শামীম নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে নামিয়ে দেয়, তারপর নিজে ছোট একটা লাফ দিয়ে নৌকার গলুইয়ে বসে গেল। নৌকার অন্য মাথায় সেরিনা বসে শামীমের দিকে তাকিয়েছিল। সে মাথা নেড়ে বলল, “ভেরি গুড আব্বু।”
শামীম বৈঠাটা হাতে নিয়ে বলল, “কোন জিনিষটা ভেরি গুড?”
“এই যে তুমি পানিতে আছাড় না খেয়ে নৌকাতে উঠতে পেরেছে সেইটা ভেরি গুড।”
শামীম বলল, “তোর ধারণা শুধু তুই পানিতে ওঠা-নামা করতে পারিস, আমরা পারি না?”
“তুমি যেরকম জবুথবু তোমাকে দেখে তো সে-রকমই মনে হয়।”
“আমার সাথে ঠাট্টা করবি না, খবরদার।”
“ঠিক আছে তোমার সাথে ঠাট্টা করব না।” সেরিনা এক মুহূর্ত থেমে বলল, “থ্যাংকু আব্বু। তোমাকে অনেক থ্যাংকু।”
“কেন? হঠাৎ করে আমাকে এতো থ্যাংকু কেন?”
“এই যে তুমি আমাকে আজকে এই বিলে নিয়ে এসেছ, সেইজন্যে।”
শামীম বৈঠা দিয়ে পানি কাটতে কাটতে বলল, “কাজটা খুব সহজ হয় নাই। এই নৌকাটা কিনতে হয়েছে, নৌকা চালানো শিখতে হয়েছে।”
সেরিনা আরেকটা বৈঠা হাতে নিয়ে বলল, “ভালোই তো হয়েছে, নৌকা চালানো অনেক ভালো ব্যায়াম। তুমি তো শুধু চেয়ার টেবিলে বসে লেখাপড়া করো। তোমার ব্যায়াম করা দরকার ছিল। আজকে তোমার ব্যায়াম হবে।”
শামীম বলল, “অনেক হয়েছে। এখন মুখটা বন্ধ কর।”
“না, আব্বু, তোমাকে আসলেই থ্যাংকু। আমাদের পুকুরের তলাটা দেখতে দেখতে চোখটা পচে গেছে; ওখানে দেখার মতো কিছুই নাই। এই বিলটার কথা চিন্তা কর–কতো বড় একটা বিল, এইটার পানির নিচে না জানি কতো কি আছে?”
“সেইটা ভালো না খারাপ আমি বুঝতে পারছি না।”
“খারাপ কেন হবে?”
“পানির নিচে কী আছে কে জানে!”
সেরিনা খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলল, “আব্বু তুমি পানিকে এতো ভয় পাও কেন?”
“আমি মোটেও পানিকে ভয় পাই না। প্রত্যেকদিন ঘুমানোর আগে আমি দুই গ্লাস পানি খাই!”
“সেটা ঠিক। বোতলের পানিকে তুমি ভয় পাও না। কিন্তু পুকুরের পানি, বিলের পানি, নদীর পানি, সমুদ্রের পানি তুমি ভয় পাও!”
শামীম মাথা নেড়ে বলল, “আমি তো তোর মতো পানির নিচে থাকতে পারি না, দেখতে পারি না–তুই যখন পানির নিচে থাকিস তখন কী করিস আমি দেখতে পারি না তাই তোর জন্য আমার একটু ভয় লাগে।”
সেরিনা গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার জন্যে তুমি একটুও ভয় করো না আব্বু। পানির নিচে কেউ আমাকে কিছু করতে পারবে না।”
“থাক এতো বড় বড় কথা বলে লাভ নেই।”
“সত্যি আব্বু। আমার কী মনে হয় জান?”
“কী মনে হয়।”
“আমি ইচ্ছে করলে পানির নিচে দিনের পর দিন থাকতে পারব।”
শামীম ভুরু কুঁচকে বলল, “কী বললি?”
সেরিনা বলল, “বলেছি যে আমি ইচ্ছে করলে পানির নিচে দিনের পর দিন থাকতে পারব।”
“খাবি কী? ঘুমাবি কোথায়?”
“শুকনো জায়গায় খাওয়ার কিছু নাই আব্বু। পানির নিচে অনেক রকম খাবার। আর ঘুমানোর জন্য পানির নিচে কিছু লাগে না। আমি যে কোনো জায়গায় ঘুমাতে পারি। তুমি তো কখনো পানির ভেতরে ভেসে ভেসে ঘুমাও নি তাই তুমি জানো না পানিতে ঘুমাতে কতো আরাম। একবার পানিতে ঘুমানো অভ্যাস হয়ে গেলে তুমি বিছানায় ঘুমাতেই পারবে না।”
শামীম একটু শংকিত দৃষ্টিতে সেরিনার দিকে তাকিয়ে থাকে একটু পরে বলে, “কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি ভালো না। তোকে পানির নিচে ঘুমাতে হবে না, থাকতেও হবে না। তোর যদি পানির নিচে থাকার কথা হতো তাহলে খোদা তোকে পাঙাস মাছ করে পাঠাতো। খোদা মোটেই তোকে পাঙ্গাস মাছ করে পাঠায় নাই। তোকে সেরিনা করে পাঠিয়েছে।”
সেরিনা খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলল, “আব্বু তুমি এতো মজা করে কথা বলতে পার! পাঙ্গাস। হি হি হি!”
শামীম চারদিকে তাকায়। আশেপাশে এখন কোনো জেলে নৌকা নেই। সেরিনা যখন পানিতে নামবে শামীম চায় না তখন কেউ সেটা দেখুক। গোপনে কয়েক ঘণ্টা পানির নিচে ভেসে বেড়িয়ে আবার বের হয়ে আসবে। শামীম বলল, “সেরিনা জায়গাটা কেমন? এখানে নামবি?”
সেরিনা বলল, “ফ্যান্টাস্টিক। পানি কতো পরিষ্কার দেখেছ? এখানে অনেক দূর পর্যন্ত আলো যাবে। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাবে।”
সেরিনা ঠিক যখন বিলের পানিতে নেমে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ দূর থেকে একটা শক্তিশালী ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেল, শামীম একটু অবাক হয়ে তাকাল, দেখল বহুদূর থেকে একটা স্পীডবোট ছুটে আসছে। শামীম বলল, “এই বিলে স্পীডবোট কোথা থেকে আসছে?”
“জানি না, আব্বু।”
সেরিনাও দূরে তাকিয়ে থাকে। স্পীড বোটটা গর্জন করে পানি কেটে তাদের দিকে আসছে। দেখতে দেখতে সেটা কাছে চলে আসে, তাদের নৌকাটার খুব কাছে দিয়ে সেটা ছুটে চলে যায়। স্পীডবোটের তৈরি ঢেউয়ে শামীম আর সেরিনার নৌকাটা বেশ ভালো রকম দুলতে থাকে।
স্পীড বোটে কয়েকজন মানুষ বসে আছে, এর মাঝে একজনকে বিদেশী মনে হলো। চোখে কালো চশমা, রঙিন সার্ট। হাতে বাইনোকুলার। শামীম বলল, “নিশ্চয়ই এনজিও।”
“কিসের এনজিও আব্বু।”
“জানি না। বিদেশী এনজিওগুলো পকেটে করে কিছু ডলার এনে ছিটিয়ে দেয় আর সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে।”
সেরিনা বলল, “এখন নামি আব্বু?”
“একটু দাঁড়া। স্পীড বোটটা একেবারে চলে যাক।”
কিন্তু স্পীড বোটটা একেবারে চলে গেল না, বেশ কিছুদূর গিয়ে আবার সেটা ঘুরে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, দেখে মনে হয় সোজা তাদের দিকে আসছে, কাছাকাছি এসে স্পীড বোটটা একটু সরে গিয়ে প্রায় তাদের নৌকায় পানি ছিটিয়ে বের হয়ে গেল। শামীম বলল, “কেমন বেয়াদপের মতো স্পীডবোট চালাচ্ছে দেখেছিস?”
“হ্যাঁ। দেখেছি।” স্পীড বোটে বসে থাকা মানুষটা যে বাইনোকুলার চোখে তাদের অনেক দূর থেকে লক্ষ্য করেছে সেটাও সে দেখেছে। কিন্তু শামীমকে কিছু বলল না।
“এবারে আমি নেমে যাই আব্বু?”
“যা নেমে যা।”
সেরিনা তখন বিলের পানিতে নেমে গেল। শামীম দেখল আশ্চর্য রকম সাবলীলভাবে তার মেয়েটি পানির গভীরে যেতে থাকে কিছুক্ষণেই সে অদৃশ্য হয়ে যায়। শামীম একটা নিশ্বাস ফেলল, আজকাল মাঝে মাঝে তার মনে হয় এই মেয়েটি বুঝি ডাঙ্গা থেকে পানিতে বেশি স্বস্তি বোধ করে।
নৌকাটা স্থির রাখার জন্যে একটা লোহার রডকে বাঁকা করে কাজ চালানোর মতো নোঙর তৈরী করে এনেছিল সেটা পানিতে ফেলে দিয়ে শামীম চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল। বহুদূরে কয়েকটা জেলে নৌকা, তার চাইতেও দূরে স্পীড বোটটা পানিতে স্থির হয়ে আছে। সেটি কাছে আসছে না আবার চলেও যাচ্ছে না। ঠিক কী কারণ জানা নেই শামীমের মনে হয় বিদেশী লোকটা বাইনোকুলার দিয়ে তাদের দেখছে। এক সময় শামীম নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়ল। মানুষেরা সাধারণ খোলা জায়গায় আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে না, মানুষ ঘরের ভেতর শোয়, তাই তাদের দৃষ্টি বাড়ীর ছাদে আটকে যায়। খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকলে দৃষ্টি কোথাও আটকে যায় না, সেই আদিগন্ত বিস্তৃত আকাশ, আকাশে সাদা মেঘ, মেঘের পাশে দুই পাখা বিস্তৃত করে আকাশে ভেসে থাকা চিল দেখা যায়। কী কারণ জানা নেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শামীম কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে যায়।
.
সূর্য পশ্চিম দিকে অনেকখানি হেলে যাবার পর সেরিনা পানি থেকে বের হয়ে এল। তার সারা শরীর পানিতে চিক চিক করছে। কোচড় বোঝাই নানা ধরনের শৈবাল, শামুক, পানির লতাপাতা ফলমূল। নৌকার মাঝে সেগুলো ঢেলে দিয়ে বলল, “আব্বু, তোমার জন্যে এনেছি।”
“আমার জন্যে?”
“হ্যাঁ আব্বু, খেয়ে দেখো।”
“তোর কবে থেকে ধারণা হলো আমি শামুক খাই, পানির লতাপাতা খাই?”
“তুমি বলছিলে না পানিতে কোনো খাবার নেই, সেই জন্যে এনেছি। ঐ কাঁটা কাটা ফলটা ভেঙ্গে দেখো ভেতরে কী মজার শাঁস। একেবারে গাজরের মতোন।”
“থাক! আমার যখন গাজর খাবার ইচ্ছে করবে তখন কাঁটা কাঁটা আজব কোনো ফল না খেয়ে বাজার থেকে গাজর কিনে আনব!”
“আব্বু তুমি খুবই বোরিং একজন মানুষ।”
“একটা ফেমিলিতে এক্সাইটিং মানুষ বেশী থাকা ভালো না। একজনই যথেষ্ট! এখন বল তুই পানির নিচে কী দেখলি।”
সেরিনার চোখ দুটো হঠাৎ চক চক করতে থাকে। সে দুই হাত নেড়ে বলল, “তুমি বিশ্বাস করবে না আব্বু পানির নিচে কী অসাধারণ সুন্দর। কতো রকম যে মাছ তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। শুধু মাছ না আব্বু আরো কতো রকম প্রাণী যে আছে–
“কতো রকম প্রাণী মানে?”
“সাপের মতন কিন্তু সাপ না। ব্যাঙের মতন কিন্তু ব্যাঙ না। এছাড়াও ভেঁদড় আছে, পানকৌড়িকেও দেখেছি! বড় বড় মাছ ঘুরে বেড়ায় তাদের পিছনে তার লক্ষ লক্ষ পোনা! কী যে মজা লাগে দেখতে! কতো রকম গাছ, গাছের ফাঁকে ফাঁকে কতো রঙিন মাছ! তোমাকে একদিন নিয়ে যেতে হবে।”
“থাক আমাকে নিতে হবে না। তুই গেলেই হবে।”
“আমি আবার যাব আব্বু। আজকে কিছুই দেখা হয় নি।”
“ঠিক আছে আরেকদিন যাবি। আজকে বাসায় চল।”
“চল আব্বু।”
শামীম নোঙরটা তুলে বৈঠা বেয়ে নৌকাটা তীরের দিকে নিতে থাকে। দূরে স্পীড বোটটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে। তারা তীরে পৌঁছানোর পর স্পীড বোটটা গর্জন করে আরো দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
.
বাংলা ক্লাশটা হওয়া উচিৎ সবচেয়ে আনন্দের কিন্তু সেরিনার কাছে বাংলা ক্লাশটা অসহ্য মনে হয়। ক্লাশটা পড়ান মকবুল স্যার। এই স্যারের মতো নিরানন্দ মানুষ পৃথিবীতে নাই, কথাবার্তাও বলেন এমনভাবে যে শুনলেই একজন মানুষ নেতিয়ে পড়বে। মকবুল স্যার ক্লাশের মাঝামাঝি গিয়েছেন আর তখন থেকে সেরিনা একটু পরে পরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে। তাদের ক্লাশরুমটা দোতলায়, দোতলা থেকে তাকালে বাইরে রাস্তা, রাস্তায় মানুষ, গাড়ী, টেম্পো সবকিছু দেখা যায়। মকবুল স্যারের একঘেয়ে গলার স্বর থেকে টেম্পুর হর্ণের শব্দ অনেক বেশি মজার।
সেরিনা রাস্তার দিকে কয়েকবার তাকিয়ে হঠাৎ করে মাইক্রোবাসটা সেরিনার চোখে পড়ল। বিয়ের সময় বরযাত্রী নেবার জন্যে যে রকম মাইক্রোবাস ভাড়া করা হয় এটা মোটেও সেরকম মাইক্রোবাস নয়, মাইক্রোবাসটা খুব চকচকে, খুবই আধুনিক। দেখলেই বোঝা যায় খুব দামী মাইক্রোবাস। তাদের মফস্বল শহরে এরকম গাড়ী কখনো দেখা যায় না।
মাইক্রোবাসটা তার ক্লাশরুমের খুব কাছাকাছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাটা ক্লাশরুমের এতো কাছে যে সে মাইক্রোবাসের প্যাসেঞ্জারকেও এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পায়। প্যাসেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল, মানুষটা বিদেশী, চোখে কালো চশমা হাতে একটা বাইনোকুলার। আর কী আশ্চর্য মানুষটা ঠিক তার দিকে তাকিয়েছিল, চোখে চোখ পড়তেই মানুষটা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। মাত্র সেদিন যখন সেরিনা তার আব্বুকে নিয়ে বিলের ভেতর গিয়েছিল তখন এই মানুষটাই স্পীড বোটে করে তাদের নৌকার চারপাশে ঘুরপাক খেয়েছে। হঠাৎ করে সেরিনার বুকটা ধ্বক করে ওঠে–তাহলে কী এই মানুষগুলো তার জন্যে এসেছে? কোনোভাবে তার খবর জেনে গেছে? সেরিনা এক ধরণের আতংক অনুভব করে। কখন মকবুল স্যারের ক্লাশ শেষ হয়ে গেছে সে টেরও পায় নি।
সেরিনা তার ডেস্ক থেকে তার বই খাতা নিয়ে উঠে গেল, গৌরী ক্লাশের পিছন দিকে বসেছে, তার কাছে গিয়ে বলল, “গৌরী তুই একটা কাজ করবি?”
“কী কাজ? “আমার সাথে সিট বদল করবি?” “সিট বদল?”
“হ্যাঁ। আমি ঐ জানালার কাছে বসেছি। তুই ওখানে বোস। আর আমি তোর সীটে বসব।”
গৌরী একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“তোকে পরে বলব। আর তুই আরো একটা কাজ করবি।”
“কী কাজ?”
“জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই তুই দেখবি রাস্তায় একটা ঘিয়ে রংয়ের মাইক্রোবাস। খুবই হাইফাই মাইক্রোবাস।”
“হুঁ। কী হয়েছে সেই মাইক্রোবাসের?”
“মাইক্রোবাসটা যদি চলে যায় তুই আমাকে সিগনাল দিবি।”
“কি রকম সিগনাল?”
“ডান হাতটা এভাবে নাড়াবি।” সেরিনা হাত দিয়ে কিছু একটা সরে যাওয়া দেখাল।
গৌরী জিজ্ঞেস করল, “আর যদি না যায়?”
“তাহলে তোর কিছু করতে হবে না। যা তুই আমার সিটে যা–তাড়াতাড়ি। আর একটা কথা–”
“কী কথা?”
সেরিনা বলল, “মাইক্রোবাসের প্যাসেঞ্জাররা যেন বুঝতে না পারে তুই তাদের লক্ষ্য করছিস। সোজাসুজি তাকাবি না।”
গৌরী অবাক হয়ে বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“তোর এখন কিছুই বুঝতে হবে না। তাড়াতাড়ি যা–এক্ষুনি রওশান ম্যাডাম চলে আসবে।
গৌরী তার বই খাতা নিয়ে জানালার কাছে সেরিনার সিটে বসে চোখের কোণা দিয়ে রাস্তায় তাকাল। সত্যিই রাস্তায় একটা ঘিয়ে রংয়ের মাইক্রোবাস। সে সরাসরি না তাকিয়ে চোখের কোণা দিয়ে মাইক্রোবাসটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
রওশান ম্যাডাম আসার পাঁচ মিনিট পর গৌরী সেরিনাকে সিগন্যাল দিয়ে জানালো মাইক্রোবাসটা চলে গেছে।
.
স্কুল ছুটির পর গৌরী সেরিনার কাছে এসে বলল, “সেরিনা, তুই বলবি কি হচ্ছে?”
“আমি ঠিক জানি না কীভাবে বলব।” আমার সাথে আয় হাঁটতে হাঁটতে বলি।
গৌরী আর সেরিনার বাসা একদিকে না, কিন্তু একটু ঘোরাপথে গেলে দুজন এক সাথে প্রথমে বেশ খানিকটা পথ যেতে পারে। মাঝে মাঝেই তারা এক সাথে হেঁটে হেঁটে এই পথে যায়। সাঁতার প্রতিযোগিতায় এক সাথে অংশ নেয়ার পর থেকে সেরিনার গৌরী, ললিতা আর বিলকিসের মাঝে অন্য এক ধরণের বন্ধুত্ব হয়েছে। প্রায় সময়েই তারা এক সাথে থাকে। বিলকিসের বাসা সম্পূর্ণ অন্যদিকে হওয়ার পরও মাঝে মাঝে সেরিনা গৌরী আর ললিতার সাথে হেঁটে হেঁটে যায়। আজকেও চারজন একদিকে রওনা দিল।
স্কুলের গেট থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে সেরিনার মনে হলো মোড়ের চায়ের দোকনে বসে থাকা দুইজন মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছে। আসলেই মানুষ দুইজন তার জন্যে উঠেছে নাকী এমনিতেই উঠেছে সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল না। সেরিনা সেটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাল না।
গৌরী বলল, “এখন বল, কী হয়েছে?”
বিলকিস জিজ্ঞেস করল, “কিসের কী হয়েছে?”
গৌরী বলল, “আমি জানি না।“
চারজনের মাঝে ললিতা কম কথা বলে তাই সে কিছু বলল না, অন্যেরা কী বলে শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। সেরিনা বলল, “আমি ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না।”
বিলকিস বলল, “ধানাই পানাই না করে কী বলবি বলে ফেল।”
সেরিনা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “হয়েছে কী, আমার মনে হচ্ছে আমাকে ধরে নেবার জন্যে একটা দল এসেছে।”
গৌরী, বিলকিস আর ললিতা একসাথে প্রায় চিৎকার করে বলল, “কী বললি? তোকে ধরে নিতে একটা দল এসেছে?”
“আমার মনে হয়।”
“কেন? তুই কী করেছিস?”
সেরিনা বলল, “মনে আছে আমরা সাঁতারে চাম্পিওন হয়েছিলাম!”
“হ্যাঁ। মনে আছে।”
“মনে আছে শেষ অংশটাতে আমি সাঁতার দিয়েছিলাম?”
তিনজন এবারে এক সাথে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, বলল, “হ্যাঁ! তুই যে গুলির মতো ছুটে গেলি! একবার পানি থেকে মাথা পর্যন্ত বের করলি না!”
সেরিনা বলল, “কাজটা ঠিক হয় নাই।” “কোন কাজটা ঠিক হয় নাই?”
“এই যে আমি এতো ভালো করে সাঁতার দিলাম এখন আমার ওপরে অনেকের নজর পড়ে গেছে!”
বিলকিস বলল, “সেটা তো ভালো। তুই সাঁতারের টিমে থাকবি দেশ বিদেশ থেকে মেডেল আনবি।”
সেরিনা মাথা নাড়ল, “উঁহু। জিনিষটা এতো সোজা না। আমি তোদেরকে সব কিছু বলতে পারব না। শুধু জেনে রাখ আমি যে এরকম সাঁতার কাটতে পারি এটা জানাজানি হওয়া আমার জন্যে ভালো না। মনে হয় সেইজন্যে আমাকে ধরে নিতে এসেছে।“
গৌরী জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে জানিস?”
সেরিনা বলল, “মনে আছে তোকে আজকে জানালার কাছে বসিয়েছিলাম?
“হ্যাঁ মনে আছে।”
“একটা মাইক্রোবাস দেখিয়েছিলাম, তোকে?”
“হ্যাঁ।” গৌরী মাথা নাড়ল।
“ঐ মাইক্রোবাসে একটা বিদেশী লোক থাকে–আমি যেখানেই যাই লোকটা আমার পিছু পিছু যায়। দূর থেকে বাইনোকুলার দিয়ে দেখে।” সেরিনা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “এই যে আমি হাঁটছি, আমার মনে হচ্ছে দুইজন মানুষ আমার পিছনে পিছনে আসছে।”
তিনজন আঁতকে উঠে বলল, “সত্যি?”
“তোরা কেউ এখন পিছনে তাকাবি না, যদি আসলেই থাকে তাহলে সন্দেহ করবে।”
ললিতা ভয়ে ভয়ে বলল, “এখন তাহলে কী করব?”
সেরিনা বলল, “আয় হেঁটে হেঁটে ঐ দোকানটা পর্যন্ত যাই। সেইখানে আমি ভান করব আমার কিছু একটা মনে পড়েছে, তখন তোদের ছেড়ে আমি আবার এই রাস্তা দিয়ে ফিরে যাব। তোরা দোকান থেকে লক্ষ্য করবি পিছনের দুইটা মানুষও আবার আমার পিছু নেয় কী না। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে। তারপর কী করব?”
“তারপর তোরা তোদের বাসায় যাবি, আমি আমার বাসায় যাব।”
“না।” বিলকিস হুংকার দিল, “আমরা তোকে বাসায় পৌঁছে দিব। কার ঘাড়ে দুইটা মাথা আছে তোকে কিডন্যাপ করবে? আমরা দেখে নিব।”
শান্তশিষ্ট ললিতা পর্যন্ত সেই হুংকারে সামিল হল। গৌরী বলল, “তুই সামনে গিয়ে ডানদিকে ঘুরে যা–আমরাও এদিক দিয়ে গিয়ে বাম দিকে ঘুরে তোর সাথে একত্র হব। তারপর সবাই মিলে তোকে বাসায় পৌঁছে দেব।”
বিলকিস বলল, “কাল থেকে তুই আর একা স্কুলে আসবি না। আমরা সকালে তোর বাসায় যাব। তারপর একসাথে স্কুলে আসব।”
অন্যেরা মাথা নেড়ে বিলকিসের কথায় সায় দিল। দেখে মনে হল এতোদিন পর সবাই একটা মনের মতো কাজ পেয়েছে।
দোকানের কাছে পৌঁছে চারজন দাঁড়িয়ে যায় তারপর সেরিনা কিছু একটা মনে পড়েছে সেরকম ভান করে যে দিক দিয়ে এসেছিল ঠিক সেই দিক দিয়ে ফিরে যেতে থাকে। সেরিনা এবং তার সাথে সাথে অন্য তিন জন দেখল দুটো মানুষ হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে যায়। তারা তখন নিজেদের ভেতর কথা বলে একজন পকেট থেকে সিগারেট বের করে তারপর দুজনে দুটো সিগারেট মুখে দেয়, একজন পকেট থেকে ম্যাচ বের করে, সিগারেট ধরায় এবং চোখের কোনা দিয়ে সেরিনাকে লক্ষ্য করতে থাকে।
সেরিনা মানুষ দুজনকে পার করে আরো বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর মানুষ দুটো আবার ঘুরে সেরিনার পিছু পিছু হটতে থাকে।
কারো মনে আর কোনো দ্বিধা থাকে না যে সেরিনার সন্দেহ সত্যি। মানুষ দুটো আসলেই সেরিনার পিছু পিছু যাচ্ছে। কিন্তু মানুষ দুটো আসলেই কি সেরিনাকে কিডন্যাপ করার জন্য এসেছে?
সেরিনা ডানদিকে ঘুরে যেতেই বাকী তিনজনের সাথে দেখা হয়ে গেল, তারা অন্য রাস্তা দিয়ে আগেই ছুটতে ছুটতে এখানে চলে এসেছে এখন তারা এক মুহূর্তের জন্যেও সেরিনাকে একাকী ছাড়তে রাজী নয়।
গৌরী, ললিতা আর বিলকিস মিলে সেরিনাকে তার বাসায় পৌঁছে দিল। ওরা ঠিক করে নিল পরের দিন বেশ সকালেই ওরা সেরিনাকে স্কুলে নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে কী করা যায় ঠিক করা হবে।