নিরানন্দ দালান
জিগিকে নিয়ে আমি আমার এপার্টমেন্টে যেতে চাইলাম কিন্তু সে রাজি হল না। যে জায়গা থেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে রাখা নেই সেখানে জিগি যায় না। বাধ্য হয়ে আমাকে তার সাথে নতুন এক জায়গায় যেতে হল। জায়গাটি বেআইনি–এখানে কখনো নিরাপত্তাকর্মীরা আসে না। সে কারণে পুরো এলাকাটির মাঝে এক ধরনের থমথমে নিরানন্দ ভাব, এখানকার মানুষজন বেপরোয়া এবং নিষ্ঠুর। বেশিরভাগই মাদকাসক্ত না হয়। ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহারকারী। আমরা আকাশের কাছাকাছি একটা ছোট ঘরে রাত কাটাবার আয়োজন করলাম। রাতের খাবার খেয়ে জিগি কোথায় কোথায় যেন যোগাযোগ করল, বিচিত্র রকমের মানুষেরা এসে তাকে কিছু যন্ত্রপাতিও দিয়ে গেল, সেগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে সে একটা নিউরাল কম্পিউটার দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে থাকে। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি নিউরাল কম্পিউটার তৈরি করছ?
জটিল একটা যন্ত্রের মাঝখানে আঙুল দিয়ে কিছু অবলাল রশ্মি আটকে দিয়ে বলল, হুম।
কিন্তু
কিন্তু কী?
এটা তো দেখছি ইন্টারফেস। মূল প্রসেসর আর মেমোরি কোথায়?
জিগি দাঁত বের করে হেসে আমার মাথায় আঙুল দিয়ে দুইবার টোকা দিল। আমি অবাক হয়ে বললাম, মস্তিষ্ক? মানুষের মস্তিষ্ক?
জিগি মাথা নাড়ল, বলল, নিখুঁতভাবে বলতে চাইলে বলা যেতে পারে তোমার মস্তিষ্ক! আমার বহুদিনের শখ ছিল একটা নিউরাল কম্পিউটারের, কিন্তু কে তার মস্তিষ্ক আমাকে ব্যবহার করতে দেবে? আর দিলেও আমি ইন্টারফেস করব কেমন করে? এখন একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম।
আমি আতঙ্কিত হয়ে জিগির দিকে তাকালাম, তুমি আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করবে?
তা না হলে কার? ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস আমি কেমন করে পাব? অকাট্য যুক্তি কিন্তু শুনে আমি আতঙ্কে শিউরে উঠি। মাথা নেড়ে বললাম, না–না। মস্তিষ্ক নিয়ে কোনো ছেলেখেলা না।
জিগি মুখ শক্ত করে বলল, ছেলেখেলা? তোমার ধারণা আমি ছেলেখেলা করি?
সত্যি কথা বলতে কী আমার তাই ধারণা। কিন্তু তাই বলে মনে করো না যে তোমার ওপরে আমার বিশ্বাস নেই।
জিগি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, তা হলে?
তা হলে কী?
তা হলে তোমার মস্তিষ্ক আমাকে ব্যবহার করতে দিচ্ছ না কেন? আমি কি নিজের জন্যে চাইছি? তোমার জন্যেই চাইছি!
আমার জন্যে?
জিগি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। তোমার জন্যে। তোমার অস্তিত্বকে রক্ষা করার জন্যে যদি নেটওয়ার্কে ঢুকতে হয় তা হলে একটা নিউরাল কম্পিউটার দরকার। তোমার সেই নেটওয়ার্কিং কেন্দ্রে কি আমাদের এমনিতে ঢুকতে দেবে? দেবে না–দরজার গোপন পাসওয়ার্ড বের করতে হবে। একটা ভালো নিউরাল কম্পিউটার ছাড়া কি গোপন পাসওয়ার্ড বের করতে পারব? পারব না।
আমি তবু অস্বস্তি বোধ করতে থাকি। জিগি আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, আমার ওপর বিশ্বাস রাখ লাতুল, আমি তোমার এক বিলিয়ন নিউরন শুধু ব্যবহার করব, একটা নিউরনেরও ক্ষতি করব না। এস–এই টেবিলটার ওপর শুয়ে পড়।
আমি খুব অনিচ্ছার সাথে টেবিলের ওপর শুয়ে পড়লাম। জিগি তার বিচিত্র জোড়াতালি দেওয়া যন্ত্রটি আমার মাথার কাছে নিয়ে এল। সেখান থেকে একটা মান্টিকোর কো–এক্সিয়াল তার বের হয়ে এসেছে, তার এক পাশে একটা বিদঘুঁটে সকেট। সকেটটি সে চাপ দিয়ে আমার মাথার পেছনে ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেসে লাগিয়ে দিল। সাথে সাথে আমার পুরো শরীরে আমি একটি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভব করি। মাথার ভেতরে হঠাৎ করে প্রচণ্ড যন্ত্রণা করে ওঠে অনেকগুলো আলোর ঝলকানি, উচ্চ কম্পনের একটা শব্দ এবং ঝুঁজালো এক ধরনের গন্ধের সাথে সাথে মুখে তীব্র এক ধরনের বিস্বাদ অনুভব করতে লাগলাম। আমি ছটফট করে উঠলাম, জিগি শক্ত করে আমাকে টেবিলে চেপে ধরে বলল, নড়বে না, খবরদার নড়বে না। এক্ষুনি সব ঠিক হয়ে যাবে।
জিগির কথা সত্যি প্রমাণিত হল, সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মাঝে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এল, শুধুমাত্র কোথায় যেন একটা ভোঁতা শব্দ শুনতে থাকলাম। জিগি আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, চমৎকার! নিউরাল কম্পিউটারের সাথে আমার প্রথম সফল যোগাযোগ। এখন। তোমাকে দিয়ে আমি কিছু জটিল সমস্যার সমাধান করাব।
কী ধরনের সমস্যা?
বায়োমেটেরিয়ালে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশানে নন লিনিয়ার উপঘাত
আমি এসব কিছুই জানি না।
জিগি আনন্দে হা–হা করে হাসল, বলল, এটাই তো মজা, তুমি এর কিছুই জান না কিন্তু তুমি এর সমাধান বলে দেবে। আমি সমস্যাটি সমান্তরাল করে দেব–তোমার মস্তিষ্কে যখন সেটি যাবে তুমি সমাধান করতে পার সেভাবে
আমি বুঝতে পারছি না।
এক্ষুনি বুঝতে পারবে। হঠাৎ হঠাৎ করে তুমি এখন বিচিত্র জিনিস দেখবে, তোমার সেই বিচিত্র জিনিস থেকে কোনো কিছু করার ইচ্ছে করবে তুমি সেটা করবে এবং আমি আমার সমাধান পেয়ে যাব।
যদি কিছু না করি?
করবে। জিগি অর্থবহভাবে চোখ টিপে বলল, করবে নিশ্চয়ই করবে!
জিগির কথা শেষ হবার আগেই আমি চোখের সামনে দেখতে পেলাম ছোট ছোট
অনেকগুলো বৃত্তাকার বস্তু। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, তবুও সেগুলো দেখা যেতে লাগল। সেগুলো ক্রমাগত বড় হচ্ছে, বড় হতে হতে সেগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন করে কিছু বৃত্ত তৈরি হচ্ছে যেগুলো আকার পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। আমার মনে হতে থাকে এই বৃত্তগুলোর একটার সাথে আরেকটার সমন্বয় করতে হবে–না করা পর্যন্ত আমি বুঝি শান্তি পাব না। আমার বিচিত্র এক ধরনের কষ্ট হতে থাকে। শারীরিক কোনো কষ্ট নয়, অন্য কোনো এক ধরনের কষ্ট। আমি প্রাণপণে সেই বিচিত্র বৃত্তাকার বস্তুগুলোকে আমার মাথার ভেতরে সাজাতে থাকি, হঠাৎ হঠাৎ সেগুলো সাজানো হয়ে যায় এবং আমি তখন নিজের ভেতরে এক আশ্চর্য প্রশান্তি অনুভব করি কিন্তু সেটি মুহূর্তের জন্যে; আবার সেগুলো পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায় এবং আমি বিচিত্র এক ধরনের কষ্ট অনুভব করতে থাকি। আমি প্রাণপণে নিজের সেই কষ্ট কমানোর চেষ্টা করে ভাসমান প্রতিচ্ছবির সাথে যুদ্ধ করতে থাকলাম।
কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না হঠাৎ করে সবকিছু মিলিয়ে গেল এবং আমি তখন নিজের ভেতরে আশ্চর্য এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করতে থাকলাম। আমি জিগির গলা শুনতে পেলাম, চমৎকার ত্রাতুল! তোমার কাজ শেষ।
আমি ওঠার চেষ্টা করতেই জিগি টেবিলে চেপে ধরে রেখে বলল, এক সেকেন্ড দাঁড়াও, তোমার মাথা থেকে সকেটটা খুলে নিই।
আমি কিছু বলার আগেই সে হ্যাঁচকা টান দিয়ে মাথার পেছন থেকে সকেটটা খুলে নেয়, মুহূর্তের জন্যে আমার শরীর ভয়ংকর রকম অনিয়ন্ত্রিতভাবে খিচুনি দিয়ে ওঠে। আমার মনে হল কানের কাছে একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটেছে, চোখের সামনে উজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো আলো ঝলসে উঠল এবং মুখে তিক্ত এক ধরনের স্বাদ অনুভব করলাম। জিগি আমাকে টেনে। বসিয়ে দিয়ে আমার সামনে একটা মনিটর ধরে রাখল, বলল, এই দেখ।
আমি তখনো অল্পসল্প কাঁপছি, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখব?
তোমার সমাধান এবং আসন সমাধান। হুবহু মিলে গেছে। জিগি আনন্দে হা–হা করে হেসে বলল, আমি এখন একটি ব্যক্তিগত নিউরাল কম্পিউটারের মালিক।
না। আমি মাথা নাড়লাম, তুমি এখনো নিজেকে মালিক বলে দাবি করো না। আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা আনন্দের না–তোমার নিউরাল হিসেব করতে হলে আমার যদি এরকম কষ্ট হয় তা হলে আমি তোমাকে কখনো আমার মাথায় সকেট বসাতে দেব না।
জিগি হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, কষ্ট খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। সন্তান জন্ম দিতে মায়েদের কী রকম কষ্ট হয় জান? সেজন্যে কখনো শুনেছ কোনো মা সন্তান জন্ম দেয় নি?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণের মাঝে আনার চেষ্টা করে বললাম, আমাকে এখন খানিকটা বিশ্রাম নিতে দাও আমি সোজাসুজি চিন্তাও করতে পারছি না।
জিগি মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। তোমার এখন বিশ্রাম নেওয়া দরকার।
আমি কোনোমতে বিছানায় এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম এবং প্রায় সাথে সাথেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি জিগি তার যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছে। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে সে চতুষ্কোণ একটা যন্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বলল, এই যে তৈরি করে ফেলেছি।
কী তৈরি করেছ?
নেটওয়ার্ক কেন্দ্রের দরজা খোলার জন্যে পাসওয়ার্ড বের করার ইন্টারফেস।
ব্যাপারটি কীভাবে কাজ করছে সেটা জানার সেই মুহূর্তে আমার কোনো কৌতূহল ছিল কিন্তু জিগি সেটা লক্ষ করল না। গলায় বাড়তি উৎসাহ নিয়ে বলল, আমি পিঠে ব্যাকপেকের মাঝে রাখব পাওয়ার সাপ্লাই আর ডিকোডার। সেখান থেকে একটা কেবল যাবে দরজায়–তুমি থাকবে আমার পাশে তোমার মাথা থেকে সকেট হয়ে আসবে। ডিকোডারে
আমার মাথা থেকে?
হ্যাঁ। তোমার মাথাকে নিউরাল কম্পিউটার হিসেবে ব্যবহার না করলে পাসওয়ার্ড বের করব কেমন করে?
আমি কোনো কথা না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সম্পূর্ণ গোপন একটা পাসওয়ার্ড কয়েক মিনিটের মাঝে খুঁজে বের করতে হলে মানুষের মস্তিষ্কের মতো কিছু একটা প্রয়োজন, সেটাই অস্বীকার করি কী করে?
আমরা আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে সকালবেলাতেই রওনা দিয়ে দিলাম। একটা বাইভার্বালে করে যেতে পারলে ভালো হত, কিন্তু জিগি বলল পাতাল ট্রেনে করে গেলে মানুষের ভিড়ে সহজে লুকিয়ে থাকা যাবে। আমরা আমাদের ব্যাগ নিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই মানুষের ভিড়ে মিশে গেলাম। সুপারকন্ডাষ্টিং১৮ রেলের ওপর দিয়ে পাতাল ট্রেনটা কয়েক ঘণ্টার মাঝেই আমাদের নির্দিষ্ট শহরটিতে নিয়ে আসে। এলাকাটিতে এক ধরনের নিরানন্দ ভাব, আমি তার মাঝে খুঁজে খুঁজে পুরাতন দালানটি বের করে ফেললাম। বাইরে অপ্রশস্ত গেট, গেটের উপর জটিল একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা– ঠিক পাসওয়ার্ডটি প্রবেশ করিয়ে গেট খুলে ঢুকে যেতে হবে। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে এই দালানটিতে কোনো মানুষজন নেই, একটা পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়ির মতো চেহারা। কে জানে হয়তো আসলেই এখানে এমনিতে মানুষজন থাকে না, প্রয়োজনে কেউ কেউ আসে।
আমি আর জিগি খানিকটা উদাসভাবে এলাকাটা একটু সতর্কভাবে ঘুরে এলাম। তারপর পুরাতন দালানটির সামনে এসে দাঁড়ালাম। ব্যাগ থেকে দুটি পানীয়ের বোতল বের করে হাতে নিয়েছি–আশপাশে মানুষজন খুব বেশি নেই। যদি হঠাৎ করে কেউ চলেও আসে দেখলে ভাববে দুই বন্ধু দেওয়ালে হেলান দিয়ে অলস মধ্যাহ্নে গল্পগুজব করছে। পানীয়ে চুমুক দিতে দিতে জিগি পেছনে দরজার নিরাপত্তা ব্যবস্থাটুকুতে চতুষ্কোণ যন্ত্রটি লাগিয়ে ফেলল। তারপর অন্যমনস্ক একটা ভঙ্গি করে ব্যাকপেক থেকে সকেটটা বের করে আমাকে চাপা গলায় বলল, কাছে এস।
আমি চাপা অস্বস্তি এবং এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে জিগির কাছে এগিয়ে গেলাম। জিগি চোরাচোখে দুই পাশে তাকিয়ে হঠাৎ চোখের পলকে আমার মাথার পেছনে ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেসে সকেটটা লাগিয়ে দিল। আমার সারা শরীরে আবার তীব্র একটা ঝাঁকুনি হয়, চোখের সামনে নানা রঙ খেলা করতে থাকে এবং কানে তীক্ষ্ণ এক ধরনের শব্দ শুনতে পাই। জিগি আমার হাত ধরে রেখে বলে, সাবধান, দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাক, পড়ে যেও না।
আমি কোনোভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম এবং হঠাৎ করে মনে হল চোখের সামনে গোলাকার বৃত্ত আসতে শুরু করেছে। আমার ভয়ংকর এক ধরনের অস্বস্তি হতে থাকে–কী করব বুঝতে পারি না এবং সেই বিচিত্র বৃত্তগুলোকে একটার ওপর আরেকটার বসানোর চেষ্টা করতে থাকি। সত্যি সত্যি সেগুলো সমন্বিত হতেই নিজের ভেতরে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব হয়–কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্যেই, আবার চোখের সামনে বিচিত্র কিছু ছবি ভেসে ওঠে এবং আমি সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে সেগুলোর সমন্বয় করার চেষ্টা করতে থাকি। আমি শুনতে পেলাম আমার কানের কাছে জিগি ফিসফিস করে বলছে, চমৎকার ব্রতুল, চমৎকার! চালিয়ে যাও
কতক্ষণ এভাবে চালিয়ে গিয়েছিলাম আমি বলতে পারব না–আমার মনে হল এক যুগ বা আরো বেশি এবং তখন হঠাৎ করে একসময় জিগি মাথার পেছন থেকে টান দিয়ে সকেটটা খুলে নিল। আমার মনে হল মুহূর্তের জন্যে আমার মাথার ভেতরে বুঝি একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। আমি কোনোমতে পেছনের গেটটা দুই হাতে ধরে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুনতে পেলাম জিগি ফিসফিস করে বলছে, চমৎকার ত্রাতুল, দরজা খুলে গেছে!
আমি কোনোমতে চোখ খুলে বললাম, খুলে গেছে?
হ্যাঁ। এখন কিছুই হয় নি এরকম একটা ভাব করে ভেতরে ঢুকো।
ঢুকব?
হ্যাঁ। এস।
জিগি আমার হাত ধরে ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে গেটটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। আমি টলতে টলতে কোনোভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, জিগি চারদিকে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে আসলেই এখানে কেউ নেই। কিন্তু কোনো রকম ঝুঁকি নেব না। এমনভাবে ভেতরে ঢুকব যেন আমরা এখানেই থাকি।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, ঠিক আছে।
কেউ যদি আমাদের লক্ষ করছে সে যেন কোনো সন্দেহ না করে।
ঠিক আছে।
যদি কিছু জিজ্ঞেস করে আমরা বলব যে ট্রাইকিনিওয়াল যোগাযোগ পরীক্ষা করার জন্যে এসেছি।
ঠিক আছে।
ভান করব যে তুমি হচ্ছ আমাদের পরীক্ষার বিষয়। তোমাকে দিয়ে আমরা সিস্টেম পরীক্ষা করি।
ঠিক আছে।
জিগি বিরক্ত হয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার? যেটাই জিজ্ঞেস করি তার উত্তর দেও ঠিক আছে? কথা বলতে কি তোমার ইউনিট খরচ হয়?
আমি কষ্ট করে চোখ খোলা রেখে বললাম, ইউনিট খরচ হলে সহজ হত। তোমার মস্তিষ্কের নিউরনে কখনো কেউ স্টিমুলেশন দেয় নি বলে তুমি জান না।
ও! জিগি হঠাৎ করে খানিকটা ব্যস্ত হয়ে বলল, আমি বুঝতে পারি নি ব্যাপারটি এত কষ্টের। তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?
খানিকটা। একটু সময় দাও, ঠিক হয়ে যাবে।
জিগি আর কথা বলল না, আমরা পাশাপাশি হেঁটে বড় পুরাতন দালানটির ভেতরে ঢুকলাম। বাইরের গেটের পাসওয়ার্ড জানার কারণে খুব সহজেই দালানের দরজা খুলে ফেলা গেল। ভেতরে পা দিতেই অনেকগুলো বাতি জ্বলে উঠল এবং পরিশোধিত বাতাস সঞ্চালনের জন্যে কিছু পাম্প চালু হয়ে গেল—-আমরা তার চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। জিগি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, চমৎকার! তার মানে এখানে কেউ নেই।
আমি এতক্ষণে মোটামুটি নিজের পায়ের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি। করিডরটার দিকে তাকিয়ে বললাম, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চলে কোনো একটা ঘরে ঢুকে যাই।
হ্যাঁ। জিগি উৎফুল্ল গলায় বলল, মূল পাসওয়ার্ড জেনে গেছি, এখন আর কেউ আমাদের আটকাতে পারবে না।
মাত্র দুদিন আগেই আমি এখানে ছিলাম, তাই করিডর ঘর দরজা খানিকটা পরিচিত মনে হচ্ছে। জিগিকে নিয়ে আমি নির্দিষ্ট ঘরটিতে উপস্থিত হলাম, ভেতরে কমিউনিকেশানের যন্ত্রপাতি, মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা, নেটওয়ার্ক এবং নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ সাজানো। ঘরটিতে ঢুকে জিব দিয়ে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে জিগি এক ধরনের আনন্দধ্বনি করে বলল, এন্ড্রোমিডার কসম! এই রকম একটা জায়গা যদি আমার থাকত।
আমি অস্ত্রোপচার করার বিছানাটিতে পা ঝুলিয়ে বসে বললাম, এই তো পেয়ে গেলে! কী করবে কর।
কিন্তু পাকাপাকিভাবে তো পাই নি। অল্পক্ষণের জন্যে পেয়েছি। যাই হোক জিগি ঘাড় থেকে ব্যাগ নামিয়ে সাথে সাথে কাজে লেগে গেল। আমি যন্ত্রপাতির ঘুঁটিনাটি তার মতো এত ভালো করে জানি না বলে আপাতত বিছানায় বসে বসে তার কাজ দেখতে লাগলাম।
কিছুক্ষণের মাঝেই বোঝা গেল এটি নেটওয়ার্কের একটা বড় নোড। মানুষের নতুন অস্তিত্ব সৃষ্টি করে এখান থেকেই সেটা এই নেটওয়ার্কে প্রবেশ করানো হয়। এখান থেকে নানা ধরনের ফাইবারের অসংখ্য ক্যাবল ভূগর্ভে চলে গেছে। মূল তথ্যকেন্দ্রগুলো কোথায় কে জানে কিন্তু সবগুলোয়ই এখান থেকে যোগায়োগ করা সম্ভব। জিগি মাথায় একটা হেলমেট পরে উবু হয়ে বসে কাজ শুরু করে দেয়।
ঘণ্টাখানেক পরে উত্তেজিত গলায় জিগি বলল, পেয়েছি।
কী পেয়েছ?
মূল তথ্যকেন্দ্র।
সত্যি? আমি কাছে এগিয়ে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?
এই দেখ বলে জিগি তার মনিটরে কিছু পরিবর্তনশীল সংখ্যা দেখাতে থাকে। টেবিলে হাত দিয়ে থাবা দিয়ে বলে, এখন শুধু ভেতরে ঢুকে যাওয়া। ঢুকে গিয়ে ইচ্ছে করলেই সব তথ্য পাল্টে দিতে পারি!
হ্যাঁ। কিন্তু আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, আমাদের অস্তিত্বগুলো কি পেয়েছ? কোথায় আছে? কেমন আছে?
আছে, আছে এখানেই আছে। জিগি সংখ্যাগুলো দেখিয়ে বলল, এর মাঝে কোনো একটা তোমাদের অস্তিত্ব। আমি ইচ্ছে করলেই এখন সব শেষ করিয়ে দিতে পারি, ধ্বংস করে দিতে পারি, উড়িয়ে দিতে পারি! জিগি আনন্দে হা–হা করে হেসে বলল, আমি এখন একটা ছোটখাটো ঈশ্বরের মতো।
থামো। আমি জিগিকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে বললাম, ঈশ্বর শুধু ধ্বংস করতে পারে না, তৈরিও করতে পারে। তুমি তো শুধু শেষ করে দেওয়ার কথা বলছ। আমরা তো শেষ করতে চাইছি না–যোগাযোগ করতে চাইছি। আমার অস্তিত্ব কিংবা রিয়ার অস্তিত্বের সাথে কথা বলতে চাইছি। তারা কেমন আছে কোথায় আছে জানতে চাইছি।
হ্যাঁ। জিগি মাথা নাড়ল, মনিটরের সংখ্যাগুলো আরো কিছুক্ষণ মনোযাগ দিয়ে লক্ষ করে বলল, সবচেয়ে ভালো হয় তুমি যদি এখানে ঢুকে যাও।
ঢুকে যাব?
হ্যাঁ। এই যে দেখ এখানে ছয়টা পরাবাস্তব জগৎ রয়েছে, এর মাঝে কোনো একটা তোমার। অন্যগুলো
অন্যগুলো কী?
জিগি মাথা চুলকে বলল, বুঝতে পারছি না। নিজে না দেখে বলা মুশকিল। তুমি ঢুকে দেখে আস। তোমার মাথায় ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস আছে–তোমার জন্যে একেবারে পানির মতো সোজা।
আমি জিগির দিকে কাতর চোখে তাকালাম, ভেতরে কী আছে কে জানে কিন্তু আমি সেখানে ঢোকার মতো সাহস পাচ্ছি না। জিগি বলল, কী হল, ঢুকবে না?
আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম, বললাম, ঠিক আছে। ঢুকে দেখে আসি।
জিগি চকচকে চোখে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই। এখানে অনেক যন্ত্রপাতি আছে, আমি তোমাকে খুব ভালোভাবে দেখেশুনে রাখব। বাইরের কিছু তোমার মাথায় ঢুকতে দেব না। যদি দেখি তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে।
আমি চমকে উঠে জিগির দিকে তাকালাম, বললাম, সমস্যা কী হতে পারে? কিছু একটা কি মাথায় ঢুকে যেতে পারে?
সেটা তো পারেই। ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস হচ্ছে দ্বিমুখী। তোমার মস্তিষ্ক থেকে যেতে পারে আসতেও পারে। আমি লক্ষ রাখব কিছু যেন না আসে। তুমি ভয় পেয়ো না।
আমি তবুও ভয় পেলাম, কিন্তু পেলেও আর কিছু করার নেই। অস্ত্রোপচারের উঁচু টেবিলটাতে লম্বা হয়ে শুয়ে বললাম, নাও, কী করবে কর।
আমি আমার সমস্ত স্নায়ু শক্ত করে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবার জন্যে নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকি।