জোজো আরাম করে বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ে যাচ্ছে, কত বেলা হল তার হুঁশই নেই।
পাশের একটা ছোট টুলে রাখা আছে পেঁয়াজ-লঙ্কা দিয়ে মাখা একবাটি মুড়ি, মাঝে মাঝে সেই মুড়ি খাচ্ছে মুঠো করে।
বইটা শেষ হয়নি, কিন্তু মুড়ি শেষ হওয়ার পর তার খেয়াল হল, অনেকক্ষণ সন্তুর সাড়াশব্দ নেই। সন্তু কোথায় গেল?
বিছানা থেকে নেমে পড়ল সে।
পাশের ঘরে গিয়ে দেখল, সন্তু খুব কাজে ব্যস্ত।
সারা ঘরে পুরনো খবরের কাগজ ছড়ানো। একটা কাঁচি নিয়ে সন্তু সেই খবরের কাগজ কাটছে।
জোজো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী করছিস রে সন্তু?
সন্তু বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল, দুম পট পট পটাস! জোজো তার পাশে বসে পড়ে বলল, কাগজ কাটছিস কেন?
সন্তু এবার গম্ভীরভাবে বলল, টাকা বানাচ্ছি! আজ সন্ধের মধ্যেই পাঁচ লাখ টাকা চাই!
পাশে তিনখানা একশো টাকার নোট। সন্তু খবরের কাগজ কাটছে সেই নোটের সাইজে।
জোজো বলল, এই খবরের কাগজের টাকা দিয়ে তুই ছেলেচোরদের ঠকাবি? এত সহজ নাকি?
সন্তু বলল, সহজ নয় ঠিকই। খুব কঠিন। সেই কঠিন কাজটাই চেষ্টা করতে হবে। শঙ্খচূড় আবার চিঠি দিয়েছে, টাকাটা আজই রাতে নিয়ে যেতে হবে নৌকোয় করে। কোনও পুলিশের লোক থাকলে সুকোমলকে আর জ্যান্ত ফেরত পাওয়া যাবে না। তাই পুলিশের লোকের বদলে আমি যাব টাকা নিয়ে। সুকোমলের বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে।
জোজো বলল, কিন্তু এই খবরের কাগজের টাকা ওরা বুঝি ব্যাগ খুলে দেখবে না?
সন্তু বলল, তা দেখবে নিশ্চয়ই। প্রথম তিনটে বান্ডিলের ওপর এই সত্যিকারের একশো টাকার নোট থাকবে একটা করে। ছোটমামার কাছ থেকে তিনশো টাকা চেয়ে নিয়েছি। এই দেখে যদি ওরা সন্তুষ্ট থাকে তো ভাল কথা।
জোজো বলল, আর যদি সব বান্ডিল দেখে?
সন্তু বলল, তখন অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
জোজো জিজ্ঞেস করল, অন্য ব্যবস্থা মানে?
সন্তু বলল, সে তখন দেখা যাবে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
জোজো বন্ধুর মুখের দিকে একটুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আড়ষ্ট গলায় বলল, সন্তু, তুই এই নকল টাকা নিয়ে একা যাবি?
সন্তু বলল, তুই তো যেতে পারবি না। তুই সাঁতার জানিস না। নৌকোটা যদি উলটেফুলটে যায়।
জোজো বলল, কাকাবাবু ফিরলেন না—
সন্তু বলল, কাকাবাবু ফেরেননি, কোনও খবর পাঠাননি। নিশ্চয়ই কোনও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এখন আমাদের বুদ্ধিমতন কাজ করা উচিত।
জোজো বলল, পাঁচ লাখ টাকা তৈরি হয়নি? তার মানে কত টুকরো জানিস?
সন্তু বলল, জানব না কেন? পাঁচ লাখ মানে পাঁচ হাজার একশো টাকার নোট!
জোজো বলল, এরকমভাবে কাঁচি দিয়ে কাটলে সারাদিনেও পাঁচ হাজার হবে।
সন্তু বলল, তুইও একটা কাঁচি জোগাড় করে আন। হাত লাগা।
জোজো বলল, আমি একসঙ্গে দশখানা নোট বানাবার টেকনিক শিখিয়ে দিচ্ছি তোকে
প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে দুজনে দর্জির মতন কাঁচি চালাতে লাগল কচাকচ শব্দে।
তারপর পরোটা আর বেগুনভাজা খাওয়ার বিরতি।
ছোটমামা এসে বললেন, গগন এসেছে। রাজাদার খোঁজ করছে। বললাম, রাজাদা নেই, তোদের সঙ্গে কথা বলতে চায়।
সন্তু আর জোজো বারান্দায় বেরিয়ে এল।
গগন সাহা খাকি প্যান্ট আর হলুদ রঙের শার্ট পরে আছে, হাতে একটা গোল করে পাকানো খবরের কাগজ। চেয়ারে বসেনি, দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে, মুখে একটা ছটফটে ভাব।
ওদের দেখে বলল, কী হে, কেমন আছ তোমরা? তোমাদের কাকাবাবু কলকাতায় গেছেন শুনলাম। আজ ফিরে আসবেন?
সন্তু বলল, ঠিক বলতে পারছি না।
তোমাদের থিয়েটার আর হচ্ছে না তা হলে?
সুকোমলকে পাওয়া গেলে এখনও হতে পারে।
আমার ছেলে বিল্ট তো খুব মুষড়ে পড়েছে।
ওকে বলবেন, একা-একাই পার্ট মুখস্থ করতে।
সে আর বলতে হবে না। সর্বক্ষণই তো সুগ্রীব সেজে বিড়বিড় করছে। পড়াশোনায় মন নেই।
তারপর সে ছোটমামার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, চাঁদুদা, নিখিল মাহাতোর ছেলের কোনও খোঁজ পাওয়া গেল?
ছোটমামা বললেন, নাঃ! টাকা চেয়ে আর-একটা চিঠি এসেছে।
গগন বলল, নিখিল মাহাতো টাকা দেবে না ঠিক করেছে। খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার।
ছোটমামা বললেন, টাকা জোগাড় করার একটা চেষ্টা হচ্ছে শুনেছি।
গগন বলল, তা হলে তো খুব ভাল কথা। সে যাই হোক, আমার বউ আজ রাত্তিরে আপনাদের সবাইকে আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছে। সেদিন তো আপনারা গিয়ে এক কাপ চাও খেলেন না। রাজা রায়চৌধুরী বিখ্যাত মানুষ। তিনি নিজে থেকে আমাদের বাড়িতে এলেন, কোনও খাতির-যত্ন করা হল না। আমার ভেড়ি থেকে বড় বড় চিংড়ি আনিয়েছি, আজ আপনারা সবাই খেতে যাবেন আমাদের বাড়িতে।
ছোটমামা বললেন, রাজাদা ফিরবেন কিনা তার তো ঠিক নেই। তুমি তো তাঁর জন্যই ব্যবস্থা করছ!
গগন বলল, ফিরবেন নিশ্চয়ই। এই ছেলেরা এখানে রয়ে গেছে। তা হলে আসবেন কিন্তু। আমার বউ সকাল থেকেই রান্না করতে লেগে গেছে।
সিঁড়ি দিয়ে একধাপ নেমে সে আবার বলল, এখানকার পুলিশরা একেবারে অপদার্থ। আমার মোটরসাইকেলটা চুরি গেছে, এখনও উদ্ধার করতে পারল না!
বাগানের বাইরে একটা সাইকেল রিকশা দাঁড় করানো ছিল। গগন উঠে গেল তাতে।
জোজো বলল, আরে, উনি খবরের কাগজটা ফেলে গেলেন যে!
গগনের হাতে যে পাকানো খবরের কাগজটা ছিল, সেটা পড়ে আছে বারান্দার বেদির ওপর।
ততক্ষণে সাইকেল রিকশাটা মিলিয়ে গেছে রাস্তার বাঁকে।
সন্তু বলল, দৌড়ে গিয়ে দিয়ে আসব? ছোটমামা বললেন, তার দরকার নেই, খবরের কাগজ তো পড়া হলে লোকে এমনিই ফেলে দিয়ে যায়।
জোজো কাগজটা খুলে বলল, ওরেব্বাস, এ যে দেখছি দারুণ খবর!
এটা কলকাতার কাগজ নয়। স্থানীয় সংবাদপত্র, নাম বসিরহাট বার্তা, ধ্যাবড়া কালিতে ছাপা। প্রথম পাতায় নীচের দিকে, হাতে-আঁকা একটা মস্তবড় সাপের ছবি। তার তলার দিকটা কুণ্ডলী পাকানো, ওপরে ফণা তুলে আছে। নীচে লেখা : শঙ্খচূড়। তারপর বড় বড় অক্ষরে লেখা : আজই সুকোমল মাহাতোর উদ্ধারের শেষ দিন। আজ রাতের মধ্যে টাকা না পৌঁছে দিলে শঙ্খচূড়ের দংশন থেকে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। আমরা সবদিকে নজর রাখছি। পুলিশ কিংবা কোনও ফোঁপরদালাল কোনওরকম চালাকির চেষ্টা করলে ছেলেটির লাশ নদীর জলে ভাসবে। মনে থাকে যেন, ঠিক রাত নটায় মাঝনদীতে বাঁকের মুখে।
সবাই লেখাটা পড়ে একটুক্ষণ এ-ওর মুখের দিকে তাকাল। ছোটমামা বললেন, গগন কি ইচ্ছে করে কাগজটা এখানে রেখে গেল?
সন্তু বলল, নাও হতে পারে।
ছোটমামা বললেন, বলা যায় না। ভারী ধূর্ত লোক। একদিকে আমাদের কত খাতির দেখিয়ে নেমন্তন্ন করে গেল, আবার ভয় দেখিয়েও গেল মনে হচ্ছে?