০৭. জানালার কাছে বসে

জানালার কাছে বসে টুকি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে রাবি বসেছিল সে বিরক্ত ভঙ্গী করে ঘুরে টুকির দিকে তাকিয়ে কর্কশ স্বরে বলল, কী হল? এরকম লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলছ কেন? মহাকাশযানের ভিতরে ভাল লাগছে না?

টুকি সাথে সাথে বিগলিত ভঙ্গী করে বলল, না, না, কী যে বল। চমৎকার লাগছে আমাদের। চমৎকার লাগছে।

ঝাও যন্ত্রের মত মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার লাগছে।

রোবি গলার স্বরে অধৈর্যের ভাব ফুটিয়ে বলল, দিনরাত দেখি ভ্যাবলার মত বসে আছ। একটু কাজকর্ম করতে পার না?

সাথে সাথে টুকি এবং ঝা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, অবশ্যি করতে পারি। কী করতে হবে বল?

মহাকাশযানটা যে একটা আঁস্তাকুড় হয়ে আছে খেয়াল করেছ? এটা একটু পরিষ্কার করা যায় না?

টুকি এবং ঝা সাথে সাথে মহাকাশযানটাকে ঘসে মেজে পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়। রবোটদের গ্রহে রোবির কপোট্রনে নানারকম অনুভূতি জুড়ে দেবার পর রোবির বড় পরিবর্তন হয়েছে। বেশিরভাগ সময় সে তিরিক্ষ মেজাজে থাকে, মাঝে মাঝে অকারণে তার মন খারাপ হয়ে যায় তখন কয়েকঘন্টা উচ্চস্বরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে। তার কাছে তখন যাওয়া যায় না। কারণ সে যেভাবে হাত পা ছুড়তে থাকে যে ধারে কাছে গিয়ে বেকায়দা লেগে গেলে কম্পাউন্ড ফ্রাকচার হয়ে যাবার আশংকা থাকে। টুকি এবং ঝায়ের কোন কোন কাজকর্ম দেথে হঠাৎ হঠাৎ রোবির মাঝে প্রবল ঘৃণাবোধ জেগে উঠে তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে টুকি ঝা এবং সমস্ত মনুষ্য জাতিকে গালি-গালাজ করতে থাকে। কখনো কখনো তার মনে আনন্দের ভাব এসে যায়, সেটি আরো বিপজ্জনক তখন সে টুকি এবং ঝাকে ধরে নাচানাচি করার চেষ্টা করতে থাকে। টুকি কিংবা ঝ দুজনেরই মধ্যবয়স, নাচানাচি করার সময় অনেক দিন হল চলে গিয়েছে, চেষ্টা করে তাদের বিশেষ বিড়ম্বনা হয়। সব মিলিয়ে বলা যায় তাদের জীবন এই মহাকাশযানে বিষময় হয়ে আছে। কবে আরো তিন সপ্তাহ পার হবে, তারা ছোট নক্ষত্রটির পাশে পৌঁছে হাইপার ডাইভ দিয়ে পৃথিবীর দিকে রওনা দেবে সেই আশায় হা করে বসে আছে।

কিন্তু তার আগেই তাদের গতিপথে একটা ছোট গ্রহ পাওয়া গেল। রোবি গ্রহটাকে একপাক ঘুরে এসে বলল, এইখানে নামা যাক।

টুকি ভয়ে ভয়ে বলল, নামার দরকারটা কী? কে না কে আছে আবার নতুন কোন ঝামেলায় পড়ে যাব।

রোবি গলার স্বরে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, এখানে কেউ নেই। কেমন করে জান?

কারণ মানুষ রবোট যাই থাকুক তাদের জন্যে শক্তির দরকার। শক্তি খরচ হলে বায়ুমণ্ডলে তার চিহ্ন থাকে। রেডিয়েশান হিসেবে, বাড়তি কার্বন ডাইঅক্সাইড, ওজোন লেয়ার বা অন্য কোনভাবে। এখানে সেরকম কিছু নেই।

ঝা বলল, কিন্তু গ্রহটা ফাঁকা বলেই কী নামতে হবে? সবকয়টা ফাঁকা গ্রহে যদি নামতে নামতে যাই তাহলে তো একশ বছর লেগে যাবে–

রোবি একটা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর বেকুব কোথাকার। আমরা কী মশকরা করার জন্যে নামছি? হাইপার ডাইভ দেবার আগে বড় ইঞ্জিনটা সার্ভিস করতে হবে, সে জন্যে নামছি।

ঝা তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলল, অবশ্যি অবশ্যি।

ফাঁকা গ্রহটিতে মহাকাশযানটি মোটামুটি নিরাপদভাবে নামল। রোবির কথা সত্যি, ধূ ধূ প্রান্তর কোথাও জন-মানব সভ্যতার চিহ্ন নেই। লাল রংয়ের পাথর ছড়ানো, দেখে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়।

রোবি যখন মহাকাশযানের বড় ইঞ্জিনটা খুলে আবার লাগানো শুরু করেছে তখন টুকি আর ঝা হাঁটতে বের হল। গ্রহটিতে খুব হালকা একটা বাতাসের স্তর রয়েছে, নিঃশ্বাস নেবার জন্যে তাদের আলাদা মাস্ক পরে নিতে হল। গ্রহটা জনমানবহীন মনে হচ্ছে সত্যি কিন্তু যদি কোন বিপদ আপদ ঘটে যায় সেজন্যে সাথে নিল দুটি শক্তিশালী লেজার গান, সহজে চলাফেরা করার জন্যে পিঠে রাখল শক্তিশালী জেট প্যাক।

দুজনে লাল পাথরের প্রায় মরুভূমি এলাকায় হাঁটতে থাকে, সামনে একটা বড় পাথরের স্তর। সেটা পার হয়ে অন্য পাশে এসে তারা বিচিত্র কিছু গাছগাছালী আবিষ্কার করল। টুকি গাছগুলো পরীক্ষা করে নিচু গলায় বলল, এই গ্রহে যদি গাছগাছালী থাকে তাহলে অন্য প্রাণীও থাকতে পারে।

হ্যাঁ! ঝা ভয়ে ভয়ে বলল, চল ফিরে যাই।

চল।

দুজনে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে, কয়েক পা এগিয়েই টুকি দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, ঝা—

কী হল? মনে হচ্ছে আমাদের কেউ অনুসরণ করছে।

ঝা শুকনো গলায় বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। দৌড় দেব নাকী?

দৌড় দেবে কেন? আমাদের জেট প্যাক আছে না? সুইচ টিপলেই আকাশে উড়ে যাব। ভয়ের কিছু নেই।

লেজার গানটা বের করে রাখব?

হ্যাঁ! বিপদ দেখলেই গুলি। মনে থাকবে তো?

টুকির কথা শেষ হবার আগেই বিপদ যেন তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, হঠাৎ করে চারিদিক থেকে হৈ হৈ করে অসংখ্য মানুষ তাদের দিকে ছুটে আসে। টুকি এবং ঝা লেজার গান উদ্যত করে গুলি করার জন্যে ট্রিগারে হাত দিয়েও তারা হতচকিতের মত দাঁড়িয়ে রইল, কারণ যারা হৈ হৈ করে তাদের দিকে ছুটে আসছে সবাই মেয়ে, স্বল্প বসনা এবং অনিন্দ্য সুন্দরী। পুরুষ মানুষ হয়ে এরকম সুন্দরীর মেয়েদেরকে আর যাই করা যাক গুলি করা যায় না।

কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই মেয়েগুলো টুকি এবং ঝাকে ঘিরে ফেলল। নীল চোখ এবং সোনালী চুলের একটি মেয়ে যার শরীর এত সুগঠিত যে একবার চোখ পড়লে চোখ ফেরানো যায় না—সবার আগে কথা বলল, ভাষাটি টুকি এবং ঝায়ের ভাষা থেকে খানিকটা ভিন্ন কিন্তু তবু বুঝতে অসুবিধে হল না। মেয়েটি বলল, হায় ঈশ্বর! এতো দেখছি পুরুষ মানুষ!

কালো চুলের একটি মেয়ে বিস্মিত হয়ে বলল, কী রকম পরিবারের মানুষ যে পুরুষদের একা একা বের হতে দিয়েছে?

নীল চোখের সোনালী চুলের মেয়েটি বলল, থাক, থাক, কিছু বলে কাজ নেই, ভয় পেতে পারে।

টুকি এবং ঝা এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে, হাতের অস্ত্রটা নামিয়ে রেখে হাসার চেষ্টা করে বলল, তোমাদের অভিনন্দন।

সাথে সাথে সব কয়জন মেয়ে বিস্ময়ে হতবাক হবার মত একটা শব্দ করল। কম বয়সী একটা মেয়ে নিজের চোখ ঢাকতে ঢাকতে বলল, কী রকম বেশরম দেখেছ? আমাদের সাথে কথা বলছে!

পোশাকটা দেখেছ? সারা শরীর দেখা যাচ্ছে, লজ্জায় মরে যাই!

টুকি এবং ঝা এবারে খানিকটা হতচকিত হয়ে গেল, তাদের পুরুষ হওয়া নিয়ে এখানে কোন একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। টুকি আবার চেষ্টা করল, বলল, তোমদের সবার জন্যে অভিবাদন। শুভ সকাল—কিংবা বিকাল যেটাই এখন হয়ে আছে।

মেয়েগুলো আবার একটা বিস্ময়ধ্বনি করে একটু পিছিয়ে গেল। কমবয়সী আরেকটা মেয়ে একটু বিচলিত হয়ে নীল চোখের মেয়েটিকে বলল, টাইরা, কিছু একটা কর, লজ্জায় মারা যাচ্ছি।

টাইরা পিছনে ফিরে বলল, দুইটা চাদর দাও।

পিছনের মেয়েরা দুটি উজ্জ্বল রংয়ের চাদর এগিয়ে দিল। টাইরা চাদরগুলো সাবধানে টুকি এবং ঝায়ের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, ভাল করে শরীরটাকে ঢেকে নাও। পুরুষ মানুষের শরীর দেখানো খুব লজ্জার ব্যাপার।

টুকি এবং ঝা কিছুই বুঝতে পারছিল না, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে তর্ক করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হল না। তারা উজ্জ্বল রংয়ের কাপড় দুটি দিয়ে নিজেদের ভাল করে ঢেকে নিল। নিজেদেরকে হঠাৎ তাদের বোকার মত মনে হতে থাকে। টুকি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

টাইরা টুকিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল, পুরুষেরা কখনো অপরিচিত মেয়েদের সাথে কথা বলে না। সেটা ভারী লজ্জার ব্যাপার।

ঝা ঢোক গিলে বলল, তাহলে পুরুষেরা কার সাথে কথা বলে?

অন্য পুরুষের সাথে। তাদের ঘরের বাইরে যাবার কথা নয়। পুরুষদের সবসময় মেয়েদের সামনে পর্দা করার কথা।

টুকি এবং ঝা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, হঠাৎ করে তাদের কাছে অনেক জিনিস পরিষ্কার হয়ে যায়। মানুষের একটা বিচ্ছিন্ন সমাজ এখানে গড়ে উঠেছে যেখানে মেয়েরা ঘরের বাইরে থাকে আর পুরুষেরা অন্তঃপুরে বন্দী।

টুকি এবং ঝ ইচ্ছে করলে তাদের জেট প্যাক ব্যবহার করে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারতো কিন্তু যেহেতু পরিবেশটা সেরকম বিপজ্জনক মনে হচ্ছে না তারা ব্যাপারটা আরো একটু যাচাই করে দেখতে চাইল।

মেয়েদের দলটি তাদেরকে হাটিয়ে হাঁটিয়ে নিতে থাকে। বয়স্ক মানুষেরা যেভাবে শিশুদের সাথে ব্যবহার করে মেয়েরা তাদের সাথে ঠিক সেরকম ব্যবহার করছিল। এই সমাজে পুরুষ মানুষেরা নিশ্চয়ই খুব কোমল প্রকৃতির।

হেঁটে হেঁটে তারা একটা লোকালয়ের কাছে পৌঁছতেই অনেকে তাদের দিকে ছুটে এল, সবাই মেয়ে। কেউ বালিকা, কেউ কিশোরী, কেউ তরুণী, কেউ যুবতী, কেউ কেউ মধ্যবয়স্কা। সবাই কৌতূহলী চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিশোরী এবং বখে যাওয়া কিছু তরুণী শীষ দিয়ে টুকি এবং ঝায়ের কাপড় ধরে টান দেয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু টাইরার প্রচণ্ড ধমক খেয়ে তারা পালিয়ে গেল। টুকি এবং ঝা হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করে রাস্তার দুপাশে পাথরের ঘরের ভিতরে জানালার ফাঁক দিয়ে ঘোমটায় ঢাকা পুরুষ মানুষেরা উঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে।

মেয়েদের দলটি টুকি এবং ঝাকে নিয়ে একটা বড় বাসার সামনে হাজির হল। বাসাটি সম্ভবত টাইরার, কারণ অন্য সব মেয়েরা বাইরের বারান্দায় অপেক্ষা। করতে লাগল, শুধু টাইরা টুকি এবং ঝাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। সাথে সাথে ভিতর থেকে সুদর্শন কোমল চেহারার একজন পুরুষ মানুষ টাইরার দিকে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওগো সোনামনি, তুমি ফিরে এসেছ?

টাইরা মাথা নাড়ল। পুরুষ মানুষটি নিশ্চয়ই টাইরার স্বামী, সে আদুরে। বেড়ালের মত ভঙ্গী করে বলল, টাইরা, সোনামনি আমার, পথে কোন কষ্ট হয়নি তো?

না।

তোমায় এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানীয় এনে দিই?

না, লাগবে না। তুমি বরং এই দুজন পুরুষ মানুষকে দেখ।

টাইরার স্বামী, কোমল চেহারার পুরুষটি এবারে টাইরাকে ছেড়ে দিয়ে টুকি এবং ঝায়ের দিকে তাকাল। অবাক হয়ে বলল, এরা কারা?

লাল পাহাড়ের কাছে পেয়েছি। একেবারে বেপর্দা হয়ে হাঁটাহাঁটি করছিল।

টাইরার স্বামী লজ্জায় জিবে কামড় দিয়ে বলল, ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

হ্যাঁ! অত্যন্ত বেশরম মানুষ–নিজে থেকে আমাদের সাথে কথা বলছিল।

কী লজ্জা! কী লজ্জা!

তুমি তাদের সাথে একটু কথা বলে দেখ, ব্যাপারটা কী? কোথা থেকে এসেছে, কী সমাচার। না জানি বেচারার স্ত্রীরা এখন কোথায় কী দুশ্চিন্তা করছে।

টাইরার স্বামী মুখে একটা কপট রাগের ভান করে বলল, আমি বুঝতে পারি না কী রকম মেয়েমানুষ তাদের স্বামীদের এরকম একলা ছেড়ে দেয়। যদি কিছু একটা হত? যদি তোমাদের সামনে না পড়ে কোন খারাপ মেয়েদের সামনে পড়ত?

টুকি এবং ঝা দেখল টাইরার কোমল চেহারার সুদর্শন স্বামী ব্যাপারটা চিন্তা করে আতংকে কেমন জানি শিউরে উঠে।

টাইরা চলে যাবার পর টুকি এবং ঝা তাদের সারা শরীরে ঢাকা চাদরগুলো খুলে রাখল। টাইরার স্বামী বিস্মিত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা কারা ভাই? একা একা কী করছ? তোমাদের স্ত্রীরা কই? তোমাদের একা ছেড়ে দিল কেমন করে?

টুকি মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের স্ত্রী নেই।

মানুষটার মুখে হঠাৎ সমবেদনার চিহ্ন ফুটে উঠে, আহা। বিয়ে হয় নি এখনো? কোন মেয়ে পছন্দ করল না?

না, মানে–

মেয়েদের মন জয় করতে হলে একটু চেষ্টা করতে হয়। সেজে গুজে থাকতে হয়, দাড়ি কামিয়ে চুল পরিপাটি করে আচড়াতে হয়, শরীরে পারফিউম দিয়ে সুন্দর কাপড় পরতে হয়। তোমাদের যেরকম রুক্ষ চেহারা, সাথে যেভাবে বেশরম কাপড় পরেছ কোন ভদ্র পরিবারের মেয়ে তোমাদের পছন্দ করবে ভেবেছ?

টুকি বলল, আসলে ব্যাপারটা তা নয়। আমরা যেখান থেকে এসেছি, সেখানকার নিয়ম-কানুন অন্যরকম।

কোথা থেকে এসেছ তোমরা?

অন্য একটা গ্রহ থেকে। এটা যেরকম এম সেভিন্টিওয়ান–

টাইরার স্বামী বাধা দিয়ে বলল, থাক থাক আর বলতে হবে না। আমি ওসব বুঝি না। আমরা পুরুষ মানুষেরা ঘর সংসার করি বড় বড় জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শুনে কী করব?

টুকি ভুরু কুচকে বলল, তোমরা শুধু ঘর সংসার কর?

টাইরার স্বামী অবাক হয়ে বলল, আর কী করব? একজন পুরুষ মানুষ যদি তার স্ত্রীকে খুশী রাখতে পারে তাহলে তার জীবনে আর কী চাইবার আছে? সারাদিন পরিশ্রম করে স্ত্রী ঘরে এলে তার জন্যে রান্না করে খাবার দেওয়া, পোশাক ধুয়ে রাখা বাচ্চা মানুষ করা—

টুকি এবং ঝা কেমন জানি ভয়ে ভয়ে টাইরার স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক এরকম সময় দরজা খুলে একজন তরুণ এসে ঢুকল, তার চোখে পানি টল টল করছে। টাইরার স্বামী জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার?

আমি আর বাইরে যাব না বাবা। কখনো বাইরে যাব না।

আবার বুঝি পাড়ার বখা মেয়েরা–

হ্যাঁ! আমাকে দেখে শীষ দিয়ে এত খারাপ খারাপ কথা বলেছে— তরুণটা হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। মানুষটি তার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কাদিস নে বাবা। তোর মাকে বলব দেখি কিছু করতে পারে কী না।

ছেলেটি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলে মানুষটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আগের যুগের সেই নিয়ম-নীতি আর নেই। সবার মাঝে কেমন জানি ভোগ লালসা। মাঝে মাঝে যখন বাইরে যাই বুঝতে পারি মেয়েরা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার শরীরের দিকে। মনে হয় চোখ দিয়ে সমস্ত শরীরটাকে চেটে খাচ্ছে।

মানুষটির সারা শরীর বিতৃষ্ণায় কেমন জানি শিউরে উঠল।

টুকি এবং ঝা এতক্ষণে তাদের মহাকাশযানে ফিরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে। মেয়েদের এই সমাজ ব্যবস্থায় রাস্তাঘাটে বের হলে তাদের দেখে যে যাই মনে করুক তাদের কিছু করার নেই। জেট প্যাক ব্যবহার করে তারা আকাশে উড়ে যাবে। পুরুষদের ঘরের মাঝে আটকে রাখা তাদের কাছে যতই বিচিত্র মনে হোক এখানে এটা ঘটছে। হাজার বছর আগে পৃথিবীতে ঠিক তার উল্টো ব্যাপার ঘটেছিল, মেয়েদেরকে ঘরের মাঝে আটকে রাখ হয়েছিল।

টুকি আর ঝা টাইরার স্বামীর কাছে গিয়ে বলল, তোমাদের এখানে এসে আমাদের খুব ভাল লেগেছে, এখন আমরা যাব।

টাইরার স্বামী চোখে কপালে তুলে বলল, যাবে? কোথায় যাবে? মহাকশনের কথা বলে খুব একটা লাভ হবে না বলে তারা সে চেষ্টা করল। বলল, যেখান থেকে এসেছি।

কিন্তু তোমাদের খাওয়া হয়নি, বিশ্রাম হয়নি–

না হোক। আমরা ফিরে গিয়ে খাব বিশ্রাম নেব।

কোমল চেহারার সুদর্শন মানুষটির চোখে মুখে সত্যিকার দুশ্চিন্তার ছাপ। ফুটে উঠল, বলল, ঠিক আছে যেতে চাও যাবে তবে কিছু না খেয়ে যেতে পারবে না।

মানুষটির গলার স্বরে এক ধরনের আন্তরিকতা ছিল, টুকি এবং ঝা না করতে পারল না।

খাবারের আয়োজন ছিল সহজ, কিন্তু খুব সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। টুকি এবং ঝা খুব তৃপ্তি করে খেল। খাওয়া সেরে উঠতে গিয়ে হঠাৎ করে টুকি এবং ঝায়ের মাথা দুলে উঠে, কোনমতে টেবিল ধরে নিজেদের সামলে নিল। টাইরার স্বামী বলল, তোমরা হাঁটাহাঁটি করো না। তোমাদের খাবারের সাথে আমি ঘুমের ওষুধ দিয়েছি।

টুকি হতচকিত হয়ে বলল, কী দিয়েছ?

ঘুমের ওষুধ।

টুকি হঠাৎ করে এক ধরনের আতংক অনুভক করে। সত্যি সত্যি ঘুমে তাদের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কোন মতে কষ্ট করে চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল, কেন দিয়েছে?

একা বাইরে গিয়ে কী বিপদে পড়বে। বাইরে শুধু দুষ্ট মেয়ে মানুষ আর নষ্ট মেয়ে মানুষ। তোমাদের মত সাদাসিধে পুরুষদের একা পেলে কী অবস্থা হবে জান?

টুকি আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই গভীর ঘুমে তাদের দুই চোখের পাতা জড়িয়ে এল।