০৭. তেরো, চোদ্দ, প্রেমে মজে সদ্য
জাহাজ কোম্পানির টিকিট কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন রেইলি। দূর থেকে তাকে দেখে এরকুল পোয়ারো এগিয়ে এলেন। বললেন–মি. রেইলি বোধ হয়?
গলা শুনে পাশ ফিরে তাকালেন রেইলি। বিশাল গোঁফ আর ডিম্বাকৃতি মাথার ছোটো খাটো একজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।
পোয়ারো আবার বলে উঠলেন–আমাকে চিনতে পারলেন না, মনে হচ্ছে,?
রেইলি হেসে জবাব দিলেন–আপনার মতো স্বনামধন্য মানুষকে একবার দেখলে সহজে ভোলা যায় না, মঁসিয়ে পোয়ারো।
-কোথায় চলেছেন এ দেশ ছেড়ে?
–আমি চলেছি সুদূর আমেরিকায়। আপনি নিশ্চয় ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন। মঁসিয়ে?
পোয়ারো বললেন নিজের দেশ বেলজিয়ামে যাচ্ছি। মাঝে মধ্যে ওখানে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আসি।
রেইলি বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন–তাহলে আপনি আবার ফিরছেন। কিন্তু আমার ফেরার আশা নেই। কুইন শার্ট স্ট্রিটে আমাকে আর ডাক্তারি করতে দেওয়া হবে না, মঁসিয়ে পোয়ারো।
সত্যিই খুব দুঃখের কথা, মি. রেইলি!
–এতে আমি একটুও দুঃখ পাইনি। অনেক টাকা ঋণ করেছি এখানে। রেইলি হেসে আবার বললেন–তবে ভাবলে খুব আনন্দ পাই। একথা সত্যি ধার রেখে যাচ্ছি বলে গুলি করে আত্মঘাতী হব, এমন মানসিকতা আমার নেই। আমার মত হল, যা হয়ে গেছে তা পিছনে ফেলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। আমি উচ্চশিক্ষিত। তাই কাজ পেতে আমার খুব একটা অসুবিধা হবে না।
সেদিন মিস জর্জিনা মলের সাথে দেখা হয়েছিল।
–তাতে কি আপনি খুব খুশি হয়েছিলেন? মনে হয় না। মেয়ে সৈনিকের মতো দশাসই চেহারা, গোমড়া মুখো, বদ মেজাজী মহিলা আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই।
পোয়ারো এবার প্রসঙ্গে ঘুরিয়ে বললেন মি. মর্লের মৃত্যু সম্পর্কে কানোর আদালত যে রায় ঘোষণা করেছে সেটা আপনি শুনেছেন? এ বিষয়ে আপনার কি মত?
রেইলি ধীরে ধীরে বললেন–আদালতে প্রমাণিত হয়েছে মি. মর্লে গ্রীক ভদ্রলোকটিকে ভুল ইঞ্জেকশান দিয়েছিলেন। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সে মাতাল অবস্থায় ছিল। নতুবা সে তাকে খুন করার জন্যই এই ভুল করেছিল। আমি একথা জোর দিয়ে বলতে পারি হেনরি কখনো মদ ছোঁয়নি।
আপনার বয়ান অনুযায়ী বলতে হবে এটা তার ইচ্ছাকৃত গাফিলতি।
–আপনি ভুল করছেন। আমি একথা বলিনি। এমন দোষারোপ অত্যন্ত অন্যায়। আসলে তার দ্বারা এরকম ভুল হওয়া আদৌ সম্ভব না। আর আমিও বিশ্বাস করি না।
–এর নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।
–অবশ্য আছে। তবে এনিয়ে এখনও আমি ভাবনা চিন্তা করিনি।
পোয়ারো জানতে চাইলেন–খুনের দিন মি. মর্লেকে শেষে কখন জীবিত দেখেছিলেন আপনি? মনে আছে?
মাথা নেড়ে রেইলি বললেন–হ্যাঁ, মনে আছে। তবে খুনের দিন হেনরির সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল ঘটনার আগের দিন। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ।
পোয়ারো গলার স্বরে তীব্রতা এনে বললেন–উঁহু, আপনি ঠিক বলছেন না। আমার যতদূর মনে পড়ে, আপনি ঘটনার দিন তার ঘরে গিয়েছিলেন। এই ধরুন সাড়ে এগারোটা হবে তখন।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আমি গিয়েছিলাম। সেই সময় সে একজন রোগী দেখছিল। আমার কিছু যন্ত্রপাতি কেনার ছিল। তাই ওই বিষয়ে ওর কাছে পরামর্শ নিতে গিয়েছিলাম।
সায় দিয়ে পোয়ারো বললেন আপনার এক রোগী মি. রেইকস এসেছিলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি চলে গিয়েছিলেন। আপনি ওই আধঘন্টা কি করছিলেন?
সুযোগ পেলে যা করে থাকি। গ্লাসে কিছু পানীয় ঢেলে পান করি। মর্লেকে টেলিফোন করি। তারপর এক মিনিট সেখানে থেকে চলে আসি।
পোয়ারো জেরার ভঙ্গীতে বললেন–সাড়ে বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত মি. বার্নেস আপনার ঘরে ছিলেন। তারপর আর কোনো রোগী আপনার ছিল না। আপনি কটার সময় ওখান থেকে বেরিয়ে আসেন?
–সাড়ে বারোটার পর।
–তারপর কি করেন?
–ঠিক আগে যা করেছি। আপনি তো জানেন আমার মদ্য পানে অরুচি নেই।
আবার মর্লের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?
–আপনি বলতে চাইছেন আমি তাকে গুলি করেছি। এর আগেও আমি বলেছি, ওটা আমার কাজ নয়। অবশ্য আপনার ওপর নির্ভর করছে বিশ্বাস করা না করা।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন–বাড়ির পরিচারিকা অ্যাগনেস সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন?
বিস্ময়ের সুরে রেইলি বললেন, ভারী অদ্ভুত প্রশ্ন। তবুও বলছি, ওর বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কাজের মেয়েদের ভার জর্জিনার ওপর। ও সব কিছুর তদারকি করে থাকে। মেয়েটা আমাকে ভীষণ ভয় পায়। চোখ তুলে দেখেনি কোনোদিন।
মেয়েটিকে দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল ও বোধহয় কিছু বলার চেষ্টা করেছিল।
রেইলি হেসে মাথা নাড়লেন। তারপর টিকিট নিয়ে চলে গেলেন।
পোয়ারো যাবেন কিনা এখনও স্থির করতে পারেননি। তাই কাউন্টারের সামনে থেকে সরে এলেন।
এরকুল পোয়ারো একদিন এলেন হ্যামস্টেডে। মিসেস অ্যাডামসের সাথে সাক্ষাৎ করতে। তাকে দেখে মিসেস অ্যাডামস অবাক হয়েছিলেন। পোয়ারো স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপের প্রতিভূ হয়ে গিয়েছিলেন। মিসেস অ্যাডামসের কাছে তাঁর পরিচয় বিদেশী হিসেবে।
ফ্ল্যাটে পাওয়া নিহত মহিলার পরিচয়ের চাঞ্চল্যকর বর্ণনা শোনার পর মিসেস অ্যাডমস বললেন, খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারলাম দেহটা মিস সেইনসবারি সীলের নয়, মিসেস চ্যাপমান নামে এক মহিলার। খবরটা পড়ে আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে এটা ভেবে দুঃখ হচ্ছে আপনারা এখনও তার খোঁজ পেলেন না। আর সে কেন যে এভাবে অদৃশ্য হয়ে রয়েছে বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, মি. পোয়ারো, আমার বান্ধবীর কি স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে?
পোয়ারো সায় দিয়ে বললেন–এটা হওয়া সম্ভব। এরকম ঘটনার কথা এর আগে আমি শুনেছি। ডাক্তারি শাস্ত্রে একে বলে অ্যামনেসিয়া। মিসেস অ্যাডামস বললেন, হ্যাঁ, আমার এক বন্ধুর এরকম রোগ হয়েছিল।
পোয়ারো সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–মাদাম, মিস সীলের মুখে কখনো মিসেস অ্যালবার্টের নাম শুনেছেন?
না। মিসেস অ্যাডামস আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলেন, পুলিশ কি বুঝতে পেরেছে। মিসেস চ্যাপম্যানকে কে খুন করেছে?
–এটা তদন্ত সাপেক্ষ। এবার পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, আপনি কি মিস সীলকে দন্ত–চিকিৎসক মি. মর্লের কাছে যেতে বলেছেন?
-না, আমি হার্লে স্ট্রিটের মি. ফ্রেস্কের কাছে যাই। আমি যদি জানতাম সেইনসবারি দাঁতের অসুখে কষ্ট পাচ্ছে তাহলে সেখানেই পাঠাতাম। মি. মর্লের কাছে নয়।
পোয়ারো বললেন মিস সীল, মর্লের নাম শুনেছেন মিসেস চ্যাপম্যানের থেকে।
মিসেস অ্যাডামস বললেন–হতে পারে।
পোয়ারো এবার ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন মিস সেইনসবারি সীলের সাথে প্রথম দেখা হয় কোথায়?
তিনি জবাব দিলেন মিস সীলকে প্রথম দেখি ভারতে। সেখানেই তার সাথে আমার পরিচয় হয়।
–মিস সীলের সঙ্গে মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের প্রথম দেখা হয় কি ভারতেই?
–ওহ্, আমি বলতে পারব না। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট! সেই বিখ্যাত ব্যাঙ্কার। ওরা ভাইসরায়ের কাছে গিয়েছিলেন। মনে হয় না আমার বান্ধবী কখনো মি. ব্লাস্টকে দেখেছে। এত উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হলে সে অবশ্যই আমাকে বলত।
ব্লাস্ট পরিবারের অন্য কাউকে তিনি চিনতেন কি?
–ওহ, হ্যাঁ। ও তাদের চিনত মনে হয় না। আমাদের সব বান্ধবীরা একরকম সাধারণ মানুষ।
মিসেস অ্যাডামস বান্ধবীর প্রশংসা করতে লাগলেন। তিনি বলে চললেন, ওর মতো বান্ধবী খুব কম পাওয়া যায়। ওর মন খুব নরম। সকলের দুঃখে ও দুঃখী। ও সবার উপকার করত প্রাণ দিয়ে। ওর প্রতিবেশীদের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। এছাড়া কলকাতার মিশনারীদের জন্য ও চাঁদা তুলত। এই টাকা জোগারের জন্য আমার বান্ধবী অপরাধ করতেও কুণ্ঠা বোধ করত না। এবার বুঝতে পারছেন তো ও কতটা উদারমনস্ক মানুষ ছিল, মঁসিয়ে পোয়ারো।
সত্যিই, তাই। পোয়ারো ভাবলেন, মিস সীলের গুণের কথা মি. বার্নেসও বলেছিলেন। তাঁর মতে মিস সীল দয়ালু, সম্ভ্রান্ত, ভদ্র একজন মহিলা। এরকম মানুষের মধ্যে অপরাধ বোধের বাসনা সুপ্ত থাকে। নিপুণভাবে পরখ করলে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
মি. অ্যামবেরিওটিস ও মিস সীল একই জাহাজে ভারত থেকে ফিরেছিলেন। তারা একসঙ্গে স্যাভয় হোটেলে লাঞ্চ সেরেছেন, এই প্রমাণও পাওয়া গেছে। তিনি কিং লিওগোল্ড ম্যানসনে দু’দিন গিয়েছিলেন। যে ফ্ল্যাটে তিনি গিয়েছিলেন সেই ফ্ল্যাটে একটি মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। তার পরনে ছিল মিস সীলের পোশাক। এমনকি তার হাত ব্যাগটিও ওই মৃতদেহের পাশে পাওয়া গিয়েছিল।
তিনি পুলিশের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তারপর হঠাৎ একদিন গ্রেনগাউরি কোর্ট হোটেল থেকে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন।
এরকুল পোয়ারোর থিয়োরির সঙ্গে মিলিয়ে এর কোনো ব্যাখ্যা কি আছে?
তিনি ভাবলেন, অবশ্যই আছে।
একরকম ঘোরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছেন এরকুল পোয়ারো। ট্যাক্সি ধরতে হবে। তিনি এসে হাজির হলেন রিজেন্ট পার্কে।
গ্রীষ্মকালীন একটা বিকেল। ফুরফুরে বাতাস বইছে। কিছু বাচ্চা আয়াদের সঙ্গে পার্কে বেড়াতে এসেছে। তারা প্যারামবুলেটারে শুয়ে হাত-পা নাড়ছে। হাসছে, খেলছে। কোনো কোনো বাচ্চা কাগজের নৌকো তৈরি করে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। গাছের নিচে প্রেমিক প্রেমিকা বসে আলাপচারিতায় মত্ত রয়েছে।
এইসব দেখে তার মনে পুলক জাগল। তার অতীতের কথা মনে পড়ল। কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব সুখের দিনগুলো।
তাঁর মনের পরদায় ভেসে উঠল এক রহস্যময়ী নারীর চেহারা। এক ভেনাস যেন স্বর্গের এক পরী। সে রাশিয়ান বংশোদ্ভুত কাউন্টেস ভেরা। অপূর্ব সুন্দরী তন্বীর কাউন্টেসের সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনো মেয়েই নেই এই দেশে। পোয়ারোর এও মনে পড়ল কত বড় তস্কর কাউন্টেস।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে চললেন খুশি মনে। আচমকা তার চোখে ধরা পড়ল এক রোমান্টিক দৃশ্য।
একটি গাছের আড়ালে একটি তরুণ ও তরুণী বসে আছে। তরুণটি মুখের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বোঝাতে চাইছে বলে পোয়ারোর মনে হল। তিনি ওই দুটি মূর্তিকে চিনতে পারলেন।
জেন অলিভেরা ও তার আমেরিকান বন্ধু হাওয়ার্ড রেইকস। এরাও তাহলে রিজেন্ট পার্কে আসে বেড়াতে? তার মুখে কাঠিন্যের ভাব।
মিনিট কয়েক চিন্তা করলেন। তারপর তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বিচিত্র কায়দায় মাথার টুপি খুলে তাদের সামনে তিনি দাঁড়ালেন।
তাকে দেখে জেন অলিভেরার চোখ মুখ খুশিতে ভরে গেল। কিন্তু হাওয়ার্ড রেইকস তার অযাচিত আবির্ভাবে খুব রেগে গেল।
সে বিরক্ত হয়ে বলল–ওহ, এখানেও আপনাকে আসতে হল। আপনি কি আমাদের পেছন ছাড়বেন না?
জেন শান্ত স্বরে বলল–কি অদ্ভুতভাবে আপনি সব জায়গায় হাজির হন তাই না, মঁসিয়ে পোয়ারো?
রেইকস ঠাণ্ডা গলায় বলল–সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা।
পোয়ারো মিষ্টি হেসে বলল–অনধিকার প্রবেশ করিনি তো?
মিস অলিভেরা সহজভাবে বলল একদম না। রেইকস মুখে কিছু বলল না। তবে মনে মনে গর্জে উঠতে চাইল।
–বেশ খোশ-মেজাজে আছেন তো?
–আগে ছিলাম, এই মুহূর্তে আর নেই। রেইকস গর্জে উঠে বলল।
জেন ধমক দিয়ে বলল–চুপ কর, হাওয়ার্ড। তুমি শালীনতা হারিয়ে ফেলছ।
রেইকস বলল–হুম, শালীনতা বজায় রাখব কার জন্য?
জেন বলল–ভবিষ্যতে মি. পোয়ারোকে তোমারই উপকারে লাগবে। উনি আমার কোনো প্রয়োজনে আসবেন না। আমি সুন্দরী, অঢেল প্রতিপত্তি আছে। এছাড়া কিছু প্রভাবশালী বন্ধু বান্ধব আছে। তাই অভদ্র ব্যবহার করলেও আমার কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
রেইকস বলল–এইসব নিম্নমানের কথাবার্তা আমার পছন্দ নয়। তাই এখানে থাকা আমার উচিত হবে না। আমি চলে যাচ্ছি, জেন। সে উঠে দাঁড়াল এবং পোয়ারোর দিকে মাথা নুইয়ে বিদায় নিল।
জেন তার গমনপথের দিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল।
এরকুল পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটু ইতস্তত করে বললেন–একটা প্রবাদ আছে, জানেন মিস অলিভেরা। যখন প্রেম করবেন তখন দু’জনই শ্রেয়, তৃতীয় ব্যক্তি এলেই সব গোলমাল হয়ে যায়।
–আপনি খুব মজার কথা বলতে পারেন, জেন হেসে জবাব দিল।
-তেরো, চোদ্দতে প্রেম জমে সদ্য। দেখুন চারপাশের লোকগুলোকে। তারা সবাই প্রেমাস্পদের হাত ধরে বিবাহের প্রস্তাব দিচ্ছেন। আপনারাও তো সেইরকম বিবাহ ইচ্ছুক জোড়।
জেন ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে পোয়ারোকে লক্ষ্য করল। পরে বলল, আপনি আমায় ক্ষমা করুন মঁসিয়ে পোয়ারো। সেদিন আমি ভুল বুঝেছিলাম। আমার ধারণা ছিল আপনি হাওয়ার্ডের ওপর নজরদারি করার জন্য এসেছেন ক্রমহ্যামে কিন্তু অ্যালিস্টেয়ারো কাকার কাছে শুনলাম তিনিই আপ-কে এখানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি ওই নিরুদ্দিষ্ট মহিলা মিস সেইনসবারি সীলের অন্তর্ধান রহস্যের তদন্ত ভার দিয়েছেন আপনাকে। কথাটা ঠিক বলছি তো?
পোয়ারো সহাস্যে বললেন–একশোভাগ ঠিক।
–সেদিন আপনাকে কটু কথা বলার জন্যে আমি লজ্জিত ও দুঃখিত, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার সন্দেহ হয়েছিল, আমার ও হাওয়ার্ডের মধ্যেকার সম্পর্ককে নষ্ট করতে চাইছিলেন। হাওয়ার্ডের প্রতি কাকার মনে বিতৃষ্ণা পোষণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
যদি কথাটা সত্যি হত, মাদামোয়াজেল। আমি সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। মি. রেইস যদি সাহস করে কার্টারের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়নে তাহলে কি হত বলুন তো? তিনি আক্রমণকারীকে প্রতিরোধ করেছিলেন বলেই সে আর গুলি ছুঁড়তে পারেনি। এর ফলেই মি. ব্লাস্টের প্রাণ রক্ষা পেল।
আপনি খুব সহজ করে কথাগুলো বলতে পারলেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি বুঝতে পারি না আপনি রসিকতা করছেন কিনা?
পোয়ারো বললেন–না, না মাদামোয়াজেল, আমি রসিকতা করছি না, আমি সত্যি কথা বলছি।
জেন বলল–এভাবে তাকিয়ে আপনি কি দেখছেন? মনে হয় আপনি আমার দুঃখে কষ্ট পাচ্ছেন। আপনি ঠিক ধরেছেন, মিস অলিভেরা, অতি সত্বর আমি একটি দুঃখজনক কাজ করব, তার জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
–তাহলে সেটা না করাই মঙ্গলের।
না, না মাদামোয়াজেল, কাজটা আমাকে করতেই হবে।
জেন অলিভেরা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে পোয়ারোকে দেখল। তারপর বলল মিস সীল না কি যেন নাম মহিলার, তাকে কি খুঁজে পেয়েছেন?
পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–না খুঁজে পাইনি। তবে কোথায় আছে জানতে পেরেছি।
–সে কি এখনও বেঁচে আছেন?
–আমি কি সেকথা বলেছি?
জেন অসন্তুষ্ট হয়ে বলল–আশ্চর্য তোলয় জীবিত আর নয় মৃত, একটা হবেই।
খুব সহজ ব্যাপার নয়, মিস অলিভেরা।
–গোয়েন্দাদের এই একটা মস্ত দোষ। সব কিছুতেই গলদ দেখেন।
সাধারণ লোকেরা আমাদের সম্বন্ধে এইরকম ধারণাই করে থাকেন।
জেন উঠে দাঁড়াল। বলল–ব্যাপারটাকে এত মজার ভাববেন না। সে একটু ইতস্তত করল। তারপর বলল, হাওয়ার্ড বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। ওর ধারণা আমি খুব দুর্বল মনের মানুষ। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। আমি ওকে এখনও সম্মতি জানায়নি। আপনি একটা বুদ্ধি বের করুন, মঁসিয়ে পোয়ারো। কথা বলতে বলতে সে পোয়ারোর একটা হাত উত্তেজনার বশে চেপে ধরলেন।
পোয়ারো স্মিত হেসে বললেন আমার কাছে পরামর্শ চাইছেন? আপনার অনেক প্রিয়জন আছেন বুদ্ধি দেবার জন্য।
আমার প্রিয়জন বলতে মা আর অ্যালিস্টেয়ার কাকা। কথাটা শুনে মা ভীষণ রাগারাগি করবেন। আর রইলেন কাকা। তিনি খুব সাবধানী মানুষ। বলবেন, আমি এখনও ছোট আছি। তোমার বন্ধুকে ভালো করে চেনো। একটু ভাবনা চিন্তা করো। তারপর না হয় বিয়ের জন্য প্রস্তুত হবে। এত তাড়াহুড়ো করার দরকার কি…..।
–আপনার বন্ধুরা?
আমার কোনো বন্ধু নেই। একদল বোকা আছে যাদের সঙ্গে আমি মাঝেমধ্যে কথা বলে থাকি। একমাত্র হাওয়ার্ডকেই সত্যিকারের মানুষ বলে আমার মনে হয়েছে। তাই ওকে এত ভালবাসি।
তবুও আমি আপনার আপনজন নই। আমার থেকে পরামর্শ নেওয়ার কারণ কি, মিস অলিভেরা?
জেন বলল–কারণ আপনার মুখের অদ্ভুত ভাবটা আমাকে বিচলিত করেছে। আমি বুঝতে পারছি আপনি কোনো বিপদের আশঙ্কা করছেন। এমন কিছু ঘটতে চলেছে যা আপনি বুঝতে পারছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে জেন একটু থামল। আবার বলল–বলুন, আমি ঠিক বলেছি কিনা?
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
এরকুল পোয়ারোর বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। তিনি বাড়িতে ঢুকতেই জর্জের মুখে জানতে পারলেন চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপ এসেছেন।
পোয়ারো দ্রুতবেগে ঘরে ঢুকলেন। জ্যাপের মুখের ওপর তার চোখ পড়ল। সেখানে বিষণ্ণতার পরশ রয়েছে।
পোয়ারোকে দেখে জ্যাপ বললেন–আমি এসে গেছি বন্ধু। সত্যিই আপনার তুলনা নেই! দারুণ খেল দেখালেন মশাই! আপানার মাথায় এসব আসে কোথা থেকে?
আগে বলুন কি নেবেন? কফি না হুইস্কি?
হুইস্কি হলে ভালই হবে।
ঠিক আছে। পোয়ারো জর্জকে হুইস্কি আনার নির্দেশ দিলেন। জর্জ মনিবের হুকুম তামিল করল। দুজনে গ্লাস তুলে নিলেন।
পোয়ারো সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে জ্যাপকে দেখছেন। তিনি প্রশ্ন করলেন–কি ব্যাপার, এত প্রশংসার কারণ কি?
জ্যাপ বললেন–এরকুল পোয়ারো যেটা বলেন সেটা ঠিক হয়।
–কি রকম, বন্ধু।
–একটা অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটল। আমরা অর্থাৎ পুলিশের ভাষায় সেটা আত্মহত্যা আর পোয়ারোর মতে সেটা খুন হল। অতএব তিনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সেটা সত্যিই খুন বলে প্রমাণিত হল।
–তাহলে আপনি আমার সঙ্গে এক মত?
–আমি কি খুব বোকা? সাক্ষ্য প্রমাণ এড়িয়ে চলব কি করে। সমস্যা হল এর আগে কোনো প্রমাণ আমার হাতে ছিল না। সম্প্রতি আমি পেয়েছি। তাই আপনার কাছে চলে এলাম। আপনাকে সব জানাব বলে। সেই সঙ্গে নিজের ভুলও শুধরে নেওয়ার ইচ্ছে আছে।
–আমার আর দেরি সইছে না, দয়া করে তাড়াতাড়ি বলুন বন্ধু।
–একটু ধৈর্য ধরুন, বলছি। যে পিস্তল দিয়ে ফ্র্যাঙ্ক কার্টার অ্যালিস্টেয়ারকে গুলি করার চেষ্টা করেছিল সেইরকম একটা পিস্তল দিয়ে মি. মর্লেকে গুলি করা হয়েছিল। অর্থাৎ মর্লের মৃতদেহের পাশে যে পিস্তলটি পাওয়া গেছে সেটি এরই জোড়া।
পোয়ারো বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–এ কি করে সম্ভব?
-হ্যাঁ, ফ্র্যাঙ্কের পক্ষে এটা সম্ভব।
–এটাই কি আপনার প্রকৃত সূত্র।
-না, তা, নয়, দুটো বন্দুকই বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। এছাড়া এগুলো সচরাচর ব্যবহার করা হয়নি।
এরকুল পোয়ারো বিস্ময়ে বিহ্বল। তিনি সুযুগল বাঁকিয়ে বললেন–ফ্রাঙ্ক কার্টার? না, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
জ্যাপ বিরক্ত হয়ে বললেন–বন্ধু, আপনার হাবভাব আমার ঠিক ভালো লাগছে না। এতদিন আপনি বলে এসেছেন হেনরি মর্লে আত্মহত্যা করেনি, তাকে খুন করা হয়েছে। এখন সেই আমি বললাম আপনার মতকেই আমরা সানন্দে গ্রহণ করেছি, এখন আপনি সেটা মানতে রাজি নন।
–আপনার স্থির বিশ্বাস মলের খুনি ফ্র্যাঙ্ক কার্টার?
–সাক্ষ্য প্রমাণ তো সেটাই বলছে। আপনি জানেন মর্লে কার্টারকে পছন্দ করত না। তাই তার ওপর কার্টারের রাগ থাকা স্বাভাবিক। তার বক্তব্য থেকে জানা যায়, সে সেদিন কুইন শার্ল স্ট্রিটে গিয়েছিল। তার বান্ধবী গ্ল্যাডিসকে নতুন চাকরির কথা জানাতে। তবে আমাদের কাছে খরব আছে সে তখনও চাকরিটা পায়নি। পরে অবশ্য সে কাজটা পেয়েছিল। এছাড়া বারোটার পরে সে কোথায় ছিল তাও সঠিক বলতে পারেনি, সে বলেছে ওই সময় সে মেরিলিকোশ রোড ধরে হাঁটছিল। তবে একটার সময় সে একটা বারে বসে মদ খাচ্ছিল। একথা সে সত্যি বলেছে। আমাদের কাছে তার প্রমাণ আছে। সেখানকার বারম্যানকে চাপ দিয়ে জানতে পেরেছি। তাকে সে সময় খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।
এরকুল পোয়োরো হতাশ হয়ে বললেন, আমার মন কিন্তু একথা বলছে না, বন্ধু।
ঠিক বুঝলাম না। একটু স্পষ্ট করে বলুন।
আপনার কথা আমায় চিন্তায় ফেলল। আমি যা অনুমান করেছিলাম তার সঙ্গে একটুও. মিল খুঁজে পাচ্ছি না। আর যদি আপনার কথাই ঠিক হয় তাহলে….
এমন সময় জর্জ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল, সে বলল–দুঃখিত, স্যার।
কথাটা সে শেষ করতে পারল না। তার আগেই ঝড়ের গতিতে এসে প্রবেশ করল গ্ল্যাডিস নেভিল। তার চোখে জল। সে বলল–ওহ, মঁসিয়ে পোয়ারা।
–এখানে আমি অবাঞ্ছনীয়, বলেই জ্যাপ বিদায় নিলেন।
পলায়নরত জ্যাপের দিকে মিস নেভিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
সে চিৎকার করে বলল–এই লোকটা–স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের এই অফিসার বেচারা ফ্র্যাঙ্ককে ফাঁসিয়েছেন। ওর বিরুদ্ধে নানা মিথ্যে অভিযোগ এনেছেন।
–ঠিক আছে, আপনি বসুন মিস নেভিল। আপনার সব কথা শুনব আপনি। অত উত্তেজিত হবেন না। পোয়ারো তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
প্রথমে উনি বললেন–ফ্র্যাঙ্ক মি. ব্লাস্টকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছে, আর এখন মি. মর্লের খুনের জন্যে ওকে দোষী সাব্যস্ত করছেন।
একটু হেসে পোয়ারো বললেন যেদিন মি. ব্লাস্টকে গুলি করা হয় সেদিন আমি তাঁর সাথে ছিলাম। আর তখনই বন্দুক সহ ফ্র্যাঙ্ককে ধরা হয়। প্রত্যক্ষদশী হিসেবে এটা অস্বীকার করতে পারি না আমি।
এ কথায় গ্ল্যাডিস নিজের রাগ সংবরণ করে বলল আমি বিশ্বাস করি না ফ্র্যাঙ্ক একাজ করতে পারে। যদিও করে থাকে তাহলে বলতে হবে তার বুদ্ধির অভাব ঘটেছে। ও দেশকে খুব ভালোবাসে, ওর খারাপ মতলব ছিল না, বিশ্বাস করুন, মঁসিয়ে পোয়ারো।
–তাহলে ধরে নেব, মি. কার্টারের আত্মপক্ষ সমর্থনের এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা?
–ওহ না। যদিও পুলিশ ওর সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেয়নি। আমি কথা বলার সুযোগ পাইনি। তবুও ওর উকিলের কাছে জেনেছি, ফ্র্যাঙ্ক একাজ করেনি, বন্দুকটাও কখনো দেখেনি। ফ্র্যাঙ্ককে ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্র এটা।
মি. কার্টারের উকিল ওই একটি যুক্তিতে সন্তুষ্ট নন। তিনি বলছেন, তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হলে আরও কয়েকটি মোক্ষম যুক্তি দেখাতে হবে।
উকিলরা সবাই একরকম হয়। তারা যুক্তি ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেন না। আমি নিশ্চিত মি. হেনরি মর্লেকে ও খুন করতে পারে না। এর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণও নেই। আমি চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপের অভিযোগ মানতে পারছি না।
–যেদিন মি. মর্লে খুন হন সেদিনও কি মি. কার্টার বেকার ছিলেন? অর্থাৎ তখনও তিনি চাকরি পাননি?
–হ্যাঁ, ও তখনও বেকার ছিল। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, এতে কি যায় আসে?
–সে জবানবন্দি দিয়েছে, সে সেদিন গিয়েছিল নতুন চাকরি পাওয়ার সংবাদ জানাতে। কিন্তু সেটা সত্যি ছিল না। তবে সত্যিটা কি? কেন গিয়েছিল?
–ওহ মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না। আমাকে নিয়ে মি. মর্লে ও ফ্র্যাঙ্কের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। ও জানত মি. মর্লে ওকে পছন্দ করেন না। ওকে যাতে আমি বিয়ে না করি সেই চেষ্টা করতেন তিনি। এতে ও খুব দুঃখ পেয়েছিল। তাই মি. মর্লেকে বোঝাবার জন্যে সেদিন সে কুইন শার্লট স্ট্রিটে গিয়েছিল। বেচারা, কি ভুলই না সেদিন করেছিল সে
–আমার মনে হয় সে বোঝাতে যায়নি, সে গিয়েছিল মি. মর্লেকে খুনের হুমকি দিতে।
না, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার সঙ্গে একমত হতে পারছি না আমি। গ্ল্যাডিস কাঁদতে কাঁদতে বলল।
এরকুল পোয়ারো তার সজল চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন মি. কার্টারের কোনো বন্দুক ছিল কিনা আপনি জানেন?
–ওহ, না, আমার জানা নেই। ওর মুখে কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।
পোয়ারো দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
গ্ল্যাডিস বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল–মঁসিয়ে পোয়ারো, দয়া করে আমাদের বাঁচান, আমাদের সাহায্য না করলে….।
পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন–অবশ্যই, আমাকে সত্য উদঘাটন করতেই হবে।
পোয়ারোর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে গ্ল্যাডিস বিদায় নিল।
গ্ল্যাডিস চলে যেতে এরকুল পোয়ারো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফোন করলেন। ফোন ধরলেন সার্জেন্ট বেডোর্জ।
পোয়ারো জানতে চাইলেন–চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপ আছেন?
ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল না, তিনি এখনও ফেরেননি।
পোয়ারো বললেন আমার কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল, আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?
মি. বেডোর্জ বললেন–হ্যাঁ, বলুন।
ক্রমহ্যামে যে বন্দুক থেকে মি. ব্লাস্টকে গুলি করা হয়েছিল সেটা কি মি. কার্টারের নিজের?
না, স্যার, সেটা এখনও প্রমাণ সাপেক্ষ।
কার্টারকে জেরা করে আর কিছু জানতে পেরেছেন?
-হ্যাঁ, সে তার চাকরি সংক্রান্ত কিছু খবর জানিয়েছে। সে বলেছে, সিক্রেট সার্ভিস থেকেই তাকে ক্রমহ্যামে পাঠানো হয়েছে। মালি হিসেবে। এর জন্য তাকে অগ্রিম প্রচুর টাকা দেওয়া হয়েছে। মালির কাজের প্রশংসাপত্রও সে পায়। মি. ব্লাস্টের প্রধান মালি ম্যাকের কাছে প্রথমে ফ্র্যাঙ্ক যায়। ম্যাক মি. ব্লাস্টকে আবেদন জানাতে বলে। এছাড়া বলা হয় সে যেন নিজেকে একজন কমিউনিস্ট বলে পরিচয় দেয়। এজন্য তাকে একজন মহিলার অধীনে কিছুদিন থাকতে হয়েছিল। যিনি কিউ. এইচ. ৫০ নামে খ্যাত। তার কাছে তালিম নিতে হয়েছিল। শিক্ষানবাস সময়ে মহিলাকে সে ভালোভাবে দেখতে পেত না। কেবল তার কণ্ঠস্বরকে অনুসরণ করতে হত। যেখানে তালিম দেওয়া হত সেখানে আলোর ব্যবস্থা ক্ষীণ ছিল। তাই সে দ্বিতীয়বার দেখলে চিনতে পারবে না ওই মহিলাকে।
পোয়ারোর মুখ থেকে অস্ফুষ্ট একটা শব্দ বের হল। তিনি রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। সেই একই নকশা। তবে এই প্রমাণটা কার্টারের পক্ষে যাবে। তিনি ভাবলেন, মি.বার্নেসের সঙ্গে পরামর্শ করলে কেমন হয়।
সন্ধ্যার ডাকে তার নামে একটি চিঠি এল। সস্তা দামের একখানা খাম। হাতে লেখা চিঠি। অশিক্ষিত হস্তাক্ষর। হার্টফোর্ড সায়রের ডাকঘরের স্ট্যাম্প দেওয়া। তিনি চিঠিটা খুলে ফেললেন। তাতে লেখা আছে।
শ্রদ্ধেয় মহাশয়,
আপনাকে চিঠি লিখে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইছি। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি। আগেই আপনাকে সব কথা জানানো উচিত ছিল আমার। আমি ভেবেছিলাম মি. মর্লে আত্মহত্যা করেছেন। তাই কোনো গোলমাল হবে না। এছাড়া আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই। সেই কারণে পুলিশ থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলাম। আমি মিস নেভিলের তরুণ বন্ধুকে চিনি। তাই তাকে ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। এমনকি আমি ভাবিনি তার দ্বারা একাজ সম্ভব হবে। এখন দেখছি ফ্র্যাঙ্ক সব পারে। খবরের কাগজ পড়ে জানলাম ক্রমহ্যামে কোনো একটি বাড়িতে মালির কাজ করত সে। সেই বাড়ির মালিককে সে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছিল। খবরটা পড়ে শিউরে উঠেছিলাম। মারাত্মক একটা খুনে। আপনি আমার মালকিনের বন্ধু। তাই আপনাকে বলাই শ্রেয় মনে করলাম। আপনাকে সব জানাব যা এতদিন গোপন রেখেছিলাম।
—আপনার বিশ্বস্ত
অ্যাগনেস ফ্লেচার।
এরকুল পোয়ারো চিঠিটা পড়ে বিচলিত হলেন। ভাবলেন, একজন এত কান্ডের মূল পাণ্ডা সেটা ঠিক বুঝতে পেরেছি। কিন্তু যাকে ধরে ছিলাম সে নয়। এখানেই মস্ত বড় ভুল করেছি।