০৭. পত্রাবলী ১৭৫-১৮৪

১৭৫*

54 W. 33rd St., নিউ ইয়র্ক
১১ এপ্রিল, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার পত্র পেলাম—ঐ সঙ্গে মনিঅর্ডার ও ‘ট্রান্সক্রিপ্ট’৫৯ কাগজটাও পেলাম। আজ ব্যাঙ্কে যাব—ডলারগুলি ভাঙিয়ে পাউণ্ড করে আনতে। কাল মিঃ লেগেটের কাছে চলে যাচ্ছি কয়েকদিন পল্লীতে বাস করবার জন্য। আশা করি, একটু বিশুদ্ধ বায়ুসেবনে ভালই হবে।

এ বাড়ী এখনই ছেড়ে দেবার কল্পনা ত্যাগ করেছি, কারণ তাতে অত্যন্ত বেশী খরচা পড়বে। অধিকন্তু এখনই বদলান যুক্তিযুক্ত নহে; আমি ধীরে ধীরে সেটি করবার চেষ্টা করছি।

মিস হ্যামলিন আমায় যথেষ্ট সাহায্য করছেন—আমি সেজন্য তাঁর নিকট বিশেষ কৃতজ্ঞ। তিনি আমার প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করছেন—আশা করি, তাঁর ভাবের ঘরেও চুরি নাই। তিনি আমাকে ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চান—আমার ভয় হয়, পূর্বে যেমন একবার শেখান হয়েছিল, ‘নিজেকে সামলে রেখো, যার তার সঙ্গে মিশো না’—এ ব্যাপার তারই দ্বিতীয় সংস্করণ। প্রভু যাঁদের পাঠান, তাঁরাই খাঁটি লোক; আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় এই কথাই তো আমি বুঝেছি। তাঁরাই যথার্থ সাহায্য করতে পারেন, আর তাঁরাই আমাকে সাহায্য করবেন। আর অবশিষ্ট লোকদের সম্বন্ধে বক্তব্য এই, প্রভু তাদের সকলেরই কল্যাণ করুন, আর তাদের হাত থেকে আমায় রক্ষা করুন।

আমার বন্ধুরা সবাই ভেবেছিলেন, একলা একলা দরিদ্রপল্লীতে এভাবে থাকলে এবং প্রচার করলে কিছুই হবে না, আর কোন ভদ্রমহিলা কখনই সেখানে আসবেন না। বিশেষতঃ মিস হ্যামলিন মনে করেছিলেন, তিনি কিম্বা তাঁর মতে যারা ‘ঠিক ঠিক লোক’, তারা যে দরিদ্রোচিত কুটীরে নির্জনবাসী একজন লোকের কাছে এসে তার উপদেশ শুনবে, তা হতেই পারে না। কিন্তু তিনি যাই মনে করুন, যথার্থ ‘ঠিক ঠিক লোক’ ঐ স্থানে দিনরাত আসতে লাগল, তিনিও আসতে লাগলেন। হে প্রভো, মানুষের পক্ষে তোমার ও তোমার দয়ার উপর বিশ্বাস-স্থাপন—কি কঠিন ব্যাপার!! শিব, শিব! মা, তোমায় জিজ্ঞাসা করি, ঠিক ঠিক লোকই বা কোথায়, আর বেঠিক বা মন্দ লোকই বা কোথায়? সবই যে তিনি!! হিংস্র ব্যাঘ্রের মধ্যেও তিনি, মৃগশিশুর ভেতরও তিনি; পাপীর ভেতরও তিনি, পুণ্যাত্মার ভেতরও তিনি—সবই যে তিনি!! সর্বপ্রকারে আমি তাঁর শরণাগত, সারা জীবন তাঁর কোলে আশ্রয় দিয়ে এখন কি তিনি আমায় পরিত্যাগ করবেন? ভগবানের কৃপাদৃষ্টি যদি না থাকে, তবে সমুদ্রে এক ফোঁটা জলও থাকে না, গভীর জঙ্গলে একটা ছোট ডালও পাওয়া যায় না, আর কুবেরের ভাণ্ডারে একমুঠো অন্ন মেলে না; আর তাঁর ইচ্ছা হলে মরুভূমিতে ঝরণা বয়ে যায়, এবং ভিক্ষুকেরও সকল অভাব ঘুচে যায়। একটি চড়ুই পাখী কোথায় উড়ে পড়ছে—তাও তিনি দেখতে পান।৬০ মা, এগুলি কি কেবল কথার কথা—না অক্ষরে অক্ষরে সত্য ঘটনা?

এই ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ কথা এখন থাক। হে আমার শিব, তুমিই আমার ভাল, তুমিই আমার মন্দ। প্রভো, বাল্যকাল থেকেই আমি তোমার চরণে শরণ নিয়েছি। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বা হিমানীমণ্ডিত মেরুপ্রদেশে, পর্বতচূড়ায় বা মহাসমুদ্রের অতল তলে—যেখানেই যাই, তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। তুমিই আমার গতি, আমার নিয়ন্তা, আমার শরণ, আমার সখা, আমার গুরু, আমার ঈশ্বর, তুমিই আমার স্বরূপ। তুমি কখনই আমায় ত্যাগ করবে না—কখনই না, এ আমি ঠিক জানি। হে আমার ঈশ্বর, আমি কখনও কখনও একলা প্রবল বাধাবিঘ্নের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়ি, তখন মানুষের সাহায্যের কথা ভাবি। চিরদিনের জন্য ওসব দুর্বলতা থেকে আমায় রক্ষা কর, যেন আমি তোমা ছাড়া আর কারও কাছে কখনও সাহায্য প্রার্থনা না করি। যদি কেউ কোন ভাল লোকের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, সে কখনও তাকে ত্যাগ করে না বা তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে না। প্রভু, তুমি সকল ভালর সৃষ্টিকর্তা—তুমি কি আমায় ত্যাগ করবে? তুমি তো জান, সারা জীবন আমি তোমার—কেবল তোমারই দাস। তুমি কি আমায় ত্যাগ করবে—যাতে অপরে আমায় ঠকিয়ে যাবে বা আমি মন্দের দিকে ঢলে পড়ব?

মা, তিনি কখনই আমায় ত্যাগ করবেন না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

আপনার চির আজ্ঞাবহ সন্তান
বিবেকানন্দ

১৭৬*

[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]

54 W 33rd St., নিউ ইয়র্ক
২৪ এপ্রিল, ১৮৯৫
… জননীর ন্যায় আপনার সৎপরামর্শের জন্য আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। আশা করি জীবনে তদনুযায়ী কাজ করতে পারব।… যে রহস্যময় চিন্তারাশি সম্প্রতি পাশ্চাত্য জগতে অকস্মাৎ আবির্ভূত হইয়াছে, তাহার মূলে যদিও কিছু সত্য আছে, তথাপি আমি সম্যক অবগত আছি, ইহাদের অধিকাংশই বাজে ও কাণ্ডজ্ঞানহীন মতলবে পরিপূর্ণ। আর এইজন্যই ভারতে কিম্বা অন্য কোথাও ধর্মের এই দিকটার সঙ্গে আমি কোন সম্বন্ধ রাখি নাই এবং রহস্যবাদী সম্প্রদায়গুলিও আমার প্রতি বিশেষ অনুকূল নহে।

প্রাচ্যে কিম্বা পাশ্চাত্যে—সর্বত্র একমাত্র অদ্বৈতদর্শনই যে মানবজাতিকে ‘ভূতপূজা’ এবং ঐ জাতীয় কুসংস্কার হইতে মুক্ত করিতে পারে এবং কেবল উহাই যে মানবকে তাহার স্ব স্ব ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়া শক্তিমান্‌ করিয়া তুলিতে সমর্থ, সে বিষয়ে আমি আপনার সহিত সম্পূর্ণ একমত। পাশ্চাত্য দেশেরই ন্যায় বা তদপেক্ষা অধিক ভারতের নিজেরও এই অদ্বৈতবাদের প্রয়োজন আছে। অথচ কাজটি অত্যন্ত দুরূহ; কারণ প্রথমতঃ আমাদিগকে সকলের মনে রুচি সৃষ্টি করিতে হইবে, তারপর চাই শিক্ষা; সর্বশেষে সমগ্র সৌধটি নির্মাণ করিবার জন্য অগ্রসর হইতে হইবে।

চাই পূর্ণ সরলতা, পবিত্রতা, বিরাট বুদ্ধি এবং সর্বজয়ী ইচ্ছাশক্তি। এই সকল গুণসম্পন্ন মুষ্টিমেয় লোক যদি কাজে লাগে, তবে দুনিয়া ওলটপালট হইয়া যায়। গত বৎসর এদেশে আমি যথেষ্ট বক্তৃতা দিয়াছিলাম, বাহবাও অনেক পাইয়াছিলাম; কিন্তু পরে দেখিলাম, সে-সব কাজ যেন আমি নিছক নিজের জন্যই করিয়াছি। চরিত্রগঠনের জন্য ধীর ও অবিচলিত যত্ন, এবং সত্যোপলব্ধির জন্য তীব্র প্রচেষ্টাই কেবল মানবজাতির ভবিষ্যৎ জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। তাই এ বৎসর আমি সেই ভাবেই আমার কার্যপ্রণালী নিয়মিত করিব, স্থির করিয়াছি। কয়েকজন বাছা বাছা স্ত্রী-পুরুষকে অদ্বৈত- বেদান্তের উপলব্ধি সম্বন্ধে হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিব—কতদূর সফল হইব, জানি না। কেহ যদি শুধু নিজের সম্প্রদায় বা দেশের জন্য না খাটিয়া সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে ব্রতী হইতে চায়, তবে পাশ্চাত্য দেশই তাহার উপযুক্ত ক্ষেত্র।

পত্রিকা বাহির করা বিষয়ে আমি আপনার সহিত সম্পূর্ণ একমত, কিন্তু এ-সব করিবার মত ব্যবসাবুদ্ধি আমার একেবারে নাই; আমি শিক্ষাদান ও ধর্মপ্রচার করিতে পারি, মধ্যে মধ্যে কিছু লিখিতে পারি। সত্যের উপর আমার গভীর বিশ্বাস। প্রভুই আমাকে সাহায্য করিবেন এবং তিনিই প্রয়োজনমত কর্মীও পাঠাইবেন, আমি যেন কায়মনোবাক্যে পবিত্র, নিঃস্বার্থ এবং অকপট হইতে পারি।

‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্। সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ॥’ বৃহত্তর জগতের কল্যাণার্থ নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ যে বিসর্জন দিতে পারে, সমগ্র জগৎ তাহার আপনার হইয়া যায়। … আমার ইংলণ্ডে যাওয়া এখনও অনিশ্চিত। সেখানে আমার পরিচিত কেহই নাই; অথচ এখানে কিছু কিছু কাজ হইতেছে। প্রভুই যথাসময়ে আমাকে পথ দেখাইবেন।

১৭৭*

[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]

19 W. 38th Street, নিউ ইয়র্ক

প্রিয় বন্ধু,
আপনার শেষ পত্র আমি যথাসময়ে পাইয়াছি। এই অগষ্ট মাসের শেষভাগে ইওরোপে যাইবার একটা ব্যবস্থা পূর্বেই হইয়াছিল বলিয়া আপনার আমন্ত্রণ ভগবানের আহ্বান বলিয়া মনে করি।

‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্।’ মিথ্যার কিঞ্চিৎ প্রলেপ থাকিলে সত্যপ্রচার সহজ হয় বলিয়া যাঁহারা মনে করেন, তাঁহারা ভ্রান্ত। কালে তাঁহারা বুঝিতে পারেন যে, বিষ—এক ফোঁটা মিশ্রিত হইলেও সমস্ত খাদ্য দূষিত করিয়া ফেলে। যে পবিত্র ও সাহসী, সে-ই জগতে সব কাজ করিতে পারে।

প্রভু আপনাকে সর্বদা মায়ামোহ হইতে রক্ষা করুন। আমি আপনার সহিত কাজ করিতে সর্বদাই প্রস্তুত আছি। যদি আমরা নিজেরা খাঁটি থাকি, তবে প্রভুও আমাদিগকে শত শত বন্ধু প্রেরণ করিবেন। ‘আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুঃ …।’

চিরকালই ইওরোপ হইতে সামাজিক এবং এশিয়া হইতে আধ্যাত্মিক শক্তির উদ্ভব হইয়াছে এবং এই দুই শক্তির বিভিন্ন প্রকার সংমিশ্রণেই জগতের ইতিহাস গড়িয়া উঠিয়াছে। মানবজাতির ইতিহাসের একটি নূতন পৃষ্ঠা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হইতেছে এবং সর্বত্র তাহারই চিহ্ন দেখা যাইতেছে। শত শত নূতন পরিকল্পনার উদ্ভব ও বিলয় হইবে, কিন্তু একমাত্র যোগ্যতমেরই প্রতিষ্ঠা সুনিশ্চিত—সত্য ও শিব অপেক্ষা যোগ্যতম আর কি হইতে পারে?

ভবদীয়
বিবেকানন্দ

১৭৮*

54 W. 33rd Street, নিউ ইয়র্ক
২৫ এপ্রিল, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
গত পরশু মিস ফার্মারের একখানি হৃদ্যতাপূর্ণ পত্র পেলাম—তার সঙ্গে বার্বার হাউসে প্রদত্ত বক্তৃতাগুলির জন্য একশত ডলারের একখানি চেকও এল। আগামী শনিবার তিনি নিউ ইয়র্কে আসছেন। অবশ্য আমি মিস ফার্মারকে তাঁর বক্তৃতার বিজ্ঞাপনে আমার নাম দিতে মানা করব। বর্তমানে গ্রীনএকারে যেতে পারছি না, সহস্রদ্বীপোদ্যানে (Thousand Island Park) যাবার বন্দোবস্ত করেছি—ঐ স্থান যেখানেই হোক। সেখানে আমার জনৈকা ছাত্রী মিস ডাচারের এক কুটীর আছে। আমরা কয়েকজন সেখানে নির্জন বাস করে বিশ্রাম ও শান্তিতে কাটাব, মনে করেছি। আমার ক্লাসে যাঁরা আসেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে ‘যোগী’ করতে চাই। গ্রীনএকারের মত কর্মচঞ্চল হাট এ কাজের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। অপর জায়গাটি আবার লোকালয় থেকে সম্পূর্ণ দূরে বলে যারা শুধু মজা চায়, তারা কেউ সেখানে যেতে সাহস করবে না।

জ্ঞানযোগের ক্লাসে যাঁরা আসতেন, তাঁদের ১৩০ জনের নাম মিস হ্যামলিন টুকে রেখেছিলেন—এতে আমি খুব খুশী আছি। আরও ৫০ জন বুধবারে যোগ-ক্লাসে আসতেন—আর সোমবারের ক্লাসে আরও ৫০ জন। মিঃ ল্যাণ্ডসবার্গ সব নামগুলি লিখে রেখেছিলেন—আর নাম লেখা থাক বা নাই থাক, এঁরা সকলেই আসবেন। মিঃ ল্যাণ্ডসবার্গ আমার সংস্রব ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু নামগুলি সব এখানে আমার কাছে ফেলে গেছেন। তারা সকলেই আসবে—আর তারা যদি না আসে তো অপরে আসবে। এইরূপেই চলবে— প্রভু, তোমারই মহিমা!!!

নাম টুকে রাখা এবং বিজ্ঞাপন দেওয়া একটা মস্ত কাজ সন্দেহ নেই; আমার জন্য এই কাজ করেছেন বলে তাঁদের উভয়ের কাছে আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পেরেছি যে, অপরের ওপর নির্ভর করা আমার নিজেরই আলস্য, সুতরাং উহা অধর্ম—আর আলস্য থেকে সর্বদা অনিষ্টই হয়ে থাকে। সুতরাং এখন থেকে ঐ-সব কাজ আমিই করছি এবং পরেও নিজেই সব করব। তাতে আর ভবিষ্যতে কারও কোন উদ্বেগের কারণ থাকবে না।

যাই হোক, আমি মিস হ্যামলিনের ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ মধ্যে যাকে হোক নিতে পারলে ভারি সুখী হব; কিন্তু আমার দুরদৃষ্টক্রমে তেমন একজনও তো এখনও এল না। আচার্যের চিরন্তন কর্তব্য হচ্ছে অত্যন্ত ‘বেঠিক’ লোকদের ভিতর থেকে ‘ঠিক ঠিক লোক’ তৈরী করে নেওয়া।

মোদ্দা কথাটা এই, মিস হ্যামলিন নামে সম্ভ্রান্ত মহিলাটি আমাকে নিউ ইয়র্কের ‘ঠিক ঠিক লোকগুলির’ সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার আশা ও উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং কার্যতঃ তিনি আমায় যেরূপ সাহায্য করেছিলেন, তার জন্য যদিও আমি তাঁর কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ, তবু মনে করছি আমার যা অল্পস্বল্প কাজ আছে, তা আমার নিজের হাতে করাই ভাল। এখনও অন্যের সাহায্য নেবার সময় হয়নি—কাজ অতি অল্প। আপনার যে উক্ত মিস হ্যামলিন সম্বন্ধে অতি উচ্চ ধারণা, তাতে আমি খুব খুশী। আপনি যে তাঁকে সাহায্য করবেন, এ জেনে অন্যে যা হোক, আমি তো বিশেষ খুশী; কারণ তাঁর সাহায্য প্রয়োজন। কিন্তু মা, রামকৃষ্ণের কৃপায় কোন মানুষের মুখ দেখলেই আমি যেন স্বভাবসিদ্ধ সংস্কারবলে তার ভিতর কি আছে, তা প্রায় অভ্রান্তভাবে জানতে পারি; আর এর ফলে এই দাঁড়িয়েছে যে, আপনি আমার সব ব্যাপার নিয়ে যা খুশী করতে পারেন, আমি তাতে এতটুকু অসন্তোষ পর্যন্ত প্রকাশ করব না। আমি মিস ফার্মারের পরামর্শও খুব আনন্দের সঙ্গেই নেব—তিনি যতই ভূত-প্রেতের কথা বলুন না কেন। এ-সব ভূত-প্রেতের অন্তরালে আমি একটি অগাধপ্রেমপূর্ণ হৃদয় দেখতে পাচ্ছি, কেবল এর ওপর একটা প্রশংসনীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার সূক্ষ্ম আবরণ রয়েছে—তাও কয়েক বৎসরে নিশ্চয় অন্তর্হিত হবে। এমন কি—ল্যাণ্ডস‍্‌বার্গও মাঝে মাঝে আমার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে তাতে কোন আপত্তি করব না। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এঁদের ছাড়া অন্য কোন লোক আমায় সাহায্য করতে এলে আমি বেজায় ভয় পাই—এই পর্যন্ত আমি বলতে পারি। আপনি আমাকে যে সাহায্য করেছেন, শুধু তার দরুন নয়—আমার স্বাভাবিক সংস্কারবশতই (অথবা যাকে আমি আমার গুরুমহারাজের প্রেরণা বলে থাকি) আপনাকে আমি আমার মায়ের মত দেখে থাকি। সুতরাং আপনি আমাকে যে-কোন উপদেশ দেবেন, তা আমি সর্বদাই মেনে চলব—কিন্তু ঐ পরামর্শ বা আদেশ সাক্ষাৎ আপনার কাছ থেকে আসা চাই। আপনি যদি আর কাকেও মাঝখানে খাড়া করেন, তাহলে আমি নিজে বেছে নেওয়ার দাবী প্রার্থনা করি। এই কথা আর কি!

আপনার চিরানুগত সন্তান
বিবেকানন্দ

পুঃ—মিস হ্যামলিন এখনও এসে পৌঁছননি। তিনি এলে আমি সংস্কৃত বইগুলি পাঠাব। তিনি কি আপনার কাছে মিঃ নওরোজী-কৃত ভারত সম্বন্ধে একখানি বই পাঠিয়েছেন? আপনি যদি আপনার ভাইকে বইখানি একবার আগাগোড়া দেখতে বলেন, তবে আমি খুব খুশী হব। গান্ধী এখন কোথায়?

বি

১৭৯*

54 W. 33rd St. New York
মে, ১৮৯৫

প্রিয়,
তোমাকে চিঠি লেখবার পর আমার ছাত্রেরা আবার এসেছে আমায় সাহায্য করবার জন্য; ক্লাসগুলি এখন খুবই সুন্দরভাবে চলবে, সন্দেহ নেই।

এতে আমি খুব খুশী হয়েছি, কারণ শেখান ব্যাপারটা আমার জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্য ও বিশ্রাম যেমন প্রয়োজন, আমার জীবনে এও তেমনি প্রয়োজন।

তোমার
বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমি ইংরেজী পত্রিকা ‘The Borderland’-এ—এর বিষয়ে অনেক কিছু পড়েছি— ভারতে খুব ভাল কাজ করছে এবং হিন্দুরা যাতে তাদের ধর্ম বুঝতে পারে, সে বিষয়ে চেষ্টা করছে। আমি —র লেখায় কোনপ্রকার পাণ্ডিত্য দেখতে পাইনি, … অথবা কোন আধ্যাত্মিকতাও নয়। যাই হোক, যে জগতের ভাল করতে চায়, তার উদ্দেশ্য সফল হোক।

কত সহজেই এ সংসার ধাপ্পাবাজিতে ভুলে যায়! এবং সভ্যতার সূচনা থেকেই কত যে জুয়াচুরি বেচারা মানুষের মাথার ওপর জমছে!

১৮০*

[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]৬১

U. S. A.
মে (?), ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
‘যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি ধর্মের গৌরব পুনঃস্থাপনের জন্য আবির্ভূত হই’—হে মহারাজ, ইহা পবিত্র গীতামুখে উচ্চারিত সেই সনাতন ভগবানের বাক্য, এই কথাগুলি জগতে আধ্যাত্মিক শক্তি-তরঙ্গের উত্থান-পতনের মূল সুর।

ধর্মজগতে এই পরিবর্তন বারংবার তাহার নূতন নূতন বিশিষ্ট ছন্দে প্রকাশিত হইতেছে; যদিও অন্যান্য বিরাট পরিবর্তনের ন্যায় নিজস্ব এলাকার মধ্যগত প্রত্যেকটি বস্তুর উপর এই পরিবর্তনগুলিও প্রভাব বিস্তার করে, তথাপি শক্তি-ধারণে সমর্থ বস্তুর উপরেই তাহাদের কার্যকারিতা সমধিক প্রকাশ পায়।

বিশ্বগতভাবে যেমন জগতের আদিম অবস্থা ত্রিগুণের সাম্যভাব, এই সাম্যভাবের চ্যুতি ও তাহা পুনঃপ্রাপ্তির জন্য সমুদয় চেষ্টা লইয়াই এই প্রকৃতির বিকাশ বা বিশ্বজগৎ; যতদিন না এই সাম্যাবস্থা পুনরায় ফিরিয়া আসে, ততদিন এইভাবেই চলিতে থাকে। সীমাবদ্ধভাবে তেমনি আমাদের এই পৃথিবীতে যতদিন মনুষ্যজাতি এইভাবেই থাকিবে, ততদিন এই বৈষম্য ও তাহার অপরিহার্য পরিপূরক এই সাম্যলাভের চেষ্টা—দুই-ই পাশাপাশি বিরাজ করিবে। তাহাতে পৃথিবীর সর্বত্র ভিন্ন ভিন্ন জাতির ভিতর, উপজাতিগুলির ভিতর, এমন কি প্রত্যেকটি ব্যক্তিতে সুস্পষ্ট বিশেষত্ব থাকিবে।

অতএব নিরপেক্ষভাবে এবং সাম্য রক্ষা করিয়া সকলকে শক্তি প্রদত্ত হইলেও প্রত্যেক জাতিই যেন একটি বিশেষ প্রকার শক্তিসংগ্রহ ও বিতরণের উপযোগী এক-একটি অদ্ভুত যন্ত্র- স্বরূপ; ঐ জাতির অন্যান্য অনেক শক্তি থাকিলেও সেই শক্তিটিই তাহার বিশেষ লক্ষণরূপে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়। মনুষ্যপ্রকৃতিতে একটি ভাবের তরঙ্গ উঠিলে, তাহার প্রভাব অল্প-বিস্তর সকলেই অনুভব করিলেও ঐ ভাব যে-জাতির বিশেষ লক্ষণ এবং সাধারণতঃ যে-জাতিকে কেন্দ্র করিয়া ঐ ভাবের আরম্ভ, সেই জাতির অন্তস্তল পর্যন্ত উহা দ্বারা আলোড়িত হয়। এই কারণেই ধর্মজগতে কোন আলোড়ন উপস্থিত হইলে তাহার ফলে ভারতে অবশ্যই নানাপ্রকার গুরুতর পরিবর্তন হইতে থাকিবে, ভারতকে কেন্দ্র করিয়াই বহুবিস্তৃত ধর্মতরঙ্গসমূহ বারংবার উত্থিত হইয়াছে, কারণ সর্বোপরি ভারত ধর্মের দেশ।

যাহা দ্বারা আদর্শলাভের সহায়তা হয়, মানুষ কেবল সেটিকেই বাস্তব বলে। সাংসারিক মানুষের নিকট যাহা কিছুর বিনিময়ে টাকা পাওয়া যায়, তাহাই বাস্তব; যাহার বিনিময়ে টাকা হয় না, তাহা অবাস্তব। প্রভুত্ব যাহার আকাঙ্ক্ষা, তাহার নিকট যাহাদ্বারা সকলের উপর প্রভুত্ব করিবার বাসনা চরিতার্থ হয়, তাহাই বাস্তব, বাকী সব কিছুই নয়। যাহা জীবনে বিশেষ প্রীতির প্রতিধ্বনি করে না, তাহার মধ্যে মানুষ কিছুই দেখিতে পায়

যাহাদের একমাত্র লক্ষ্য জীবনের সমুদয় শক্তির বিনিময়ে কাঞ্চন, নাম বা অপর কোনরূপ ভোগসুখ অর্জন করা, যাহাদের নিকট সমরসজ্জায় সজ্জিত সৈন্যদলের যুদ্ধযাত্রাই শক্তি-বিকাশের একমাত্র লক্ষণ, যাহাদের নিকট ইন্দ্রিয়সুখই জীবনের একমাত্র সুখ, তাহাদের নিকট ভারত সর্বদাই একটা বিশাল মরুভূমির মত প্রতীয়মান হইবে; তাহাদের কাছে জীবনের বিকাশ বলিয়া যাহা পরিচিত, তাহার পক্ষে ঐ মরুভূমির প্রতিটি দমকা বাতাস মারাত্মক।

কিন্তু যাঁহাদের জীবনতৃষ্ণা ইন্দ্রিয়জগতের অতি দূরে অবস্থিত অমৃতনদীর সলিলপানে একেবারে মিটিয়া গিয়াছে, যাঁহাদের আত্মা সর্পের জীর্ণত্বকমোচনের ন্যায় কাম, কাঞ্চন ও যশঃস্পৃহারূপ ত্রিবিধ বন্ধনকে দূরে ফেলিয়া দিয়াছে, যাঁহারা চিত্তস্থৈর্যের উন্নত শিখরে আরোহণ করিয়া তথা হইতে—ইন্দ্রিয়-বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তিগণের ‘ভোগ’ বলিয়া কথিত আপাতমনোহর বস্তুর জন্য নীচজনোচিত কলহ, বিবাদ, দ্বেষহিংসার প্রতি প্রীতি ও প্রসন্নতার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, সঞ্চিত সৎকর্মের ফলে চক্ষু হইতে অজ্ঞানের আবরণ খসিয়া পড়ায় যাঁহারা অসার নামরূপের পারে প্রকৃত সত্যদর্শনে সমর্থ হইয়াছেন, তাঁহারা যেখানেই থাকুন না কেন, আধ্যাত্মিকতার জন্মভূমি ও অফুরন্ত খনি ভারতবর্ষ তাঁহাদের দৃষ্টিতে ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয়; শূন্যে বিলীয়মান ছায়ার মত এই জগতে যিনি একমাত্র প্রকৃত সত্তা, তাঁহার সন্ধানরত প্রত্যেকটি সাধকের নিকট ভারত আশার আলোকরূপে প্রতীত হয়।

অধিকাংশ মানব তখনই শক্তিকে শক্তি বলিয়া বুঝিতে পারে, যখন অনুভবের উপযোগী করিয়া স্থূল আকারে উহা তাহাদের সম্মুখে ধরা হয়, তাহাদের নিকট যুদ্ধের উত্তেজনা শক্তির প্রত্যক্ষ বিকাশ বলিয়া প্রতীত হয়; আর যাহা কিছু ঝড়ের মত আসিয়া সম্মুখের সব কিছু উড়াইয়া লইয়া যায় না, উহা তাহাদের দৃষ্টিতে মৃত্যুস্বরূপ। সুতরাং শত শত শতাব্দীব্যাপী যে ভারতবর্ষ কোনরূপ বাধাদানে নিশ্চেষ্ট হইয়া বিদেশী বিজেতৃগণের পদতলে পতিত, জনতা সেখানে একতাহীন, স্বদেশপ্রেমের ভাবও যেখানে এতটুকু নাই—সেই ভারত তাহাদের নিকট বিকৃত অস্থিপূর্ণ দেশ, প্রাণহীন পচনশীল পদার্থের স্তূপ বলিয়া প্রতীত হইবে।

বলা হয়, যোগ্যতমই কেবল জীবনসংগ্রামে জয়ী হইয়া থাকে। তবে সাধারণ ধারণানুসারে যে-জাতি সর্বাপেক্ষা অযোগ্য, সে-জাতি দারুণ দুর্ভাগ্য সহ্য করিয়াও কেন বিনাশের কিছুমাত্র চিহ্ন প্রদর্শন করিতেছে না? তথাকথিত বীর্যবান্‌ ও কর্মপরায়ণ জাতিসমূহের শক্তি দিন দিন কমিয়া আসিতেছে, আর এদিকে ‘দুর্নীতিপরায়ণ (?)’ হিন্দুর শক্তি সর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পাইতেছে, ইহা কিরূপে হইতেছে? এক মুহূর্তের মধ্যে যাহারা জগৎকে শোণিতসাগরে প্লাবিত করিয়া দিতে পারে, তাহারা খুব প্রশংসা পাইবার যোগ্য। যাহারা জগতের কয়েক লক্ষ লোককে সুখে-স্বচ্ছন্দে রাখিবার জন্য পৃথিবীর অর্ধেক লোককে অনাহারে রাখিতে পারে, তাহারাও মহৎ গৌরবের অধিকারী! কিন্তু যাহারা অপর কাহারও মুখ হইতে অন্ন কাড়িয়া না লইয়া লক্ষ লক্ষ মানুষকে সুখে রাখিতে পারে, তাহারা কি কোনরূপ সম্মান পাইবার যোগ্য নয়? শত শত শতাব্দী ধরিয়া অপরের উপর বিন্দুমাত্র অত্যাচার না করিয়া লক্ষ লক্ষ লোকের ভাগ্য পরিচালনা করাতে কি কোনরূপ শক্তি প্রদর্শিত হয় না?

সকল প্রাচীন জাতির পুরাণেই দেখা যায়, বীরপুরুষদের প্রাণ তাঁহাদের শরীরের কোন বিশেষ ক্ষুদ্র অংশে ঘনীভূত ছিল। যতদিন সেখানে হাত পড়িত না, ততদিন তাঁহারা দুর্ভেদ্য থাকিতেন। বোধ হয় যেন প্রত্যেক জাতিরও এইরূপ একটি বিশেষ কেন্দ্রে জীবনীশক্তি সঞ্চিত আছে; তাহাতে হাত না পড়া পর্যন্ত কোন দুঃখবিপদই সেই জাতিকে বিনষ্ট করিতে পারে না।

ধর্মেই ভারতের এই জীবনীশক্তি। যতদিন হিন্দুরা তাহাদের পূর্বপুরুষগণের নিকট উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান বিস্মিত না হইতেছে, ততদিন জগতে কোন শক্তি তাহাদের ধ্বংস করিতে পারিবে না।

যে ব্যক্তি সর্বদাই স্বজাতির অতীতের দিকে ফিরিয়া তাকায়, আজকাল সকলেই তাহাকে নিন্দা করিয়া থাকে। অনেকে বলেন, এইরূপ ক্রমাগত অতীতের আলোচনাই হিন্দুজাতির নানারূপ দুঃখের কারণ। কিন্তু আমার বোধ হয়, ইহার বিপরীতটিই সত্য; যতদিন হিন্দুরা তাহাদের অতীত ভুলিয়া ছিল, ততদিন তাহারা হতবুদ্ধি হইয়া অসাড় অবস্থায় পড়িয়াছিল। যতই তাহারা অতীতের আলোচনা করিতেছে, ততই চারিদিকে নূতন জীবনের লক্ষণ দেখা যাইতেছে। অতীতের ছাঁচেই ভবিষ্যৎকে গড়িতে হইবে, এই অতীতই ভবিষ্যৎ হইবে।

অতএব হিন্দুগণ যতই তাঁহাদের অতীত আলোচনা করিবেন, তাঁহাদের ভবিষ্যৎ ততই গৌরবময় হইবে; আর যে-কেহ এই অতীতকে প্রত্যেকের কাছে তুলিয়া ধরিতে চেষ্টা করিতেছেন, তিনিই স্বজাতির পরম হিতকারী। আমাদের পূর্বপুরুষগণের রীতিনীতিগুলি মন্দ ছিল বলিয়া যে ভারতের অবনতি হইয়াছে, তাহা নহে; এই অবনতির কারণ, ঐ রীতিনীতিগুলির যে ন্যায়সঙ্গত পরিণতি হওয়া উচিত ছিল, তাহা হইতে দেওয়া হয় নাই।

প্রত্যেক বিচারশীল পাঠকই জানেন, ভারতের সামাজিক বিধানগুলি যুগে যুগে পরিবর্তিত হইয়াছে। প্রথম হইতেই এই নিয়মগুলি এক বিরাট পরিকল্পনার প্রতিফলনের চেষ্টাস্বরূপ ছিল, কালক্রমে ধীরে ধীরে এগুলি বিকশিত হইবার কথা। প্রাচীন ভারতের ঋষিগণ এত দূরদর্শী ছিলেন যে, তাঁহাদের জ্ঞানের মহত্ত্ব বুঝিতে জগৎকে এখনও অনেক শতাব্দী অপেক্ষা করিতে হইবে। আর তাঁহাদের বংশধরগণের এই মহান্‌ উদ্দেশ্যের পূর্ণভাব ধারণা করিবার অক্ষমতাই ভারতের একমাত্র কারণ।

শত শত শতাব্দী ধরিয়া প্রাচীন ভারত তাহার প্রধান দুই জাতির—ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের উচ্চাভিলাষপূর্ণ অভিসন্ধি-সাধনের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল।

একদিকে পুরোহিতগণ সাধারণ প্রজাদের উপর রাজাদের অবৈধ সামাজিক অত্যাচার নিবারণে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এই প্রজাগণকে ক্ষত্রিয়গণ আপনাদের ‘ন্যায়সঙ্গতভক্ষ্য’রূপে ঘোষণা করিতেন। অপর দিকে ক্ষত্রিয়গণই ভারতে একমাত্র শক্তিসম্পন্ন জাতি ছিলেন, যাঁহারা পুরোহিতগণের আধ্যাত্মিক অত্যাচার ও সাধারণ মানুষকে বন্ধন করিবার জন্য তাঁহারা যে ক্রমবর্ধমান নূতন নূতন ক্রিয়াকাণ্ড প্রবর্তন করিতেছিলেন, তাহার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া কিছু পরিমাণে কৃতকার্য হইয়াছিলেন।

অতি প্রাচীনকাল হইতেই উভয় জাতির এই সংঘর্ষ আরম্ভ হইয়াছিল। সমগ্র শ্রুতির ভিতরেই ইহা অতি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। সাময়িকভাবে এই বিরোধ মন্দীভূত হইল, যখন ক্ষত্রিয়দের এবং জ্ঞানকাণ্ডের নেতা শ্রীকৃষ্ণ সামঞ্জস্যের পথ দেখাইয়া দিলেন। তাহার ফল গীতার শিক্ষা, যাহা ধর্ম দর্শন ও উদারতার সারস্বরূপ। কিন্তু বিরোধের কারণ তখনও বর্তমান ছিল, সুতরাং তার ফলও অবশ্যম্ভাবী।

সাধারণ দরিদ্র মূর্খ প্রজার উপর প্রভুত্ব করিবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্বোক্ত দুই জাতির মধ্যেই বর্তমান ছিল, সুতরাং বিরোধ আবার প্রবলভাবে জাগিয়া উঠিল। আমরা সেই সময়কার যে সামান্য সাহিত্য পাই, তাহা সেই প্রাচীনকালের প্রবল বিরোধের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র, কিন্তু অবশেষে ক্ষত্রিয়ের জয় হইল, জ্ঞানের জয় হইল, স্বাধীনতার জয় হইল আর কর্মকাণ্ডের প্রাধান্য রইল না, ইহার অধিকাংশই চিরকালের জন্য চলিয়া গেল।

এই উত্থানের নাম বৌদ্ধ সংস্কার। ধর্মের দিকে উহা কর্মকাণ্ড হইতে মুক্তি সূচনা করিতেছে, আর রাজনীতির দিকে ক্ষত্রিয় দ্বারা পুরোহিত-প্রাধান্যের বিনাশ সূচিত হইতেছে।

বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, প্রাচীন ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ যে দুই মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা উভয়েই—কৃষ্ণ ও বুদ্ধ—ক্ষত্রিয় ছিলেন। ইহা আরও বেশী লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, এই দুই দেবমানবই স্ত্রী-পুরষ জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের জন্যই জ্ঞানের দ্বার খুলিয়া দিয়াছিলেন।

অদ্ভুত নৈতিক বল সত্ত্বেও বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন মত ধ্বংস করিতে অত্যধিক সমুৎসুক ছিল। উহার অধিকাংশ শক্তিই নেতিমূলক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হওয়াতে বৌদ্ধধর্মকে উহার জন্মভূমি হইতে প্রায় বিলুপ্ত হইতে হইল; আর যেটুকু অবশিষ্ট রহিল, তাহাও বৌদ্ধধর্ম যে-সকল কুসংস্কার ও ক্রিয়াকাণ্ড নিবারণে নিয়োজিত হইয়াছিল, তদপেক্ষা শতগুণ ভয়ানক কুসংস্কার ও ক্রিয়াকাণ্ডে পূর্ণ হইয়া উঠিল। যদিও উহা আংশিকভাবে বৈদিক পশুবলি নিবারণে কৃতকার্য হইয়াছিল, কিন্তু উহা সমুদয় দেশ, মন্দির, প্রতিমা, প্রতীক, যন্ত্র ও সাধুসন্তের অস্থিতে ভরিয়া ফেলিল।

সর্বোপরি বৌদ্ধধর্মের জন্য আর্য মঙ্গোলীয় ও আদিম প্রভৃতি ভিন্ন প্রকৃতির জাতির যে মিশ্রণ হইল, তাহাতে অজ্ঞাতসারে কতকগুলি বীভৎস বামাচারের সৃষ্টি হইল। প্রধানতঃ এই কারণেই সেই মহান্‌ আচার্যের উপদেশাবলীর এই বিকৃত পরিণতিকে শ্রীশঙ্কর ও তাঁহার সন্ন্যাসি-সম্প্রদায় ভারত হইতে বিতাড়িত করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

এইরূপে মনুষ্যদেহধারিগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভগবান্ বুদ্ধ কর্তৃক প্রবর্তিত জীবন-প্রবাহও পূতিগন্ধময় বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হইল; ভারতকে কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করিতে হইল, যতদিন না ভগবান্ শঙ্করের আবির্ভাব এবং কিছু পরে-পরেই রামানুজ ও মধ্বাচার্যের অভ্যুদয় হইল।

ইতোমধ্যে ভারতেতিহাসের এক সম্পূর্ণ নূতন অধ্যায় আরম্ভ হইয়াছে। প্রাচীন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় জাতি অন্তর্হিত হইয়াছে। হিমালয় ও বিন্ধ্যের মধ্যবর্তী আর্যভূমি, যেখানে কৃষ্ণ ও বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, যাহা মহামান্য রাজর্ষি ও ব্রহ্মর্ষিগণের শৈশবের লীলাভূমি ছিল, তাহা এখন নীরব; আর ভারত উপদ্বীপের সর্বশেষ প্রান্ত হইতে, ভাষায় ও আকারে সম্পূর্ণ বিভিন্ন এক জাতি হইতে, প্রাচীন ব্রাহ্মণগণের বংশধর বলিয়া গৌরবকারী বংশসমূহ হইতে বিকৃত বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল।

আর্যাবর্তের সেই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ কোথায় গেলেন? তাঁহারা একেবারে বিলুপ্ত, কেবল এখানে ওখানে ব্রাহ্মণত্ব বা ক্ষত্রিয়ত্ব-অভিমানী কতকগুলি মিশ্র জাতি বাস করিতেছে। আর তাঁহাদের ‘এতদ্দেশপ্রসূতস্য সকাশদগ্রজন্মনঃ’ পৃথিবীর সকল মানুষ আপন আপন চরিত্র শিক্ষা করিবে,৬২ এইরূপ অহঙ্কৃত, আত্মশ্লাঘাময় উক্তি সত্ত্বেও তাঁহাদিগকে অতি বিনয়ের সহিত দীনবেশে দাক্ষিণাত্যবাসীদের পদতলে বসিয়া শিক্ষা করিতে হইয়াছিল। ইহার ফলে ভারতে পুনরায় বেদের অভ্যুদয় হইল—বেদান্তের পুনরুত্থান হইল; এইরূপ বেদান্তের চর্চা আর কখনও হয় নাই, গৃহস্থেরা পর্যন্ত আরণ্যকপাঠে নিযুক্ত হইলেন।

বৌদ্ধধর্ম-প্রচারে ক্ষত্রিয়েরাই প্রকৃত নেতা ছিলেন এবং দলে দলে তাঁহারাই বৌদ্ধ হইয়াছিলেন। সংস্কার ও ধর্মান্তরকরণের উৎসাহে সংস্কৃত ভাষা উপেক্ষিত হইয়া লোকপ্রচলিত ভাষাসমূহের চর্চা প্রবল হইয়াছিল। আর অধিকাংশ ক্ষত্রিয়ই বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃত শিক্ষার বহির্ভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন। সুতরাং দাক্ষিণাত্য হইতে যে এই সংস্কার-তরঙ্গ আসিল, তাহাতে কিয়ৎপরিমাণে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণগণেরই উপকার হইল। কিন্তু উহা ভারতের অবশিষ্ট লক্ষ লক্ষ লোকের পক্ষে অধিকতর ও নূতনতর বন্ধনের কারণ হইয়াছিল।

ক্ষত্রিয়গণ চিরকালই ভারতের মেরুদণ্ডস্বরূপ, সুতরাং তাঁহারাই বিজ্ঞান ও স্বাধীনতার পরিপোষক। দেশ হইতে কুসংস্কার দূরীভূত করিবার জন্য বারংবার তাঁহাদের বজ্রকণ্ঠ ধ্বনিত হইয়াছে, আর ভারতেতিহাসে প্রথম হইতে তাঁহারাই পুরোহিতকুলের অত্যাচার হইতে সাধারণকে রক্ষা করিবার অভেদ্য প্রাচীররূপে দণ্ডায়মান।

যখন তাঁহাদের অধিকাংশ ঘোর অজ্ঞানে নিমগ্ন হইলেন, এবং অপরাংশ মধ্য এশিয়ার বর্বর জাতিগুলির সহিত শোণিতসম্বন্ধ স্থাপন করিয়া ভারতে পুরোহিতগণের প্রাধান্য-স্থাপনে তরবারি নিয়োজিত করিল, তখনই ভারতে পাপের মাত্রা পূর্ণ হইয়া আসিল, আর ভারতভূমি একেবারে ডুবিয়া গেল। যতদিন না ক্ষত্রিয়-শক্তি জাগরিত হইয়া নিজেকে মুক্ত করে এবং অবশিষ্ট জাতির চরণ-শৃঙ্খল মোচন করিয়া দেয়, ততদিন আর ভারত উঠিবে না। পৌরোহিত্যই ভারতের সর্বনাশের মূল। নিজ ভ্রাতাকে অবনমিত করিয়া মানুষ স্বয়ং কি অবনত না হইয়া থাকিতে পারে?

জানিবেন, রাজাজী, আপনার পূর্বপুরুষগণের দ্বারা আবিষ্কৃত সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যঃ বিশ্বজগতের একত্ব। কোন ব্যক্তি নিজের কিছুমাত্র অনিষ্ট না করিয়া কি অপরের অনিষ্ট করিতে পারে? এই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণের অত্যাচার-সমষ্টি চক্রবৃদ্ধিহারে তাঁহাদেরই উপর ফিরিয়া আসিয়াছে, এই সহস্রবর্ষব্যাপী দাসত্ব ও অপমানে তাহারা অনিবার্য কর্মফলই ভোগ করিতেছে।

আপনাদেরই একজন পূর্বপুরুষ বলিয়াছিলেন, ‘ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।’৬৩—যাঁহাদের মন সাম্যে অবস্থিত, তাঁহারা জীবদ্দশাতেই সংসার জয় করিয়াছেন। তাঁহাকে লোকে ভগবানের অবতার বলিয়া বিশ্বাস করিয়া থাকে, আমরা সকলেই ইহা বিশ্বাস করি। তবে তাঁহার এই বাক্য কি অর্থহীন প্রলাপমাত্র? যদি তাহা না হয়, আর আমরা জানি তাঁহার বাক্য প্রলাপ নয়, তবে জাতি লিঙ্গ—এমন কি গুণ পর্যন্ত বিচার না করিয়া সমুদয় সৃষ্ট জগতের এই পূর্ণ সাম্যের বিরুদ্ধে যে-কোন চেষ্টা ভয়ানক ভ্রমাত্মক; আর যতদিন না এই সাম্যভাব আয়ত্ত হইতেছে, ততদিন কেহ কখনই মুক্ত হইতে পারে না।

অতএব হে রাজন, আপনি বেদান্তের উপদেশাবলী পালন করুন—অমুক ভাষ্যকারের বা টীকাকারের ব্যাখ্যানুসারে নহে, আপনার অন্তর্যামী আপনাকে যেরূপ বুঝাইয়াছেন, সেইভাবে। সর্বোপরি এই সর্বভূতে সর্ববস্তুতে সমজ্ঞানরূপ মহান্‌ উপদেশ পালন করুন—সর্বভূতে সেই এক ভগবানকে দর্শন করুন।

ইহাই মুক্তির পথ; বৈষম্যই বন্ধনের পথ। কোন ব্যক্তি বা কোন জাতি বাহিরের একত্ব-জ্ঞান ব্যতীত বাহিরের স্বাধীনতা লাভ করিতে পারে না, আর সকলের মানসিক একত্ব-জ্ঞান ব্যতীত মানসিক স্বাধীনতাও লাভ করিতে পারে না।

অজ্ঞান অসাম্য ও বাসনা—এই তিনটি মানবজাতির দুঃখের কারণ, আর উহাদের মধ্যে একটির সহিত অপরটির অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। একজন মানুষ নিজেকে অপর কোন মানুষ হইতে, এমন কি পশু হইতেও শ্রেষ্ঠ ভাবিবে কেন? বাস্তবিক সর্বত্রই তো এক বস্তু বিরাজিত। ‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী’৬৪ —তুমি স্ত্রী, তুমি পুরুষ, তুমি কুমার আবার তুমিই কুমারী।

অনেকে বলিবেন, ‘এরূপ ভাবা সন্ন্যাসীর পক্ষে ঠিক বটে, কিন্তু আমরা যে গৃহস্থ!’ অবশ্য গৃহস্থকে অন্যান্য অনেক কর্তব্য করিতে হয় বলিয়া সে পূর্ণভাবে এই সাম্য-অবস্থা লাভ করিতে পারে না, কিন্তু ইহা তাহাদেরও আদর্শ হওয়া উচিত। এই সমত্বভাব লাভ করাই সমগ্র সমাজের, সমুদয় জীবের ও সমগ্র প্রকৃতির আদর্শ। কিন্তু হায়, লোকে মনে করেঃ বৈষম্যই এই সমজ্ঞান-লাভের উপায়; অন্যায় কাজ করিয়া তাহারা যেন ন্যায়ের লক্ষ্যে—সত্যে পৌঁছিতে পারে!

ইহাই মনুষ্যপ্রকৃতিতে বিষবৎ কার্য করে; মনুষ্যজাতির উপর অভিশাপস্বরূপ, সকল দুঃখের মূল কারণ—এই বৈষম্য। ইহাই শরীরিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক সর্ববিধ বন্ধনের মূল।

‘সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্বিতমীশ্বরম্।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্॥’৬৫

ঈশ্বরকে সর্বত্র সমভাবে অবস্থিত দেখিয়া তিনি আত্মা দ্বারা আত্মাকে হিংসা করেন না, সুতরাং পরম গতি লাভ করেন। এই একটি শ্লোকে অল্প কথার মধ্যে সকলের উপযোগী মুক্তির উপায় বলা হইয়াছে।

রাজপুত আপনারা প্রাচীন ভারতের গৌরবস্বরূপ। আপনাদের অবনতি হইতেই জাতীয় অবনতি আরম্ভ হইল। লুণ্ঠিত ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা ভাগ করিয়া লইবার জন্য নহে, জ্ঞানহীনগণকে জ্ঞানদানের জন্য ও পূর্বপুরুষদের পবিত্র বাসভূমির প্রনষ্ট গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য যদি ক্ষত্রিয়দের বংশধরগণ ব্রাহ্মণের বংশধরগণের সহিত সমবেত চেষ্টায় বদ্ধপরিকর হন, তবেই ভারতের উন্নতি সম্ভব।

আর কে বলিতে পারে, ইহা শুভ মুহূর্ত নহে? কালচক্র আবার ঘুরিয়া আসিতেছে, পুনর্বার ভারত হইতে সেই শক্তিপ্রবাহ বাহির হইয়াছে, যাহা অনতিদূরকালমধ্যে নিশ্চয়ই জগতের দূরতম প্রান্তে পৌঁছিবে। এক মহাবাণী উচ্চারিত হইয়াছে, যাহার প্রতিধ্বনি প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, প্রতিদিনই যাহা অধিক হইতে অধিকতর শক্তিসংগ্রহ করিতেছে, আর এই বাণী পূর্ববর্তী সকল বাণী হইতেই অধিকতর শক্তিশালী, কারণ ইহা পূর্ববর্তী বাণীগুলির সমষ্টিস্বরূপ। যে বাণী একদিন সরস্বতীতীরে ঋষিগণের নিকট প্রকাশিত হইয়াছিল, যাহার প্রতিধ্বনি নগরাজ হিমালয়ের চূড়ায় চূড়ায় প্রতিধ্বনিত হইতে হইতে কৃষ্ণ বুদ্ধ ও চৈতন্যের ভিতর দিয়া সমতল প্রদেশে নামিয়া সমগ্র দেশ প্লাবিত করিয়াছিল, তাহাই আবার উচ্চারিত হইয়াছে। আবার দ্বার উদ্ঘাটিত হইয়াছে!

আর হে প্রিয় মহারাজ, আপনি সেই (ক্ষত্রিয়) জাতির বংশধর, যাঁহারা সনাতন ধর্মের জীবন্ত স্তম্ভস্বরূপ, অঙ্গীকারবদ্ধ রক্ষক ও সাহায্যকারী; আপনি রাম ও কৃষ্ণের বংশধর। আপনি কি এই কর্তব্য পালন না করিয়া দূরে থাকিবেন? আমি জানি, তাহা কখনই হইতে পারে না। আমার নিশ্চয় ধারণা, পুনরায় ধর্মের সাহায্যে আপনারই হস্ত প্রথমে প্রসারিত হইবে। হে রাজা অজিত সিং, যখনই আমি আপনার কথা ভাবি—যাঁহার মধ্যে আপনাদের বংশের সর্বজনবিদিত বৈজ্ঞানিক শিক্ষার সহিত এমন পবিত্র চরিত্র (যাহা থাকিলে একজন সাধুও গৌরবান্বিত হইতে পারেন) এবং সকল মানবের জন্য অসীম প্রেম যুক্ত হইয়াছে—যখন এইরূপ ব্যক্তিগণ সনাতন ধর্মের পুনর্গঠনে ইচ্ছুক, তখন আমি ইহার মহাগৌরবময় পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাসী না হইয়া থাকিতে পারি না।

চিরকালের জন্য আপনার উপর ও আপনার স্বজনগণের উপর শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ বর্ষিত হউক, আর আপনি পরের হিতের জন্য ও সত্যপ্রচারের জন্য দীর্ঘকাল জীবিত থাকুন, ইহাই সর্বদা বিবেকানন্দের প্রার্থনা।

১৮১*

[কলিকাতার জনৈক ব্যক্তিকে লিখিত]

আমেরিকা
২ মে, ১৮৯৫

প্রিয়,
তোমার সহৃদয় সুন্দর পত্রখানি পাইয়া বড়ই আনন্দিত হইলাম। তুমি যে আমাদের কার্য সাদরে অনুমোদন করিয়াছ, সেজন্য তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ। নাগমহাশয় একজন মহাপুরুষ। এরূপ মহাত্মার দয়া যখন তুমি পাইয়াছ, তখন তুমি অতি সৌভাগ্যবান। এই জগতে মহাপুরুষের কৃপালাভই জীবের সর্বোচ্চ সৌভাগ্য। তুমি এই সৌভাগ্যের অধিকারী হইয়াছ। ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’,৬৬ তুমি যখন তাঁহার৬৭ একজন শিষ্যকে তোমার জীবনের পথপ্রদর্শকরূপে পাইয়াছ, তখন তুমি তাঁহাকেই পাইয়াছ জানিবে।

প্রেমে মানুষে মানুষে, আর্যে ম্লেচ্ছে, ব্রাহ্মণে চণ্ডালে, এমন কি—পুরুষে নারীতে পর্যন্ত ভেদ করে না। প্রেম সমগ্র বিশ্বকে আপনার গৃহসদৃশ করিয়া লয়। যথার্থ উন্নতি ধীরে ধীরে হয়, কিন্তু নিশ্চিতভাবে। যে-সকল যুবক ভারতের নিম্নশ্রেণীর উন্নয়নরূপ একমাত্র কর্তব্যে মনপ্রাণ নিয়োগ করিতে পারে, তাহাদের মধ্যে কাজ কর, তাহাদিগকে জাগাও—সঙ্ঘবদ্ধ কর এবং এই ত্যাগ-মন্ত্রে দীক্ষিত কর। এ-কাজ ভারতের যুবকগণের উপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করিতেছে।

সকল বিষয়ে আজ্ঞাবহতা শিক্ষা কর; নিজ ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করিও না, গুরুজনের অধীন হইয়া চলা ব্যতীত কখনই শক্তির কেন্দ্রীকরণ হইতে পারে না, আর এইরূপ বিচ্ছিন্ন শক্তিগুলিকে কেন্দ্রীভূত না করিলে কোন বড় কাজ হইতে পারে না। কলিকাতার মঠটি প্রধান কেন্দ্র। অন্যান্য সকল শাখার সভ্যদের উচিত এই কেন্দ্রের সহিত একযোগে ও নিয়মানুসারে কার্য করা।

ঈর্ষা ও অহংভাব তাড়াইয়া দাও—সঙ্ঘবদ্ধভাবে অপরের জন্য কাজ করিতে শিখ। আমাদের দেশে এইটির বিশেষ অভাব।

শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ

পুঃ—নাগমহাশয়কে আমার অসংখ্য সাষ্টাঙ্গ জানাইবে।

বি

১৮২

[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]

নিউ ইয়র্ক
৫ মে, ১৮৯৫

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
যা ভেবেছিলাম, তাই হয়েছে। যদিও অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার তাঁর হিন্দুধর্মবিষয়ক রচনাসমূহের শেষভাগে ক্ষতিকর একটি মন্তব্য না দিয়ে ক্ষান্ত হন না, আমার তবু সর্বদাই মনে হত, কালে সমগ্র তত্ত্বই তিনি বুঝতে পারবেন। যত শীঘ্র পার, ‘বেদান্তবাদ’ (Vedantism) নামে তাঁর শেষ বইখানা সংগ্রহ কর। বইখানিতে দেখবে তিনি সবই সাগ্রহে গ্রহণ করেছেন—মায় জন্মান্তরবাদ।

আমি তোমাদের এ যাবৎ যা বলেছি, তারই কিছু অংশ এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ; বইখানি তোমার মোটেই দুরূহ বলে মনে হবে না।

অনেক বিষয়ে দেখবে চিকাগোয় আমি যা সব বলেছি, তারই আভাস।

বৃদ্ধ যে সত্য বস্তু ধরতে পেরেছেন—এতে আমি এখন আনন্দিত। কারণ আধুনিক গবেষণা ও বিজ্ঞানের বিরোধিতার মুখে ধর্ম অনুভব করবার এই হল একমাত্র পথ।

আশা করি, টড্-এর ‘রাজস্থান’ ভাল লাগছে। আন্তরিক ভালবাসা জেনো। ইতি

 

তোমাদের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

পুঃ—মেরী কবে বোষ্টনে আসছে?

—বি

১৮৩*

[মিঃ ফ্রান্সিস লেগেটকে লিখিত]

আমেরিকা
৬ মে, ১৮৯৫

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আজ প্রাতে তোমার শেষ চিঠিখানা এবং রামানুজাচার্যের ভাষ্যের প্রথম ভাগ পেলাম। কয়েকদিন আগে তোমার আর একখানা পত্র পেয়েছিলাম। মণি আয়ারের কাছ থেকেও একখানা পত্র পেয়েছি।

আমি ভাল আছি—কাজকর্ম আগের মতই চলছে। তুমি লাণ্ড বলে একজনের বক্তৃতার কথা লিখেছ; তিনি কে এবং কোথায় থাকেন, তার কিছুই জানি না। হতে পারে তিনি কোন গীর্জার বক্তা। কারণ তিনি যদি বড় বড় সভায় বক্তৃতা দিতেন, তাহলে আমরা নিশ্চয় তাঁর কথা শুনতে পেতাম। হতে পারে তিনি কোন কোন খবরের কাগজে তাঁর বক্তৃতার রিপোর্ট বার করে ভারতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, আর মিশনরীরা তাঁর সাহায্যে নিজেদের ব্যবসা জমাবার চেষ্টা করছে। তোমার চিঠি থেকে তো আমি এই পর্যন্ত অনুমান করছি। এখানে এই ব্যাপারটা নিয়ে সাধারণের ভেতর এমন কিছু সাড়া পড়েনি, যাতে আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে। কারণ তাহলে এখানে প্রত্যহ আমাকে শত শত লোকের সঙ্গে লড়াই করতে হয়।

এখন এখানে ভারতের খুব সুনাম, এবং ডাঃ ব্যারোজ ও অন্যান্য গোঁড়ারা সবাই মিলে এই আগুন নেভাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয়তঃ ভারতের বিরুদ্ধে গোঁড়াদের এই বক্তৃতাগুলিতে আমার প্রতি রাশি রাশি গালিগালাজ থাকা চাই-ই। … সন্ন্যাসী হয়ে আমাকে কি সেগুলির বিরুদ্ধে ক্রমাগত আত্মসমর্থন করে যেতে হবে? এখানে আমার কয়েকজন প্রভাবশালী বন্ধু আছেন, তাঁরাই মাঝে মাঝে জবাব দিয়ে এঁদের চুপ করিয়ে দেন। আর হিন্দুরা সবাই যদি নিশ্চিন্তে ঘুমায়, তবে হিন্দুধর্ম সমর্থন করবার জন্য আমার এত শক্তি অপচয় করার দরকার কি বল? এখন এখানে ভারতের খুব সুনাম, এবং ডাঃ ব্যারোজ ও অন্যান্য গোঁড়ারা সবাই মিলে এই আগুন নেভাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয়তঃ ভারতের বিরুদ্ধে গোঁড়াদের এই বক্তৃতাগুলিতে আমার প্রতি রাশি রাশি গালিগালাজ থাকা চাই-ই। … সন্ন্যাসী হয়ে আমাকে কি সেগুলির বিরুদ্ধে ক্রমাগত আত্মসমর্থন করে যেতে হবে? এখানে আমার কয়েকজন প্রভাবশালী বন্ধু আছেন, তাঁরাই মাঝে মাঝে জবাব দিয়ে এঁদের চুপ করিয়ে দেন। আর হিন্দুরা সবাই যদি নিশ্চিন্তে ঘুমায়, তবে হিন্দুধর্ম সমর্থন করবার জন্য আমার এত শক্তি অপচয় করার দরকার কি বল?

তোমরা ত্রিশ কোটি মানুষ—বিশেষ যারা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধির অহঙ্কারে এত গর্বিত, তারা—কি করছ বল দেখি? লড়াই করবার ভারটা তোমরা নিয়ে আমাকে কেবল প্রচার ও শিক্ষার জন্য ছেড়ে দাও না কেন? এখানে আমি দিনরাত অচেনা বিদেশীদের ভেতরে থেকে প্রাণপণ সংগ্রাম করছি, প্রথমতঃ নিজের অন্নের জন্য, দ্বিতীয়তঃ—যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করে আমার ভারতীয় বন্ধুদের সাহায্য করবার জন্য। ভারত কি সাহায্য পাঠাচ্ছে বল? ভারতবাসীর মত দেশপ্রেমহীন আর কোন জাতি পৃথিবীতে আছে কি? যদি তোমরা বার জন সুশিক্ষিত দৃঢ়চেতা ব্যক্তিকে ইওরোপ-আমেরিকায় প্রচারের জন্য পাঠাতে এবং কয়েক বৎসর তাদের এখানে থাকবার খরচ যোগাতে পারতে, তাহলে তোমরা ভারতের নৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় প্রকার প্রভূত উপকার করতে পারতে। ভারতের প্রতি নৈতিক সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি রাজনৈতিক বিষয়েও ভারতের বন্ধু হয়ে দাঁড়ায়।

পাশ্চাত্যের অনেকে তোমাদিগকে অর্ধনগ্ন বর্বর জাতি মনে করে, সুতরাং ভাবে—খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের সভ্য করে তুলতে হবে। তোমরা এর বিপরীতটা প্রমাণ কর না কেন? তোমরা কুকুর-বিড়ালের মত কেবল বংশবৃদ্ধি করতে পার। … যদি তোমরা ত্রিশ কোটি লোক ভয়ে ভীত হয়ে বসে থাক, একটি কথা বলবারও সাহস না পাও, তবে এই সুদূর দেশে একটা মানুষ আর কত করবে বল? আমি তোমাদের জন্য যতটুকু করেছি, তোমরা ততটুকুরও উপযুক্ত নও। তোমরা আমেরিকার কাগজে হিন্দুধর্ম সমর্থন করে প্রবন্ধ লিখে পাঠাও না কেন? কে তোমাদের বেঁধে রেখেছে? দৈহিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক সব বিষয়ে কাপুরুষের জাত—তোমরা যেমন পশুতুল্য, তেমন ব্যবহার পাচ্ছ। কেবল দুটো জিনিষ তোমাদের লক্ষ্য—কাম ও কাঞ্চন। তোমরা একজন সন্ন্যাসীকে খুঁচিয়ে তুলে দিনরাত লড়াতে চাও, আর তোমরা নিজেরা—সাহেবদের, এমন কি মিশনরীদের ভয়ে ভীত! তোমরা আবার বড় বড় কাজ করবে—ফুঃ! কেন তোমরা কয়েকজন মিলে বেশ উত্তমরূপে হিন্দুধর্ম সমর্থন করে বোষ্টনের এরেনা পাবলিশিং কোম্পানীর কাছে লেখা পাঠাও না? ‘এরেনা’ (Arena) একখানি সাময়িক পত্র—ওরা খুব আনন্দের সঙ্গে তা ছাপাবে, আবার হয়তো পারিশ্রমিকস্বরূপ তোমাদের যথেষ্ট টাকাও দেবে। তাহলেই তো চুকে গেল।

এইটি মনে রেখো যে, এ পর্যন্ত যে-সব হতভাগা হিন্দু এই পাশ্চাত্য দেশে এসেছে, তারা অর্থ বা সম্মানের জন্য নিজের দেশ ও ধর্মের কেবল বিরুদ্ধ সমালোচনাই করেছে। তোমরা জান, আমি এখানে নাম-যশের জন্য আসিনি—আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও এসব এসে পড়েছে। ভারতে গিয়ে আমি কি করব? কে আমায় সাহায্য করবে? ভারতের কি দাসসুলভ স্বভাব বদলেছে? তোমরা ছেলেমানুষ—ছেলেমানুষের মত কথা বলছ—কিসে কি হয়, তোমরা তা জান না। মান্দ্রাজে তেমন লোক কোথায়, যারা ধর্মপ্রচারের জন্য সংসার ত্যাগ করবে? দিবারাত্র বংশবৃদ্ধি ও ঈশ্বরানুভূতি—একদিনও একসঙ্গে চলতে পারে না। আমিই একা সাহস করে নিজের দেশকে সমর্থন করছি; হিন্দুদের কাছ থেকে এরা যা আশাই করেনি, তাই আমি এদের দিয়েছি … । অনেকেই আমার বিরুদ্ধে, কিন্তু আমি কখনও তোমাদের মত কাপুরুষ হব না। আমি কাজ করতে করতেই মরব—পালাব না। কিন্তু এই দেশে হাজার হাজার লোক রয়েছে, যারা আমার বন্ধু এবং শত শত ব্যক্তি রয়েছে, যারা মৃত্যু পর্যন্ত আমার অনুসরণ করবে; প্রতি বৎসরই এদের সংখ্যা বাড়বে। আর যদি এখানে আমি তাদের সঙ্গে থেকে কাজ করি, তবে আমার ধর্মের আদর্শ—জীবনের আদর্শ সফল হবে, বুঝলে?

আমেরিকায় যে সর্বজনীন মন্দির (Temple Universal) স্থাপিত হবার কথা উঠেছিল, সে সম্বন্ধে আর বড় উচ্চবাচ্য শুনতে পাই না। তবে মার্কিন জীবনের কেন্দ্রস্বরূপ নিউ ইয়র্কে আমার প্রতিষ্ঠা দৃঢ় হয়েছে, এখানে আমার কাজ চলতে থাকবে। আমি আমার শিষ্যদের যোগ, ভক্তি ও জ্ঞান শিক্ষার সমাপ্তির জন্য একটি গ্রীষ্মাবাসে নির্জন স্থানে নিয়ে যাচ্ছি—যাতে তারা কাজ চালিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে।

যা হোক, বৎস, আমি তোমাদের যথেষ্ট তিরস্কার করেছি। তোমাদের তিরস্কার করা দরকার ছিল। এখন কাজে লাগ—কাগজখানার জন্য এখন উঠে পড়ে লাগ। আমি কলিকাতায় কিছু টাকা পাঠিয়েছি; মাসখানেকের ভেতর কাগজটার জন্য তোমাদের কাছেও কিছু টাকা পাঠাতে পারব। এখন অবশ্য অল্পই পাঠাব, পরে নিয়মিতরূপে কিছু কিছু পাঠাতে পারব। এখন কাজে লাগ। হিন্দু ভিখারীদের কাছে আর ভিক্ষা করতে যেও না। আমি নিজের মস্তিষ্ক এবং সবল দক্ষিণ বাহুর সাহায্যে নিজেই সব করব। এখানে বা ভারতে আমি কারও সাহায্য চাই না। কলিকাতা ও মান্দ্রাজ দু-জায়গায় কাজের জন্য যা টাকা দরকার, তা আমি নিজেই রোজগার করব। … রামকৃষ্ণকে অবতার বলে মানবার জন্য লোককে বেশী পীড়াপীড়ি করো না।

এখন তোমাদের কাছে আমার নূতন আবিষ্কারের কথা বলছি। ধর্মের যা কিছু সব বেদান্তের মধ্যেই আছে, অর্থাৎ বেদান্তদর্শনের দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও অদ্বৈত—এই তিনটি স্তরে আছে, একটির পর একটি এসে থাকে। এই তিনটি মানবের আধ্যাত্মিক উন্নতির তিনটি ভূমিকা। এদের প্রত্যেকটিরই প্রয়োজন আছে। এই হল ধর্মের সারকথা। ভারতের বিভিন্ন জাতির আচার-ব্যবহার মত ও বিশ্বাসে প্রয়োগের ফলে বেদান্ত যে রূপ নিয়েছে, সেইটি হচ্ছে হিন্দুধর্ম; এর প্রথম স্তর অর্থাৎ দ্বৈতবাদ—ইওরোপীয় জাতিগুলির ভাবের ভেতর দিয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে খ্রীষ্টধর্ম, আর সেমেটিক জাতিদের ভেতর হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলমান ধর্ম; অদ্বৈতবাদ উহার যোগানুভূতির আকারে হয়ে দাঁড়িয়েছে বৌদ্ধধর্ম প্রভৃতি। এখন ‘ধর্ম’ বলতে বুঝায় বেদান্ত। বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন প্রয়োজন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং অন্যান্য অবস্থা অনুসারে তার প্রয়োগ অবশ্যই বিভিন্ন হবে।

তোমরা দেখতে পাবে যে, মূল দার্শনিক তত্ত্ব যদিও এক, তবু শাক্ত শৈব প্রভৃতি প্রত্যেকেই নিজ নিজ বিশেষ ধর্মমত ও অনুষ্ঠান-পদ্ধতির ভেতর তাকে রূপায়িত করে নিয়েছে। এখন তোমাদের কাগজে এই তিন ‘বাদ’ সম্বন্ধে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ লিখে ওদের মধ্যে একটি অপরটির পর আসে, এইভাবে সামঞ্জস্য দেখাও—আর আনুষ্ঠানিক ভাবটা একেবারে বাদ দাও। অর্থাৎ দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক দিকটাই প্রচার কর; লোকে সেগুলি তাদের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকলাপাদিতে লাগিয়ে নিক। আমি এ বিষয়ে একখানি বই লিখতে চাই—সেজন্য সব ভাষ্যগুলি চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার কাছে এ পর্যন্ত কেবল রামানুজ-ভাষ্যের একখণ্ড মাত্র এসেছে।

আমেরিকান থিওসফিষ্টরা অন্য থিওসফিষ্টদের দল ছেড়ে দিয়েছে …। ইংলণ্ডের স্টার্ডি সাহেব সম্প্রতি ভারতে গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে আমার গুরুভ্রাতা শিবানন্দের সাক্ষাৎ হয়েছিল; তিনি আমাকে এক পত্র লিখে জানতে চেয়েছেন, কবে আমি ইংলণ্ডে যাচ্ছি। তাঁকে একখানি সুন্দর পত্র লিখেছি। বাবু অক্ষয়কুমার ঘোষের খবর কি? আমি তাঁর কাছ থেকে আর কোন খবর পাইনি। মিশনরীগণকে ও অপরাপর সকলকে তাদের যা প্রাপ্য, দিয়ে দাও। আমাদের দেশের কতকগুলি বেশ দৃঢ়চেতা লোককে ধর—ভারতে বর্তমানে ধর্মের নবজাগরণ সম্বন্ধে বেশ সুন্দর ওজস্বী অথচ সুরুচিসঙ্গত একটা প্রবন্ধ লেখ আর সেটি আমেরিকার কোন সাময়িক পত্রে পাঠিয়ে দাও। আমার ঐরকম দু-একখানা কাগজের সঙ্গে জানাশোনা আছে। তোমরা তো জান, আমি বিশেষ লিখিয়ে নই; আর লোকের দোরে দোরে ঘুরে বেড়ানর অভ্যাসও আমার নেই। আমি চুপচাপ বসে থাকি, আর যা কিছু আসবার আমার কাছে আসে—তার জন্য আমি বিশেষ চেষ্টা করি না। নিউ ইয়র্ক থেকে Metaphysical Magazine বলে একখানা নূতন দার্শনিক পত্রিকা বের হয়েছে—ওখানা বেশ ভাল কাগজ। পল কেরসের কাগজটা মন্দ নয়, তবে ওর গ্রাহকসংখ্যা বড় কম। বৎসগণ! আমি যদি কপট বিষয়ী হতাম, তবে এখানকার কাজ সংগঠিত করে খুব সাফল্য অর্জন করতে পারতাম। হায়, এখানে ধর্ম বলতে তার বেশী কিছু বুঝায় না। টাকার সঙ্গে নাম- যশ—এই হল ধর্মযাজক; আর টাকার সঙ্গে কাম যোগ দিলে হল সাধারণ গৃহস্থ।

আমাকে এখানে একদল নূতন মানুষ সৃষ্টি করতে হবে, যারা ঈশ্বরে অকপট বিশ্বাসী হবে এবং সংসারকে একেবারে গ্রাহ্য করবে না। অবশ্য এটি হবে ধীরে—অতি ধীরে। ইতোমধ্যে তোমরা কাজ করে চল, আর যদি তোমাদের ইচ্ছা থাকে এবং সাহস থাকে, তবে মিশনরীরা যা পাবার উপযুক্ত, তাদের তাই দাও। যদি আমি তাদের সঙ্গে লড়াই করতে যাই, [এখানে] আমার শিষ্যেরা চমকে যাবে। মিশনরীরা তো আর তর্ক করে না, তারা কেবল গালাগাল করে; সুতরাং ওদের সঙ্গে বিবাদ করলে আমার চলবে না। সেদিন রমাবাঈ নামক খ্রীষ্টান মহিলাটি আমার একজন বিশেষ বন্ধু অধ্যাপক জেমসের কাছ থেকে খুব জোর ধাক্কা খেয়েছেন—কাগজের সেই অংশটা তোমাকে পাঠালাম। সুতরাং তোমরা দেখছ, তারা আমার এখানকার বন্ধুবর্গের কাছ থেকে মাঝে মাঝে এইরূপ ধাক্কা খাবে, আর তোমরাও ভারতে মধ্যে মধ্যে তাদের ঐরূপ দু-চার ঘা দিতে থাক—ঐ দুটোর মধ্যে আমি আমার নৌকো সিধে চালিয়ে নিয়ে যাই।

এখন কাগজখানা কোনরূপে বার করবার খুব ঝোঁক হয়েছে আমার। এই পত্রিকায় গুরুগম্ভীর বিষয় যেন লঘুভাবে আলোচিত না হয়, এর সুর—ধীর গম্ভীর উচ্চ গ্রামে বাঁধা চাই। আমি তোমাদের টাকা পাঠাব … কাজ আরম্ভ করে দাও। আমি এখানে অনেক গ্রাহক যোগাড় করে দেব, আমি নিজে ওর জন্য প্রবন্ধ লিখব এবং সময়ে সময়ে আমেরিকান লেখকদের দিয়ে প্রবন্ধ লিখিয়ে পাঠাব। তোমরাও একদল পাকা নিয়মিত লেখক ধর। তোমার ভগিনীপতি তো একজন খুব ভাল লেখক। তারপর আমি তোমাকে জুনাগড়ের দেওয়ান হরিদাসভাই, খেতড়ির রাজা, লিমডির ঠাকুরসাহেব প্রভৃতির নামে পত্র দেব, তাঁরা কাগজটার গ্রাহক হবেন—তাহলেই ওটা খুব চলে যাবে। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ও দৃঢ়চিত্ত হও এবং কাজ করে যাও। আমরা বড় বড় কাজ করব—ভয় পেও না। এই একটি নিয়ম কর যে, কাগজের প্রত্যেক সংখ্যায় পূর্বোক্ত তিনটি ভাষ্যের মধ্যে কোন না কোন একটির খানিকটা অনুবাদ থাকবে। আর এক কথা—তুমি সকলের সেবক হও, অপরের উপর এতটুকু প্রভুত্ব করতেও চেষ্টা করো না। তাতে ঈর্ষার উদ্রেক হবে ও সব মাটি করে দেবে। কাগজের প্রথম সংখ্যাটার বাইরের চাকচিক্য যেন ভাল হয়। আমি ওর জন্য একটা প্রবন্ধ লিখব। আর ভারতে ভাল ভাল লেখকদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের বেশ ভাল ভাল প্রবন্ধ সংগ্রহ কর। তার মধ্যে একটা যেন দ্বৈত-ভাষ্যের অংশবিশেষের অনুবাদ হয়। পত্রিকার প্রচ্ছদপটে প্রবন্ধ ও লেখকদের নাম থাকবে, আর চারধারে খুব ভাল প্রবন্ধগুলির ও ওদের লেখকদের নাম থাকবে। আগামী মাসের মধ্যেই আমি প্রবন্ধ ও টাকা পাঠাচ্ছি। কাজ করে চল। তুমি এ যাবৎ চমৎকার কাজ করেছ। আমরা সাহায্যের জন্য বসে থাকব না। হে বৎস! আমরাই এটা কাজে পরিণত করব—আত্মনির্ভরশীল ও বিশ্বাসী হও, ধৈর্য ধরে থাক। আশা করি, সামান্না তোমায় কিছু সাহায্য করতে পারে। আমার অপর বন্ধুদের বিরোধিতা করো না—সকলের সঙ্গে মিলেমিশে চল। সকলকে আমার অনন্ত ভালবাসা জানিও।

সদা আশীর্বাদক
তোমাদের বিবেকানন্দ

পুঃ—‘—’ আয়ার এবং অন্যান্য ভদ্রমহোদয়গণের সহিত সকল বিষয়ে পরামর্শ করে চলবে। যদি তুমি নিজেকে নেতারূপে সামনে দাঁড় করাও, তাহলে কেউ তোমায় সাহায্য করতে আসবে না, বোধ হয় এই হচ্ছে তোমার বিফলতার কারণ।—আয়ারের নামটাই যথেষ্ট; তাঁকে যদি না পাও, অন্য কোন বড়লোককে তোমাদের নেতা কর। যদি কৃতকার্য হতে চাও, অহংটাকে আগে নাশ করে ফেল। ইতি

—বি

১৮৪*

54 W. 33rd Street, নিউ ইয়র্ক
৭ মে, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
মিস ফার্মারের সঙ্গে ঐ ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তি করে ফেলবার দরুন আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ। ভারতবর্ষ থেকে একখানা খবরের কাগজ পেলাম, তাতে ভারত থেকে ডাঃ ব্যারোজকে ধন্যবাদ পাঠান হয়েছিল, তার সংক্ষিপ্ত উত্তর বেরিয়েছে। মিস থার্সবি আপনাকে সেটা পাঠিয়ে দেবেন।

গতকাল মান্দ্রাজ অভিনন্দন-সভার সভাপতির কাছ থেকে আর একখানা পত্র পেলাম—তাতে তিনি মার্কিনদের ধন্যবাদ দিয়েছেন, আমাকেও একটা অভিনন্দন পাঠিয়েছেন। আমি তাঁকে আমার মান্দ্রাজী বন্ধুদের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে বলেছিলাম। এই ভদ্রলোকটি মান্দ্রাজ শহরের অধিবাসিগণের মধ্যে সর্বপ্রধান, মান্দ্রাজের প্রধান ধর্মাধিকরণের (High Court) একজন বিচারপতি—ভারতে এ একটি অতি উচ্চপদ।

আমি নিউ ইয়র্কে জনসভায় আর দুটি বক্তৃতা দেব; ‘মট্ স্মৃতি-মন্দিরের’ ওপর- তলায় এই দুটি বক্তৃতা হবে। প্রথমটি আগামী সোমবার, বিষয়—‘ধর্মবিজ্ঞান’; দ্বিতীয়টির বিষয়—‘যোগের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা’।

মিস থার্সবি প্রায় ক্লাসে আসেন। মিঃ ফ্লন এক্ষণে আমার কার্যের ওপর বিশেষ অনুরাগ দেখাচ্ছেন ও প্রসারের জন্য যত্ন নিচ্ছেন। ল্যাণ্ডস‍্‌বার্গ আসে না। আমার আশঙ্কা হয়, সে আমার ওপর খুব বিরক্ত হয়েছে। মিস হ্যামলিন কি ভারতের আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে বইখানি আপনাকে পাঠিয়েছে? আমার ইচ্ছা, আপনার ভাই বইখানি পড়ে দেখেন এবং নিজে নিজে বোঝেন—ভারতে ইংরেজ শাসন বলতে কি বুঝায়।

আপনার চিরকৃতজ্ঞ সন্তান
বিবেকানন্দ