০৭. নিকি বাইভার্বালের বাক্সের ভেতর

নিকি বাইভার্বালের বাক্সের ভেতর থেকে গুড়ি মেরে ফের হয়ে এলো। চারপাশে বড় বড় গাছ, তার মাঝে একটি হ্রদ। হ্রদের অন্যপাশে দূরে একটি উঁচু বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের চারপাশে উঁচু পাথরের দেওয়াল। নিকি জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় এসেছি ক্রিনিটি?

ক্রিনিটি বলল, এটি ইস্পানা নগর।

যেখানে আরেকজন মানুষের বাচ্চা আছে?

হ্যাঁ।

কোথায় আছে মানুষের বাচ্চাটি?

ঐ যে বিল্ডিংটা দেখছ, সেখানে!

সত্যি?

হ্যাঁ। এই বিল্ডিংটি হচ্ছে জাতীয় গবেষণাগার।

নিকি বাইভার্বাল থেকে নেমে দূরে বিল্ডিংটির দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে জিজ্ঞেস করল, আমরা বিল্ডিং-এর ভেতর কখন যাব?

ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করে। সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে বলল, সেটি এখনো ঠিক করা হয় নি।

কেন ঠিক করা হয় নি।

তার কারণ রোবটরা যদি তোমাকে দেখে তাহলে তোমাকে ধরে ফেলবে। কখনো বের হতে দেবে না। তাই ভেতরে যদি যেতে হয় তাহলে আমাদের যেতে হবে গোপনে।

গোপনে?

হ্যাঁ। এমনভাবে যেতে হবে যেন কেউ জানতে না পারে।

সেটি কেমন করে হবে?

ক্রিনিটি বলল, আমি এখনও জানি না। আমাদের এই জাতীয় গবেষণাগার নিয়ে প্রথমে সব রকম তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

কেমন করে কবে?

সেটি এখনো জানি না।

যখন তুমি সবরকম তথ্য সংগ্রহ করবে, তখন তুমি কী করবে ক্রিনিটি?

আমি সেটি এখনো জানি না।

নিকি এবারে খুক খুক করে একটু হাসল। ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন হাসছ?

আমি তোমাকে যেটিই জিজ্ঞেস করি তুমি তার উত্তরে বল আমি সেটি এখনো জানি না?

ক্রিনিটি বলল, কোনো কিছু না জানার মাঝে হাস্যকর কিছু নেই। তোমাকে নিয়ে আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না।

আমার খুব ভেতরে গিয়ে মানুষের বাচ্চাটিকে দেখতে ইচ্ছে করছে।

কিন্তু তোমাকে তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

আমার অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে না।

ক্রিনিটি নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, তার পরেও তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ আমি বাইভার্বালটিকে এই বনের মাঝে নামিয়েছি। কেউ যেন আমাদের দেখতে না পারে সেজন্যে। তুমি এই মুহূর্তে বাইরে খোলা জায়গায় বের হয়ো না।

কেন ক্রিনিটি?

খোলা জায়গায় বের হলে তোমাকে দেখে ফেলতে পারে।

ও।

বিল্ডিংটায় চারপাশে দেওয়ালের ওপরে ইলেকট্রিক তার লাগানো আছে। কেউ যেন দেওয়াল টপকাতে না পারে সেজন্যে।

নিকি মাথা নাড়ল, ধলল, ও।

আমি নিশ্চিত সেখানে লেজার লাইট আছে। নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে। কোনোকিছু স্পর্শ করলেই এলার্ম বেজে উঠবে।

নিকি এবারে জোরে জোরে মাথা নাড়ল, রোবনগরীতে একটি বাইভার্বাল শুধুমাত্র ছোঁয়ার সাথে সাথে কী বিকট স্বরে এলার্ম বেজে উঠেছিল সেটি তার এখনো মনে আছে।

ক্রিনিটি বলল, আমি ইতোমধ্যে আমার নেটওয়ার্ক চালু করেছি। রোবটদের কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছি। ভেতরের ম্যাপটা পেয়ে গেলে বুঝতে পারব। মানবশিশু কোথায় থাকে সেটিও অনুমান করতে হবে।

আমি তাহলে কী করব?

তুমিও বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করো। আমরা রোবটেরা শুধুমাত্র যুক্তিপূর্ণ সমাধান বের করি। মানুষ মাঝে মাঝে অযৌক্তিক এবং অবাস্তব সমাধান বের করে ফেলে।

নিকি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।।

ক্রিনিটি সারাদিন নানাধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত থাকল। নিকি প্রথমে কিছুক্ষণ তার পাশে থেকে সে কী করছে বোঝার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। তখন সে বনের ভেতর ইতস্তত ঘুরতে শুরু করে। পৃথিবীর সব মানুষ মরে গিয়েছে কিন্তু অন্যসব প্রাণী, পোকামাকড়, পাখি, সরীসৃপ সবকিছু বেঁচে আছে। তাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে নিকির খুব ভালো লাগে। সে অনেকক্ষণ একটি গুবরে পোকাকে মাটির ভেতর ঢুকে যেতে দেখল। একটি ছোট মাকড়শাকে খুব ধৈর্য ধরে একটি জাল তৈরি করতে। দেখল। একটি প্রজাপতির পেছনে পেছনে সে অনেকক্ষণ হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াল। তারপর সে ধবধবে সাদা পুতুলের মতো একটি খরগোশের বাচ্চাকে দেখে তার সাথে ভাব করার চেষ্টা করল।

খরগোশের বাচ্চাটি সতর্ক দৃষ্টিতে নিকিকে লক্ষ করে, তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারবে কিনা সেটি বুঝতে পারছিল না বলে একটু কাছাকাছি যেতেই ছোট ছোট কয়েকটি লাফ দিয়ে সেটি একটু দূরে সরে যাচ্ছিল। খরগোশটার পিছু পিছু নিকি অনেকদূর চলে এল, হঠাৎ করে আবিষ্কার করল সামনে টলটলে পানি। সে একটি খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সামনে একটি হ্রদ হ্রদের উপর দিয়ে খাড়া দেওয়াল উপরে উঠে গেছে। ক্রিনিটি বলেছিল সে যেন খোলা জায়গায় না যায়, খরগোশের পিছু পিছু সে ঠিক খোলা জায়গায় চলে এসেছে।

নিকি কী করবে বুঝতে পারল না। ক্রিনিটি তাকে খোলা জায়গায় আসতে নিষেধ করেছে সত্যি কিন্তু আবার তাকে ভেতরে ঢোকার বিষয়টি নিয়ে চিন্তাও করতে বলেছে। কাজেই বিল্ডিং ঘিরে তৈরি করা উঁচু দেওয়ালটার এতো কাছাকাছি যখন চলেই এসেছে তখন আরেকটু কাছে গিয়ে দেওয়ালটা ভালো করে দেখে আসা মনে হয় খুব অন্যায় হবে না।

নিকি তখন হ্রদের তীর ঘেষে দেওয়ালটার দিকে ছুটে যেতে থাকে। দেওয়ালটার কাছাকাছি এসে সে থেমে গেল। সতর্কভাবে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল তাকে কেউ দেখে ফেলেছে কিনা। কেউ তাকে দেখে নি, চারপাশে একধরনের সুনসান নীরবতা।

নিকি দেয়ালটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল, শক্ত পাথরের উঁচু দেয়াল। উপরে ধাতব জাল দিয়ে ঘেরা, ক্রিনিটি বলেছে কেউ যেন সেদিক দিয়ে যেতে না পারে সেজন্যে সেখানে উঁচু ভোল্টেজের বিদ্যুৎ রয়েছে। নিকি দেয়ালটা স্পর্শ করে হ্রদের দিকে এগিয়ে গেল। টলটলে হ্রদের পানিতে দেয়ালটা ড়ুবে। রয়েছে। নিকি সেদিক দিয়ে তাকিয়ে থাকে, মাঝখানে হ্রদের পানি যেখানে। গভীর সেখানে দেয়ালটাও কী অনেক গভীর থেকে শুরু হয়েছে?

নিকি কিছুক্ষণ দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে থাকে, দেয়ালের ওপর দিয়ে কেউ যেতে পারবে না, কিন্তু নীচে দিয়ে কী যাওয়া যাবে না? এমনকি হতে পারে হ্রদের পানির যেখানে দেয়ালটা উঠে এসেছে সেখানে বড় বড় গর্ত রয়েছে? কেউ ইচ্ছে করলে সেদিক দিয়ে ঢুকে যেতে পারবে? নিকি নিজে নিজে বিষয়টা চিন্তা করে, তারপর বড় মানুষের মতো গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল। ক্রিনিটিকে বলতে হবে কোনো একটি যন্ত্র দিয়ে হদের নিচে পরীক্ষা করে দেখতে। ক্রিনিটিকে সে কখনো পানিতে নামাতে পারে নি। রোবটের ধাতব দেহ নাকি পানিতে ভেসে থাকতে পারে না শুধু তাই না সার্কিটে পানি ঢুকে গেলে নাকি অনেক বড় সমস্যা হয় তাই কেউ পানির কাছে আসতে চায় না।

নিকি হ্রদের তীর ধরে একটি দৌড় দিতে গিয়ে থেমে গেল। ইচ্ছে করলে সে নিজেই তো হ্রদের পানিতে ড়ুব দিয়ে নিচে নেমে দেখতে পারেন, ক্রিনিটির যন্ত্রপাতির জন্যে অপেক্ষা করে থাকতে না। নিকি দুই এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর হলের পানিতে নেমে এলো।

হ্রদের কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে তার শরীরটি কাটা দিয়ে ওঠে, নিকি এক লাফে পানি থেকে উঠে আসতে চাইছিল কিন্তু সে উঠে এলো না। নিকি জানে পানিতে নামলে সবসময় প্রথমে শরীর কাটা দিয়ে ওঠে, একটু পর শরীর সেও ঠাণ্ডায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। নিকি দাঁতে দাঁত চেপে আরো গভীর পানিতে নামতে থাকে। পায়ের নিচে শ্যাওলা ঢাকা পিচ্ছিল নুড়িপাথর। নিকি সাবধানে দেয়ালটা ধরে আরো গভীরে নেমে যায়। নিকি জানে ধীরে ধীরে শীতল পানিতে নামা থেকে এক ঝটকায় নেমে পড়া সহজ। তাই সে আর দেরি না। করে মাথা নিচু করে পানিতে ড়ুবে যায়। তীক্ষ্ণ কনকনে শীতে তার সারা শরীর শিউরে ওঠে। নিকি সেটা সহ্য করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পানির নিচে নেমে যেতে থাকে। দেয়ালটি স্পর্শ করে দেখে, শ্যাওলা ঢাকা পিচ্ছিল দেয়ালটি বৈচিত্র্যহীন। পানির নীচে সবকিছুকেই ঝাঁপসা দেখায়, মনে হয় দেয়ালটি হ্রদের গভীরে নেমে গেছে।

যতক্ষণ বুকের মাঝে বাতাস আটকে রাখতে পারল নিকি দেয়ালটি পরীক্ষা করে দেখল তারপর ভুস করে ভেসে উঠল। কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে তার শরীরটা কাটা দিয়ে উঠছে। নিকি পানি থেকে উঠে পড়তে চাইল কিন্তু কী মনে করে আরো একবার সে পানিতে ড়ুব দেয়। দেয়ালটা স্পর্শ করে আরো গভীরে নেমে পড়ে। নিচে অন্ধকার ভালো করে কিছু দেখা যায় না-হাত বুলাতে বুলাতে হঠাৎ সে একটি ফাঁকা জায়গা আবিষ্কার করে নিকির মনে হয় দেয়ালটার মাঝখানে একটি গর্ত। নিকি গর্তটা ভালো করে পরীক্ষা করতে পারল না তার আগেই তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নিকি ভূঁস করে আবার। উপরে উঠে আসে। বড় করে একটি নিঃশ্বাস নিয়ে আবার সে ড়ুব দিল, দ্রুত নিচে নেমে এসে সে গর্তটি পরীক্ষা করে, ছোট একটি গর্ত দেয়ালের অন্যপাশে চলে গেছে, নিকি ভেতর দিয়ে যেতে পারবে কিনা পরীক্ষা করার জন্যে তার মাথাটা ঢোকালো, চওড়া দেয়ালের অন্যপাশে মাথাটা বের করে সে উপরে তাকায় পানির নীচে সবকিছু আবছা দেখায় তার মাঝে সে ফাঁকা একটা জায়গা দেখতে পেল। ইচ্ছে করলেই সে এখন দেয়ালে ঘেরা জাতীয় গবেষণাগারের এলাকার ভেতরে ভেসে উঠতে পারে।

নিকি ভেসে ওঠার চেষ্টা করল না, সেখানে কী আছে সে জানে না, হঠাৎ করে এদিকে ভেসে উঠলে বিপদে পড়ে যেতে পারে। নিকি আবার পিছন দিকে ফিরে যেতে গিয়ে আবিষ্কার করল সে ছোট গর্তটার মাঝে আটকে গিয়েছে, বের হতে পারছে না। হঠাৎ করে সে আতঙ্ক অনুভব করে, প্রাণপণে সে নিজেকে ছোটানোর চেষ্টা করল, কী করছে বুঝতে না পেরেই সে ছটফট করে সামনের দিকেই বের হয়ে এল। অল্প একটু বাতাসের জন্যে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, নিকি দুই পা দিয়ে দেয়ালটা ধাক্কা দিয়ে উপরে ভেসে উঠে, তারপর বুক ভরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নেয়।

নিকি এবার ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাল, বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা ধ্বক ধ্বক করে শব্দ করছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে সে নিজেকে একটু শান্ত করল। দূরে জাতীয় গবেষণাগারের বিল্ডিংটি দেখা যাচ্ছে। ভেতরে বড় একটি খোলা জায়গা সেখানে ছোট বড় অনেকগুলো গাছ। নিকি চারদিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, কোথাও অস্ত্র হাতে কোনো রোবট পাড়িয়ে নেই। সে বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে দিয়ে দেওয়ালটা ধরে পানিতে ভেসে থাকে। তার এই মুহূর্তে বের হয়ে যাওয়া উচিৎ কিন্তু নিকি বের হল না, বিস্ময় নিয়ে সে এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর ভেসে ভেসে তীরে উঠে এল। পানি থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটেই সে খানিকদূর এগিয়ে যায়। একটি গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে সে জাতীয় গবেষণাগারের বিল্ডিংটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। ক্রিনিটির কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এখানে ঠিক তার মতো একজন মানব শিশু আছে। সেই মানবশিশুটির সাথে কী তার দেখা হবে? যদি সত্যি দেখা হয় তাহলে দুজন কী নিয়ে কথা বলবে?

ঠিক এরকম সময় তার পেছন থেকে কে যেন খুব স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

নিকি পাথরের মতো জমে গেল, প্রথমে মনে হলো সে এক ছুটে পানিতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে কিন্তু সে তা করল না। খুব ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাল, দেখল তার পেছনে কয়েক হাত দূরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। যে দাঁড়িয়ে আছে সে রোবট নয়, সে তার মতো মানুষ। তার থেকে একটু বড়, চুলগুলো লম্বা এবং কুচকুচে কালো। শরীরে হালকা সবুজ রঙের একটি কাপড়।

মানুষটি আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? গলার স্বরটি ভারী সুন্দর। শুনলে আরো শুনতে ইচ্ছে করে।

নিকি কাঁপা গলায় বলল, আমি নিকি।

নিকি?

হ্যাঁ।

তুমি কি রোবট?

নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি রোবট না।

তুমি তাহলে কী?

আমি মানবশিশু।

নিকি দেখল তার মতো দেখতে মানুষটির মুখে একধরনের হাসি ফুটে ওঠে, হাসি হাসি মুখে বলল, মিথ্যে কথা বল না। পৃথিবীতে কোনো মানুষ নেই। সব মানুষ মরে গেছে।

নিকি বলল, তাহলে তুমি কেমন করে বেঁচে আছ।

সেটি কেউ জানে না। আমি কিভাবে কিভাবে জানি বেঁচে গেছি।

তুমি যেরকম কিভাবে কিভাবে বেঁচে গেছ আমিও সেরকম কিভাবে কীভাবে বেঁচে গেছি।

ছোট মানুষটি জিজ্ঞেস করল, সত্যি?

সত্যি।

পৃথিবীতে শুধু সত্যিকারের মানুষেরা হাসতে পারে। তুমি কী হাসতে পার?

পারি।

হাস দেখি।

নিকি গম্ভীর মুখে বলল, এমনি এমনি কেউ হাসতে পারে না। হাসির কোনো কারণ ঘটলে মানুষ হাসতে পারে।

নিকি থেকে একটু বড় আর ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা কালো চুলের ছোট মানুষটি মাথা নাড়ল, বলল, তুমি এটি ঠিকই বলেছ। রোবটেরা যখন আমাকে নিয়ে গবেষণা করে তখন মাঝে মাঝে আমাকে বলে তুমি একটু হাস। আমি তাদেরকে বলি মানুষ ইচ্ছে করলেই হাসতে পারে না। তারা আমার কথা। বিশ্বাস করে না।

নিকি মাথা নাড়ল, বলল, রোবটদের কোনো কোনোদিক দিয়ে অনেক বুদ্ধি আবার কোনো কোনোদিক দিয়ে তারা অনেক বোকা।

মানুষটি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, তুমি সত্যি। সত্যি একজন মানুষ?

হ্যাঁ।

কী আশ্চর্য! তুমি একজন মানুষ আবার আমি একজন মানুষ। কিভাবে কিভাবে আমাদের দেখা হয়ে গেল। তাই না?

নিকি বলল, মোটেও কিভাবে কিভাবে আমাদের দেখা হয় নি। তোমাকে খুঁজে বের করতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।

মানুষটি অবাক হয়ে বলল, তোমরা আমাকে খুঁজে বের করেছ?

আমি আর ক্রিনিটি।

ক্রিনিটি কে?

ক্রিনিটি আমাকে দেখে শুনে রাখে। একটি রোবট—আমার বন্ধু। সে। আমাকে খুব ভালোবাসে।

ছোট মানুষটি না সূচক ভাবে মাথা নাড়ল, বলল, রোবট কাউকে ভালোবাসতে পারে না। ভালোবাসার জন্যে হরমোন দরকার হয়। রোবটদের। কোনো হরমোন নেই। শুধু মানুষের হরমোন আছে।

তুমি কেমন করে জান?

আমি জানি। আমি পড়েছি। ছেলেদের একরকম হরমোন মেয়েদের অন্যরকম। ছোট মানুষটি এবারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিকিকে লক্ষ করল তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি ছেলে না মেয়ে?

আমি ছেলে। তুমি?

আমি মেয়ে। আমার বয়স এগারো। তোমার বয়স কতো?

নিকি বলল, আমার বয়স সাত।

এগারো বছরের মেয়েটি বলল, তুমি যখন বড় হবে তখন আমি আর তুমি বিয়ে করতে পারি। তখন আমাদের ছেলেমেয়ে হবে।

বিয়ে কেমন করে হয়?

সেটি আমি এখনো জানি না। আমি বিয়ে করার জন্যে একটি ছেলে পাব কখনো ভাবি নি তাই সেটি নিয়ে পড়াশোনা করি নি।

ও।

মেয়েটি কিছুক্ষণ নিকির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কী আমাকে বিয়ে করবে?

যদি পৃথিবীতে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ না থাকে তাহলে তো করতেই হবে।

মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, তাহলে অনেক মজা হবে। তুমি আর আমি এখানে থাকতে পারব।

নিকি মাথা নাড়ল, বলল, আমি এখানে থাকতে চাই না।

কেন?

আমি এই জায়গাটা চিনি না।

কয়েকদিন থাকলেই তুমি চিনে নেবে।

এখানে রোবটরা আমাকে নিয়ে গবেষণা করবে। আমার সেটি ভালো লাগে না।

মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, সেটি মোটেও খারাপ না। রোবটেরা আমাকে নিয়ে গবেষণা করে, আমি জানি। মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছে করে ভুল কথা বলে দিই তখন তাদের কপোট্রন উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। খুব মজা হয়। তখন।

নিকি চারদিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু এটির চারদিকে দেয়াল। আমি দেয়াল দিয়ে ঘিরে থাকা জায়গায় থাকতে পারব না। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।

নিকির কথা শুনে মনে হলো মেয়েটি একটু অবাক হল। বলল, কেন, নিঃশ্বাস কেন বন্ধ হবে? দেয়াল দিয়ে ঘেরা বলে জায়গাটা খুব নিরাপদ। বন্য পশু আসতে পারে না। কপোট্রন বিগড়ে গেছে এরকম রোবটও আসতে পারে না।

নিকি বলল, সেটি আমি জানি না। কিন্তু খোলা জায়গায় থাকলে অনেক মজা। যেখানে খুশি যাওয়া যায়। যা খুশি করা যায়।

যদি কোনো বিপদ হয়?

হলে হবে।

মেয়েটি কেমন যেন বিভ্রান্তির মাঝে পড়ে গেল। বলল, কিন্তু এখানে থাকলে কোনো বিপদ নেই। কোনো কিছু নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তোমাকে খেতে দেবে। তোমাকে বই পড়তে দেবে। আনন্দ করতে দেবে। যদি তোমার অসুখ হয় তাহলে চিকিৎসা করবে।

নিকি মাথা নাড়ল, বলল, কিন্তু এর মাঝে কোনো আনন্দ নেই।

তাহলে তুমি কী করতে চাও?।

তুমি আমার সাথে চল, আমরা দুজন মিলে থাকব। আমি যেখানে থাকি সেটি খুব সুন্দর জায়গা। খুব ভালো জায়গা। সেখানে কিকি আছে, মিক্কু আছে আরো অনেকে আছে। আমরা তাদের সঙ্গে খেলব। আনন্দ করব।

কিকি কে? মিক্কু কে?

কিকি হচ্ছে পাখি। আর মিক্কু বানর।

তুমি বনের পশুপাখির সাথে খেল? তারা তোমাকে আক্রমণ করে না?

নিকি খুক করে হেসে ফেলল, বলল, কেন, বনের পশু আমাকে আক্রমণ করবে? বনের পশুরা আমার বন্ধু। তারা কখনো আমাকে আক্রমণ করে না।

মেয়েটি খুব অবাক হয়ে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। ইতস্ততঃ করে। বলল, বন্ধু, বনের পশুরা তোমার বন্ধু?

হ্যাঁ।

তাহলে আমাকে যে সবাই বলেছে বাইরের পৃথিবীতে আমার নিরাপদে থাকার কোনো উপায় নেই?

মিথ্যে কথা।

ঠিক এরকম সময় দূর থেকে ঘণ্টা বাজার মতো একটি শব্দ হলো। মেয়েটি তখন বলল, ঐ যে ঘণ্টা বাজছে।

কিসের ঘণ্টা?

আমার ফিরে যাবার ঘণ্টা। এখন আমার ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। তারপর বিকেলের নাস্তা খেয়ে লেখাপড়া করতে হবে।

নিকি একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, ও।

তুমি কী আমার সাথে যাবে? আমার মনে হয় তোমাকে পেলে রোবটরা খুশি হবে।

নিকি মাথা নাড়ল। বলল, না, আমি যাব না।

তাহলে আমি যাই। আমার যেতে দেরি হলে–মেয়েটি থেমে গেল।

তোমার যেতে দেরি হলে কী হবে?

মেয়েটির মুখটি কেমন যেন ম্লান হয়ে যায়, সেখানে কেমন যেন ভয়ের ছাপ পড়ে। সে মাথা নেড়ে বলল, না। কিছু না।

মেয়েটি বলল, আমি এখন যাই?

নিকি মাথা নাড়ল, বলল, যাও।

মেয়েটি যখন মাথা নীচু করে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছিল তখন সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিকির মনে হলো এই মেয়েটি আসলে খুব দুঃখি একটি মেয়ে। কেন মেয়েটা দুঃখি সেটি সে বুঝতে পারল না কিন্তু অকারণে তার মনটাও কেমন জানি দুঃখ দুঃখ হয়ে গেল।

নিকি অন্যমনস্কভাবে হ্রদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে—তখন হঠাৎ তার মনে হলো মেয়েটিকে তার নাম জিজ্ঞেস করা হয় নি।