জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির পাশ দিয়ে গোরক্ষনাথের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে পিচের রাস্তা ছেড়ে প্রায় মেঠো পথে বাইক নামাল অর্জুন। কিছু গাছগাছালি রয়েছে, টিনের বাড়িটা ভাঙাচোরা, অনেককাল হাত পড়েনি।
বাইক থেকে নেমে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে গোরক্ষনাথ বলল, পেটের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাই, বাড়িটা যে পড়ে যায়নি এই ঢের। আসুন, আসুন।
ভাঙা টিনের দরজা খুলে গোরক্ষনাথ অর্জুনের সঙ্গে একচিলতে উঠোনে ঢুকল। উঠোনের একপাশে একটা পিড়িতে যে মহিলা বসে আছেন তাঁর বয়স অনুমান করা মুশকিল। মাথায় শনের মতো সাদা কিছু চুল, মুখের চামড়ায় মোটা মোটা ভাঁজ। ওদের দেখে চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন তিনি।
বেড়ালটাকে মাছ দিয়েছ? গোরক্ষনাথ জিজ্ঞেস করল।
দিয়েছি। খায়নি ওটা। বিদায় কর, বিদায় কর গোরক্ষ।
গোরক্ষনাথ অর্জুনের দিকে তাকাল, এই হয়েছে বিপদ। বড়লোকের বাড়িতে দামি মাছ খেয়ে খেয়ে ব্যাটা এমন মুখ করেছে, শস্তার মাছে মন ভরছে না। খাবে, খিদে যখন ছোবল মারবে তখন ওই মাছ গিলতে হবে ব্যাটাকে।
এই সময় বুড়ি চিৎকার করে উঠল, ওটা কী? অ্যাাঁ, ওটা কী?
গোরক্ষনাথ পাখিসুষ্ঠু হাতটা ওপরে তুলল, শকুন। খোঁড়া শকুন।
ছ্যা ছ্যা ছ্যা। যত অমঙ্গল বাড়িতে ঢোকাচ্ছে। আমি থাকব না, এখানে আর কিছুতেই থাকব না। কালো বেড়াল, খোঁড়া শকুন। বুড়ি সমানে চেঁচিয়ে যেতে লাগল।
গোরক্ষনাথ একটা বড় খাঁচা বের করল। তারপর শকুনের একটা পা থেকে দড়ি খুলে মাটিতে রাখতেই সেটা টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। দড়ির অন্য প্রান্ত একটা গাছের ডালে বেঁধে বলল, এটার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
উঠোনের ওপাশে একটা ছোট্ট ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চিৎকার করল গোরক্ষনাথ, এ কী, তুমি গোটাকয়েক মাছ খেয়েছ বলে মনে হচ্ছে? অর্জুন দেখল, বুড়ি মুখ বন্ধ করে মাথা দোলাল অস্বীকারের ভঙ্গিতে।
গোরক্ষনাথ রান্নাকরা দুটো ছোট মাছ নিয়ে বাইরে এসে শকুনটার সামনে ফেলে দিতেই পাখিটা মুখ ঘুরিয়ে দেখল। ওর মুখ এখনও বাঁধা, গোরক্ষনাথ বাঁধন খুলে দিতেই বোঝা গেল শকুনটা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। নিমেষেই মাছ দুটোকে গলায় পুরে দিল পাখিটা। এবার খাঁচাটাকে নিয়ে বড় ঘরটার ভেতর ঢুকল গোরক্ষনাথ। অর্জুন লক্ষ করল ঘরটির দরজা-জানলা ভাল করে বন্ধ করে রাখা আছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোরক্ষনাথ বেরিয়ে এল। ওর হাতের খাঁচার ভেতর একটা কালো বেড়াল বসে আছে। এমন গাঢ় কালো রঙের বেড়াল কখনও দেখেনি অর্জুন। সে এগিয়ে গেল। এবং তখনই নজরে পড়ল বেড়ালের গলায় একটা কালো কাপড়ের বেল্ট লাগানো রয়েছে। লোমের রঙের সঙ্গে মিশে থাকায় দূর থেকে আলাদা করে বোঝা যায়নি। বেড়ালটা চোখ বন্ধ করে আছে, সম্ভবত অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকায় বাইরের আলো সহ্য করতে পারছে না। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এই সেই বেড়াল?
হ্যাঁ বাবু। ওই বুড়িকে জিজ্ঞেস করে, দেখুন। সন্দীপবাবু গতকালই এটাকে আমার হাতে দিয়ে গেছেন। ভীষণ বদমাশ। দাঁড়ান, পরীক্ষা করি। নিজের জামা খুলে খাঁচাটার ওপর চাপিয়ে দিল গোরক্ষনাথ। বেড়ালটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। দড়ি ধরে শকুনটাকে টানতেই ওটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাঁচার দিকে এগিয়ে আসছিল। একেবারে খাঁচার গায়ে নিয়ে আসার পর গোরক্ষনাথ জামাটাকে তুলে নিতেই বেড়ালটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রাগী আওয়াজ গলা থেকে বের করল। ওর চোখ এই দিনের আলোতেও বোঝা গেল, জ্বলছে। সঙ্গে সঙ্গে শকুনটা চোখ বন্ধ করল। তারপর ধীরে ধীরে পা মুড়ে মাটিতে বসে পড়ল। ওটা বসামাত্র বেড়ালটা শান্ত হয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে পা মুড়ে বসল।
হঠাৎ গোরক্ষনাথ দুহাত তুলে নাচতে লাগল, মিল গিয়া। দুটো পেয়ে গেছি। খোঁড়া শকুন আর কালো বেড়াল। খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছিল সে।
বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল অর্জুন। পরস্পরকে দেখামাত্র এই প্রাণীদুটো এমন আচরণ করল কেন? বেড়ালটার রেগে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরে এই যে সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী ভাব, এটার কারণ কী? শকুনটা যে সেই চোখ বন্ধ করেছে, আর খুলছে না।
অর্জুন হেসে জিজ্ঞেস করল, এবার আপনার কানা কাক দরকার?
হ্যাঁ বাবু। গোরক্ষনাথ গাছগাছালির দিকে তাকাল। সেখানে এখন কোনও কাক নেই। বলল, দেখি এদের টানে সে ব্যাটা যদি এখানে এসে পড়ে–।
অর্জুন বলল, একটা অনুরোধ করছি। আজ সন্ধেবেলায় বাড়িতে থাকবেন।
সন্ধেবেলায়? কেন বাবু?
আপনি যেমন কানা কাকের সন্ধান করছেন আমিও তেমন কিছু করছি। সেটা পেতে আপনার সাহায্য চাই।
ঠিক আছে বাবু, আমি থাকব। গোরক্ষনাথ মাথা নাড়ল।
বাইকে বসে অর্জুনের মনে হল একবার মেজরের খবর নেওয়া দরকার। ওঁরা। খাওয়াদাওয়া করছেন কোথায় সেটা জানা তার কর্তব্য। কিন্তু তার পরেই মনে হল মেজর তো একবারও ওব্যাপারে কথা বলে গেলেন না। সম্ভবত সঙ্গে নিয়ে আসা টিনফুড খেয়ে ওঁদের দিব্যি চলে যাচ্ছে।
বাড়িতে ফিরে এসে সে ফাঁপরে পড়ল। মা একগাদা রান্না করে বড় টিফিন ক্যারিয়ারে ভর্তি করে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন। দুপুর শেষ হয়ে যাচ্ছে অথচ ছেলে বাড়িতে ফিরছে না দেখে পাড়ার একটি ছেলেকে দিয়ে সেই টিফিন ক্যারিয়ার সার্কিট হাউসে পাঠিয়ে দিয়েছেন মেজরের লাঞ্চের জন্যে। মা যে নিজে থেকেই ওঁদের জন্যে রান্নাবান্না করবেন তা অৰ্জুন জানত না। তাই যখন বকুনি শুনতে হল, সে চুপচাপ মেনে নিল। স্নান খাওয়া শেষ করে সে ছুটল সার্কিট হাউসে। এখন বেলা তিনটে। মেজর তাঁর ঘরে নেই। ওঁদের পাওয়া গেল ডাইনিং রুমে। সেখানে দুজন মুখোমুখি বসে। মাঝখানে মায়ের পাঠানো টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিগুলো সাজানো।
ওকে দেখামাত্র মেজর চিৎকার করলেন, আমি জীবনে কখনও দুবার লাঞ্চ করিনি। কিন্তু এরকম খাবার পেলে দুশোবার করতে আপত্তি নেই। ওঃ, কী দারুণ রান্না। ড়ু ইউ নো গোরান, একে বড়ি বলে। তোমার চোদ্দ পুরুষ আজ খুশি হবে, কারণ তুমি বড়ি খাচ্ছ।
হঠাৎ গোরানসাহেব উঠে দাঁড়ালেন। উনি ভুলে গেলেন ওঁর ডান হাত এঁটো সেই অবস্থায় অর্জুনের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি খুব ভাগ্যবান মানুষ। তোমাকে খুব হিংসে হচ্ছে আমার। তুমি এই রান্না রোজ খাও! আহা।
গতকাল থেকে এই লোকটিকে অর্জুন গোমড়া হয়ে থাকতে দেখেছে। বরং কিছু কিছু সময়ে ওঁর অভিব্যক্তি দেখে ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়েছে। কিন্তু এখন ওঁকে এরকম আবেগে আক্রান্ত দেখে বেশ মজা লাগল অর্জুনের। সে বলল, আপনারা বাড়িয়ে বলছেন।
ওঁরা একথা মানতে রাজি নন। চেটেপুটে খাওয়ার পর মেজর বললেন, এখন একটু না গড়িয়ে নিলে অপরাধ হবে ভাই। তুমি জানো, আজ কী করেছি?
কী?
ফিরে এসে এক টিন সার্ডিন মাছ আর পাউরুটি খেয়ে হুইস্কির বোতলটা খুলব খুলব করছি, এই সময় টিফিন ক্যারিয়ার এসে হাজির। ছোকরা বলল, তোমার মা পাঠিয়ে দিয়েছেন। খুলে দেখতে গিয়ে যে চমৎকার গন্ধ নাকে এল, তাতে মনে হল না খেয়ে থাকা যাবে না। কিন্তু গোরান তখন বাথরুমে। হুইস্কি খেতে গিয়ে মনে হল অ্যালকোহল যদি জিভের বারোটা বাজিয়ে দেয় তা হলে রান্নার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হব। তাই তখন থেকে হুইস্কি না খেয়ে বসে ছিলাম। গোরান বের হলে ওকে বললাম, ও প্রথমে যেতে রাজি হচ্ছিল না। তারপর ওর সামনে যখন আমি খাওয়া আরম্ভ করলাম তখন একটু টেস্ট করছি বলে বসে বেশিরভাগটাই মেরে দিল। বুঝলে হে, নিরামিষ রান্না যদি এমন হয় তা হলে হুইস্কি খাওয়ার কোনও মানে হয় না।
অর্জুন হাসল, তা হলে এখন থেকে নিরামিষ শুরু করুন।
আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এই জলপাইগুড়িতে আমি তো সারাজীবন থাকতে পারব না। যাগ গে; তোমার প্রোগ্রাম কী?
ওই যে গোরান রাত্রে হুতুমপুরে যাবে!
গোরানসাহেব হাসলেন, অর্জুন, তুমিও চলো না আমাদের সঙ্গে।
অর্জুন একটু ভেবে নিল। তারপর বলল, আপনারা যে উদ্দেশে যাচ্ছেন সেটার জন্যে রাত একটু গভীর হওয়া উচিত। হুতুমপুরে দশটা নাগাদ পৌঁছলে কোনও আপত্তি আছে? এখান থেকে নটায় বের হওয়া যাবে।
মেজরের যে ঘুম আসছিল তা বোঝা গেল, পাঁচ সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা না ঘুমোলে শরীর ঠিক বুঝতেই পারছ।
মেজর ঘুমোতে চলে গেলে অর্জুন গোরানসাহেবকে জিজ্ঞেস করল, আপনি এখন একটু বিশ্রাম নেবেন না?
না। আমি একটুও ক্লান্ত নই।
চলুন, নীচের লবিতে গিয়ে বসি।
গোরানসাহেব আপত্তি করলেন না। এখন দ্রুত রোদ বদলাচ্ছে। পাশাপাশি বসার পর অর্জুন সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, আপনি ভূতপ্রেত আছে বলে বিশ্বাস করেন?
গোরানসাহেব বললেন, ওয়েল, অবিশ্বাস করার জন্যে অনেকদিন ধরে খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছি, এখনও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।
কেন?
দ্যাখো, এই যে এত মানুষ প্রতিদিন মারা যায়, কোথায় যায়? তোমরা মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেললো, ছাই হয়ে যায়। আমরা সমাধি দিই। মাটিতে মিশে যায়। কিন্তু সেটা তো রক্তমাংসের শরীর। তার? আর কী হয়? যে মানুষটা দীর্ঘকাল পৃথিবীতে হেঁটেচলে বেড়ালো, শরীরের সঙ্গে সঙ্গে তার সবকিছু শেষ হয়ে গেল? বিজ্ঞান মানছে না বটে, কিন্তু তোমাদের শাস্ত্রগুলো, আমাদের পৌরাণিক কাহিনী, ধর্মীয় গ্রন্থগুলোয় আত্মার উপস্থিতি স্বীকার করেছে অনেকবার। এসব যাঁরা লিখেছেন তাঁরা নির্বোধ মানুষ ছিলেন না। দেখবে, কোনও কোনও বয়স্ক মানুষ বলেন তাঁদের আত্মা দেখার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু তাঁরা প্রমাণ দিতে পারেন না। আমি ওই প্রমাণটার খোঁজে আছি। গোরানসাহেব গুছিয়ে কথাগুলো বললেন।
আপনি এখানে এসেছেন ড্রাকুলার সন্ধানে। কিন্তু ড্রাকুলা কনসেপ্ট ভারতবর্ষে কখনও চালু হয়নি। আপনি কি ভুল জায়গায় আসেননি?
আমি জানি না। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমার হাতে একটা ডায়েরি এসেছিল। একজন স্কটিশ টি-প্ল্যান্টার সেই ডায়েরিতে লিখেছেন হঠাৎই তাঁর এলাকায় ড্রাকুলার আবির্ভাব হয়েছে। প্রায় রাত্রেই মানুষকে আক্রমণ করে তার গলায় দাঁত বসিয়ে রক্তপান করছে। এই ডায়েরির কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। মাসখানেক আগে নিউ ইয়র্ক মিরর কাগজের এশিয়ান নিউজে একটা ছোট্ট খবর ছাপা হয়েছিল। মানুষের শরীর থেকে রক্ত চুষে নিয়ে যাচ্ছে ভ্যাম্পায়ার জাতীয় প্রাণী। যে এলাকায় এটা হয়েছে, মিলিয়ে দেখলাম সেটা ওই স্কটিশ টি-প্ল্যান্টার্সের এলাকা।
সে কী! এরকম কোনও খবর আমি এখানকার কাগজে পড়িনি।
তাই?
হ্যাঁ। এমন ঘটনা ঘটলে নিশ্চয়ই হইচই পড়ে যেত।
তা হলে দুটো ব্যাপার হতে পারে। কেউ ভুল খবর পাঠিয়েছে অথবা তোমাদের এখানকার কাগজগুলো খবরটা পায়নি। যাই হোক, আমি জায়গাটায় কিছুদিন থাকতে চাই।
আপনি এর আগে কোনও ড্রাকুলা দেখেছেন?
না। ড্রাকুলা আছে খবর পেয়ে স্পেনের একটি গ্রামে পৌঁছেছিলাম। যে বাড়িতে ড্রাকুলা বাস করত বলে লোকে ভাবত সেটা একটা পোড়ো বাড়ি। কোনও মালিক ছিল না। আমি পৌঁছবার একদিন আগে সরকারি লোকজন বাড়িটাকে ভেঙে মাঠ করে দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম ওই বাড়ির একটা ঘরে কফিনে কঙ্কাল ছিল। গ্রামের লোকজন পেট্রল ঢেলে আগুনে ছাই করে দিয়েছে।
একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
অনায়াসে।
গতকাল আপনি ওই বিষধর শঙ্খচূড়কে খালি হাতে কী করে ধরলেন?
সাপ যখন আক্রমণ করে তখন ভয়ঙ্কর হয়। কিন্তু যেই আত্মরক্ষা করার কথা ভাবে তখনই বোকামি আরম্ভ করে। তা ছাড়া–। কথা শেষ করে হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ করে থেমে গেলেন গোরানসাহেব।
সাপের ওপর আপনার বেশ রাগ আছে, তাই না?
হ্যাঁ। আমি এখনও মনে করি সাপ শয়তানের সঙ্গী। কোনও সাপকে মারতে পারলেই আমি তার মাথা কেটে ফেলি।
কেন?
কারণ মাথা কেটে ফেললে আর কোনও ভয় থাকবে না।
সেই কাটা মাথা কি আপনি সঞ্চয় করেন?
কে বলল তোমাকে?
আমার অনুমান।
হ্যাঁ। আমার বাড়িতে বেশ কয়েকটা জারে সাপের বিভিন্ন ধরনের মাথা ওষুধে ড়ুবিয়ে রাখা আছে। যেখানেই যাই সাপ পেলে মাথা কেটে প্লাস্টিক বাক্সে ঢুকিয়ে ওষুধে ভিজিয়ে রাখি ওই জারগুলোর জন্যে। যাক গে, তুমি আজ কী করছ? প্রোগ্রাম কী?
সন্ধেবেলায় একটা কাজ আছে। বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না।
ঠিক আছে। আমরা নটা নাগাদ এখান থেকে বের হব। ও হ্যাঁ, এর জন্যে কি পুলিশের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে?,
পুলিশকে জানিয়ে যাওয়াই ভাল। আমি আপনাদের হয়ে ওটা জানিয়ে দেব। অর্জুন উঠে দাঁড়াল। ঠিক তখনই সার্কিট হাউসের লনের নুড়ির ওপর একটা ছোট সাপকে এঁকেবেঁকে আসতে দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গে গোরানসাহেব সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখ চকচক করে উঠল। অর্জুন লক্ষ করল ওঁর মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ঝট করে একটা পাথর কুড়িয়ে বৃদ্ধ ছুড়লেন সাপটাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। সাপটা দ্রুত চোখের আড়ালে চলে যেতেই গোরাসাহেবের মুখে হতাশা ফুটে উঠল।
অর্জুন আর কথা না বাড়িয়ে বাইকে উঠে বসল। এই সাপ নির্বিষ, হেলে সাপ। তবু গোরানসাহেব হিংস্র হয়ে উঠেছিলেন। সাপ দেখলে এই ভদ্রলোক আর স্থির থাকতে পারেন না। মানুষের স্বভাব কত বিচিত্র ধরনের।
সোজা থানায় চলে এল অর্জুন। অবনীবাবু তাঁর চেয়ারে ছিলেন। ঘরে ঢুকতেই বললেন, কোথায় ছিলেন মশাই, সারাদিন দেখা নেই।
কেন? কী ব্যাপার? অর্জুন চেয়ারে বসল।
আর বলবেন না। এমন ধড়িবাজ ছেলে, কোনও ক্লু পাওয়া গেল না।
সন্দীপের কথা বলছেন?
হ্যাঁ, আজ সকালে গিয়েছিলাম তদন্ত করার নাম করে। ওঁর মা সত্যি খুব ভালমানুষ। ছেলের জন্যে চিন্তায় আছেন তা বোঝা গেল। কিন্তু অনেক প্রশ্ন করেও হেলের মুখ থেকে কথা বের করতে পারলাম না। মাকে জিজ্ঞেস করলাম বেড়ালটার কথা। তিনি বললেন ওটা ছেলের ঘরেই বন্দি থাকত। রুই মাছের পেটি রান্না হত বেড়ালটার জন্যে। ভাবুন।
ওর বন্ধুদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন?
হ্যাঁ। স্রেফ বলে দিল, আমার বেড়াল চুরি গিয়েছে আর তার সঙ্গে আমার বন্ধুদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি কার সঙ্গে মিশছি সেটা আমার নিজস্ব ব্যাপার। বুঝুন।
অর্জুন ঘড়ি দেখল। সন্ধে হয়ে আসছে। সে বলল, আপনাকে একটু উঠতে হবে। বেশিদূরে যাব না।
আবার কী হল? আটটা নাগাদ এস. পি. সাহেব ডেকেছেন। তাঁকে কৈফিয়ত দিতে যেতে হবে ভাই।
দেবেন। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই হাইওয়েতে ডাকাতির সমাধান চান।
একশোবার। চলুন আমি রেডি।
জিপে উঠে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি আমাকে কোনও প্রশ্ন না করেই চলে এলেন যে! সময়টা তো অকারণে নষ্ট হতে পারে।
পারে। তবে সারাদিন যখন আপনার দেখা পাইনি তখন একটা কিছু না জেনে বলবেন বলে মনে হয় না। অবনীবাবু হাসলেন।
রাস্তায় আলো জ্বলে উঠতেই ওরা গোরক্ষনাথে বাড়িতে পৌঁছে গেল। অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কী ব্যাপার? আসামি এখানে আছে নাকি? আগে বলবেন তো, ফোর্স নিয়ে আসতাম।
না, না। আসামি নেই। সে জিপ থেকে নেমে ভাঙা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল, গোরক্ষনাথবাবু, ও গোরক্ষনাথবাবু।
ভেতর থেকে সেই বুড়ি চেঁচিয়ে বলল, যজমান ডেকে নিয়ে গিয়েছে, এক্ষুনি ফিরে আসবে। দাঁড়াতে বলেছে।
উনি কি কানা কাক পেয়েছেন?
মর, মর। সন্ধেবেলায় যত্তসব অকথা কুকথা। বুড়ি চেঁচাল।
অবনীবাবুকে গল্পটা শোনানো শেষ করা মাত্রই গোরক্ষনাথ এসে গেল। অর্জুনদের দেখে দুটো হাত মাথার ওপর তুলে বলল, অপরাধ মার্জনা করে দেবেন বাবু। আপনাকে কথা দিয়েছি তাই যেতে চাইনি। কিন্তু এমন করে ধরল। বলল, বুড়ি মা আমার সঙ্গে একটু কথা বলবেন।
আপনার যজমান।
ওই আর কি! বাড়ির ঝিটাকে ধরেছে। ধরে আর ছাড়ে। আমাকে গিয়ে শান্তিস্বস্ত্যয়ন করতে হবে। কিন্তু এখনও তো কানা কাক পেলাম না। তিন মাথা এক না হলে তাকে তাড়ানো মুশকিল হবে।
ঠিক আছে। এখন আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
আমাকে? কোথায়?
অবনীবাবু বললেন, সন্দীপ ডায়েরি করেছে তার বেড়াল চুরি গিয়েছে। তুমি অর্জুনকে বলেছ সে নিজে এসে তোমাকে দিয়ে গেছে। বেড়ালটাকে তোমার হেফাজতে পাওয়া গেলে আমার উচিত তোমাকে অ্যারেস্ট করা। তারপর তুমি প্রমাণ করো সন্দীপ মিথ্যে বলেছে।
আপনি বিশ্বাস করুন—। ককিয়ে উঠল গোরক্ষনাথ।
সেটা করব তুমি যদি বেড়ালটাকে নিয়ে আমার গাড়িতে ওঠো।
থানায় নিয়ে যাবেন? কাঁদোকাঁদো গলায় বলল লোকটা।
না। থানায় নয়।
তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে বাঁকের মুখে গাড়ি দাঁড় করালেন অবনীবাবু। এখন চারপাশে ঘন অন্ধকার। জিপের পেছনে বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে গোরক্ষনাথ চুপচাপ বসে আছে। অর্জুন দেখল অন্ধকারে ওটার চোখ জ্বলছে।
অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এই জায়গাটা চলবে?
ঠিক আছে। গাড়িটাকে ওই জঙ্গলের আড়ালে নিয়ে যান।
ওরা নেমে দাঁড়াতে ড্রাইভার নির্দেশ পালন করল।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এটাকে কোলে নিলে কামড়াবে?
বোধ হয়। কাল থেকে ভাব করেছি বলে আমাকে কিছু বলছে না।
অর্জুন বলল, অবনীবাবু, আপনি রাস্তার ওপাশের গাছের আড়ালে চলে যান। আপনি আমার সঙ্গে আসুন।
গোরক্ষনাথকে নিয়ে রাস্তার উলটো দিকে চলে যেতেই হুসহাস গাড়ি বেরিয়ে গেল। অর্জুন গোরক্ষনাথকে বলল, বেড়ালটার গলার কাপড়ের বেল্টের সঙ্গে একটা দড়ি বেঁধে ফেলুন তো?
দড়ি! দড়ি কোথায় পাব?
আপনার ঝোলায় দড়ি থাকা উচিত। ঝোলা খুঁজে হাতকতক লম্বা দড়ি বের করে বেড়ালটার গলায় আটকানো কাপড়ের বেল্টের সঙ্গে ওটা বেঁধে মাটিতে নামিয়ে গোরক্ষনাথ উঠে দাঁড়াতেই দড়ির প্রান্ত অর্জুন নিয়ে নিল।
কী করবেন বাবু?
ওপারে যান। ওখানে থানার বড়বাবুর পাশে এমনভাবে গিয়ে দাঁড়াবেন যাতে কোনও গাড়ি থেকে আপনাকে না দেখা যায়।
গোরক্ষনাথ আদেশ পালন করলে অবনীবাবুর চিৎকার ভেসে এল, ওকে?
ঠিক তখনই একটা অ্যাম্বাসাড়ার গাড়ি বার্নিশের দিক থেকে ছুটে আসছিল। হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। গাড়িটাকে দেখামাত্র বেড়ালটা রাস্তার ওপাশে যাওয়ার জন্যে এগোতেই দড়িতে টান পড়ল। অর্জুন দড়ি ছেড়ে দিতে ওটা তীরের মতো রাস্তার মাঝখানে চলে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে প্রচণ্ড জোরে ব্রেক করে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। বেড়ালটা ক্রুদ্ধ চোখে একবার তাকিয়ে রাস্তার ওপাশে গিয়ে গোরক্ষনাথের সামনে দাঁড়িয়ে ফ্যাঁচ শব্দ করল। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে গাড়িটা চলে যেতেই ওরা আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। অবনীবাবু বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ অর্জুন।