জিপগাড়িতে ওঠার পর কাকাবাবু আর গৌতমকাকুর চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
কাকাবাবু গৌতমকাকুকে বললেন, বাধা দিয়ো না। দ্যাখোই না কী হয়। ভয়ের কিছু নেই।
গৌতমকাকু বললেন, আমি মোটেই ভয় পাইনি। তুই তো সঙ্গে আছিস!
কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে বললেন, মিস্টার শঙ্কর রায়বর্মন, আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে পারি কি? আপনাকে কী বলে ডাকব?
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, হ্যাঁ, যা খুশি জিজ্ঞেস করতে পারেন। আসলে মিস্টার বলার দরকার নেই। হয় রাজাবাবু বলবেন, অথবা পুরোপুরি নাম, শঙ্কর রায়বর্মন! শঙ্করবাবুটাই চলবে না।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে প্রথমটা জানতে পারি কি, কেন আপনার নাম রাজাবাবু?
আমার নাম রাজাবাবু নয়। রাজাকে তো সবাই রাজাই বলবে। আমি এখানকার রাজা। আমি দলিলপত্র দেখিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারি যে, আমার পূর্বপুরুষ এই জঙ্গল মহলের রাজা ছিল। ইংরেজরা জোর করে সেটা দখল করে নিয়েছিল, এখন আমি ভারত সরকারের কাছ থেকে সেই রাজত্ব ফেরত চাই।
এখনকার দিনে কি রাজা কিংবা রাজত্ব বলে কিছু আছে? সবই তো স্বাধীন ভারতের অংশ।
বাজে কথা! নেপাল, ভুটান, এইসব দেশে রাজা নেই? আমার এই জঙ্গল মহলও সেরকম আলাদা রাজত্ব হবে।
নেপাল আর ভুটান তো ভারতের মধ্যে ছিল না কখনও। কিন্তু কুচবিহার কিংবা ত্রিপুরা ভারতে ঢুকে গেছে।
তর্ক করবেন না, তর্ক করবেন না। কুচবিহার, ত্রিপুরার রাজারা ভিতু ছিল, লড়াই করেনি। আমি যুদ্ধ করে জিতে নেব। সেইজন্যই সৈন্যবাহিনী তৈরি করছি। আমার অনেক টাকা চাই।
আমাদের মতন নিরীহ মানুষদের ধরে রেখে টাকা আদায় করবেন? আমরা তো অত টাকা দিতে পারব না।
তা হলে আপনাদের মতন কটাকে মেরে ফেলতে হবে। হাত-পা কেটে, মুণ্ডু কেটে বাইরে ফেলে দিয়ে আসব। তা হলেই অন্যরা ভয়ে টাকা দেবে! আপনাকে পেয়ে আমার দারুণ লাভ হল।
কেন, আমি তো আগেই বলেছি, আমি টাকা দিতে পারব না।
টাকা না পেলেও চলবে। সবাই জানে, রাজা রায়চৌধুরী, সবাই যাকে কাকাবাবু বলে জানে, তার দারুণ বুদ্ধি, সব বিপদ থেকে উদ্ধার পায়। কিন্তু আমার হাত থেকে আপনি কিছুতেই পালাতে পারবেন না। আপনাকে টুকরো-টুকরো করে কেটে ফেললে সবাই বুঝবে, আমার কতখানি শক্তি!
আমি খোঁড়া মানুষ, দৌড়ে পালাতে পারি না। আমাকে মেরে ফেলা তো খুব সহজ। কিন্তু এই সহজ কাজটাও কিন্তু এ পর্যন্ত কেউ পারেনি।
এবার দেখুন। দশদিন অপেক্ষা করব। গভর্নমেন্ট বা অন্য কেউ যদি আপনার হয়ে বিশ লাখ টাকা দেয়, তা হলে আর মারব না। কিন্তু সেটাও তো আপনার পরাজয় হবে, তাই না?
তা বটে কিন্তু কেউ অত টাকা দেবে না। আপনার বন্ধুটি তো আমেরিকার ডাক্তার। ওদের অনেক টাকা। ওকে বলুন, আপনাদের দুজনের টাকা দিয়ে দিতে।
গৌতমকাকু বললেন, আমেরিকায় টাকা গাছে ফলে না। অনেক পরিশ্রম করে রোজগার করতে হয়। আমার পরিশ্রমের টাকা আমি যাকে-তাকে দেব কেন?
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, যাকে-তাকে? হুঁ, কটা দিন যাক, তারপর এই তেজ কোথায় থাকে, দেখব!
খানিক পরে জিপগাড়িটা থেমে গেল।
তখনও কাকাবাবুদের চোখের বাঁধন না খুলে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল কিছুদূর। সেখানে ঠিক কোনও রাস্তা নেই, এগোতে হচ্ছে ঝোপ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে কাকাবাবুর।
একবার তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন।
শঙ্কর রায়বর্মন তাঁর কোটের কলার ধরে টেনে তুলে বলল, চালাকি করার চেষ্টা করছেন নাকি? কোনও লাভ নেই।
কাকাবাবু বললেন, আমার ক্রাচ একটা লতায় জড়িয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে চালাকির কী আছে?
গৌতমকাকু বললেন, আপনি মশাই নিজেকে রাজা বলছেন। ওর নামও রাজা। রাজার প্রতি রাজার মতন ব্যবহার করুন।
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, শাট আপ!
একটু পরে একটা খাটিয়ার ওপর ওদের বসিয়ে দিয়ে খুলে দেওয়া হল চোখের বাঁধন।
কাকাবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখলেন।
জায়গাটা নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে। নিরেট অন্ধকারের মধ্যে শুধু একটা মশাল জ্বলছে দাউ দাউ করে। ঘরটর কিছু নেই, শুধু ফাঁকা জায়গায় কয়েকটা খাটিয়া পাতা।
আর একটা খাটিয়ায় একজন প্যান্ট-কোট পরা লোক দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে।
শঙ্কর রায়বর্মন তাকে দেখিয়ে বলল, একে চেনেন? এর নাম প্রমথ বসু, একটা চা-বাগানের ম্যানেজার। কালকে ওর জন্য কুড়ি লাখ টাকা পৌঁছে দেওয়ার শেষ দিন। টাকাটা যদি কাল সূর্যাস্তের মধ্যে না আসে, তা হলে দেখবেন, আপনাদের চোখের সামনে ওর একটা হাত কেটে ফেলা হবে।
সে-কথা শুনেও প্রমথ বসু মুখ থেকে হাত সরালেন না।
জঙ্গলের ভেতর থেকে টর্চ হাতে এগিয়ে এল একজন। কাছে আসতে বোঝ গেল, সে একজন মহিলা। তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়েস, মুখোনা সুন্দর, একটা কালো কাপড় পরা।
সে শঙ্কর রায়বর্মনকে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবুকে ধরতে পেরেছ? কোনজন গো কাকাবাবু?
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, ওই যে গোঁফওয়ালা ভদ্রলোক। ওকে ধরতে গিয়ে আর-একটি রাঘব বোয়ালও পেয়েছি। এর মাথার দাম মিনিমাম পঞ্চাশ লাখ।
মহিলাটি বলল, গ্র্যান্ড, গ্র্যান্ড!
তারপর কাকাবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার তো খুব বুদ্ধি শুনেছি। আপনি আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে এখান থেকে পালাতে পারবেন?
কাকাবাবু হাসলেন।
মহিলাটি কাকাবাবুর গায়ে টর্চের খোঁচা দিয়ে বলল, চুপ করে রইলেন কেন? উত্তর দিন!
কাকাবাবু বললেন, শুধু বুদ্ধি দিয়ে কি আর পালানো যায়? পালাতে গেলে দৌড়োতে হয়। আমার তো দৌড়োবার ক্ষমতাই নেই!
মহিলাটি বলল, আমি শঙ্করের সঙ্গে বাজি ফেলেছি। কী বাজি তা বলব না। ও যদি আপনার ডান হাতটা কেটে ফেলতে পারে, তা হলেই আমি ওর কাছে বাজি হেরে যাব।
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, আমি তো এক্ষুনি কেটে ফেলতে পারি। দেখবে?
মহিলাটি বলল, যাঃ, তা হলে আর মজা রইল কী। ওঁকে কয়েকটা দিন অন্তত পালাবার সুযোগ দাও!
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, আমার সেনাবাহিনীটা এখনও তেমন বড় নয়। কিন্তু যে-কজন আছে, তারা প্রত্যেকে আমার জন্য জান লড়িয়ে দিতে পারে। এই জায়গাটা ঘিরে দশজন পাহারা দিচ্ছে। তাদের নজর এড়িয়ে কাকপক্ষীটিও ঢুকতে বা বেরোতে পারবে না।
মহিলাটি বলল, এখানে কোনওদিন পুলিশও আসতে পারবে না। যদি ভাবেন যে, পুলিশ এসে আপনাদের উদ্ধার করবে, তা হলে সে গুড়ে বালি। শুনুন কাকাবাবু, আমার নাম মহাদেবী। আপনি পালাবার চেষ্টা করে আমাকে বাজিতে জিতিয়ে দিন না! অবশ্য আমি আপনাকে কোনওরকম সাহায্য করব না।
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, আমার সঙ্গে বাজিতে জেতা অত সহজ নয়, বুঝলে মহাদেবী! কুড়ি লাখ টাকা কিংবা ডান হাত কাটা, আমার যে-কোনও একটা চাই! খিদে পেয়ে গেছে, কিছু খাবারটাবারের ব্যবস্থা করো!
রাত্তিরের খাবার শুধু কয়েকখানা রুটি আর খানিকটা গুড়। আর এক জাগ জল।
মহাদেবী আর শঙ্কর রায়বর্মন অন্য কোথাও চলে গেছে। পাশাপাশি দুটো খাটিয়ায় শুয়ে পড়লেন কাকাবাবু আর গৌতমকাকু। অন্য একটা খাটিয়ায় প্রমথ বসু। বাকি খাটিয়াগুলো ফাঁকা, এখানে কেউ পাহারা দিচ্ছে না।
কাকাবাবুদের হাত-পা বাঁধা নয়।
কিন্তু এত গভীর রাতে নিরস্ত্র অবস্থায় পালাবারও প্রশ্ন নেই। তা ছাড়া নিশ্চয়ই ওরা দূর থেকে নজর রেখেছে।
একটু পরে প্রমথ বসু হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতেই আপনমনে বলতে লাগলেন, আমার মেয়ের বয়েস মাত্র তিন বছর। সে তার বাবাকে আর দেখবে না। আমার স্ত্রী, আমার মা, আমার মা এখনও বেঁচে আছেন…
গৌতমকাকু ফিসফিস করে বললেন, সত্যি সত্যি মেরে ফেলবে নাকি?
কাকাবাবু বললেন, এরা সাধারণ ডাকাত নয়। শঙ্কর রায়বর্মন আর ওই মহাদেবী নামের মহিলাটি, দুজনকেই মনে হয় শিক্ষিত। অথচ কত অবলীলাক্রমে হাত-পা কেটে ফেলার কথা বলছে! মানুষ কত নিষ্ঠুর হয়ে গেছে।
গৌতমকাকু বললেন, ওই শঙ্কর রায়বর্মনটা তো পাগল। পাগল না হলে কেউ এ যুগে রাজ্য উদ্ধার করে রাজা হতে চায়? কিছুদিন এই ভাবে চালাবে, তারপর গভর্নমেন্ট নিশ্চয়ই আর্মি পাঠিয়ে ওদের শেষ করে দেবে!
কাকাবাবু বললেন, আমারও ওকে একধরনের পাগল বলেই মনে হয়েছে।
গৌতমকাকু বললেন, এই ধরনের পাগলরা বেশি বিপজ্জনক। কখন যে কী করবে ঠিক নেই। হাসতে-হাসতে বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে পারে। রাজা, আমাদের কী হবে, সত্যি এখান থেকে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারব?
কাকাবাবু বললেন, দশদিন সময় দিয়েছে। প্রথম দু-একদিন অবস্থাটা ভাল করে বুঝে নিই! তোদের এখানে এনে দারুণ বিপদের মধ্যে ফেলে দিলাম!
গৌতমকাকু বললেন, আমরা তো ইচ্ছে করেই এসেছি। সত্যি যে এরকম হবে, ভাবতে পারিনি। তোর ওপর আমার ভরসা আছে। একটা কিছু হবেই!
খানিকটা পরে ঘুমিয়ে পড়লেন দুজনেই। প্রমথ বসু কেঁদেই চলেছেন।
ভোরবেলা দারুণ চ্যাঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে গেল।
দূর থেকে হেঁটে আসছে শঙ্কর রায়বর্মন, তার পোশাক আজ অন্যরকম। পাজামার ওপর একটা জরি বসানো আলখাল্লা পরা, মাথায় একটা লাল ফেট্টিতে পালক গোঁজা। অনেকটা রাজা-রাজা ভাব।
তাকে ঘিরে ধরে লাফাতে লাফাতে আসছে তার অনুচরেরা। একজন একটা বাঁশি বাজাচ্ছে।
গৌতমকাকু জিজ্ঞেস করলেন, আজ এদের উৎসব আছে নাকি?
কাকাবাবু বললেন, দ্যাখোই না কী হয়!
শঙ্কর রায়বর্মন কাছাকাছি এসে দাঁড়াবার পর তার অনুচররা মাটিতে শুয়ে পড়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে লাগল।
অন্য একদিক থেকে মহাদেবী এসে চিৎকার করে বলল, আজ আমাদের তিন নম্বর জয় হল! চা বাগানের ম্যানেজারের নামে কুড়ি লাখ টাকা আজ ভোরবেলাই পৌঁছে গেছে! ম্যানেজার, তুমি আজ ছুটি পাবে!
প্রমথ বসুও উঠে বসেছেন। মাথার চুল উশকোখুশকো। তিনি ভ্যাবাচ্যাকা ভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, যেন তাঁর মুক্তির কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না।
মহাদেবী তাঁর পাশে গিয়ে বলল, নিন, উঠে পড়ুন। রাজাকে প্রণাম করুন। আপনার ডান হাতখানা একটুর জন্য বেঁচে গেল। আর একটু দেরি হলেই—
প্রমথ বসু উঠে দাঁড়ালেন। দুজন লোক তাঁকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেল শঙ্কর রায়বর্মনের কাছে। হাঁটু গেড়ে বসে শঙ্কর রায়বর্মনের পায়ে হাত দিলেন।
মহাদেবী তখন কাকাবাবুদের দিকে ফিরে বলল, যান, আপনারাও গিয়ে প্রণাম করুন।
গৌতমকাকু বললেন, আমরা কেন প্রণাম করতে যাব? আমাদের থেকে বয়েসে ছোট!
ভীমের মতন চেহারার একজন লোক ওঁদের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, উঠুন, উঠুন!
গৌতমকাকু বললেন, না, আমি যাব না! সেই লোকটা হাঁটু দিয়ে গৌতমকাকুর পিঠে একটা ধাক্কা দিল।
কাকাবাবু বললেন, চলো গৌতম, এরা যা বলছে করতেই হবে। শুধু শুধু মার খেয়ে লাভ নেই।
দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে লাগলেন শঙ্কর রায়বর্মনের দিকে। কাকাবাবু ফিসফিস করে বললেন, যদি বেঁচে থাকি, এর প্রত্যেকটি ব্যাপারের প্রতিশোধ নেব!