০৭. ধন্যবাদ ফিবোনাক্কি

বদরুল চোখ বড় বড় করে বলল, আবার কাগজ?

মনসুর সাহেব বললেন, হ্যাঁ।

মনসুর সাহেবের চোখ লাল। চুল উস্কুখুম্বু। গায়ে জ্বর আছে। আজ তিনি ক্লাসেও যাননি।

কাগজ কতগুলো দেব? পাঁচ দিস্তা?

না। দশ দিস্তা।

গতকালই তো স্যার পাঁচ দিস্তা কাগজ নিয়ে গেছেন। শেষ হয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

এক রাতে অঙ্ক করে ভরিয়ে ফেলেছেন?

না। অন্য কাজে…

বদরুল কৌতূহল চাপতে পারল না। আগ্রহ নিয়ে বলল, পাঁচ দিস্তা কাগজ দিয়ে কি করেছেন?

নৌকা বানালাম। নৌকা বানালেন?

কাগজের নৌকা?

হুঁ।

সেই নৌকা দিয়ে কি করলেন স্যার?

মনসুর সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে বললেন—নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি।

বদরুলের মুখ হা হয়ে গেল। সে গলার বিস্ময় চাপা দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বলল—মগরা নদীতে সব কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছেন?

হুঁ।

খুব ভালো করেছেন। পুলাপানরা কাগজের নৌকা ভাসাবে, আমরা ভাসাব না তা হয় না। বসেন স্যার চা খান।

না চা খাব না। শরীর ভালো না।

চা না খেলেও একটু বসুন। আপনার মতো জ্ঞানী লোকের পাশে কিছুক্ষণ থাকলেও গায়ে জ্ঞানের বাতাস লাগবে। প্লিজ স্যার চেয়ারটায় বসুন।

মনসুর সাহেব কথা বাড়ালেন না। বসলেন।

আপনি হলেন স্যার জ্ঞান-সমুদ্র। ছোটখাটো জ্ঞানী প্রায়ই দেখা যায় জ্ঞান-চৌবাচ্চা, জ্ঞান-ডোবা, জ্ঞান-পুকুর। কিন্তু জ্ঞান-সমুদ্র কখনো দেখা যায়। না। আপনি যে এসে বসে থাকেন এত ভালো লাগে।

মনসুর সাহেব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটা ভালো রসিকতা করছে। সে সবার সঙ্গেই রসিকতা করে না শুধু তার সঙ্গেই করছে।

বদরুল চোখ বড় বড় করে বলল, আমি স্যার একটা কাজ করব। আপনার কিছু পায়ের ধুলা ডেনোর একটা টিনে ভয়ে রাখব। জীবনের একটা সঞ্চয় হয়ে থাকবে। লোকজনদের বলতে পারব হায়াৎ মউতের কথাতো বলা যায় না। হঠাৎ একদিন মরে গেলেন তখন ধুলা পাব কোথায়?

আমি আজ উঠি বদরুল?

জ্বি আচ্ছা।

মনসুর সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন–রসিকতা আমি করতে পারি না। সবাই সব জিনিস পারে না। রসিকতা করার বিদ্যা আমার অনায়ত্ত। তুমি করতে পার। তোমার রসিকতা শুনতে ভালো লাগে। তোমার রসিকতা শোনার ললাভেই মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে থাকি।

বদরুল হা করে তাকিয়ে রইল। মনসুর সাহেব বললেন—তোমাকে দেখি আর ভাবি প্রকৃতি মানুষকে কত বিচিত্র ক্ষমতা দিয়েই না পাঠিয়েছেন। রসিকতা করতে হলে তীক্ষ্ণবুদ্ধির প্রয়োজন। তুমি নির্বোধ। তারপরেও তুমি অসাধারণ সব রসিকতা কর। তোমাকে এই ক্ষমতা দিয়ে প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের একটা জিনিস বুঝিয়ে দেন—তা হচ্ছেদেখ আমাকে দেখ। দেখ কি করতে পারি। বদরুল যাই। শরীরটা ভালো লাগছে না। নয়ত আরো কিছুক্ষণ বসতাম।

তিনি সরাসরি বাসার দিকে রওনা হলেন। স্কুলে গেলেন। তাঁর পকেটে একটা দরখাস্ত সেখানে লিখলেন

…আমার শরীর খুবই অসুস্থ। স্কুলের দায়িত্ব পালনে বর্তমানে অক্ষম। আমার অতি জরুরি কিছু ব্যক্তিগত কাজও শেষ করা প্রয়োজন। কাজেই আমি আর স্কুলে আসব না বলে স্থির করেছি। অবসর গ্রহণের আগেই আমি অবসর প্রার্থনা করছি।…

হেডমাস্টার সাহেব স্কুলে ছিলেন না। ফুড ফর ওয়ার্ক প্রগ্রামে সরকার গম দিচ্ছে তিনি সেই গমের ব্যাপারে সিও সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন। কখন ফিরবেন ঠিক নেই। মনসুর সাহেব হেডস্যারের টেবিলে দরখাস্ত রেখে বাসার দিকে রওনা হলেন। তাঁর গায়ের তাপ আরো বেড়েছে, তিনি ঠিকমতো পা ফেলতেও পারছেন না। তাঁর মনে হল প্রকৃতির একটা নিষ্ঠুর দিক আছে। এই নিষ্ঠুরতা তিনি মানুষের ক্ষেত্রেই সবচে বেশি প্রয়োগ করেন। বয়সের সঙ্গে মানুষের জ্ঞান বাড়ে, বুদ্ধি বাড়ে, বিচক্ষণতা বাড়ে, যুক্তি বাড়ে কিন্তু এই সবের সমন্বয় করে কাজ করার যে ক্ষমতা তা কমতে থাকে। পরিপূর্ণ মাত্রায় সব দেয়ার শেষে হঠাৎ একদিন তিনি একসঙ্গে সব কেড়ে নেন।

 

হরমুজ বলল, স্যার আপনের কি হইছে?

শরীর ভালো না জ্বর আসছে। আর কিছু না। দুপুরে আমি কিছু খাব না। উপাষ দিব।

ডাক্তার আনি।

না ডাক্তার লাগবে না। তুমি ব্যস্ত হয়ো না।

আপনার শরীরের এই অবস্থা আমি ব্যস্ত হব না। এটা স্যার কি বলেন।

তুমি ভালো করে আমাকে লেবুর সরবত দাও। আর কিছু লাগবে না।

লেবুর সরবত বানিয়ে এনে হরমুজ মনসুর সাহেবের গায়ে হাত রেখে প্রায় কেঁদে ফেলল। জ্বরে সর্বাঙ্গ পুড়ে যাচ্ছে। সে ভীত গলায় বলল, এত জটিল অবস্থা।

মনসুর সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, অবস্থা মোটেই জটিল না। অবস্থা সহজ। তুমি এখন আমার সামনে থেকে যাও আমি কাজ করব।

এই শরীরে কি কাজ করবেন।

কাজ শুরু করলে শরীরের কথা মনে থাকবে না।

আপনার পায়ে ধরি স্যার আপনি বিশ্রাম করেন।

হরমুজ সত্যি সত্যি পা ধরতে এগিয়ে এল। মনসুর সাহেব ধমক দিয়ে তাকে বিয়ে করে সত্যি সত্যি কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। পুরানো সব ফাইল বের করলেন। সব হাতের কাছে থাকুক। একটা ভালো ক্যালকুলেটর থাকলে খুব উপকার হত। হিসেবগুলি দ্রুত করা যেত। আজিজ বেপারিকে বললে সে এনে দেবে। এই লোক তাকে পছন্দ করে। খুবই পছন্দ করে। এই জীবনে তিনি তেমন কিছু পান নি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। হরমুজের কথা ধরা যাক। তাকে অসুস্থ দেখে সে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। হেডমাস্টার সাহেবের কথাই ধরা যাক। তিনি অসুস্থ শুনলে দ্রলোক স্কুল ছুটি দিয়ে সব ছাত্র নিয়ে চলে আসবেন। ডাক্তার বজলুর রহমান…এমনকি বদরুল…

মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণা। একটু আগে লেবুর সরবত খেয়েছেন এখন আবার পিপাসা বোধ করছেন। শরীরও কাঁপছে। ঘরে থার্মোমিটার থাকলেও জ্বর মাপা যেত। ঘরে কোনো থার্মোমিটার নেই।

মনসুর সাহেব উবু হয়ে বসেছেন—বসার ভঙ্গির জন্যেই কি লিখতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বুকের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়লেন। বুকে হাঁপ ধরছে। ধরুক। ঘরে আলো কমে আসছে। আকাশে কি মেঘ আছে। চৈত্র মাসে এসব কি শুরু হল দুদিন পর পর বৃষ্টি—মনসুর সাহেব অঙ্কের পাশাপাশি লিখলেন–

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদেয় এল বান।

 

স্যার কেমন আছেন?

মনসুর সাহেব মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন–ফিবোনাক্কি। দিনের বেলা এই প্রথম তাঁর দেখা পাওয়া। বাহ সুন্দর চেহারাতে। এত সুন্দর চোখ। যে কোনো সুন্দর জিনিস দেখামাত্র হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছা করে, শুরু চোখ ঠুতে ইচ্ছে করে না। ফিবোনাক্কি আবার বলল, কেমন আছেন স্যার?

ভালো।

কাজতো অনেকদূর করেছেন।

চেষ্টা করছি।

ঐ দুটা লাইন কি স্যার কবিতা?

হুঁ।

হঠাৎ কবিতা লিখলেন যে?

বুঝতে পারছি না।

আমার মনে হয় আপনার এখন বিশ্রাম করা উচিত। শুয়ে থাকুন।

শুয়েই তো আছি।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন।

অল্প কিছু বাকি আছে ঐটা শেষ হলেই…

মনসুর সাহেব কাগজের উপর ঝুঁকে পড়লেন। ফিবোনাক্কি বলল আমাকে কিছু কাগজ দেবেন স্যার।

কি করবে?

নৌকা বানাব। কাগজের নৌকা। ঐদিন নৌকা বানিয়ে খুব আরাম পেয়েছি। আপনি কি স্যার মগরা নদীতে আমার ভাসানো কাগজের নৌকা দেখেছেন?

না।

সবগুলি নৌকা যখন চলছিল দেখতে খুব মজা লাগছিল।

তোমার কথায় আমার কাজের অসুবিধা হচ্ছে।

তাহলে স্যার আর কথা বলব না। আমি যদি নিঃশব্দে নৌকা বানিয়ে যাই তাহলে কি কাজের অসুবিধা হবে?

না।

স্যার ঘরে কি মোম আছে।

কেন?

নৌকা পানিতে ভাসালে সমস্যা যা হয় তা হল কাগজ ভিজে যায়। কাগজ ভিজে নৌকা পানিতে তলিয়ে যায়। আমি ভাবছি মোম গলিয়ে নৌকার পেছনে লাগিয়ে দেব। তাহলে নৌকা আর ডুববে না।

ঘরে মোম নেই।

হরমুজকে দিয়ে আনানো যায় না?

ফিবোনাক্কি তুমি আমাকে বিরক্ত করছ।

নৌকার নিচটায় মোমতো মাখিয়ে দিলে নৌকা ভারি হবে বাতাসে সহজে দুলবে না।

তুমি অকারণ কথা বলছ ফিবোনাক্কি—আমার চিন্তায় অসুবিধা হচ্ছে।

আমি খুব দুঃখিত—স্যার পাই সংখ্যাটির রহস্যময়তা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? পাই হল বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের অনুপাত। আপাত দৃষ্টিতে কত সহজ একটা ব্যাপার। আপনার রাশিমালায় এই পাই নিয়ে আসা যায় না…

তুমি আমাকে আমার মতো কাজ করতে দাও।

আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।

আমার কারোর সাহায্যের প্রয়োজন নেই।

স্যার খুব ভুল কথা বলছেন—একা একা আগানো যায় না। আগাতে হলে সাহায্য লাগে…

সবার লাগে না। গণিতজ্ঞ এবেলিয়ানের লাগেনি, রামানুজনের লাগেনি, আমার দাদাজানের লাগেনি…

আপনার দাদাজানকে এঁদের সঙ্গে তুলনা করাটা কি ঠিক হচ্ছে?

হ্যাঁ ঠিক হচ্ছে। তিনি মহান গণিতজ্ঞ ছিলেন তার প্রতিভা বাইরের কেউ জানতে পারেনি।

ফিবোনাক্কি হাসছে। শব্দ করে হাসছে। মনসুর সাহেব বললেন, হাস কেন?

হাসছি কারণ গণিতজ্ঞরা দুর্ভাগা। বেশির ভাগ গণিতজ্ঞের প্রতিভা অজ্ঞাত থেকে গেছে। সেই তুলনায় নিম্নমানের প্রতিভা অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

যেমন?

যেমন ধরুন গানের প্রতিভা। একজনের সুন্দর গানের গলা—তার প্রতিভা কখনোই চাপা থাকবে নাসে গান গাইবে। কেউ তা শুনবে। তারা অন্যদের জানাবে প্রতিভার খবর ছড়াবে জিওমেট্রিক্যাল প্রসেনের নিয়মে কিন্তু আপনাদের বেলায় ব্যাপারটা ভিন্ন। আপনারা কাজ করবেন সেই কাজ ফাইলবন্দি পড়ে থাকবে। এক সময় ফাইল যাবে হারিয়ে।

তুমি আমাকে বিরক্ত করছ ফিবোনাক্কি। তোমার জন্যে আমি কাজ করতে পারছি না।

আর বিরক্ত করব না কাজ করুন। আপনার মাথার যন্ত্রণার অবস্থা কি? এখনো যন্ত্রণা হচ্ছে?

হ্যাঁ।

খুব বেশি?

হ্যাঁ।

হরমুজকে বলুন যন্ত্রণার কোনো ওষুধ নিয়ে আসতে।

তুমি আমাকে খুব বিরক্ত করছ।

আপনার কষ্ট দেখে খারাপ লাগছে বলেই করছি। আর করব না।

মনসুর সাহেব লিখে যাচ্ছেন। তাঁর চোখ আবার সমস্যা করছে—পানি পড়ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়ায় দেখতে অসুবিধা হচ্ছে। মাথার যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমুতে পারলে ভালো হত। একবার ঘুমুতে গেলে সেই ঘুম আর ভাঙবে না। ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে না-কি?

ফিবোনাক্কি।

জ্বি স্যার।

বৃষ্টি হচ্ছে না-কি।

হচ্ছে স্যার। এই জন্যেইতো নৌকা বানিয়ে এত আরাম পাচ্ছি।

ফিবোনাক্কি নৌকা বানাচ্ছে। একটা দুটা না অসংখ্য। দ্রুত বানিয়ে যাচ্ছে। সে ঘর ভর্তি করে ফেলছে কাগজের নৌকায়।

ফিবোনাক্কি গুন গুন করে গাইছে

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।

একই লাইন বার বার, বার বার। গান শুনতে শুনতেই মনসুর সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন।

 

হরমুজ হেডমাস্টার সাহেবকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে। হেডমাস্টার সাহেব সত্যি সত্যি স্কুল ছুটি দিয়ে এসেছেন। এসেছেন আজিজ খা, বদরুল।

মনসুর সাহেব চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। মুখের কষ বেয়ে রক্তের ক্ষীণ ধারা। বুক ওঠা নামা করছে। প্রাণ এখনো আছে। কতক্ষণ থাকবে সেটাই কথা।

ঘরময় কাগজ ছড়ানো—লেখা কাগজ, ভেঁড়া কাগজ, আর অসংখ্য কাগজের নৌকা।

আজিজ খাঁ বললেন, এসব কি? কাগজের নৌকা।

বদরুল বলল, স্যারের মাথায় গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল—আমার কাছ থেকে কাগজ নিতেন—নৌকা বানিয়ে নদীতে ছাড়তেন।

আজিজ খাঁ হুংকার দিয়ে বললেন, আগে বলনি কেন? কেন আগে বলনি?

বদরুল কাঁদছে। তার চোখ দিয়ে টপ টপ পানি পড়ছে। হরমুজ কাদোকাদো গলায় বলল, এই কাগজগুলাই স্যারের সর্বনাশ করেছে। স্যার দিন রাত লেখতেন-লেখতে লেখতে…

হেডমাস্টার সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় বললেন—সব কাগজ নিয়ে আগুন দিয়ে। পুড়িয়ে ফেল। সব কাগজ। একটাও যেন না থাকে। হারামজাদা কাগজ।

অচেতন অবস্থাতেও মনসুর সাহেব কথা বলার চেষ্টা করলেননা না। বলতে পারলেন না—শুধু তাঁর ঠোট কাপল।

হেডমাস্টার সাহেব বললেন—এক্ষুণি উনাকে ঢাকায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা। করতে হবে। এক সেকেন্ডও দেরি করা যাবে না—আশ্চর্য কেউ একজন বললও না লোকটার এই অবস্থা? আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে… বলতে বলতে হেডমাস্টার সাহেবের চোখে পানি এসে গেল।

আজিজ খা গাড়ি নিয়ে এসেছেন। গাড়ি সরাসরি ঢাকা যাবে। হরমুজ সব কাগজ আগুনে দিয়েছে। আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে

 

হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কিছুক্ষণের জন্যে মনসুর সাহেবের জ্ঞান ফিরল। অপরিচিত ঠাণ্ডা ঘর। শরীরে নানা যন্ত্রপাতি লাগানো। অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। কয়েকজন ডাক্তার এবং নার্স উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। মনসুর সাহেব ব্যস্ত হয়ে খুঁজলেন ফিবোনাক্কিকে। ঐ তো ফিবোনাক্কি। তার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু ঠোট ফাঁক করার ক্ষমতা তার নেই কথাতো অনেক দূরের ব্যাপার। তিনি মনে মনে ডাকলেন—ফিবোনাক্কি।

ফিবোনাক্কি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, জি স্যার।

ওরা আমার সমস্ত কাগজপত্র আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে।

স্যার আমি জানি।

তুমি কি খুশি হয়েছ ফিবোনাক্কি?

ফিবোনাক্কি জবাব দিল না। মনসুর সাহেব বললেন–আমি তোমাকে আমার কল্পনার একটি অংশ ভেবে ভুল করেছিলাম। তুমি আমার কল্পনার অংশ নও। তুমি আসলেই শূন্য জগতের কেউ।

স্যার আপনি ঠিকই ধরেছেন।

তোমাকে পাঠানো হয়েছিল আমার কাজ নষ্ট করে দেয়ার জন্যে।

জ্বি স্যার।

যখন বুঝতে পারলাম তখন আর করার কিছু নেই। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাচ্ছি তাই না ফিবোনাক্কি।

স্যার আমার তাই ধারণা।

মৃত্যু কেমন ফিবোনাক্কি?

মৃত্যু কেমন আমি বলতে পারছি না স্যার। আমাদের জগতে মৃত্যু নেই। আমরা বাস করি মৃত্যুহীন জগতে।

ও।

আমরা যদি আমাদের জগতটাকে সুরক্ষিত রাখতে চাই সেটা কি অন্যায়?

না অন্যায় নয়।

পৃথিবীর মানুষরা আমাদের জগতে ঢুকে পড়তে চাচ্ছে। তারা শূন্যের রহস্য একবার ধরে ফেললে আমাদের কি হবে? আমরা থাকতে চাই আমাদের মতো। সেখানে কারোরই প্রবেশাধিকার নেই। আমরা কিছুতেই এ রহস্য ভেদ করতে দেব না। যারাই এই চেষ্টা করবে তাদেরই আমরা দূরে সরিয়ে দেব। তাদের কাজ নষ্ট করে দেব।

আমি এখন তোমাদের রহস্য জানি। আমিতো সমাধান করেছি।

স্যার আমি জানি। এই জন্যেইতো আপনার কাজ পুড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে।

আমাতেই তো সব শেষ হচ্ছে না। আবারো একজন আসবেন।

আমরা লক্ষ রাখি। কিছুই আমাদের লক্ষের বাইরে নয়।

মনসুর সাহেবের ঘুম পাচ্ছে। চোখ আর মেলে রাখতে পারলেন না। মনে হচ্ছে। এটাই শেষ ঘুম। ফিবোনাক্কি বলল-স্যার শুনুন। তিনি বললেন, শুনছি।

আমাকে ক্ষমা করে দিন স্যার। আমি যা করেছি আমার জগতের দিকে তাকিয়ে করেছি। আপনিও নিশ্চয়ই আপনার পৃথিবী, আপনার প্রিয় জগৎ রক্ষার জন্যে যা করণীয় তা করবেন। করবেন না স্যার?

হ্যাঁ করব।

স্যার আমি কি কিছু করতে পারি আপনার জন্যে।

আমার সময় শেষ—এই শেষ সময়ে তুমি কি করবে?

আপনার মস্তিষ্কে অনেক সুখ স্মৃতি আছে। তার একটি দেখতে দেখতে যেন আপনার জীবনের ইতি হয় সেই ব্যবস্থা করব।

তার প্রয়োজন নেই ফিবোনাক্কি।

আপনার জন্যে কিছু একটা করতে ইচ্ছা হচ্ছে স্যার। আমাকে দয়া করে অনুমতি দিন আপনার মস্তিষ্কের অতি গোপন একটা জায়গা থেকে মিষ্টি একটা স্মৃতি আমি বের করে আনি—আপনার ভালো লাগবে। আপনার খুব ভালো লাগবে।…

মনসুর সাহেব কিছু বলার আগেই ঝমঝুম শব্দ শুনতে পেলেন। বৃষ্টির শব্দ। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ছে। তিনি দেখলেন তিনি তাদের গ্রামের বাড়িতে শোবার ঘরে আধাশোয়া হয়ে আছেন। হাতে একটা বই। গভীর রাত। পাশের টেবিলে হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের ক্ষীণ আলোয় তিনি বৃষ্টির রাতে বই পড়ছেন দরজা ঠেলে কে ঢুকছে? আরে রূপা না! হাঁ রূপা। তাঁর কিশোরী বধূ। আহা কতদিন পর দেখলেন রূপাকে। এত সুন্দর মেয়ে। এত মিষ্টি চেহারা। রূপা বলল—এই বৃষ্টি হচ্ছে! বৃষ্টিতে ভিজবে?

না না-পাগল হয়েছ দুপুর রাতে বৃষ্টিতে ভিজব কি? তোমার কি সব পাগলামি।

রূপা মন খারাপ করে বসে আছে। তার চোখ ভিজে উঠেছে। ফিবোনাক্কি এই স্মৃতি কেন দেখাল। এই স্মৃতি তাঁর জীবনের দুঃখময় স্মৃতির একটি। তিনি সে রাতে স্ত্রীর সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে যাননি। এইসব ছেলেমানুষি তার চরিত্রে ছিল না।

তিনি দেখছেন অভিমানে রূপার চোখ ভিজিয়ে উঠতে শুরু করেছে। তখন তিনি বই ফেলে দিয়ে বললেন—চল যাই ভিজি। রূপা আনন্দে হেসে ফেলল।

ঘটনা এ রকম ঘটে নি। তিনি রূপাকে অগ্রাহ্য করে সে রাতে বই পড়েছেন—এখানে ঘটনা বদলে যাচ্ছে। ফিবোনাক্কি তাঁর স্মৃতি পাল্টে দিচ্ছে

তিনি দেখছেন–রূপাকে নিয়ে উঠোনে নেমে গেছেন। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে রূপা হাসছে খিলখিল করে…আহ কী সুন্দর স্মৃতিকী মধুর স্মৃতি। ফিবোনাক্কি চমক্কার একটি স্মৃতি তৈরি করে তাঁকে উপহার দিচ্ছে। তিনি গাঢ় স্বরে বললেন—ধন্যবাদ ফিবোনাক্কি। ধন্যবাদ।

রূপার হাত ধরে তিনি বৃষ্টিতে ভিজছেন। এক একবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় দেখছেন জলভেজা আশ্চর্য মায়াবী এক মুখ…তিনি আবারো বললেন—ধন্যবাদ ফিবোনাক্কি।