইতেছে। প্রিয় বৎস! জানিবে, কোন বড় কাজই গুরুতর পরিশ্রম ও কষ্টস্বীকার ব্যতীত হয় নাই। আমার মহিলাবন্ধুর এক জ্ঞাতিভাই আজ আমাকে দেখিতে আসিবেন। তিনি তাঁহার ভগিনীকে লিখিতেছেন, ‘প্রকৃত হিন্দু সাধককে দেখিয়া বিশেষ আনন্দ ও শিক্ষা হইতে পারে সন্দেহ নাই, তবে আমি এখন বুড়া হইয়াছি। এসোটেরিক বৌদ্ধগণ আমাকে আর ঠকাইতে পারিতেছে না।’ এই তো এখানে থিয়োজফির প্রভাব এবং উহার প্রতি ইহাদের শ্রদ্ধা! ‘মো—’র এক সময় বষ্টনের একটি খুব ধনী মহিলার কাছে বিশেষ খাতির ছিল, কিন্তু ‘মো-’র দরুনই বিশেষ উহাদের সব পসার মাটি হইয়াছে। এখন উক্ত মহিলা ‘এসোটেরিক বৌদ্ধধর্ম’ ও ঐরূপ সমুদয় ব্যাপারের প্রবল শত্রু হইয়া দাঁড়াইয়াছেন।
জানিয়া রাখো, এই দেশ খ্রীষ্টানের দেশ। এখানে আর কোন ধর্ম বা মতের প্রতিষ্ঠা কিছুমাত্র নাই বলিলেই হয়। আমি জগতে কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার ভয় করি না। আমি এখানে মেরী-তনয়ের সন্তানগণের মধ্যে বাস করিতেছি; প্রভু ঈশাই আমাকে সাহায্য করিবেন। একটি জিনিষ দেখিতে পাইতেছি; ইঁহারা আমার হিন্দুধর্মসম্বন্ধীয় উদার মত ও নাজারেথের অবতারের প্রতি ভালবাসা দেখিয়া খুব আকৃষ্ট হইতেছেন। আমি তাঁহাদিগকে বলিয়া থাকি যে, আমি সেই গালিলীয় মহাপুরুষের বিরুদ্ধে কিছুমাত্র বলি না, কেবল তাঁহারা যেমন যীশুকে মানেন, সেই সঙ্গে ভারতীয় মহাপুরুষগণকেও মানা উচিত। এ কথা ইঁহারা আদরপূর্বক গ্রহণ করিতেছেন। এখন আমার কার্য এইটুকু হইয়াছে যে, লোকে আমার সম্বন্ধে কতকটা জানিতে পারিয়াছে ও বলাবলি করিতেছে। এখানে এইরূপেই কার্য আরম্ভ করিতে হইবে। ইহাতে দীর্ঘ সময় ও অর্থের প্রয়োজন। এখন শীত আসিতেছে। আমাকে সকল রকম গরম কাপড় যোগাড় করিতে হইবে, আবার এখানকার অধিবাসী অপেক্ষা আমাদের অধিক কাপড়ের আবশ্যক হয়। … বৎস! সাহস অবলম্বন কর। ভগবানের ইচ্ছায় ভারতে আমাদের দ্বারা বড় বড় কার্য সম্পন্ন হইবে। বিশ্বাস কর, আমরাই মহৎ কর্ম করিব, এই গরীব আমরা—যাহাদের লোকে ঘৃণা করে, কিন্তু যাহারা লোকের দুঃখ যথার্থ প্রাণে প্রাণে বুঝিয়াছে। রাজারাজড়াদের দ্বারা মহৎ কার্য হইবার আশা অতি অল্প।
চিকাগোয় সম্প্রতি একটা বড় মজা হইয়া গিয়াছে। কপুরতলার রাজা এখানে আসিয়াছিলেন, আর চিকাগো সমাজের কতকাংশ তাঁহাকে কেষ্ট-বিষ্টু করিয়া তুলিয়াছিল। মেলার জায়গায় এই রাজার সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছিল, কিন্তু তিনি বড় লোক, আমার মত ফকিরের সঙ্গে কথা কহিবেন কেন? এখানে একটি পাগলাটে, ধুতিপরা মারাঠী ব্রাহ্মণ মেলায় কাগজের উপর নখের সাহায্যে প্রস্তুত ছবি বিক্রয় করিতেছিল। এ লোকটা খবরের কাগজের রিপোর্টারদের নিকট রাজার বিরুদ্ধে নানা কথা বলিয়াছিল; সে বলিয়াছিল—এ ব্যক্তি খুব নীচ জাতি, এই রাজারা ক্রীতদাসস্বরূপ, ইহারা দুর্নীতিপরায়ণ ইত্যাদি; আর এই সত্যবাদী (?) সম্পাদকেরা—যাহার জন্য আমেরিকা বিখ্যাত—এই লোকটার কথায় কিছু গুরুত্ব-আরোপের ইচ্ছায় তার পরদিন সংবাদপত্রে বড় বড় স্তম্ভ বাহির করিল, তাহারা ভারতাগত একজন জ্ঞানী পুরুষের বর্ণনা করিল—অবশ্য আমাকেই লক্ষ্য করিয়াছিল। আমাকে স্বর্গে তুলিয়া দিয়া আমার মুখ দিয়া তাহারা এমন সকল কথা বাহির করিল, যাহা আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবি নাই; তারপর এই রাজার সম্বন্ধে মারাঠী ব্রাহ্মণটি যাহা যাহা বলিয়াছিল, সব আমার মুখে বসাইল। আর তাহাতেই চিকাগো সমাজ একটা ধাক্কা খাইয়া তাড়াতাড়ি রাজাকে পরিত্যাগ করিল। এই মিথ্যাবাদী সম্পাদকেরা আমাকে দিয়া আমার দেশের লোককে বেশ ধাক্কা দিলেন। যাহা হউক—ইহাতে বুঝা যাইতেছে যে, এই দেশে টাকা অথবা উপাধির জাঁকজমক অপেক্ষা বুদ্ধির আদর বেশী।
কাল নারী-কারাগারের অধ্যক্ষা মিসেস্ জন্সন্ মহোদয়া এখানে আসিয়াছিলেন; এখানে কারাগার বলে না, বলে—সংশোধনাগার। আমেরিকায় যাহা যাহা দেখিলাম, তাহার মধ্যে ইহা এক অতি অদ্ভুত জিনিষ। কারাবাসিগণের সহিত কেমন সহৃদয় ব্যবহার করা হয়, কেমন তাহাদের চরিত্র সংশোধিত হয়, আবার তাহারা ফিরিয়া গিয়া সমাজের আবশ্যকীয় অঙ্গরূপে পরিণত হয়! কি অদ্ভুত, কি সুন্দর! না দেখিলে তোমাদের বিশ্বাস হইবে না। ইহা দেখিয়া তারপর যখন দেশের কথা ভাবিলাম, তখন আমার প্রাণ অস্থির হইয়া উঠিল। ভারতবর্ষে আমরা গরীবদের, সামান্য লোকদের, পতিতদের কি ভাবিয়া থাকি! তাহাদের কোন উপায় নাই, পালাইবার কোন রাস্তা নাই, উঠিবার কোন উপায় নাই। ভারতের দরিদ্র, ভারতের পতিত, ভারতের পাপিগণের সাহায্যকারী কোন বন্ধু নাই। সে যতই চেষ্টা করুক, তাহার উঠিবার উপায় নাই। তাহারা দিন দিন ডুবিয়া যাইতেছে। রাক্ষসবৎ নৃশংস সমাজ তাহাদের উপর ক্রমাগত যে আঘাত করিতেছে, তাহার বেদনা তাহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছে, কিন্তু তাহারা জানে না—কোথা হইতে ঐ আঘাত আসিতেছে। তাহারাও যে মানুষ, ইহা তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে। ইহার ফল দাসত্ব ও পশুত্ব। চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ কিছুদিন হইতে সমাজের এই দুরবস্থা বুঝিয়াছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁহারা হিন্দুধর্মের ঘাড়ে এই দোষ চাপাইয়াছেন। তাঁহারা মনে করেন, জগতের মধ্যে এই মহত্তর ধর্মের নাশই সমাজের উন্নতির একমাত্র উপায়। শোন বন্ধু, প্রভুর কৃপায় আমি ইহার রহস্য আবিষ্কার করিয়াছি। হিন্দুধর্মের কোন দোষ নাই। হিন্দুধর্ম তো শিখাইতেছেন—জগতে যত প্রাণী আছে, সকলেই তোমার আত্মারই বহু রূপ মাত্র। সমাজের এই হীনাবস্থার কারণ, কেবল এই তত্ত্বকে কার্যে পরিণত না করা, সহানুভূতির অভাব, হৃদয়ের অভাব। প্রভু তোমাদের নিকট বুদ্ধরূপে আসিয়া শিখাইলেন তোমাদিগকে গরীবের জন্য, দুঃখীর জন্য, পাপীর জন্য প্রাণ কাঁদাইতে, তাহাদের সহিত সহানুভূতি করিতে; কিন্তু তোমরা তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিলে না। তোমাদের পুরোহিতগণ—ভগবান্ ভ্রান্তমত-প্রচার দ্বারা অসুরদিগকে মোহিত করিতে আসিয়াছিলেন, এই ভয়ানক গল্প বানাইলেন। সত্য বটে, কিন্তু অসুর আমরা; যাহারা বিশ্বাস করিয়াছিল, তাহারা নহে। আর যেমন য়াহুদীরা প্রভু যীশুকে অস্বীকার করিয়া আজ সমগ্র জগতে গৃহশূন্য ভিক্ষুক হইয়া সকলের দ্বারা অত্যাচারিত ও বিতাড়িত হইয়া বেড়াইতেছে, সেইরূপ তোমরাও যে-কোন জাতি ইচ্ছা করিতেছে, তাহাদেরই ক্রীতদাস হইতেছ। অত্যাচারিগণ! তোমরা জান না যে, অত্যাচার ও দাসত্ব এক জিনিষেরই এপিঠ ওপিঠ। দুই-ই এক কথা।
বালাজী ও জি.জি-র স্মরণ থাকিতে পারে, একদিন সায়ংকালে পণ্ডিচেরীতে এক পণ্ডিতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে তর্কবিতর্ক হইতেছিল। তাহার সেই বিকট ভঙ্গী ও তাহার ‘কদাপি ন’ (কখনও না)—এই কথা চিরকাল আমার স্মরণ থাকিবে। ইহাদের অজ্ঞতার গভীরতা দেখিয়া অবাক হইতে হয়। তাহারা জানে না, ভারত জগতের এক অতি ক্ষুদ্র অংশ, আর সমুদয় জগৎ এই ত্রিশ কোটি লোককে অতি ঘৃণার চক্ষে দেখিয়া থাকে। তাহারা দেখে, এরা কীটতুল্য, ভারতের মনোরম ক্ষেত্রে বিচরণ করিতেছে, এবং এ উহার উপর অত্যাচার করিবার চেষ্টা করিতেছে। সমাজের এই অবস্থাকে দূর করিতে হইবে ধর্মকে বিনষ্ট করিয়া নহে, পরন্তু হিন্দুধর্মের মহান্ উপদেশসমূহ অনুসরণ করিয়া এবং তাহার সহিত হিন্দুধর্মের স্বাভাবিক পরিণতিস্বরূপ বৌদ্ধধর্মের অদ্ভুত হৃদয়বত্তা লইয়া। লক্ষ লক্ষ নরনারী পবিত্রতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া, ভগবানে দৃঢ় বিশ্বাসরূপ বর্মে সজ্জিত হইয়া দরিদ্র পতিত ও পদদলিতদের প্রতি সহানুভূতিজনিত সিংহবিক্রমে বুক বাঁধুক এবং মুক্তি, সেবা, সামাজিক উন্নয়ন ও সাম্যের মঙ্গলময়ী বার্তা দ্বারে দ্বারে বহন করিয়া সমগ্র ভারতে ভ্রমণ করুক।
হিন্দুধর্মের ন্যায় আর কোন ধর্মই এত উচ্চতানে মানবাত্মার মহিমা প্রচার করে না, আবার হিন্দুধর্ম যেমন পৈশাচিকভাবে গরীব ও পতিতের গলায় পা দেয়, জগতে আর কোন ধর্ম এরূপ করে না। ভগবান্ আমাকে দেখাইয়া দিয়াছেন, ইহাতে ধর্মের কোন দোষ নাই। তবে হিন্দুধর্মের অন্তর্গত আত্মাভিমানী কতকগুলি ভণ্ড ‘পারমার্থিক ও ব্যাবহারিক’৩২ নামক মত দ্বারা সর্বপ্রকার অত্যাচারের আসুরিক যন্ত্র ক্রমাগত আবিষ্কার করিতেছে।
নিরাশ হইও না। স্মরণ রাখিও, ভগবান্ গীতায় বলিতেছেন, ‘কর্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়।’ কোমর বাঁধো, বৎস, প্রভু আমাকে এই কাজের জন্য ডাকিয়াছেন। সারা জীবন আমার নানা দুঃখযন্ত্রণার মধ্যেই কাটিয়াছে। আমি প্রাণপ্রিয় আত্মীয়গণকে একরূপ অনাহারে মরিতে দেখিয়াছি। লোকে আমাকে উপহাস ও অবজ্ঞা করিয়াছে, জুয়াচোরে বদমাশ বলিয়াছে (মান্দ্রাজের অনেকে এখনও আমাকে এইরূপ ভাবিয়া থাকে)। আমি এ সমস্তই সহ্য করিয়াছি তাহাদেরই জন্য, যাহারা আমাকে উপহাস ও ঘৃণা করিয়াছে। বৎস! এই জগৎ দুঃখের আগার বটে, কিন্তু ইহা মহাপুরুষগণের শিক্ষালয়স্বরূপ। এই দুঃখ হইতেই সহানুভূতি, সহিষ্ণুতা, সর্বোপরি অদম্য দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির বিকাশ হয়, যে শক্তিবলে মানুষ সমগ্র জগৎ চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গেলেও একটু কম্পিত হয় না। যাহারা আমাকে ভণ্ড বিবেচনা করে, তাহাদের জন্য আমার দুঃখ হয়। তাহাদের কিছু দোষ নাই। তাহারা শিশু, অতি শিশু, যদিও সমাজে তাহারা মহাগণ্যমান্য বলিয়া বিবেচিত। তাহাদের চক্ষু নিজেদের ক্ষুদ্র দৃষ্টিসীমার বাহিরে আর কিছু দেখিতে পায় না। তাহাদের নিয়মিত কার্য—আহার, পান, অর্থোপার্জন ও বংশবৃদ্ধি—যেন গণিতের নিয়মে অতি সুশৃঙ্খলভাবে পর পর সম্পাদিত হইয়া চলিয়াছে। ইহার অতিরিক্ত আর কিছু তাহারা জানে না। বেশ সুখী তাহারা! তাহাদের ঘুমের ব্যাঘাত কিছুতেই হয় না। শত শত শতাব্দীর পাশব অত্যাচারের ফলে সমুত্থিত শোক, তাপ, দৈন্য ও পাপের যে কাতরধ্বনিতে ভারতাকাশ সমাকুল হইয়াছে, তাহাতেও তাহাদের জীবন সম্বন্ধে দিবাস্বপ্নের ব্যাঘাত হয় না! সেই শত শত যুগব্যাপী মানসিক, নৈতিক ও দৈহিক অত্যাচারের কথা যাহাতে ভগবানের প্রতিমাস্বরূপ মানুষকে ভারবাহী গর্দভে এবং ভগবতীর প্রতিমারূপা নারীকে সন্তান ধারণ করিবার দাসীস্বরূপা করিয়া ফেলিয়াছে এবং জীবন বিষময় করিয়া তুলিয়াছে, এ কথা তাহাদের স্বপ্নেও মনে উদিত হয় না। কিন্তু অন্যান্য অনেকে আছেন, যাঁহারা দেখিতেছেন, প্রাণে প্রাণে বুঝিতেছেন, হৃদয়ের রক্তময় অশ্রু বিসর্জন করিতেছেন; যাঁহারা মনে করেন, ইহার প্রতিকার আছে, আর প্রাণ পর্যন্ত পণ করিয়া যাঁহারা ইহার প্রতিকারে প্রস্তুত আছেন। ‘ইহাদিগকে লইয়াই স্বর্গরাজ্য বিরচিত।’ ইহা কি স্বাভাবিক নহে যে, উচ্চস্তরে অবস্থিত এই সকল মহাপুরুষের—ঐ বিষোদ্গিরণকারী ঘৃণ্য কীটগণের প্রলাপবাক্য শুনিবার মোটেই অবকাশ নাই?
গণ্যমান্য, উচ্চপদস্থ অথবা ধনীর উপর কোন ভরসা রাখিও না। তাহাদের মধ্যে জীবনীশক্তি নাই—তাহারা একরূপ মৃতকল্প বলিলেই হয়। ভরসা তোমাদের উপর—পদমর্যাদাহীন, দরিদ্র, কিন্তু বিশ্বাসী—তোমাদের উপর। ভগবানে বিশ্বাস রাখো। কোন চালাকির প্রয়োজন নাই; চালাকি দ্বারা কিছুই হয় না। দুঃখীদের ব্যথা অনুভব কর, আর ভগবানের নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর—সাহায্য আসিবেই আসিবে। আমি দ্বাদশ বৎসর হৃদয়ে এই ভার লইয়া ও মাথায় এই চিন্তা লইয়া বেড়াইয়াছি। আমি তথাকথিত অনেক ধনী ও বড়লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়াছি, তাহারা আমাকে কেবল জুয়াচোর ভাবিয়াছে। হৃদয়ের রক্তমোক্ষণ করিতে করিতে আমি অর্ধেক পৃথিবী অতিক্রম করিয়া এই বিদেশে সাহায্যপ্রার্থী হইয়া উপস্থিত হইয়াছি। আর আমার স্বদেশের লোকেরাই যখন আমায় জুয়াচোর ভাবে, তখন আমেরিকানরা এক অপরিচিত বিদেশী ভিক্ষুককে অর্থ ভিক্ষা করিতে দেখিলে কত কী-ই না ভাবিবে? কিন্তু ভগবান্ অনন্তশক্তিমান্; আমি জানি, তিনি আমাকে সাহায্য করিবেন। আমি এই দেশে অনাহারে বা শীতে মরিতে পারি; কিন্তু হে মান্দ্রাজবাসী যুবকগণ, আমি তোমাদের নিকট এই গরীব, অজ্ঞ, অত্যাচার-পীড়িতদের জন্য সহানুভূতি, এই প্রাণপণ চেষ্টা—দায়স্বরূপ অর্পণ করিতেছি। যাও, এই মুহূর্তে সেই পার্থসারথির মন্দিরে—যিনি গোকুলের দীনদরিদ্র গোপগণের সখা ছিলেন, যিনি গুহক চণ্ডালকে আলিঙ্গন করিতে সঙ্কুচিত হন নাই, যিনি তাঁহার বুদ্ধ-অবতারে রাজপুরুষগণের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করিয়া এক বেশ্যার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া তাহাকে উদ্ধার করিয়াছিলেন; যাও, তাঁহার নিকট গিয়া সাষ্টাঙ্গে পড়িয়া যাও, এবং তাঁহার নিকট এক মহা বলি প্রদান কর; বলি—জীবন-বলি তাহাদের জন্য, যাহাদের জন্য তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, যাহাদের তিনি সর্বাপেক্ষা ভালবাসেন, সেই দীন দরিদ্র পতিত উৎপীড়িতদের জন্য। তোমরা সারা জীবন এই ত্রিশকোটি ভারতবাসীর উদ্ধারের জন্য ব্রত গ্রহণ কর, যাহারা দিন দিন ডুবিতেছে।
এ এক দিনের কাজ নয়। পথ ভীষণ কণ্টকপূর্ণ। কিন্তু পার্থসারথি আমাদের সারথি হইতেই প্রস্তুত, তাহা আমরা জানি। তাঁহার নামে, তাঁহার প্রতি অনন্ত বিশ্বাস রাখিয়া ভারতের শতশতযুগসঞ্চিত পর্বতপ্রমাণ অনন্ত দুঃখরাশিতে অগ্নিসংযোগ করিয়া দাও, উহা ভস্মসাৎ হইবেই হইবে।
তবে এস, ভ্রাতৃগণ! সমস্যাটির অন্তস্তলে প্রবেশ করিয়া ভাল করিয়া দেখ! এ ব্রত গুরুতর, আমরাও ক্ষুদ্রশক্তি। কিন্তু আমরা জ্যোতির তনয়, ভগবানের তনয়। ভগবানের জয় হউক—আমরা সিদ্ধিলাভ করিবই করিব। শত শত লোক এই চেষ্টায় প্রাণ ত্যাগ করিবে, আবার শত শত লোক উহাতে ব্রতী হইতে প্রস্তুত থাকিবে। প্রভুর জয়! আমি এখানে অকৃতকার্য হইয়া মরিতে পারি, আর একজন এই ভার গ্রহণ করিবে! রোগ কি বুঝিলে, ঔষধ কি তাহাও জানিলে, কেবল বিশ্বাসী হও। আমরা ধনী বা বড়লোককে গ্রাহ্য করি না। আমরা হৃদয়শূন্য মস্তিষ্কসার ব্যক্তিগণকে ও তাহাদের নিস্তেজ সংবাদপত্রের প্রবন্ধসমূহও গ্রাহ্য করি না। বিশ্বাস, বিশ্বাস, সহানুভূতি, অগ্নিময় বিশ্বাস, অগ্নিময় সহানুভূতি। জয় প্রভু, জয় প্রভু। তুচ্ছ জীবন, তুচ্ছ মরণ, তুচ্ছ ক্ষুধা, তুচ্ছ শীত। জয় প্রভু! অগ্রসর হও, প্রভু আমাদের নেতা। পশ্চাতে চাহিও না। কে পড়িল দেখিতে যাইও না। এগিয়ে যাও, সম্মুখে, সম্মুখে। এইরূপেই আমরা অগ্রগামী হইব—একজন পড়িবে, আর একজন তাহার স্থান অধিকার করিবে।
এই গ্রাম হইতে কাল আমি বষ্টনে যাইতেছি। সেখানে একটি বৃহৎ মহিলাসভায় বক্তৃতা করিতে হইবে। ইহারা (খ্রীষ্টান) রমাবাইকে সাহায্য করিতেছে। বষ্টনে গিয়া আমাকে প্রথমে কাপড় কিনিতে হইবে। সেখানে যদি বেশী দিন থাকিতে হয়, তবে আমার এ অপূর্ব পোষাক চলিবে না। রাস্তায় আমায় দেখিবার জন্য শত শত লোক দাঁড়াইয়া যায়। সুতরাং আমাকে কালো রঙের লম্বা জামা পড়িতে হইবে। কেবল, বক্তৃতার সময় গেরুয়া আলখাল্লা ও পাগড়ি পরিব। কি করিব? এখানকার মহিলাগণ এই পরামর্শ দিতেছেন। তাঁহারাই এখানকার সর্বময় কর্ত্রী; তাঁহাদের সহানুভূতি না পাইলে চলিবে না। এই পত্র তোমার নিকট পৌঁছিবার পূর্বে আমার সম্বল দাঁড়াইবে ৬০।৭০ পাউণ্ড। অতএব কিছু টাকা পাঠাইবার বিশেষ চেষ্টা করিবে। এদেশে প্রভাব বিস্তার করিতে হইলে কিছুদিন এখানে থাকা দরকার। আমি ভট্টাচার্য মহাশয়ের জন্য ফনোগ্রাফ দেখিতে যাইতে পারি নাই; কারণ, তাঁহার পত্র এখানে আসিয়া পাইলাম। যদি আবার চিকাগোয় যাই, তবে উহার জন্য চেষ্টা করিব। আমি চিকাগোয় আর যাইব কি না, জানি না। আমার তথাকার বন্ধুগণ আমাকে ভারতের প্রতিনিধি হইতে বলিয়াছিলেন, আর বরদা রাও যে ভদ্রলোকটির সহিত আলাপ করাইয়া দিয়াছিলেন, তিনি চিকাগো মেলার একজন কর্তা। কিন্তু আমি প্রতিনিধি হইতে অস্বীকার করি, কারণ চিকাগোয় এক মাসের অধিক থাকিতে গেলে আমার সামান্য সম্বল ফুরাইয়া যাইত।
কানাডা ব্যতীত সমগ্র আমেরিকায় রেলগাড়ীতে ভিন্ন ভিন্ন ক্লাস নাই। সুতরাং আমাকে ফার্ষ্ট ক্লাসে ভ্রমণ করিতে হইয়াছে, কারণ উহা ছাড়া আর ক্লাস নাই। আমি কিন্তু উহার পুলমান গাড়ীতে (Pullmans) চড়িতে ভরসা করি না। এগুলি খুব আরামপ্রদ; এখানে আহার, পান. নিদ্রা, এমন কি স্নানের পর্যন্ত সুবন্দোবস্ত আছে। তুমি যেন হোটেলে রহিয়াছ, বোধ করিবে। কিন্তু ইহাতে বেজায় খরচ।
এখানে সমাজের মধ্যে ঢুকিয়া তাহাদিগকে শিক্ষা দেওয়া মহা কঠিন ব্যাপার। বিশেষতঃ এখন কেহ শহরে নাই, সকলেই গ্রীষ্মাবাসে গিয়াছে। শীতে আবার সব শহরে আসিবে, তখন তাহাদিগকে পাইব। সুতরাং আমাকে এখানে কিছুদিন থাকিতে হইবে। এত চেষ্টার পর আমি সহজে ছাড়িতেছি না। তোমরা কেবল যতটা পার, আমায় সাহায্য কর। আর যদি তোমরা নাই পার, আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করিয়া দেখিব। আর যদিই আমি এখানে রোগে, শীতে বা অনাহারে মরিয়া যাই, তোমরা এই ব্রত লইয়া উঠিয়া পড়িয়া লাগিবে। পবিত্রতা, সরলতা ও বিশ্বাস! আমি যেখানেই থাকি না কেন, আমার নামে যে-কোন চিঠি বা টাকা আসিবে, কুক কোম্পানীকে তাহা আমার নিকট পাঠাইতে বলিয়া দিয়াছি। ‘রোম এক দিনে নির্মিত হয় নাই।’ যদি তোমরা টাকা পাঠাইয়া আমাকে অন্ততঃ ছয় মাস এখানে রাখিতে পার, আশা করি—সব সুবিধা হইয়া যাইবে। ইতোমধ্যে আমিও যে-কোন কাষ্ঠখণ্ড সম্মুখে পাই, তাহাই ধরিয়া ভাসিতে চেষ্টা করিতেছি। যদি আমার ভরণপোষণের কোন উপায় করিতে পারি, তৎক্ষণাৎ তোমায় তার করিব।
প্রথমে আমেরিকায় চেষ্টা করিব; এখানে অকৃতকার্য হইলে ইংলণ্ডে চেষ্টা করিব। তাহাতেও কৃতকার্য না হইলে ভারতে ফিরিব ও ভগবানের পুনরাদেশের প্রতীক্ষা করিব। ‘রা—’র পিতা ইংলণ্ডে গিয়াছেন। তিনি বাড়ী যাইবার জন্য বিশেষ ব্যস্ত। তাঁহার অন্তরটা খুব ভাল, উপরটায় কেবল বেনিয়াসুলভ কর্কশতা। চিঠি পৌঁছিতে বিশ দিনের অধিক সময় লাগিবে।
এই নিউ ইংলণ্ডে এখনই এত শীত যে, প্রত্যহ প্রাতে ও রাত্রে আগুন জ্বালাইয়া রাখিতে হয়। কানাডায় আরও শীত। কানাডায় যত নীচু পাহাড়ে বরফ পড়িতে দেখিয়াছি, আর কোথাও সেরূপ দেখি নাই।
আমি আবার এই সোমবারে সেলেমে এক বৃহৎ মহিলাসভায় বক্তৃতা দিতে যাইতেছি। তাহাতে আরও অনেক সভাসমিতির সঙ্গে আমার পরিচয় হইবে। এইরূপে ক্রমশঃ পথ করিতে পারিব। কিন্তু এরূপ করিতে হইলে এই ভয়ানক মহার্ঘ দেশে অনেক দিন থাকিতে হয়। ভারতে টাকার (Rupee) দর চড়িয়া যাওয়ায় লোকের মনে মহা আশঙ্কার উদয় হইয়াছে। অনেক মিল বন্ধ হইয়াছে। সুতরাং এখন সাহায্যের চেষ্টা বৃথা। আমাকে এখন কিছুদিন অপেক্ষা করিতে হইবে।
এইমাত্র দরজীর কাছে গিয়াছিলাম, কিছু শীতবস্ত্রের অর্ডার দিয়া আসিলাম। তাহাতে ৩০০৲ টাকা বা তাহারও বেশী পড়িবে। ইহা যে খুব ভাল কাপড় হইবে, তাহা মনে করিও না, অমনি চলনসই গোছের হইবে। এখানকার স্ত্রীলোকেরা পুরুষের পোষাক সম্বন্ধে বড় খুঁতখুঁতে, আর এদেশে তাহাদেরই প্রভুত্ব। মিশনরীরা ইহাদের ঘাড় ভাঙিয়া যথেষ্ট অর্থ আদায় করে। ইহারা প্রতি বৎসর রমাবাইকে খুব সাহায্য করিতেছে। যদি তোমরা আমাকে এখানে রাখিবার জন্য টাকা পাঠাইতে না পার, এ দেশ হইতে চলিয়া যাইবার জন্য কিছু টাকা পাঠাইও। ইতোমধ্যে যদি অনুকূল কিছু ঘটে, লিখিব বা তার করিব। ‘কেব্ল্’ (তার) করিতে প্রতি শব্দে পড়ে ৪৲ টাকা।
তোমাদেরই
বিবেকানন্দ
৬৯*
[অধ্যাপক রাইটকে লিখিত]
সেলেম
৩০ অগষ্ট, ’৯৩
প্রিয় অধ্যাপকজী,৩৩
আজ এখান থেকে আমি চলে যাচ্ছি। মনে হয় চিকাগো থেকে আপনি কিছু উত্তর পেয়েছেন। মিঃ স্যানবর্ন-এর কাছ থেকে পূর্ণ নির্দেশসহ আমন্ত্রণ পেয়েছি। সুতরাং সোমবার সারাটোগায় যাচ্ছি। আপনার গৃহিণীকে আমার শ্রদ্ধা জানাবেন। অষ্টিন ও অন্য শিশুদের ভালবাসা দেবেন। আপনি সত্যই মহাত্মা এবং শ্রীমতী রাইট অতুলনীয়া।
প্রীতিবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৭০*
সেলেম
শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩
প্রিয় অধ্যাপকজী,
আপনার প্রদত্ত পরিচয়পত্র পেয়েই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। চিকাগোর মিঃ থেলিস্ এর কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছি, যাতে মহাসভার কয়েকজন প্রতিনিধির নাম এবং অন্যান্য সংবাদ আছে।
মিস্ স্যানবর্ন-এর কাছ থেকে প্রেরিত চিঠিতে আপনার সংস্কৃতের অধ্যাপক আমাকে পুরুষোত্তম যোশী বলে ভুল করেছেন, এবং ঐ চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন যে, বষ্টনে এমন একটি সংস্কৃত গ্রন্থাগার আছে, যার তুল্য কিছু ভারতে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। গ্রন্থাগারটি দেখতে পেলে আমি কতই না খুশী হব!
‘মিঃ স্যানবর্ন আমাকে সোমবার সারাটোগায় আসতে বলেছেন এবং সেইমত আমি সেখানে যাচ্ছি। সেখানে আমি ‘স্যানাটোরিয়াম’ নামক বোর্ডিঙ হাউসে থাকব। যদি ইতোমধ্যে চিকাগো থেকে কোন সংবাদ আসে, আশা করি অনুগ্রহ করে তা সারাটোগা স্যানাটোরিয়ামে পাঠিয়ে দেবেন।
আপনি, আপনার মহীয়সী পত্নী এবং শিশুসন্তানগুলি আমার মনে এমন ছাপ রেখেছেন, যা কিছুতেই মুছে যাবার নয়। আমি যখন আপনাদের সঙ্গে থাকি, তখন সত্যি মনে হয়—স্বর্গের কাছাকাছি আছি। যিনি সব কিছুর দাতা, তিনি আপনার উপর তাঁর শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ বর্ষণ করুন।
কয়েক লাইন লিখে পাঠাচ্ছি—কবিতার মত করে। এই অত্যাচারটুকু আপনি ভালবেসে ক্ষমা করবেন, এই আশায়।
আপনার চিরবন্ধু
বিবেকানন্দ
পাহাড়ে পর্বতে উপত্যকায়
গীর্জায়, মন্দিরে, মসজিদে—
বেদ বাইবেল আর কোরানে
তোমাকে খুঁজেছি আমি ব্যর্থ ক্রন্দনে।
মহারণ্যে পথভ্রান্ত বালকের মত
কেঁদে কেঁদে ফিরেছি নিঃসঙ্গ,—
তুমি কোথায়—কোথায়—আমার প্রাণ, ওগো ভগবান্?
নাই, প্রতিধ্বনি শুধু বলে, নাই।
দিন, রাত্রি, মাস, বর্ষ কেটে যায়,
আগুন জ্বলতে থাকে শিরে,
কিভাবে দিন রাত্রি হয় জানি না,
হৃদয় ভেঙে যায় দুভাগ হয়ে।
গঙ্গার তীরে লুটিয়ে পড়ি বেদনায়,
রোদে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি,
ধূলিকে সিক্ত করে তপ্ত অশ্রু,
হাহাকার মিশে যায় জনকলরবে;
সকল দেশের সকল মতের মহাজনদের
নাম নিয়ে ডেকে উঠি অধীর হয়ে,
বলি, আমাকে পথ দেখাও, দয়া কর,
ওগো, তোমরা যারা পৌঁছেছ পথের প্রান্তে।
কত বর্ষ কেটে গেল করুণ আর্তনাদে,
মুহূর্ত মনে হয় যুগ যেন,
তখন—একদিন আমার হাহাকারের মধ্যে
কে যেন ডাকল আমাকে আমারি নাম ধরে।
মৃদু মধু আস্বাদের মত এক স্বর—
‘পুত্র! আমার পুত্র! পুত্র মোর!’
সে কণ্ঠ বাজল হৃদয়ে একটি সুরে—
আত্মার প্রতিটি তন্ত্রী উঠল ঝঙ্কার দিয়ে।
উঠে দাঁড়াই। কোথায় সেই স্বর
যা ডাকছে আমায়—এমন ক’রে?
খুঁজে ফিরি এখানে, ওখানে—সেখানে,
বারে বারে—পথে ও প্রান্তে।
ঐ ঐ আবার সেই দৈবী স্বর!
ঐ তো শুনছি আমি, আমারি আহ্বান!
আবেগে আনন্দে নিরুদ্ধ হৃদয়
ডুবে গেল পরমা শান্তিতে।
জ্বলে উঠল আত্মা পরম জ্যোতিতে
খুলে গেল হৃদয়ের দ্বার,
আনন্দ! আনন্দ! একি অপরূপ!
প্রিয় মোর, প্রাণ মোর, সর্বস্ব আমার,
তুমি এখানে, এত কাছে,—আমারি হৃদয়ে?
আমারি হৃদয়ে তুমি নিত্যকাল রাজার গৌরবে!
সেইদিন থেকে যখনি যেখানে যাই
বুঝেছি হৃদয়ে, তুমি আছ পাশে পাশে
পর্বতে—উপত্যকায়—শিখরে—সানুতে
— দূরে বহু দূরে, ঊর্ধ্বে আরও ঊর্ধ্বে।
চাঁদের কোমল আলো, তারকার দ্যুতি,
দিবসের মহান্ উদ্ভাস—
সবার অন্তর-জ্যোতিরূপে প্রকাশিত;
তাঁর শক্তি সকল আলোর প্রাণ!
মহিমার ঊষা তিনি, সন্ধ্যা বিগলিত,
অনন্ত অশান্ত তিনি সমুদ্র,
প্রকৃতির সুষমায়, পাখীর সঙ্গীতে
শুধু তিনি, একমাত্র তিনি।
ঘোর দুর্বিপাকে যখন জড়িয়ে পড়ি,
অবসন্ন প্রাণ, ক্লান্ত ও কাতর,
যখন প্রকৃতি আমাকে চূর্ণ করে
ক্ষমাহীন তার নিয়মে—
শুনেছি তোমারি স্বর তখনি হে প্রিয়!
বলেছ গোপনে মৃদুভাষে ‘আমি এসেছি’,
জেগেছি সেই স্বরে; তোমার সঙ্গে
সহস্র মৃত্যুর মুখে আমি যে নির্ভয়।
তুমি আছ মায়ের গানে, যা শুনে
কোলের শিশু ঘুমিয়ে পড়ে মায়ের কোলে,
তুমি আছ শিশুর হাসিতে ও খেলায়,
দাঁড়িয়ে থাকো তাদের মাঝে আলো করে।
পবিত্রহৃদয় বন্ধুরা যখন মিলিত হয়
তাদেরও মাঝে দাঁড়িয়ে থাকো তুমি।
সুধা ঢেলে দাও তুমি মায়ের চুমোয়,
তুমি সুর দাও শিশুর মা-মা ডাকে।
প্রাচীন ঋষির তুমি ভগবান্,
সকল মতের তুমি চিরন্তন উৎস,
বেদ, বাইবেল আর কোরান গাইছে
তোমারি নাম উচ্চকণ্ঠে—সমস্বরে।
আছ, আছ, তুমি আছ,
ধাবমান জীবনে তুমি আত্মার আত্মা,
ওঁ তৎ সৎ ওঁ,৩৪—আমার ঈশ্বর তুমি,
প্রিয় আমার, আমি তোমার, আমি তোমারি।