তদন্তের কাজ শেষ হয়ে গেলে পোয়ারো আর আমি বাইরে বেরিয়ে আসতেই পোয়ারো আমার হাত ধরে একপাশে টেনে নিল। ওর উদ্দেশ্যে বুঝতে অসুবিধা হল না, স্কটল্যাণ্ডের ইয়ার্ডের দুজন প্রতিনিধির জন্যই পোয়ারো অপেক্ষা করতে চায়।
একটু পরে ওরা দুজন এলেই পোয়ারো ছোটোখাটো চেহারার লোকটিকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল তিনি পোয়ারোকে চিনতে পারছেন কিনা। ইনসপেক্টর তাকে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তার সঙ্গীর সাথেও তিনি পোয়ারোর পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারা দুজনে পুরনো স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন। কবে তারা কোথায় একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। কোথায় জাল করার রহস্য উদঘাটন করেছিলেন। সব ক্ষেত্রেই যে পোয়ারোর কৃতিত্ব ছিল সেকথাও তিনি অকপটে স্বীকার করলেন।
দুই বন্ধুর অতীত স্মৃতিচারণ শুনতে শুনতে একটু এগিয়ে আসতেই পোয়ারো আর ইসপেক্টর পরিচয়ের পালাটা চুকিয়ে নিলেন। ইনসপেক্টর জ্যাপের সঙ্গীর পরিচয় পেলাম তিনি সুপারিনটডেন্ট সামারহে।
পোয়ারো তাদের এখানে আসার কারণটা কি বেশ হাল্কাভাবেই জানতে চাইল।
জ্যাপ চোখ টিপে বললেন এই মামলার জন্যই তাদের এখানে আসা। তার মানে মামলাটা খুবই সহজ। পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলল তার কিন্তু তা মনে হয় না।
সামারহে বলল ব্যাপারটাকে কঠিন মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই, মিঃ ইঙ্গলথর্প তো হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছেন।
জ্যাপ পোয়ারোর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর সামারহেকেপ করতে বলে বললেন, যে এসব ব্যাপারে পোয়ারোর চেয়ে আর কেউ ভালো বোঝে না। তিনি পোয়ারোর ধারণা কি জানতে চাইলেন।
পোয়ারোর মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল, জ্যাপ পোয়ারোকে বলতে লাগলেন তারা যা কিছু দেখছেন সবই বাইরে থেকে, কিন্তু পোয়ারো ঘটনাস্থলে থাকার জন্য অনেক সুবিধা পেয়েছেন। জ্যাপ জিজ্ঞাসা করলেন পোয়ারো কিছু সূত্র পেয়েছেন কিনা। আর একথাও স্বীকার করলেন তদন্তের সময় যা শুনেছেন তাতে পোয়ারো ছাড়া অন্য কেউ বললে বিশ্বাসই করতেন না যে মিঃ ইঙ্গলথর্প তার স্ত্রীকে খুন করেছেন। তিনি অবাক হয়েছেন একথা ভেবে যে জুরীরা কেন ওকেই খুনী বলে সাব্যস্ত করল না।
পোয়ারো জানতে চাইলেন তারা গ্রেপ্তারী পরোয়ানা নিয়ে এসেছেন কিনা।
জ্যাপ ঠিকমতো উত্তর দিলেন না, বললেন পোয়ারো যা হোক কিছু ভেবে নিতে পারে। পোয়ারো ব্যাগ্র কণ্ঠে বলে উঠল তার মতে এখন গ্রেপ্তারটা মুলতুবী রাখাই ভালো। সামারহে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন তা সম্ভব নয়।
জ্যাপ জানতে চাইলেন পোয়ারো কেন গ্রেপ্তার মুলতুবী রাখতে চাইছেন। গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে পোয়ারো বলল তারা ইচ্ছে হলে ইঙ্গলথর্পপঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে কিন্তু এতে কোনো লাভ হবে না, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে না।
পোয়ারোর কথা শুনে জ্যাপের মুখ বেশ গম্ভীর হয়ে উঠল। সামারহের মুখে অবিশ্বাসের হাসি ফুটলো। আমি অবাক হয়ে গেলাম।
জ্যাপ রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন যে তারও তো ওপরওয়ালা আছে, তাদের সন্তুষ্ট করাটাই আসল কথা। তাই তিনি ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার ভাবে জানতে চাইছেন।
পোয়ারো মুহূর্ত খানেক চিন্তা করল। তারপর বলল তার এ ব্যাপারে মুখ খোেলার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তবে জ্যাপ যখন জানতে চাইছেন তখন সে চুপ করে থাকে কি করে। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল জ্যাপ এখন স্টাইলসে যাচ্ছেন কিনা।
জ্যাপ জানালেন করোনার ও ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে তারা আধঘণ্টার মধ্যেই স্টাইলসে যাবেন। পোয়ারো বললেন তারা যেন যাবার সময় তাকে গ্রামের শেষ বাড়িটা থেকে ডেকে নেন, সেও তাদের সঙ্গে যেতে ইচ্ছুক।
পোয়ারো বলল স্টাইলসে মিঃ ইঙ্গলথর্প যদি কোনো প্রমাণ দিতে অস্বীকার করে তাহলে সে এমন প্রমাণ দিতে পারবে যে তাতেই তারা বুঝতে পারবেন যে মিঃ ইঙ্গলথর্পের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই টিকবে না।
জাপকে খুশী মনে হল। অতঃপর তারা বিদায় নিয়ে চলে গেল।
এবার আমি ভাবলাম পোয়ারোকে কিছু জিজ্ঞাসা করব, কারণ আমার মনের মধ্যে হাজার খানেক প্রশ্ন জেগেছে।
কিন্তু পোয়ারো নিজেই মুখ খুলল, বলল মিঃ ইঙ্গলথর্পের কাণ্ড দেখে সে অবাক হয়ে গেছে। আমি বললাম সে তো শুধু লোকটার বোকামিই দেখছে। ও সত্যিকার দোষী বলেই চুপ করে আছে কারণ, এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
পোয়ারো বলল অনেক উপায় আছে। যদি সে নিজে কখনও কোনো খুন করত তাহলে ইঙ্গলথর্পের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী তৈরি করত।
পোয়ারোর কথা শুনে আমার খুব হাসি পেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ঐ গোয়েন্দা দুজনকে সে যা বলেছে তা তার মনের কথা কিনা; সে কি সত্যিই ইঙ্গলথর্পকে নির্দোষ বলে ভাবছে। পোয়ারো বলল নির্দোষ না ভাবার তো কোনো কারণ নেই। আমি বললাম যে ইঙ্গলথর্পের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো তো খুবই জোরালো। পোয়ারোও মাথা নেড়ে সায় দিল।
কথা বলতে বলতে আমরা লিস্টওয়েজ কুটিরের সামনে এসে গেলাম। পোয়ারো বলতে লাগল ইঙ্গলথর্পের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো খুব বেশি জোরালো। যতক্ষণ এগুলো অস্পষ্ট ও অকথিত ছিল ততক্ষণ ওগুলো অগ্রাহ্য করা এরকম অসম্ভব ছিল কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল অপরাধী নিজেকে যত গভীর জালে জড়িয়ে ফেলছে ততই সুবিধা হয়ে যাচ্ছে। ইঙ্গলথর্পের মুক্তির জন্য শুধু একটু ছিদ্রপথ প্রয়োজন।
পোয়ারোর মনের মধ্যে যে কি চলছে তা বোঝা আমার সাধ্য নয়। তাই চুপচাপ থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।
মিনিট খানেক পরে পোয়ারো বলতে লাগল ঘটনাটা এইভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যদি কোনো চালাক লোক তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে মারতে চায় তাহলে ষড়যন্ত্রটা সে কিভাবে করতে পারে। একদিন গ্রামের এক ওষুধের দোকান থেকে একটা কুকুরকে মারব বলে স্ট্রিকনিন কিনলো, তারপর সেই রাতে বিষ প্রয়োগ করল না, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার জন্য অপেক্ষা করে রইল, ঝগড়ার কথা বাড়ির সকলেই জানল। লোকটা এতটুকু সাবধান না হয়ে সেদিন রাতেই খুন করল।…কোনো লোক কখনও এত বোকা হতে পারে! কেউ যদি ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করতে চায় তবেই সে একরকম কাজ করবে।
আমি বললাম মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে যদি পোয়ারো নিরপরাধ বলে মনে করে তাহলে সে স্ট্রিকনিন কেন কিনেছিল। পোয়ারো বলল যে ইঙ্গলথর্প মোটেই স্ট্রিকনিন কেনেনি। আমি বললাম মেস যে তাকে সনাক্ত করেছে।
পোয়ারো রহস্য উদঘাটন করল, বলল মেস ইঙ্গলথর্পের পোশাকে ওরই মত দাড়িওয়ালা চশমা পরা একজনকে দেখেছে এবং তাকে হয়ত দূর থেকে দেখেছে। তাছাড়া মেস ঐ দোকানে মাত্র দিন পনেরো কাজ করছে।
আমি বললাম, তাতে কি হয়েছে?
পোয়ারো আমাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল সে যে সূত্রগুলোর কথা বলেছিল সেগুলো আমার মনে আছে কিনা। আমি একটু চিন্তা করলাম। পোয়ারো আমাকে দ্বিতীয় সূত্রটার কথা মনে করতে বলল।
আমার মনে পড়ে গেল, বললাম সে বলেছিল মিঃ ইঙ্গলথর্প অদ্ভুত পোশাক পরে, ওর কালো দাড়ি আর চশমা আছে।
পোয়ারো হঠাৎ বলল কেউ যদি লরেন্স বা জনের ছদ্মবেশ নিতে চায় তাহলে সেটা সহজ হবে কিনা। আমি বললাম যে তা সহজসাধ্য নয় কারণ ওদের দুজনেরই মুখের দাড়িগোঁফ কামানো।
পোয়ারো বলল ঠিক তাই। কিন্তু অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের ক্ষেত্রে ছদ্মবেশ ধরার কোনো অসুবিধা নেই, কারণ ওর পোশাক, দাড়ি আর চশমা তার আসল ব্যক্তিত্ব আর রূপটা আড়াল করে ফেলেছে। তাহলে অপরাধীর মনস্তত্ত্ব বলে তার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হবে নিজের ওপর থেকে সন্দেহ অন্যের ঘাড়ে ফেলা। এই ঘটনায় এরকম একজন লোক তো হাতের কাছেই রয়েছে…সে হল মিঃ ইঙ্গলথর্প। সকলেই ওর অপরাধ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবে এটা জানা কথা। তা সত্ত্বেও অপরাধী একেবারে নিশ্চিত হবার জন্য ইঙ্গলথর্পের ছদ্মবেশে স্ট্রিকনিন কিনল।
পোয়ারো বলল আসলে মেস কোনোদিন আসল ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে কথা বলেনি, তাই ঐ দাড়ি আর চশমার আড়ালে তার পক্ষে ঐ লোকটা যে ছদ্মবেশী তা বোঝা সম্ভব ছিল না।
আমি পোয়ারোর যুক্তি খণ্ডন করতে পারলাম না। তবুও বললাম যদি তাই হয়, তাহলে ইঙ্গলথর্প ছটার সময় কোথায় ছিলেন বলতে চাইছেন না কেন।
পোয়ারো বেশ শান্তভাবে বলল সেটা একটা কথা বটে। তবে সেটা নিয়ে সে ভাবছে না। পোয়ারো বলল লোকটার মৌনতার পেছনে অদ্ভুত কিছু কারণ নিশ্চয়ই আছে। নিজের স্ত্রীকে খুন না করলেও লোকটা যে মহা ধুরন্ধর তাতে সন্দেহ নেই। তার গোপন করার মত একটা কিছু যে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমি জানতে চাইলাম, সেটা কি? পোয়ারো প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল। আমাকে জিজ্ঞাসা করল ইঙ্গলথর্পপকে বাদ দিয়ে তদন্তের ব্যাপারটা আমার কেমন মনে হচ্ছে। অদ্ভুত কিছু আমার চোখে পড়েছে কিনা।
আমার মনে হল মেরী ক্যাভেণ্ডিসের কথা। তবু জিজ্ঞাসা করলাম কি বিষয়ের কথা পোয়ারো বলছে।
পোয়ারো বলল লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের সাক্ষ্যের কথা বলছে সে। আমি বললাম যে সেরকম কিছু তো আমি লক্ষ্য করিনি। তবে বরাবরই একটু দুর্বল চরিত্রের।
পোয়ারো বলল তদন্তের সময় লরেন্স বলেছিল তার মা ভুল করে স্ট্রিকনিন মেশানো টনিক খেয়ে মারা যেতে পারেন। আমি বললাম ডাক্তারও তো লরেন্সের কথাটা হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। যে কোনো সাধারণ লোকই এরকম ধারণা করতে পারে।
পোয়ারো আমাকে বলল লরেন্স ক্যাভেণ্ডিস তো সাধারণ অজ্ঞ লোক নন। সে আমাকে মনে করিয়ে দিল যে আমিই তাকে একদিন বলেছিলাম যে লরেন্স ডাক্তারী পাশ করেছেন।
আমি চমকে উঠলাম। বললাম ব্যাপারটা সত্যিই চিন্তা করার মত।
পোয়ারো মাথা নাড়ল, বলল শুরু থেকেই লরেন্সের হাবভাব একটু অদ্ভুত ধরনের। বাড়ির লোকজনের মধ্যে স্ট্রিকনিনের মৃত্যুটা স্বাভাবিকভাবে হয়েছে বলতে চাইছেন। এই কথাটা জন বললে একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যেত, কিন্তু লরেন্স ডাক্তারী পাশ করে একথা কেন বলতে চাইছেন তা চিন্তার বিষয়।
আমি বললাম সত্যিই পুরো ব্যাপারটাই গোলমেলে লাগছে।
পোয়ারো বলল, এছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। মেরী ক্যাভেণ্ডিস অনেক কিছুই বলেননি, চেপে গেছেন।
আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না। পোয়ারো জানাল সে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে মেরী ক্যাভেণ্ডিস মিঃ ও মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঝগড়ার কথাবার্তা অনেকটাই শুনেছিলেন, তা তিনি স্বীকার করুন বা না করুন।
আমি বললাম যে ওর মত মহিলার পক্ষে আড়ি পাতাটা আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।
পোয়ারো বলল এইখানেই রহস্যটা দানা বেঁধেছে। তবে সাক্ষ্য থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ডরকাসের কথাই ঠিক, ঝগড়াটা বিকেলের আগে মানে প্রায় চারটের কাছাকাছি হয়েছিল।
পোয়ারোর দিকে আড়চোখে তাকালাম। এই একটা ব্যাপারে ও যে কেন এত চিন্তা করছে বুঝে উঠতে পারলাম না।
পোয়ারো বলল তার কাছে আরো একটা ব্যাপার আশ্চর্যজনক বলে মনে হচ্ছে। উনি অত সকালবেলায় কেতাদুরস্ত হয়ে কি করছিলেন। এই বিষয়ে কেউ যে কেন কোনো প্রশ্ন করেনি সেটাও চিন্তার বিষয়।
আমি হাল্কা সুরে বললাম ভদ্রলোকের হয়ত বা অনিদ্রা রোগ আছে। পোয়ারো হেসে বলল ব্যাখ্যাটা আমি বেশ ভালোই দিয়েছি। যাই হোক সে বলল এবার থেকে ওর ওপর নজর রাখতে হবে।
এবার আমি জানতে চাইলাম পোয়ারো আর কারো সাক্ষ্যে গলদ পেয়েছে কিনা। পোয়ারো বলল তার মতে তদন্তের সময় বেশি হলে একজন বা দুজন সত্যি কথা বলেছে।
আমি বললাম, আমার তো মনে হয় মেরী বা লরেন্সকে বাদ দিলে জন আর মিস হাওয়ার্ডের সাক্ষ্য নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। ওরা দুজনে নিশ্চয়ই সত্যি কথা বলেছে।
পোয়ারো বলল ওদের দুজনের মধ্যে একজন সত্যি কথা বলেছে, দুজন কখনই বলেনি।
পোয়ারোর কথাটা ভাবতে লাগলাম। মিস হাওয়ার্ডের সাক্ষ্যের কথা মনশ্চক্ষে দেখতে পেলাম। ওর সাক্ষ্যে নতুনত্ব কিছু ছিল না। সেজন্য আমি একবারের জন্যও ভাবিনি যে মিস হাওয়ার্ডের সাক্ষ্যে কোনো মিথ্যার ছোঁয়া আছে, অথচ পোয়ারোর মতামতের ওপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে।
আমি পোয়ারোকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কি ভাবছে যে মিস হাওয়ার্ড সত্যি কথা বলেননি। আমার তো তাকে বেশ সরল বলেই মনে হয়েছে।
পোয়ারো অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল–যেন কিছু একটা বলতে চাইল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কিছুই বলল না।
আমি একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললাম মিস সিনথিয়া মারডককেও তো অবিশ্বাসের কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না।
পোয়ারো বলল এটা ভাববার বিষয় যে পাশের ঘরে থাকা সত্ত্বেও সে কোনো শব্দ শোনেনি অথচ মেরী ক্যাভেণ্ডিস বাড়ির অন্য প্রান্তে থেকেও টেবিলটা পড়ার আওয়াজ শুনেছিলেন।
আমি বললাম হয়ত সিনথিয়ার ঘুমটা একটু গাঢ়।
এই সময় নিচে দরজায় ধাক্কা শুনে বুঝতে পারলাম স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা দুজন এসে গেছেন।
পোয়ারো তাড়াতাড়ি টুপিটা হাতে নিয়ে আমাকে তার সাথে নিচে যেতে ইশারা করল। সকলে একসাথে স্টাইলসে রওনা হলাম।
স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা দুজনকে দেখে সকলেই যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, বিশেষ করে জন। যদিও সবাই জানতে এই ধরনের ব্যাপার হবেই, তবু এটা এত তাড়াতাড়ি যে হবে তা বোধহয় কেউ বুঝতে পারেনি।
দেখলাম পোয়ারো জ্যাপের সঙ্গে নিচু গলায় কিছু আলোচনা করছে। ইনসপেক্টর জ্যাপ বাড়ির সকলকে বসবার ঘরে জমায়েত হতে অনুরোধ জানালেন।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই বসবার ঘরে এসে দাঁড়ালেন। ইনসপেক্টর জ্যাপ দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। পোয়ারো সবাইকে চেয়ার এগিয়ে দিল। সকলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। আমার মনে হল এই প্রথম আমরা কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন হয়েছি।
সরকারী গোয়েন্দার পরিবর্তে পোয়ারো কথা শুরু করায় সকলে মনে হল একটু আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
বেশ নাটকীয় ঢঙে বক্তৃতা দেবার কায়দায় পোয়ারো বলতে শুরু করল যে একটা বিশেষ কারণে বাড়ির সকলকে এখানে জমায়েত হতে বলা হয়েছে, সেই কারণটা মিঃ অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে জড়িত।
ঘরের একপাশে ইঙ্গলথর্প বসেছিলেন। অন্যান্যরা হয়ত অজান্তেই তার চেয়ে একটু দূরে বসেছিলেন। পোয়ারো ইঙ্গলথর্পের নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথেই মনে হল উনি যেন একটু চমকে উঠলেন।
পোয়ারো মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে উদ্দেশ করে বলল এই বাড়ির ওপর একটা কালো ছায়া নেমে এসেছে। ইঙ্গলথর্প মাথা নাড়লেন, পোয়ারো বলতে লাগলেন যে ইঙ্গলথর্প মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন।
পোয়ারো প্রশ্ন করল ইঙ্গলথর্প ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন কিনা। ইঙ্গলথর্প জানতে চাইলেন পোয়ারো কি বলতে চাইছে।
পোয়ারো বলল সে বলতে চাইছে ইঙ্গলথর্প তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়েছেন। পোয়ারোর দৃঢ় কণ্ঠের এই উক্তি শুনে ইঙ্গলথর্প চিৎকার করে উঠলেন, বললেন তিনি এই মিথ্যা অপবাদ সহ্য করতে পারছেন না, তিনি বলতে লাগলেন কেন তিনি শুধু শুধু এমিলিকে বিষ খাওয়াতে যাবেন।
পোয়ারো বলল ইঙ্গলথর্প যদি নিজের ভালো চান তাহলে তিনি যাতে বলেন গত সোমবার সন্ধ্যা ছটার সময় কোথায় ছিলেন।
পোয়ারোর প্রশ্ন শুনে ইঙ্গলথর্প দুহাতে মুখ ঢাকলেন, তার মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রণা ফুটে বেরোলো।
পোয়ারো ইঙ্গলথর্পের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তীব্র কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
ইঙ্গলথর্প পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।
পোয়ারো বলল তাহলে মিঃ ইসলথর্প বলবেন না। ইঙ্গলথর্প বললেন যে তিনি ভাবতে পারছেন না কোনো মানুষ এভাবে অপবাদ দিতে পারে।
পোয়ারো বলল যে তাহলে সেই ইঙ্গলথর্পের হয়ে যা বলার বলবে। ইঙ্গলথর্প চমকে উঠল, প্রশ্ন করল, পোয়ারো এই ব্যাপারে কি জানেন।
পোয়ারো আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, সে নিশ্চিতভাবে বলছে যে, গত সোমবার সন্ধ্যা ছটার সময় ওষুধের দোকানে যিনি স্ট্রিকনিন কিনতে ঢুকেছিলেন, তিনি অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প নন, কারণ সেদিন ঐ সময়ে মিঃ ইঙ্গলথর্প মিসেস রেইকস্ নামে এক মহিলাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেছিলেন। এই ব্যাপারে অন্তত পাঁচজন সাক্ষী সে হাজির করতে পারে বলে দাবী করল।
এবার পোয়ারো বলল যে সকলেই নিশ্চয়ই জানেন মিসেস রেইকসের বাড়ি অ্যাবী খামারে যা গ্রাম থেকে প্রায় আড়াই মাইল দূরে।
এই কথাটাই আসলে মিঃ ইঙ্গলথর্প বলতে চাইছিলেন না, আর এর ফলস্বরূপ সবাই ধরে নিয়েছিল ইঙ্গলথর্প মিথ্যা কথা বলছেন যে তিনি স্ট্রিকনিন কিনতে দোকানে যাননি।