০৭. টিশা গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসে

দ্বিতীয়পর্ব

০৭.

টিশা গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসে চিৎকার করে বলল, “কানেকশন দাও।”

আমি গাড়ির নিচে শুয়ে ইঞ্জিন থেকে বের করে আনা দুটি তার ধরে রেখেছিলাম। ইনসিলুটেড তারের শেষ মাথা ঘষে তার ধাতব অংশ বের করে রাখা আছে, টিশা তার বই পড়ে পড়ে বের করেছে এই দুটি তার ইঞ্জিন স্টার্ট করার মুহূর্তে স্পর্শ করলে মোটর চালু করার প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাবে। আমি এতটা নিশ্চিত নই, তারপরেও টিশার উৎসাহের কারণে পরীক্ষাটা করতে রাজি হয়েছি। সত্যি সত্যি গাড়িটা চালু হয়ে যেন সেটা আমার উপর দিয়ে চলে না যায় সেজন্য চাকাগুলোর মাঝখানে শুয়েছি। টিশা যখন কানেকশন দিতে বলবে তখন কানেকশন দিতে হবে।

আমি গাড়ির নিচে শুয়ে চিৎকার করে বললাম, “দিব কানেকশন?”

“হ্যাঁ দাও।”

আমি দুটো তার ছোঁয়ানো মাত্রই একটা ভয়ংকর স্পার্ক হলো এবং পুরো গাড়িটা মনে হয় জীবন্ত প্রাণীর মতো লাফিয়ে উঠে আমার উপর দিয়ে ছুটে বের হয়ে সামনে একটা বিল্ডিংয়ে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে ভয় পাওয়া গলায় বললাম, “এটা কী হলো? টিশা? তুমি ঠিক আছ?”

আমি টিশার হাসির শব্দ শুনতে পেলাম, হঠাৎ করে একটা গাড়ি চালু হয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছুটে গিয়ে যদি কোনো কিছুতে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায় তাহলে তার ভেতরে কোন বিষয়টা হাসির আমি বুঝতে পারলাম না। টিশা গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগল। আমি একটুখানি আতঙ্কিত এবং অনেকখানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কী হলো, তুমি হাসছ কেন?”

“তুমি যদি তোমাকে দেখতে তাহলে তুমিও হাসতে! মাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছ, চোখ-মুখে একসাথে ভয়, অবিশ্বাস আর বিস্ময়!”

আমিও হাসলাম, বললাম, “তোমাকে বোঝা খুব মুশকিল টিশা।”

টিশা হঠাৎ করে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, “অন্যদের জন্যে সেটা সত্যি হতে পারে রিহি-তোমার জন্য না! তুমি আমাকে বুঝতে পেরেছ বলে আমি এখনো বেঁচে আছি। টিশা মাইনাস একটা আঙুল, কিন্তু পুরোপুরি আমি। তুমি যদি এসে আমাকে না বাঁচাতে তাহলে এত দিনে আমার হাড়গোড়ও বনের পশুরা চিবিয়ে খেয়ে ফেলত।”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “বনের পশুকে বেশি গালিগালাজ করো না–ওদের জন্য আমরা এখনো টিকে আছি!”

টিশা মাথা নাড়ল এবং হঠাৎ করে আমরা দুজনেই চুপ করে গেলাম। মরুভূমির পাথরের আড়ালে মৃতপ্রায় টিশাকে উদ্ধার করে শেষ পর্যন্ত এই নির্জন পরিত্যক্ত শহরটাতে মোটামুটি নিরাপদ আশ্রয়টা খুঁজে পেতে আমাদের কম কষ্ট করতে হয়নি।

.

আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে টিশাকে খুঁজে বের করে তাকে একটু সুস্থ করে তুলতে তুলতে আমার পানির পুরো ভান্ডার প্রায় শেষ হয়ে গেল। এক রাতে দুজন যখন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে রেখে রাতের মরুভূমির তীব্র শীত থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টা করছি। তখন হঠাৎ করে আমাদের সামনে একটা বুনো প্রাণী এসে দাঁড়াল, অন্ধকারে তার পুরো আকারটা বোঝা যায় না, শুধু চোখ দুটো জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলছে। টিশা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল “প্রাণীটা আমাদের দেখে যাচ্ছে, আমরা মরে গেলে আমাদের ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে।”

আমি কোনো কিছু না ভেবেই বললাম, “এত সোজা নয়! আমাদের খাবার শেষ হয়ে গেলে আমরাই বরং এটাকে ধরে খাব।”

টিশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এই প্রাণীটাকে খাবে?”

“সমস্যা কী? আগে কি মানুষ পশুপাখি ধরে কেটেকুটে রান্না করে খেত না? সব সময়েই কি এরকম শুকনো খাবার ছিল?”

টিশা কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তখন সেই প্রাণীটা আরো একটু সামনে এগিয়ে এল, আস্তে আস্তে সেটার সাহস বেড়ে যাচ্ছে। টিশা হাত নেড়ে সেটাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল, প্রাণীটা এক পা পিছিয়ে গেল কিন্তু সরে গেল না। অন্ধকারে তার জ্বলন্ত চোখ নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। টিশা বলল, “এটাকে সরিয়ে দাও, আমার ভালো লাগছে না।”

আমি বললাম, “দিচ্ছি।” তারপর শহরের সেন্ট্রির কাছ থেকে কেড়ে আনা অস্ত্রটা হাতে নিয়ে কীভাবে সেটা ব্যবহার করতে হয় বোঝার চেষ্টা করলাম। উপরে একটা ডায়াল, সেটার পাশে কোন মাত্রার বিস্ফোরক ব্যবহার করতে হবে সেটি লেখা। নির্বোধ প্রাণীটাকে বিস্ফোরক দিয়ে হত্যা করার কোনো ইচ্ছে নেই, শুধু ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দিতে চাইছি। ডায়ালটার শেষে ছোট করে লেখা ট্রাংকিউলাইজার-যার অর্থ এটাকে প্রাণে মারবে না কিন্তু অচেতন করে ফেলবে। পরীক্ষা করার জন্য এই সেটিংটা খারাপ না। আমি ডায়ালটা ট্রাংকিউলাইজারে টেনে এনে প্রাণীটার দিকে অস্ত্রটা তাক করে ট্রিগারটা টেনে ধরলাম, ধুপ করে একটা চাপা শব্দ হলো আর প্রাণীটা কেমন যেন লাফিয়ে উঠে ছোট একটা যন্ত্রণার শব্দ করল। তারপর ঘুরে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করল কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না, কয়েক পা গিয়েই পা ভেঙে পড়ে গেল।

.

আমি টিশার দিকে তাকিয়ে বললাম, “এই দেখো প্রাণীটাকে অচেতন করে রেখেছি। আমাদের খাবারের অভাব হলে এটা খেতে পারি।”

টিশা বলল, “আমি প্রাণীটাকে দেখতে চাই।”

আমি আলো জ্বালিয়ে প্রাণীটার কাছে গেলাম, কুকুরের মতো দেখতে একটা প্রাণী। ঘাড়ের কাছে বড় বড় লোম, অচেতন হওয়ার পরও চোখ দুটো খোলা, মুখে ধারালো দাঁত।

টিশা বলল, “প্রাণীটা যথেষ্ট তাজা। এটা নিয়মিত খেতে পায়।”

ঠিক তখন আমার মাথায় একটা চিন্তা খেলা করে গেল। আমি উত্তেজিত গলায় বললাম, “টিশা।”

“কী হয়েছে?”

“বেঁচে থাকার জন্য এই প্রাণীটাকে পানি খেতে হয় না?”

“হ্যাঁ হয়।”

“তার মানে মাঝে মাঝেই এই প্রাণীটা কোথাও না কোথাও পানি খেতে যায়।”

টিশা এক ধরনের উত্তেজনা নিয়ে আমার দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না, তারপর বলল, “যদি আমরা এটার পিছু পিছু যাই তাহলে সেটা কোথায় পানি খেতে যায় খুঁজে বের করতে পারব?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ।”

“আমাদের কাছে যদি ট্রাকিওশান থাকত তাহলে আমরা এটার শরীরে লাগিয়ে দিতাম। কোথায় যায় বের করতে পারতাম!”

আমি বললাম, “আমাদের কাছে ট্রাকিওশান আছে।”

টিশা অবাক হয়ে বলল, “ট্রাকিওশান আছে?”

“হ্যাঁ, একটু প্রাচীন। তোমার পছন্দ হবে কি না জানি না!” বলে আমি আমার ব্যাগ থেকে সুপার পলিমারের একটা দড়ি বের করে টিশার হাতে দিয়ে বললাম, “এটা হবে আমাদের ট্রাকিওশান! প্রাণীটার গলায় দড়ি বেঁধে রাখব, দড়ির অন্য মাথা ধরে আমরা এটার পিছু পিছু যাব!”

আমি কী বলছি বুঝতে টিশার এক মুহূর্ত সময় লাগল। যখন বুঝতে পারল তখন সারা শরীর দুলিয়ে সে হি হি করে হাসতে লাগল। এই মেয়েটা যখন হাসে তখন আমার বুকের ভেতর কী যেন ওলটপালট হয়ে যায়–কোনো দিন সেটা টিশাকে বলতে পারব বলে মনে হয় না।

সকালবেলার দিকে কুকুরের মতো দেখতে প্রাণীটা জেগে উঠে নড়াচড়া শুরু করল। আমরা সেটাকে একটা বড় পাথরের সাথে বেঁধে রেখেছি। ইচ্ছে করে সেটাকে ভোলা জায়গায় রেখেছি–ভয়ংকর রোদে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠবে, তাই যখন ছেড়ে দেব তখন নিশ্চয়ই প্রথমে পানি খেতে যাবে! গলার দড়ি ধরে তখন আমরা পিছু পিছু যাব!

আমি আর টিশা পাথরের ছায়ায় বসে অপেক্ষা করতে থাকি। মরুভূমির প্রচণ্ড রোদে চারিদিক ধিকিধিকি করে জ্বলছে, প্রাণীটা দীর্ঘ সময় নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেছে, না পেরে শেষ পর্যন্ত বালুতে মুখ ডুবিয়ে নির্জীবের মতো বসে আছে। প্রাণীটাকে দেখে আমাদের মায়া হচ্ছিল কিন্তু কিছু করার নেই। রোদ কমে না আসা পর্যন্ত আমরা এই প্রাণীটাকে ছেড়ে দিতে পারব না।

সূর্য ঢলে যাবার পর আমরা পাথর থেকে দড়ির বাঁধন খুলে প্রাণীটাকে যেতে দিলাম। সেটা ধুকে ধুকে এগোতে লাগল। আমি আর টিশা দড়ির অন্য মাথা ধরে সেটার পিছু পিছু যেতে থাকলাম। আমাদের ধারণা ভুল নয়। প্রাণীটা সত্যি সত্যি শুকনো বালু, পাথরের স্থূপ পার হয়ে দীর্ঘ সময় হেঁটে হেঁটে গাছপালা ঢাকা একটা জায়গায় এসে হাজির হলো। বড় একটা পাথরের ফাঁক দিয়ে সেখানে ঝিরঝির করে পানি পড়ছে, পৃথিবীতে এর থেকে সুন্দর কোনো দৃশ্য আছে বলে আমার জানা নেই।

আমরা প্রাণীটিকে প্রাণ ভরে পানি খেতে দিলাম। তারপর তার গলার বাঁধন কেটে সেটিকে ছেড়ে দিলাম। প্রাণীটি পাথরের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে গাছপালার ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি আর টিশা তখন ছোট জলাশয়ের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। গত কয়েক দিন হিসাব করে প্রত্যেক ফোঁটা পানি খেয়েছি, এখন শুধু যে যত ইচ্ছে পানি খেতে পারব তা নয়, ইচ্ছে করলে টলটলে পানিতে সারা শরীর ডুবিয়ে শুয়ে থাকতে পারব।

পানির এই ছোট ঝরনাটা পেয়ে যাবার পর আমাদের বেঁচে থাকার আর কোনো সমস্যা থাকল না। শুধু আমি আর টিশা যে পানির জন্য এখানে এসেছি তা নয়, এই এলাকায় সব পশুপাখি এখানে পানি খেতে আসে। এত দিন আমরা মানুষের জন্য তৈরি করা বিশেষ ধরনের খাবার ছাড়া আর কিছু খাইনি, কিন্তু এখন ইচ্ছে করলে আমরা পশুপাখি ধরে আগুনে ঝলসে খেতে পারব–একসময় তো মানুষ এভাবেই বেঁচে ছিল, আমরা কেন পারব না?

পানির এই ঝরনায় যেহেতু সব রকম জন্তু-জানোয়ার আসে, তার মাঝে সত্যিকারের হিংস্র পশুও থাকতে পারে, তাই আমরা এর কাছাকাছি না থেকে একটু দূরে একটা বড় পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিলাম। বিকেলের দিকে সূর্যের তেজ কমে এলে আমরা মোটর বাইকে করে আশেপাশের এলাকায় পরিত্যক্ত একটা শহর খুঁজে বেড়াতাম। খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত একটা শহর খুঁজে পেয়েছি। এক সময় নিশ্চয়ই অনেক মানুষ থাকত। একটা শহরের মানুষের থাকার জন্য যা যা থাকা দরকার তার সবই আছে। বেশির ভাগ ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে গেছে, কিন্তু কিছু কিছু বাসা একেবারে পুরোপুরি অক্ষত। দেখে মনে হয় বুঝি বাসার মানুষগুলো বাইরে গেছে, এক্ষুনি ফিরে আসবে।

এই শহরে যে জিনিসটা পেয়ে টিশার আনন্দের সীমা থাকল না সেটি হচ্ছে বিশাল একটা লাইব্রেরি। ভেতরে সারি সারি ভিডি টিউব সাজানো। শেলফে ছোট ছোট ক্রিস্টালে অসংখ্য বই। টিশা লোভাতুরের মতো সেই বইগুলোতে চোখ বুলাতে থাকে।

একদিন একটা বই দেখে টিশা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কী?”

“মানুষের মস্তিষ্কের উপর একটা বই।”

মানুষের মস্তিষ্কের উপর একটা বই দেখে এত আনন্দিত হবার কী আছে, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, টিশার অনেক কিছুই আমি বুঝতে পারি না! টিশা তখন তখনই ভিডি টিউবে ঢুকিয়ে দিয়ে বইটা পড়তে শুরু করে। আমি ভেবেছিলাম তাকে নিয়ে বের হব, কাছাকাছি আরো একটা পানির ঝরনা পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে-সেই জায়গাটা একটু দেখে আসব। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে আপাতত সেই পরিকল্পনা বন্ধ রাখতে হবে।

টিশা কিছুক্ষণ বই পড়ে হঠাৎ করে আমার দিকে তাকাল, বলল, “রিহি তুমি বই পড় না কেন?”

“বই। আমি? বই?”

“হ্যাঁ।”

আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “আমার তো তোমার মতো বই পড়ার অভ্যাস হয়নি।”

“তার মানে তুমি কিছু জান না।”

“জানি। একটা তিতির পাখি কেমন করে ঝলসে খাওয়া যায় জানি। যব দিয়ে কীভাবে রুটি তৈরি করা যায় জানি। মাথার চুল লম্বা হয়ে গেলে কীভাবে কাটতে হয় জানি”

টিশা প্রায় ধমক দিয়ে বলল, “ঠাট্টা কোরো না। আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি। তুমি ভেবেছিলে যোলো বছর বয়স হলে তোমার মাথায় ক্রেনিয়াল লাগাবে, তখন তুমি সবকিছু শিখে নেবে–কিন্তু তুমি আর কোনো দিন শহরে ফিরে যেতে পারবে না। যদি যাও তাহলে তোমার মাথায় মোটেও ক্রেনিয়াল লাগাবে না–তোমাকে ডিটিউন করে দেবে!”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “জানি।”

“তাহলে?”

“তাহলে কী?”

“তাহলে তুমি কেন বই পড়া শুরু কর না? তুমি কেন শিখতে শুরু কর না?”

আমি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, “পৃথিবীতে এত কিছু শেখার আছে, আমি কোথা থেকে শুরু করব?”

টিশার মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আমাদের নতুন আবিষ্কার করা লাইব্রেরিটা দেখিয়ে বলল, “এখানে খুব মজার কিছু বইয়ের ক্রিস্টাল আছে।”

“কীরকম মজার?”

“প্রাচীনকালে ছেলেমেয়েরা মাথায় ক্রেনিয়াল লাগিয়ে শিখত না। তারা নতুন কিছু শেখার জন্য স্কুলে যেত। কলেজে যেত। সেখানে শিক্ষকেরা তাদের বই থেকে শেখাত। কোন বয়সে কী শিখতে হবে সেগুলো ঠিক করে রাখা ছিল। সেই বইগুলো এই লাইব্রেরিতে আছে, তুমি সেই বইগুলো দিয়ে শুরু করতে পার।”

আমার আসলে টিশার মতো বই পড়ে পড়ে নতুন কিছু শেখার কোনো আগ্রহ নেই। শহরে যখন ছিলাম তখন জীবনটা ছিল খুবই বাঁধাধরা আনন্দহীন ছোট একটা জীবন। টিশার সাথে যাযাবর হয়ে যাবার পর এখন জীবনটা হয়েছে অনেক চমকপ্রদ। শহর থেকে বের হয়ে এই যাযাবর হয়ে যাবার আগে আমি জানতাম না একটা পাখির ডাক শুনেই বোঝা যায় পাখিটা সঙ্গী খুঁজছে। আমি জানতাম না হিংস্র পশু আসলে মোটেও হিংস্র নয়-যখন তাদের খিদে পায় শুধু তখন তারা অন্য কোনো প্রাণীকে হত্যা করে খায়। বই না পড়েই আমি এগুলো শিখেছি কিন্তু টিশার ধারণা এই জিনিস শিখে লাভ নেই! জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখতে হবে, গণিতের জটিল সমীকরণের সমাধান করা শিখতে হবে, তা না হলে একজন মানুষ নাকি মূর্খ থেকে যায়। আমার মূর্খ হয়ে থাকতে কোনো আপত্তি নেই কিন্তু টিশাকে সেটা বোঝাতে পারি না!

শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি টিশা আমাকে দিয়ে বই পড়াতে শুরু করল। প্রথম প্রথম কিছু একটা পড়ে সেটা বুঝতে আমার একটু সমস্যাই হতো কিন্তু আস্তে আস্তে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। গণিতের সমীকরণ সমাধান করতে শুরু করলাম। অণুপরমাণুর গঠন শিখে গেলাম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য জানতে শুরু করলাম। প্রাণিজগতের জিনেটিক কোড জেনে গেলাম, গাড়ির ইঞ্জিন কেমন করে কাজ করে জেনে গেলাম। মস্তিষ্কে ক্রেনিয়াল না লাগিয়েই যে সবকিছু জেনে যাওয়া যায় আমি সেটা বিশ্বাস করে যখন সত্যি সত্যি অনেক আগ্রহ নিয়ে রীতিমতো টিশার সাথে প্রতিযোগিতা করে লেখাপড়া শুরু করেছি, ঠিক তখন কয়েক ঘন্টায় আমাদের সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল।

আমরা একটা দস্যুদলের হাতে বন্দি হয়ে গেলাম।