এতক্ষণ আমারা রাজযোগের সূক্ষ্ম সাধনগুলি ব্যতীত বিভিন্ন সোপানসমূহ সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করিয়াছি। ঐ সূক্ষ্ম অন্তরঙ্গ সাধনগুলির উদ্দেশ্য-একাগ্রতা-সাধন। এই একাগ্রতা-শক্তি লাভ করাই রাজযোগের লক্ষ্য। আমরা দেখিতে পাই, মনুষ্যজাতির যত কিছু জ্ঞান, সেগুলি সবই সচেতন অহংবুদ্ধির। এই টেবিল ও তোমার অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমর চেতনা হইতে আমি জানি, টেবিলটি এখানে রহিয়াছে এবং তুমিও এখানে আছ। আবার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, আমার সত্তার অনেকটাই আমি অনুভব করিতে পারি না। শরীরের ভিতর বিভিন্ন যন্ত্র, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ প্রভৃতি সম্বন্ধে কাহারও জ্ঞান নাই।
যখন আহার করি, তখন তাহা জ্ঞানপূর্বক করি; কিন্তু যখন উহা পরিপাক করি, তখন অজ্ঞাতসারেই করিয়া থাকি। খাদ্য যখন রক্তে পরিণত হয়, তখনও অজ্ঞাতসারেই ঐ ক্রিয়া হইয়া থাকে। আবার যখন ঐ রক্ত হইতে শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অংশ শক্ত-সবল হয়, তখনও উহা আমার অজ্ঞাতসারেই হইয়া থাকে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলি আমাদ্বারাই সংসাধিত হইতেছে। এই শরীরের মধ্যে তো আর বিশটি লোক নাই যে তাহারা ঐ কাজগুলি করিতেছে। কিন্তু কি করিয়া জানিতে পারি যে আমিই ঐগুলি করিতেছি, অপর কেহ করিতেছে না? এ-বিষয়ে তো জোরের সহিত বলা যাইতে পারে যে, আহার ও পরিপাক করা আমার কাজ; খাদ্য হইতে শক্ত-সবল শরীর গঠন করার কাজ আমার জন্য আর একজন করিয়া দিতেছে-ইহা হইতে পারে না; কারণ ইহা প্রমাণিত হইতে পারে যে, এখন যে-সকল কাজ আমাদের অজ্ঞাতসারে হইতেছে, ঐগুলির প্রায় সবই সাধনবলে আমাদের চেতনভূমিতে আনা যাইতে পারে। আপাততঃ মনে হয়, হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া আমাদের নিয়ন্ত্রণের অধীন নয়, উহা নিজের গতিতে চলিতেছে। কিন্তু অভ্যাসবলে এই হৃদ্যন্ত্রকেও এরূপ বশে আনা যাইতে পারে যে, আমাদের ইচ্ছা অনুসারে উহা শীঘ্র বা ধীরে চলিবে, অথবা প্রায় বন্ধ হইয়া যাইবে। আমাদের শরীরের প্রায় প্রত্যেক অংশই আমাদের বশে আনা যাইতে পারে। ইহাতে কি বুঝা যাইতেছে? বুঝা যায় যে, এখন যে-সকল ক্রিয়া অবচেতনভাবে হইতেছে, সেগুলিও আমরাই করিতেছি; তবে অজ্ঞাতসারে করিতেছি, এইমাত্র। অতএব দেখা যাইতেছে, মনুষ্য-মন দুই স্তরে কাজ করিতে পারে। প্রথম অবস্থাকে সজ্ঞান-ভূমি বলা যাইতে পারে, এখানে সকল কাজ করিবার সময় সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় আমি করিতেছি, আর একটি ভূমির নাম নির্জ্ঞান-ভূমি (বা অজ্ঞান-ভূমি) বলা যাইতে পারে, এখানকার কাজের সহিত ‘আমি’-বোধ থাকে না।
আমাদের মানস কার্যকলাপের যে অংশে ‘অহং’ভাব থাকে না, তাহা অজ্ঞানভূমির ক্রিয়া, আর যে অংশে অহংভাব থাকে, তাহা জ্ঞানপূর্বক ক্রিয়া। নিম্নজাতীয় জীবজন্তুতে এই অজ্ঞানভূমির কার্যগুলিকে সহজাতবৃত্তি (instinct) বলে। উচ্চতর জীবে ও উচ্চতম জীব মনুষ্যে জ্ঞানপূর্বক ক্রিয়াই প্রবল।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ইহা অপেক্ষাও উচ্চতর ভূমিতে মন কার্য করিতে পারে। মন জ্ঞানের অতীত অবস্থায় যাইতে পারে। অজ্ঞানভূমিতে কৃত কার্য যেমন জ্ঞানের নিম্নভূমিতে ঘটে, ঠিক সেইরূপ আর এক প্রকার কাজ জ্ঞানাতীত ভূমি হইতে হইয়া থাকে। উহাতেও কোনরূপ অহংভাব থাকে না। এই অহংবুদ্ধি কেবল মধ্যস্তরেই থাকে। উহাতেও কোনরূপ অহংভাব থাকে না। এই অহংবুদ্ধি কেবল মধ্যস্তরেই থাকে। যখন মন এই স্তরের ঊর্ধ্বে বা নিম্নে থাকে, তখন আমি-রূপ কোন বোধ থাকে না, কিন্তু তখনও মনের ক্রিয়া চলিতে থাকে। যখন মন এই অহংবোধের সীমা অতিক্রম করিয়া যায়, তখন তাহাকে সমাধি বা জ্ঞানাতীত অবস্থা বলে। সমাধি-অবস্থায় মানুষ সজ্ঞানভূমির নিম্নস্তরে চলিয়া যায় নাই, অবনত হইয়া যায় নাই-ইহা আমারা কেমন করিয়া জানিব? এই দুই অবস্থার কাজই অহংভাবশূন্য। ইহার উত্তর এই-ফল দেখিয়াই নির্ণীত হইতে পারে, কে সজ্ঞানভূমির নিম্নে আর কেই বা ঊর্ধ্বে। যখন কেহ গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়, সে তখন সজ্ঞানভূমির নিম্নে অবচেতন ভূমিতে চলিয়া যায়। তখনও তাহার শরীরের সমুদয় ক্রিয়া চলিতে থাকে, সে শ্বাসপ্রশ্বাস লয়, এমন কি নিদ্রার মধ্যে শরীর সঞ্চালনও করিয়া থাকে; কিন্তু তাহার এইসকল কার্যে অহংভাবের কোন সংস্রব থাকে না, তখন তাহার চেতনা থাকে না; নিদ্রা হইতে যখন উত্থিত হয়, তখন সে যে-মানুষ ছিল, সেই মানুষই থাকিয়া যায়। নিদ্রা যাইবার পূর্বে তাহার যতখানি জ্ঞান ছিল, নিদ্রাভঙ্গের পরও ঠিক তাহাই থাকে; উহার কিছুমাত্র বৃদ্ধি পায় না। তাহার হৃদয় কোন নূতন আলোকে উদ্ভাসিত হয় না। কিন্তু যখন মানুষ সমাধিস্থ হয়-মূর্খও যদি সমাধিস্থ হয়-সমাধিভঙ্গের পর সে মহাজ্ঞানী হইয়া উঠিয়া আসে।
এই বিভিন্নতার কারণ কি? এক অবস্থা হইতে মানুষ যেমন গিয়াছিল, সেইরূপই ফিরিয়া আসিল; আর এক অবস্থা হইতে মানুষ জ্ঞানী হইয়া ফিরিল-এক সাধু-মহাপুরুষে পরিণত হইল, তাহারা স্বভাব সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হইয়া গেল, তাহার জীবনও রূপান্তরিত হইয়া গেল, সে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হইল। এই তো দুই অবস্থার বিভিন্ন ফল! ফল যখন ভিন্ন,তখন কারণও অবশ্যই ভিন্ন হইবে। সমাধিঅবস্থায় লব্ধ এই জ্ঞানালোক যেহেতু নির্জ্ঞান-অবস্থার অনুভূতি অপেক্ষা অনেক উচ্চতর, বা জ্ঞানভূমিতে যুক্তিবিচারলব্ধ জ্ঞান অপেক্ষা অনেক উচ্চতর, তখন উহা অবশ্যই জ্ঞানাতীত ভূমি হইতে আসিতেছে। সেইজন্যই সমাধি ‘জ্ঞানাতীত অবস্থা’ নামে অভিহিত হইয়াছে।
সংক্ষেপে ইহাই সমাধিতত্ত্ব। এই সমাধির কার্যকারিতা কি? এখানেই ইহার কার্যকারিতা। আমরা জ্ঞাতসারে যে-সকল কর্ম করিয়া থাকি, যাহাকে বিচারবুদ্ধির
ক্ষেত্র বলা যায়, তাহা সঙ্কীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। একটি ক্ষুদ্র বৃত্তের মধ্যেই মানুষের বিচারবুদ্ধি নড়াচড়া করিতে বাধ্য, তাহার বাহিরে যাইতে পারে না। উহার বাহিরে যাইবার সামান্য চেষ্টাও অসম্ভব। অথচ মানুষ যাহা অতিশয় মূল্যবান্ বলিয়া মনে করে, তাহা ঐ যুক্তিবিচারের বাহিরেই অবস্থিত। অবিনাশী আত্মা আছে কিনা, ঈশ্বর আছেন কিনা, এই জগতের নিয়ন্তা পরমচৈতন্যস্বরূপ কেহ আছেন কিনা এ-সকল প্রশ্ন যুক্তির এলাকার বাহিরে। যুক্তি কখনও এই-সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। যুক্তি কি বলে? যুক্তি বলেঃ আমি অজ্ঞেয়বাদী, আমি ‘হাঁ’ বা ‘না’ কিছুই জানি না। কিন্তু এই প্রশ্নগুলি আমাদের পক্ষে অতীব প্রয়োজনীয়। এই প্রশ্নগুলির যথাযথ উত্তর না পাইলে মানবজীবন উদ্দেশ্যহীন হইয়া পড়ে। আমাদের সমুদয় নৈতিক মত, সর্ববিধ মনোভাব, মনুষ্য-স্বভাবে যাহা কিছু মহৎ ও ভাল, সে-সবই যুক্তিরাজ্যের বাহির হইতে যে উত্তর আসে, তাহা দ্বারা গঠিত হয়। অতএব, এই-সকল প্রশ্নের সুমীমাংসা আমাদের একান্ত প্রয়োজন। জীবন যদি শুধু একটি নাটিকা হয়, বিশ্বজগৎ যদি কেবল কতকগুলি পরমাণুর আকস্মিক মিলনমাত্র হয়, তাহা হইলে অপরের উপকার কেন করিব? দয়া, ন্যায়পরতা অথবা সহানুভূতির প্রয়োজন কি? তবে তো সময় থাকিতে কাজ গুছাইয়া লও-এই নীতিই এ পৃথিবীতে সর্বোৎকৃষ্ট হইত। যদি আশাই না থাকে, তবে আমি আমার ভ্রাতার গলা না কটিয়া তাহাকে ভালবাসিব কেন? যদি সমুদয় জগতের অতীত কোন সত্তা না থাকে, যদি মুক্তি বলিয়া কিছু না থাকে, যদি কতকগুলি কঠোর প্রাণহীন নিয়মেই সব হইয়া পড়ে, তবে তো যাহাতে ইহলোকে সুখী হইতে পারি, শুধু তাহারি চেষ্টা করিব। আজকাল দেখা যায় অনেকে বলে, তাহাদের নীতির ভিত্তি হিতবাদ (Utility)। এই নীতির ভিত্তি কি? সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক লোকের সর্বাধিক সুখের ব্যবস্থা করা-কেন এরূপ করিব? যদি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তাহা হইলে আমি অধিকাংশ লোকের অত্যধিক অনিষ্ট সাধন করিব না কেন? হিতবাদিগণ (Utilitarians) এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন? কোনটি ভাল কোনটি মন্দ, তাহা তুমি কি করিয়া জানিবে? আমি আমার সুখের বাসনার দ্বারা পরিচালিত হইয়া উহার তৃপ্তিসাধন করিলাম, উহা আমার স্বভার, উহা অপেক্ষা অধিক কিছু জানি না। আমার এইসব বাসনা আছে, আমি এগুলি পূর্ণ করিব, তোমার আপত্তি করিবার কি অধিকার আছে? নীতি, আত্মার অমরত্ব, ঈশ্বর, প্রেম ও সহানুভূতি, সাধুত্ব ও সর্বোপরি নিঃস্বার্থতা-মনুষ্যজীবনের এই-সকল ভাব ও মহৎ সত্যগুলি কোথা হইতে আসিল?
সমুদয় নীতি-শাস্ত্র, মানুষের সকল কাজকর্ম ও চিন্তা এই নিঃস্বার্থতারূপ একটি মাত্র ভাবের উপর নির্ভর করে, মানবজীবনের সমুদয় ভাব ‘নিঃস্বার্থতা’, এই একটি মাত্র শব্দের মধ্যে সন্নিবেশিত করা যাইতে পারে। কেন আমরা স্বার্থশূন্য হইব? নিঃস্বার্থ হইবার প্রয়োজনীয়তা কি? শক্তি ও প্রেরণাই বা কোথায়? তুমি নিজেকে যুক্তিবাদী -হিতবাদী বলিয়া থাকো; কিন্তু তুমি যদি হিতসাধন করিবার যুক্তি দেখাইতে না পারো, তাহা হইলে আমি তোমাকে অযৌক্তিক বলিব। আমি কেন স্বার্থপর হইব না,
তাহার যুক্তি দেখাও। অবশ্য কবিত্ব হিসাবে নিঃস্বার্থতা অতি সুন্দর হইতে পারে, কিন্তু কবিত্ব তো যুক্তি নয়। আমাকে যুক্তি দেখাও-কেন আমি নিঃস্বার্থ হইব, কেন আমি সৎ হইব? অমুক এই কথা বলে-এরূপ কথার কোন মূল্য আমার কাছে নাই। আমার নিঃস্বার্থ হওয়ার উপযোগিতা কোথায়? ‘হিত’ বলিতে যদি ‘অধিকতম সুখ’ বুঝায়, তবে স্বার্থপর হইলেই আমার পক্ষে হিত। ইহার কি উত্তর? হিতবাদিগণ ইহার কোন উত্তর দিতে পারেন না। ইহার উত্তর-এই পরিদৃশ্যমান জগৎ এক অনন্ত সমুদ্রের একটি ক্ষুদ্র বিন্দু, অনন্ত শৃঙ্খলের একটি ক্ষুদ্র শিকলি। যাঁহারা নিঃস্বার্থতা প্রচার করিয়াছিলেন ও মনুষ্য-জাতিকে উহা শিক্ষা দিয়াছিলেন, তাঁহারা এ তত্ত্ব কোথায় পাইলেন? আমরা জানি, ইহা সহজাত বৃত্তি নয়। সহজাত-জ্ঞানসম্পন্ন পশুগণ ইহা জানে না, বিচার বুদ্ধিতেও ইহা পাওয়া যায় না, যুক্তিদ্বারা এই-সকল তত্ত্বের কিছুমাত্র জানা যায় না। তবে ঐ-সকল তত্ত্ব কোথা হইতে আসিল?
ইতিহাস-পাঠে দেখিতে পাই, জগতের মহান্ ধর্মাচার্যগণ সকলই একটি তথ্য স্বীকার করিয়া থাকেন; তাঁহারা বলেন, জগতের বাহির হইতে তাঁহারা এই সত্য লাভ করিয়াছেন, তবে তাঁহারা অনেকেই জানেন না, এই সত্য ঠিক কোথা হইতে পাইয়াছেন। কেহ হয়তো বলিলেন, এক স্বর্গীয় দূত পক্ষযুক্ত মনুষ্যাকারে আসিয়া তাঁহাকে বলিয়াছেন, ‘ওহে মানব, শোন, আমি স্বর্গ হইতে এই সুসমাচার আনয়ন করিয়াছি, গ্রহণ কর।’ দ্বিতীয় ব্যাক্তি বলিলেন, এক জ্যোতির্ময় দেবতা তাঁহার সন্মুখে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। আর একজন বলিলেন, স্বপ্নে তিনি দেখিয়াছেন, তাঁহার পিতৃপরুষ আসিয়া তাঁহাকে কতকগুলি তত্ত্ব উপদেশ দিলেন। ইহার অতিরিক্ত তিনি আর কিছুই জানেন না। এইরূপে বিভিন্ন উপায়ে তত্ত্বলাভের কথা বলিলেও ইঁহারা সকলেই এই বিষয়ে একমত যে, যুক্তিতর্কের দ্বারা তাঁহারা এই জ্ঞান লাভ করেন নাই, উহার অতীত প্রদেশ হইতে তাঁহারা উহা লাভ করিয়াছেন। এ-বিষয়ে যোগশাস্ত্র কি বলে? যোগশাস্ত্র বলে, যুক্তিবিচারের অতীত প্রদেশ হইতে তাঁহারা যে ঐ জ্ঞান লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদের এ-কথা ঠিক। প্রকৃতপক্ষে তাঁহাদের নিজেদের ভিতর হইতেই ঐ জ্ঞান আসিয়াছে।
যোর্গীরা বলেন, এই মনেরই এমন এক উচ্চতর অবস্থা আছে, যাহা যুক্তিবিচারের ঊর্ধ্বে-জ্ঞানাতীত অবস্থা। এই উচ্চাবস্থায় পৌঁছিলে মানব তর্কের অতীত এই এই জ্ঞান লাভ করে-বিষয়জ্ঞানের অতীত পরমার্থজ্ঞান বা অতীন্দ্রিয়জ্ঞান লাভ করে। যুক্তবিচারের অতীত অবস্থা লাভ করা, সধারণ মানবীয় স্বভাব অতিক্রম করা-কখন কখন মানুষের জীবনে অতর্কিতে সম্ভব হইতে পারে, সে ব্যক্তি এ ঘটনার বিজ্ঞান সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ থাকিতে পারে; সে যেন হঠাৎ এই জ্ঞান লাভ করে; ঐরূপে হঠাৎ অতীন্দ্রিয়-জ্ঞানলাভ হইলে সে সাধারণতঃ মনে করে যে, ঐ জ্ঞান বাহির হইতে আসিয়াছে। ইহা হইতে বেশ বুঝা যায় যে, এই দিব্যপ্রেরণা-পারমার্থিক জ্ঞান বিভিন্ন দেশে একই প্রকারের হইতে পারে; কোন দেশে মনে হইবে দেবদূত হইতে আসিয়াছে, কোন দেশে দেববিশেষ হইতে, আবার কোথাও বা সাক্ষাৎ ভগবান্ হইতে পাপ্ত বলিয়া মনে হইতে
পারে। ইহার অর্থ কি? ইহার অর্থ মন নিজ স্বভাব অনুয়ায়ী নিজের ভিতর হইতেই ঐ জ্ঞান লাভ করিয়াছে। কিন্তু যিনি উহা লাভ করিয়াছেন, তিনি নিজ শিক্ষা ও বিশ্বাস অনুসারে ঐ জ্ঞান কিরূপে লাভ হইল, তাহা ব্যাখ্যা করিয়াছেন। প্রকৃত কথা এই যে, ইঁহারা সকলেই ঐ জ্ঞানাতীত অবস্থায় হঠাৎ আসিয়া পড়িয়াছেন।
যোগীরা বলেন, এই অবস্থায় হঠাৎ আসিয়া পড়ায় এক ঘোর বিপদের আশঙ্কা আছে। অনেক স্থলেই মস্তিষ্ক একেবারে নষ্ট হইয়া যাইবার সম্ভাবনা। সচরাচর দেখিবে, যে-সব ব্যক্তি হঠাৎ এই অতীন্দ্রিয়জ্ঞান লাভ করিয়াছেন, অথচ ইহার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বুঝেন নাই, তাঁহারা যত বড়ই হউন না কেন, তাঁহারা অন্ধকারে হাতড়াইয়াছেন এবং তাঁহাদের সেই জ্ঞানের সহিত সাধারণতঃ কিছু না কিছু কিম্ভূতকিমাকার কুসংস্কার মিশ্রিত থাকিয়া যায়। তাঁহারা অনেক অলীক দৃশ্য দেখিয়াছেন ও উহার প্রশ্রয় দিয়া গিয়াছেন।
* * *
যাহা ইউক, আমরা অনেক মহাপুরুষের জীবনচরিত আলোচনা করিয়া দেখিতে পাই যে, সমাধিলাভের পথে পূর্বোক্তরূপ বিপদের আশঙ্কা আছে। কিন্তু আমরা দেখিতে পাই তাঁহারা সকলেই দিব্য প্রেরণা লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহারা যে-কোন ভাবেই হউক, ঐ জ্ঞানাতীত ভূমিতে আরোহণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা যে-কোন ভাবেই হউক, ঐ জ্ঞানাতীত ভূমিতে আরোহণ করিয়াছিলেন। যখনই কোন মহাপুরুষ কেবল ভাবোচ্ছ্বাসবশে এই অবস্থায় উপনীত হইয়াছেন, তিনি কিছু সত্য লাভ করিয়াছেন বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে কিছুটা কুসংস্কার ও গোঁড়ামি তাঁহাতে দেখা দিয়াছে। তাঁহার শিক্ষার মহত্ত্ব দ্বারা যেমন জগতের উপকার হইয়াছে, ঐ কুসংস্কারাদির দ্বারা তেমনি ক্ষতিও হইয়াছে। অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনুষ্যজীবনে কিছু সামঞ্জস্য ও যুক্তি দেখিতে হইলে আমাদিগকে সাধারণ যুক্তির ঊর্ধ্বে উঠিতে হইবে, কিন্তু উহা বৈজ্ঞানিকভাবে ধীরে ধীরে নিয়মিত সাধনাদ্বারা করিতে হইবে এবং সমুদয় কুসংস্কার বিসর্জন দিতে হইব। অন্য কোন বিজ্ঞান-শিক্ষার সময় আমরা যেরূপ করিয়া থাকি, সমাধিতত্ত্বশিক্ষার সময় ঠিক সেইরূপ করিতে হইবে। যুক্তির উপরই আমাদের ভিত্তিস্থাপন করিতে হইবে, যুক্তি আমাদিগকে যতদূর লইয়া যায় ততদূর যাইতে হইবে; যুক্তি যখন আর চলিবে না, তখন যুক্তিই সর্বোচ্চ অবস্থা লাভের পথ দেখাইয়া দিবে। অতএব যখন শুনিবে কেহ বলিতেছে, ‘অমি প্রত্যাদিষ্ট’, অথচ যুক্তিবিরুদ্ধ কথা বলিতেছে, তাহার কথা শুনিও না। কেন? কারণ এই তিন অবস্থা-সহজাত জ্ঞান, বিচারপূর্বক জ্ঞান ও জ্ঞানাতীত অবস্থা অথবা নির্জ্ঞান, সজ্ঞান ও জ্ঞানাতীত অবস্থা-একই মনের অবস্থাবিশেষ। একই ব্যক্তির তিনটি মন নাই, কিন্তু মনের একটি অবস্থা অপরগুলিতে পরিণত হয়। সহজাত-জ্ঞান বিচারপূর্বক-জ্ঞানে ও বিচারপূর্বক-জ্ঞান জ্ঞানাতীত আবস্থায় পরিণত হয়; সুতরাং অবস্থাগুলির মধ্যে একটি অপরটির বিরোধী নয়। প্রকৃত প্রেরণা যুক্তিবিরোধী নয়-বরং যুক্তির পূর্ণতা সাধন করে। ঈশ্বরপ্রেরিত মহাপুরুষগণ যেমন বলিয়াছেন, ‘আমি ধ্বংস করিতে আসি নাই, সম্পূর্ণ
করিতে আসিয়াছি-‘সেইরূপ প্রেরণাও যুক্তিকে পরিপূর্ন করে, যুক্তির সহিত উহার সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য আছে।
বৈজ্ঞানিক উপায়ে আমাদিগকে সমাধি বা জ্ঞানাতীত অবস্থায় লইয়া যাইবার জন্যই যোগের বিভিন্ন সোপানগুলি উপদিষ্ট হইয়াছে। অধিকন্তু এটি বুঝা বিশেষ আবশ্যক যে, এই অতীন্দ্রিয় প্রেরণালাভের শক্তি প্রাচীন মহাপুরুষগণের ন্যায় প্রত্যেক মানুষের স্বভাবেই অন্তর্নিহিত রহিয়াছে। এই মহাপুরুষগণ সম্পূর্ণ পৃথক্-অতুলনীয় কিছু ছিলেন না, তাঁহারা তোমার আমার মতোই মানুষ ছিলেন। তাঁহারা উচ্চঙ্গের যোগী ছিলেন এবং এই জ্ঞানাতীত অবস্থা লাভ করিয়াছিলেন। চেষ্টা করিলে তুমি-আমিও উহা লাভ করিতে পারি। তাঁহারা কোন বিশেষ-প্রকারের অদ্ভূত লোক ছিলেন না। একজন ঐ অবস্থা লাভ করিয়াছেন- এই ঘটনা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক ব্যাক্তির পক্ষেই ঐ অবস্থা লাভ করা সম্ভব। ইহা যে শুধু সম্ভব তাহা নয়, সকলকেই কালে ঐ অবস্থা লাভ করিতে হইবে, এবং ইহাই ধর্ম। অভিজ্ঞতাই আমাদের একমাত্র শিক্ষক। আমরা সারা জীবন তর্কবিচার করিতে পারি, কিন্তু নিজেরা প্রত্যক্ষ অনুভব না করিলে সত্যের কণামাত্র বুঝিতে পারিব না। কয়েকখানি পুস্তক পড়িতে দিয়া তুমি কোন ব্যক্তিকে অস্ত্রচিকিৎসক করিয়া তুলিবার আশা করিতে পার না। একখানি মানচিত্র দেখাইয়া আমার দেশ দেখিবার কৌতূহল চরিতার্থ করিতে পার না। একখানি মানচিত্র দেখাইয়া আমার দেশ দেখিবার কৌতূহল চরিতার্থ করিতে পার না। আমাকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করিতে হইবে। মানচিত্র কেবল অধিকতর জ্ঞানলাভের আগ্রহ জ্ন্মাইয়া দিতে পারে। ইহা ব্যতীত উহার আর কোন মূল্য নাই। শুধু পুস্তকের উপর নির্ভরতা মানুষের মনকে অবনতির দিকেই লইয়া যায়। ঈশ্বরীয় জ্ঞান কেবল এই পুস্তকে বা ঐ শাস্ত্রে সীমাবদ্ধ-এরূপ বলা অপেক্ষা ঘোরতর ঈশ্বরনিন্দা আর কি হইতে পারে? মানুষ ভগবান্কে অনন্ত বলে, আবার একটি ক্ষুদ্র গ্রন্থের গন্ডিতে তাঁহাকে আবদ্ধ করিতে চায়!-কি তাহার স্পর্ধা! কোন বিশেষ ধর্মগ্রন্থে যাহা আছে, তাহা বিশ্বাস করে নাই বলিয়া, ‘একখানি গ্রন্থের মধ্যে সমুদয় ঈশ্বরীয় জ্ঞান সীমাবদ্ধ’-ইহা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত হয় নাই বলিয়া লক্ষ লক্ষ লোক নিহত হইয়াছে। অবশ্য এই নিধনের ও হত্যার যুগ এখন চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু জগৎ এখনও ধর্মগ্রন্থে অন্ধবিশ্বাস দ্বারা দৃঢ়ভাবে শৃঙ্খলিত।
বৈজ্ঞানিক উপায়ে জ্ঞানাতীত অবস্থা লাভ করিতে হইলে তোমাদিগকে রাজযোগবিষয়ে যে-সকল উপদেশ দিতেছি, তাহার বিভিন্ন সোপান দিয়া অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। প্রত্যাহার ও ধারণার পর, এখন ধ্যানের বিষয় আলোচনা করিব। দেহের ভিতরে বা বাহিরে কোন স্থানে মনকে কিছুক্ষণ স্থির রাখিতে পারিলে মন অবিচ্ছিন্ন গতিতে ঐ দিকে প্রবাহিত হইবার শক্তি লাভ করিবে। এই অবস্থার নাম ‘ধ্যান’। ধ্যানের শক্তি যখন এত বৃদ্ধি পায় যে, সাধক অনুভবের বহির্ভাগ বর্জন করিয়া শুধু উহার অন্তর্ভাগটির অর্থাৎ অর্থের ধ্যানই করেন, তখন সেই অবস্থায় নাম ‘সমাধি’। ধারণা, ধ্যান ও সমাধি-এই তিনটিকে একত্র ‘সংযম’ বলে; অর্থাৎ প্রথমতঃ যদি কেহ কোন
বস্তুর উপর মন একাগ্র করিতে পারে, পরে দীর্ঘকাল ধরিয়া ঐ একাগ্রতার ভাব রক্ষা করিতে পারে, অবশেষে এইরূপ ক্রমাগত একাগ্রতা দ্বারা, যে অভ্যন্তরীণ কারণ হইতে ঐ বাহ্য বস্তুর অনুভূতি উৎপন্ন হইয়াছে, যদি শুধু তাহারই উপর মনকে ধরিয়া রাখিতে পারে, তবে সবকিছুই এইরূপ মনের বশীভূত হইয়া যায়।
এই ধ্যানাবস্থাই মানব জীবনের সর্বোচ্চ অবস্থা। যতক্ষণ বাসনা থাকে, ততক্ষণ যথার্থ সুখ সম্ভব নয়, কেবল ধ্যানভাবে সাক্ষিরূপে সবকিছু পর্যালোচনা করিতে পারিলেই আমাদের প্রকৃত সুখ ও আনন্দ লাভ হয়। ইতর প্রাণীর সুখ ইন্দ্রিয়ে, মানুষের সুখ বুদ্ধিতে, আর দেবমানব আধ্যাত্মিক ধ্যানেই আনন্দলাভ করেন। যিনি এইরূপ ধ্যানাবস্থা লাভ করিয়ছেন, তাঁহার নিকটই জগৎ যথার্থ সুন্দররূপে প্রতিভাত হয়। যাঁহার বাসনা নাই, যিনি কোন বিষয়ে নিজেকে লিপ্ত করেন না, তাঁহার নিকট প্রকৃতির এই বিচিত্র পরিবর্তন সুন্দর ও মহান্ ভাবের এক অফুরন্ত চিত্রপট!
ধ্যানে এই তত্ত্বগুলি বুঝিতে হইবে। মনে কর, একটি শব্দ শুনিলাম। প্রথমে বাহিরে একটি কম্পন উঠিল, তারপর স্নায়বীয় গতি উহাকে মনের কাছে লইয়া গেল, পরে মন হইতে এক প্রতিক্রিয়া হইল, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাহ্যবস্তুর জ্ঞান উদিত হইল; এই বাহ্যবস্তুটিই ইথারে কম্পন হইতে মানসিক প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন পরিবর্তনগুলির কারণ। যোগশাস্ত্রে এই তিনটিকে শব্দ, অর্থ ও জ্ঞান বলে। পদার্থবিজ্ঞান ও শারীরবিজ্ঞানের ভাষায় ঐগুলিকে ইথারের কম্পন, স্নায়ু ও মস্তিষ্কের গতি এবং মানসিক প্রতিক্রিয়া বলা হয়। এই তিনটি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হইলেও এমনভাবে মিশিয়া গিয়াছে যে, ঐগুলির প্রভেদ অতি অস্পষ্ট। বাস্তবিক আমরা এখন ঐ তিনটির কোনটিকেই অনুভব করিতে পারি না, উহাদের সন্মিলিত ফল অনুভব করি এবং সেটিকেই বাহ্যবস্তু বলি। প্রত্যেক অনুভবক্রিয়াতেই এই তিনটি ব্যাপার রহিয়াছে; উহাদিগকে পৃথক্ করিতে না পারার কোন কারণ নাই।
প্রাথমিক প্রস্তুতি দ্বারা যখন মন দৃঢ় ও নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সূক্ষ্মতর অনুভবের শক্তি লাভ করে, তখন উহাকে ধ্যানে নিযুক্ত করা কর্তব্য। প্রথমতঃ স্থূল বস্তু লইয়া ধ্যান করিতে হইবে। পরে ক্রমশঃ ধ্যান সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর হইবে, শেষে বিষয়শূন্য ধ্যানে পরিণত হইবে। মনকে প্রথমে অনুভূতির বাহ্য কারণগুলি, পরে স্নায়ুমাধ্যস্থ গতি, তারপর নিজের প্রতিক্রিয়াগুলিকে অনুভব করিবার জন্য নিযুক্ত করিতে হইবে। মন যখন বেদনা বা অনুভূতির বাহ্য কারণগুলি পৃথক্ভাবে জানিতে পারিবে, তখন মনের সমুদয় সূক্ষ্ম-জড় পদার্থ, সমুদয় সূক্ষ্মশরীর ও সূক্ষ্মরূপ অনুভব করিবার ক্ষমতা হইবে। মন যখন অভ্যন্তরীণ গতিগুলিকে পৃথক্ভাবে জানিতে পারিবে, তখন নিজের ও অপরের মানসিক তরঙ্গগুলি জড়-শক্তিরূপে পরিণত হইবার পূর্বেই মন ঐগুলি নিয়ন্ত্রিত করিবার ক্ষমতা লাভ করিবে। যখন মন মানসিক প্রতিক্রিয়াগুলিকে পৃথকভাবে অনুভব করিবে, তখন যোগী সবকিছুর জ্ঞান লাভ করিতে পারিবেন; কারণ অনুভবযোগ্য প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি চিন্তা এই মানসিক প্রতিক্রিয়ার
ফল। এরূপ অবস্থালাভ হইলে যোগী নিজ মনের ভিত্তি পর্যন্ত অনুভব করিবেন এবং মন তখন তাঁহার সম্পূর্ণ আয়ত্তে আসিবে। যোগীর তখন নানাপ্রকার অলৌকিক শক্তিলাভ হয়; যদি তিনি এই সকল শক্তির কোন একটি দ্বারা প্রলুব্ধ হইয়া পড়েন, তবে তাঁহার ভবিষ্যৎ উন্নতির পথ রুদ্ধ হইয়া যায়। ভোগের পশ্চাতে ধাবমান হইলে এই অনিষ্ট হয়। কিন্তু যদি এই-সকল অলৌকিক শক্তি পর্যন্ত ত্যাগ করিবার ক্ষমতা তাঁহার থাকে, তবে তিনি মন-সমুদ্রে বৃত্তি-তরঙ্গ সম্পূর্ণ নিরোধ-করা-রূপ যোগের চরম লক্ষ্যে উপনীত হইতে পারেন। তখনই মনের নানাপ্রকার বিক্ষেপ শরীরের নানাবিধ গতি দ্বারা বিচলিত না হইয়া আত্মার মহিমা নিজ পূর্ণ জ্যোতিতে প্রকাশিত হইবে। তখন যোগী তাঁহার শাশ্বত স্বরূপ উপলব্ধি করিবেন, বুঝিবেন-তিনি জ্ঞানঘন, অবিনাশী ও সর্বব্যাপী।
এই সমাধিতে প্রত্যেক মানুষের, এমন কি প্রত্যেক প্রাণীর অধিকার আছে। নিম্নতর জীবজন্তু হইতে উচ্চতম দেবতা পর্যন্ত সকলেই কোন না কোন সময়ে এই অবস্থা লাভ করিবে; যাহার যখন এই অবস্থা লাভ হয়, তখনই তাহার প্রকৃত ‘ধর্ম’ আরম্ভ হয়। তাহার পূর্ব পর্যন্ত আমরা শুধু ঐ অবস্থার দিকে যাইবার জন্য সংগ্রাম করিতেছি। যাহাদের কোন ‘ধর্ম’ নাই, তাহাদের সহিত আমাদের এখন কোন প্রভেদ নাই, কারণ অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব সম্বন্ধে আমাদেরও কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নাই। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় উপনীত করা ব্যতীত এই একা্গ্রতা-সাধনের কি প্রয়োজন? এই সমাধি লাভ করিবার প্রত্যেকটি সাধন-সোপান যুক্তিপূর্বক বিচার করা হইয়াছে, যথাযথভাবে বিন্যস্ত হইয়াছে ও বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে সংবদ্ধ হইয়াছে। যদি ঠিক ঠিক সাধন করা হয়, তাহা হইলে উহা নিশ্চয়ই আমাদিগকে বাঞ্ছিত লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাইয়া দিবে। তখন সমুদয় দুঃখ চলিয়া যাইবে, সকল যন্ত্রণা অন্তর্হিত হইবে, কর্মবীজ দগ্ধ হইয়া যাইবে, আত্মাও অনন্তকালের জন্য মুক্ত হইয়া যাইবে।