॥ সাত ॥
জানালার ধারে তার প্রিয় সোফায় আজও সকালে খবরের কাগজ খুলে বসেছে শ্যামল, সেন্টার টেবিলে গরম চায়ের কাপ। ভোরের রোদ রোজকার মতো এসে দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। রান্নাঘর থেকে চিংড়ি রান্নার গন্ধ আসছে। তার সুন্দরী স্ত্রী একটু আগেই উঠে বাথরুমে গেছে। বাতাসে এখন চোরা শীত। চমৎকার আবহাওয়া। মাঝে মাঝে নিজেকে বেশ সুখীই লাগে শ্যামলের। মাঝে মাঝে মনে হয় মোটা মাইনের চাকরি, নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট, সুন্দরী স্ত্রী, ফুটফুটে বাচ্চা, তার অ্যাচিভমেন্ট বড় কম নয় আবার মাঝে মাঝে এক-একটা ভুতুড়ে দিন আসে যখন সব হিসেব ওলটপালট হয়ে যেতে চায়। তখন মনে হয়, তার মতো এমন অভাগা আর কে আছে?
একটা খবরের ওপর সামান্য ঝুঁকে পড়ল সে। গান ব্যাটল অ্যাট ধানবাদ। ড্রেডেড টেররিস্ট কিলড। সুরিন্দর নিহত হয়েছে ধানবাদের এক হোটেলে। তার তিন সঙ্গীর মধ্যে দু’জন প্রাণ দিয়েছে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে।
খবরটা পড়ে একটু নিশ্চিন্ত খাস ছাড়ে শ্যামল, যাক বাবা, সুরিন্দর যে কলকাতায় হাজির হতে পারেনি সেটাই বাঁচোয়া, ওরা সাংঘাতিক লোক। বাজারে হাটে, রাস্তায় ঘাটে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ মারে। মেয়ে-পুরুষ, বাচ্চা-কাচ্চা কাউকে রেহাই দেয় না। ওদের হাতে থাকে সেই ভয়ংকর মারণাস্ত্র, যার নাম এ কে ফটি সেভেন। কী যে শুরু হয়েছে দেশটায়?
আপনমনে মাথা নাড়ল শ্যামল। অফিসের সময় এগিয়ে আসছে। একটু অন্যমনস্ক ভাবে চা খেয়ে সে বাথরুমে গেল।
খবরটা বকুল পড়ল আর-একটু বেলায়, যখন শ্যামল অফিসে গেছে। মেয়ে গেছে পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে। একা জানালার ধারে বসে বকুল খবরটা পড়ে চুপ করে বসে রইল। বুকের মধ্যে একটু দোলা। শ্যামল বলেছিল, সুরিন্দরকে ধরতেই কলকাতায় এসেছিল বিশ্বরূপ। সেই থেকে সারাক্ষণ বকুলের বুকে কাটা দিয়ে ছিল একটা ভয়। ওই বিষণ্ণ, সুন্দর, শান্ত লোকটা কি পারবে এই লড়াইতে?
বুক থেকে একটা বন্ধ বাতাসকে মোচন করল বকুল। জানালার বাইরে তাকিয়ে সে খুব আনমনা হয়ে গেল। এরকম কোনও বিপজ্জনক মানুষের সঙ্গে যদি বিয়ে হত তার, তা হলে কেমন জীবন হত বকুলের? থ্রিলিং। কিন্তু না, সে জীবন সহ্য করতে পারত না বকুল। অত টেনশন তার হয়তো হার্টের অসুখ তৈরি করত। তার চেয়ে এই-ই ভাল। এই সে বেশ আছে। জীবনটা একটু একঘেয়ে, কিছুটা আলুনি। তবু এ জীবনে তো কোনও টেনশন নেই। উদ্বেগ নেই। গান ব্যাটল অ্যাট ধানবাদ। ড্রেডেড টেররিস্ট কিন্ড। মাগো! লোকটার ভয়ডর বলে কিছু নেই। একদিন মরবে।
না, ওরকম পুরুষ চায় না বকুল। তবে মাঝে মাঝে বিশ্বরূপের কথা ভাবতে তার ভাল লাগবে। গায়ে কাঁটা দেবে আনন্দে, শিহরনে। সে চায় না বটে, কিন্তু পুরুষ মানুষ তো ওরকমই হওয়া উচিত। জঙ্গি পাইলট, আর্মি অফিসার, মাউন্টেনিয়ার, দুঃসাহসী গোয়েন্দা, রেসিং কারের ড্রাইভার।
বিশ্বরূপ তার মনটা জুড়ে রইল আজ। যদি লাঞ্চে বা ডিনারে আসত! যদি দেখা হত আবার! হবে কি? না বোধহয়। পথের পরিচয় পথেই ফুরিয়ে যায়। এতক্ষণে বিশ্বরূপই কি তার কথা মনে রেখেছে?
কলকাতায় একরকম সকাল, পাটনায় আর-একরকম। আজ পাটনার আকাশ মেঘলা। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। তার মধ্যে ভজনা দেবী তার ঘরখানা পর্দা টেনে আর-একটু আঁধার করে নিয়েছেন।
অজিত এল বেলা দশটা নাগাদ।
মা, খবর শুনেছেন তো?
বোস অজিত। সকালে পুলিশ সাহেব টেলিফোন করে জানিয়েছেন।
আজ মিশজির আত্মা ঠান্ডা হল মা। তাঁর খুনি খতম হয়েছে।
ভজনা দেবী ধ্যানস্থের মতো বসে ছিলেন। বললেন, তুই কি খুশি হয়েছিস?
হয়েছি। মিজির মতো মানুষকে ওরকম অপমান করেছিল বলে তার খতম হওয়ার খবরে খুশি হয়েছি। মিশ্রজি গান্ধীবাদী নেতা ছিলেন, ছাত্র আন্দোলন করেছেন, জেল খেটেছেন, মানুষের জন্য ত্যাগ ছিল অনেক। ওরকম একজন মানুষকে লোকটা অন্তত সাতদিন ধরে প্রায় চাকর বানিয়ে রেখেছিল। শুধু খুন করলে কিছু ছিল না, নেতারা খুন হতেই পারেন। কিন্তু হুকুমদাস বানিয়ে রাখবে কেন?
ভজনা দেবী পাথরের মতো বসে রইলেন। তারপর বললেন, ঠাকুরের যা ইচ্ছা। আজ সকাল থেকে তারই ধ্যান করছি। ঠাকুর বলতেন, মা খ্রিয়স্ব, মা জহি, শক্যতে চেৎ মৃত্যুমবলোপায়। বলতেন, ডেথ ইজ এ কিওরেবল ডিজিজ। মৃত্যুর বিরোধী ছিলেন খুব। কিন্তু আজ চারদিক থেকে কেন যে এত মরণ আমাকে ঘিরে ধরেছে!
একটা কথা আছে মা।
কী কথা রে?
মিঠিয়াকে নিয়ে।
তাও জানি। পুলিশ সাহেব বলেছেন। মিঠিয়া মরেনি, ওরা মিঠিয়া সাজিয়ে আর-একটা মেয়েকে মেরেছে।
মিশ্রজির সম্পত্তি এখনও অনেকটা আছে মা। কে দখল নেবে?
উড়ে-পুড়ে যাক।
আমার সন্দেহ হয়, মিঠিয়া এসে ক্লেম করবে। পুলিশকে বলবে আতঙ্কবাদীরা ওকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। বাকি ঘটনা ব্যাখ্যা করা সোজ।
নিক বাবা, মিঠিয়াই নিক। মিশজিকে পাপে ধরেছিল, তার প্রায়শ্চিত্ত হোক। আমাকে ওর কথা বল।
কার কথা মা?
ওই যে দুঃখী ছেলেটা, বিশ্বরূপ। ও তোর কেমন বন্ধু?
ও একটা পাগল। বিশুর এখনও ধারণা, আমাদের গাঁ জগদীশপুরে আজও অন্ধকার রাতে হলধর ভূত আর জলধর ভূত লড়াই করতে আসে, আর জ্যোৎস্নারাতে খেলা করতে নামে পরিরা। ওর দাদু নাকি প্রতিদিন সন্ধেবেলা আজও দাওয়ায় বসে থাকেন। মা অপেক্ষা করেন, আরও কত কী।
ওর কি কেউ নেই রে অজিত?
না, পরপর মরে গেল সবাই। কত কষ্ট করে মানুষ হয়েছে।
দুঃখী লোকেরা ভগবানের বড় আপন মানুষ হয়, জানিস তো!
বিশুর ভগবানও নাকি জগদীশপুরেই থাকেন। আর কোথাও নয়। জগদীশপুরে।
ওর ভাল হোক বাবা। কোনও চোট পায়নি তো! ভাল আছে?
অজিত আনমনে বলে, চোট হয়নি। তবে কেমন আছে কে জানে মা। কোন এনকাউন্টারে কবে খরচ হয়ে যাবে। ওর কথা বেশি ভাববেন না। দুঃখ পাবেন।
ওকে একখান গীতা দিয়েছিলাম। ওকে রোজ পড়তে বলিস।
দিল্লিগামী ট্রেনের এক চেয়ারকারে আর-একরকমের ভোর হল। বাইরে রোদে ভেসে যাচ্ছে মাঠঘাট। ধানখেত, প্রান্তর, উচ্চাবচ ভূমি পিছনে ফেলে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে রেলগাড়ি। একটি সিটে এলিয়ে পড়ে থাকা বিশ্বরূপের কাছে থেমে গেছে সব গতি। থেমে আছে সময়। হে কৃষ্ণ, আমি কেন কিছুই বুঝতে পারছি না কে আমার শত্রু, আর কেই বা আমার বন্ধু। হে কৃষ্ণ… হে কৃষ্ণ… কেন বুঝতে পারি না? কেন পারি না, কৃষ্ণ… হে কৃষ্ণ… হে কৃষ্ণ… কেন ভোরবেলা আমার আঁধার নেমে আসে… কেন হারিয়ে যায় কাগজের নৌকো, পরি, ভূত…
ব্রেকফাস্ট সাব?
ধীরে মুখখানা তোলে বিশ্বরূপ। ক্লান্তি আর ক্লান্তি।… রূপা, গেন বাঢ়া রে…
ডবল ডিমের ওমলেট, টোস্ট, হট কফি…
আর ইউ সিক?
বিশ্বরূপ মুখ ঘোরাল। চশমা পরা একজন ভদ্র মানুষ। বিশ্বরূপ মৃদু হেসে বলে, নো, থ্যাংক ইউ।
ইউ লুক সিক। আই ক্যান হেলপ ইউ। আই অ্যাম এ ডক্টর।
বিশ্বরূপ সোজা হয়ে গা ঝাড়া দিয়ে বসে, আই অ্যাম ও কে, ডক্টর।
ডাক্তারের ওপাশে জানালার ধারে এক ভদ্রমহিলা। একটু ঝুঁকে তিনি বিশ্বরূপের দিকে চেয়ে বলেন, ইউ লুক ভেরি ডিজেক্টেড। টায়ার্ড পারহ্যাপস?
এ বিট অফ দ্যাট। বাট ইটস অলরাইট।
একটু শীত করে বিশ্বরূপের।
আই অ্যাম ডক্টর মণি, অ্যান্ড দিস ইজ মাই ওয়াইফ মুকুল। উই আর বোথ ডক্টরস। লেট মি ফিল ইয়োর পালস।
বিশ্বরূপ হাতটা এগিয়ে দেয়।
মাই গড। ইউ আর রানিং এ হাই টেম্পারেচার। হিয়ার আর টু ট্যাবলেটস। টেক দেম উইথ টি।
বিনা প্রতিবাদে ট্যাবলেট দুটো খেয়ে নিল বিশ্বরূপ। তারপর ঘুমোল কিছুক্ষণ।
ইউ হ্যাভ এ মেলাঙ্কলিক ফেস।
বিশ্বরূপ চোখ খোলে। মণি পাশে নেই। বোধহয় টয়লেটে। তার পাশে মুকুল।
বিশ্বরূপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হে কৃষ্ণ, আমি কেন আর বুঝতে পারছি না কে শত্রু কে মিত্র? কেন গুলিয়ে যাচ্ছে সব! কত দূর ছড়িয়ে দিয়েছ তোমার কুরুক্ষেত্র, কত দূর?
আপকা শুভ নাম?
বিশ্বরূপ সেন।
ইটস এ নাইস নেম। ইউ হ্যাভ এ নাইস ফেস।
থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
গো টু স্লিপ নাইস ম্যান। উই আর হিয়ার টু হেলপ ইউ।
বিশ্বরূপ চোখ বোজে। একদিন গুপ্তঘাতক তাকে পেয়ে যাবে। বোমা বা অটোমেটিক রাইফেল বা চপার শেষ করে দেবে তাকে। তৈরি হচ্ছে তার আততায়ী। হে কৃষ্ণ, আমি কেন কিছুতেই আর বুঝতে পারি না কিছু? এই বিষাদ, এই প্রগাঢ় ক্লান্তির অর্থ, এই বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়ার অর্থ, গৃহবধু-সন্তানের অর্থ, যশ ও উন্নতির অর্থ, আমি কিছুই আর বুঝতে পারি না কেন? হে কৃষ্ণ…