০৭. চুপচাপ বসে আছি

আমি চুপচাপ বসে আছি। এলা আমার সামনে মগভর্তি কফি রেখে গেছে। তাকে আমি কফি দিতে বলি নি। এই কাজটি যে সে করল তার পেছনে কি কোন মমতা কাজ করছে? আমি হাতে মগটা নিলাম কিন্তু চুমুক দিলাম না। আমার কফি খেতে ইচ্ছা করছে না। তবে কফির গন্ধটা ভাল লাগছে।

আমার মাথায় অস্পষ্টভাবে কিছু একটা খেলা করছে। আমি স্বস্তিবোধ করছি না। আমি সামান্য টানেল-কর্মী, কফি-নামক এই মহার্ঘ পানীয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় থাকার কথা না। কিন্তু এই পানীয় আমার এত পরিচিত লাগছে কেন? কেন মনে হচ্ছে ইমা এবং আমি সমুদ্রের কাছে একটা জায়গায় কফির মগ হাতে বসে থাকতাম। সমুদ্র দেখতাম। আমাদের সামনে বাদাম ছড়ানো থাকত। কফির সঙ্গে বাদাম খেতাম। বাদাম ভেঙে দিত ইমা। বাদাম ভাঙার শব্দটা নাকি তার খুব প্রিয়। এইসব কি আমার কল্পনা?

আমি একদিন এলাকে বলেছিলাম, আগুন-গরম কফি দাও এবং বাদাম দাও। কেন বললাম? টানেল-কর্মী হিসেবে বাদাম এবং কফির বিলাসিতা তো আমার ছিল না।

ইমার কথা মনে হলেই কেন তার নাকের বিন্দু বিন্দু ঘামের ছবি মনে আসে। কল্পনার মেয়ের ছবিতে নাকে ঘাম থাকবে না। নাকের ঘাম একটি বাস্তব ছবি। এই ছবি কল্পনার হতে পারে না।

আপনি এত চিন্তিত কেন?

আমি চমকে তাকালাম। এলা প্রশ্ন করছে। আচ্ছা এই প্রশ্নটিও কি সে অভ্যাস-বসে করেছে, না মমতা থেকে করেছে? নিজের উপর বিরক্তি বোধ করছি। মমতা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছি কেন? মমতার জন্যে আমার এই ব্যাকুলতা কেন? টানেল-কর্মীর জীবনে মমতার স্থান নেই। টানেল-কর্মী মমতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমার সিডিসির সঙ্গে কথা বলা দরকার। মহাকাশযানের বিজ্ঞানীরা সিডিসিকে অকেজো করে ফেলার কথা। অকেজো করার পরেও কি আমার সঙ্গে সে কথা বলতে পারবে?

সিডিসি তুমি কি আছ?

আমি আছি।

তোমাকে অকেজো করে ফেলার কথা। এখনো করে নি?

করেছে।

তারা কিভাবে এই কাজটা করেছে?

আমি জানি না কিভাবে করেছে। আমি যা বুঝতে পারছি তা হচ্ছে অসংখ্য মেমরি-সেলে আমি ঢুকতে পারছি না। আমি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছি না। আমি নিজে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। অথচ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তুমি কি এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে?

তোমার গলার স্বর এমন বিষন্ন শোনাচ্ছে কেন?

আমার গলার স্বর আগের মতোই আছে—কোন কারণে তুমি বিশ্ন হয়ে আছ বলে আমার গলার স্বর বিষন্ন লাগছে। তুমি কি বিষন্ন?

হ্যাঁ। সিডিসি তুমি আমার বিষন্নতা দূর কর। তুমি দাবি কর তুমি মানবগোষ্ঠীর বন্ধু। আমি সেই মানবগোষ্ঠীরই একজন। আমার প্রতি কি তোমার মমতা নেই?

আছে। এলা তোমাকে কফি দিয়ে গেল। কেন দিল? আমি দিতে বলেছি বলেই দিল।

সিডিসি আমি আসলে কে?

তুমি ইয়ায়ু।

এখনো বলছ আমি ইয়ায়ু?

হ্যাঁ এখনো বলছি। মহাকাশযানের বিজ্ঞানীরা ভুল করে আমাকে মিথ্যাবাদী সাজিয়েছেন। কম্পিউটার মিথ্যা বলে না। আমি মানুষদের মধ্যে যা ভাল তা শেখার চেষ্টা করি।

আমি তাহলে ইয়ায়ু?

হ্যাঁ।

পৃথিবীতে আমি কোথায় ছিলাম?

সমুদ্রের পাশে ছোট্ট একটা শহরে। শহরের নাম সিন্টো।

ইমা কে?

ইমা বিজ্ঞান কাউন্সিলের একজন সদস্যা। তার দায়িত্ব ছিল তোমার দেখাশোনা করা।

ইমার নাকে কি সবসময় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে থাকত?

তা তো আমি বলতে পারব না। ইমার ব্যাপারটা আমি জানি তোমার স্মৃতি থেকে। তোমার স্মৃতির বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। খুব সামান্যই আছে।

স্মৃতি নষ্ট হয়েছে কেন?

নষ্ট করা হয়েছে বলেই নষ্ট হয়েছে।

কে নষ্ট করেছে, তুমি?

হ্যাঁ আমি। ইয়ায়ুর স্মৃতি নষ্ট করে সেখানে এক টানেল-কর্মীর স্মৃতি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া মস্তিষ্কের অনেক নিউরোন নষ্ট হয়। মেমোরি-সেল ওলটপালট হয়। যে পদ্ধতিতে এটা করা হয় তার নাম—এম সি জাংশান ইন্টারফেরেন্স রি এন্ট্রি।

এই কাজটা তুমি কখন কর?

মহাকাশযানে আপনি উঠে আসার পর। এটি একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং জটিল প্রক্রিয়া। আমি যা বলছি আপনি কি তা বিশ্বাস করছেন?

করছি। সামান্য কিছু খটকা আছে। খটকাগুলি দূর কর।

বলুন দূর করছি।

মহাকাশযানে ঢোকার আগ পর্যন্ত আমি ছিলাম ইয়াষু। অর্থাৎ মহাকাশযানে আমি ইয়ায়ু হিসেবেই ঢুকেছি। তুমি পরে আমার মাথায় অন্যের স্মৃতি ঢুকিয়েছ। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাকে টানেলে খবর দেয়া হল। রেড-কার্ড দেয়া হল। স্টেশন ফাইভে যেতে বলা হল…

আমি এমন একজন টানেল-কর্মীর স্মৃতি তোমার মস্তিষ্কের নিওরোনে ঢুকিয়েছি যে এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। স্টেশন ফাইভ মহাকাশযানের স্টেশন নয়। স্টেশন ফাইভে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা করা হয়। এদের স্মৃতি অংশত নষ্ট করে দেয়া হয়।

কিন্তু আমার মনে আছে একটি মেয়ে আমাকে বলছে—কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে মহাকাশযান এন্ড্রোমিডা…এইসব।

এই অংশটুকু তোমার মস্তিষ্কের কল্পনা। মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত জটিল এবং বিস্ময়কর বস্তু। এই মস্তিষ্ক স্মৃতির শূন্যস্থান কল্পনায় পূর্ণ করে নেয়। মানব মস্তিষ্ক শূন্যতা অপচ্ছন্দ করে। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ।

হ্যাঁ।

তোমার স্মৃতি নষ্ট করে কেন সাধারণ একজন টানেল-কর্মীর স্মৃতি ঢুকিয়ে দেয়া হল তা জানতে চাচ্ছ না কেন?

তুমি নিজেই বলবে এই জন্যে জিজ্ঞেস করছি না।

আমি চাচ্ছিলাম যেন মিশনটা বাতিল হয়। যেন আপনাকে রাদের হাতে তুলে দেয়া না হয়। আপনি যথেষ্টই বুদ্ধিমান। আশা করি আপনি ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছেন অতি বুদ্ধিমান প্রাণী রা মানবগোষ্ঠীর যে কোন একজন প্রাণী চায় নিচেয়েছে আপনাকে। আপনাকে তাদের পছন্দ হয়েছে আপনার ডি.এন.এ দেখে। সেই ডি.এন.এ-তে বিশেষ কিছু তারা খুঁজে পেয়েছে। এই বিশেষ কিছু অবশ্যই মানবগোষ্ঠীর জন্যে মঙ্গলজনক। কারণ অতিজ্ঞানী প্রাণীরা অমঙ্গল নিয়ে কাজ করবে না। তারা মঙ্গল চাইবে। আপনাকে পেয়ে তারা কি করবে সেটা বলি আপনার ডি.এন.এ ব্যবহার করে নতুন এক মানবগোষ্ঠী তৈরি করবে। আপনার ডি.এন.এ থেকেই ছেলে বা মেয়ে-ক্লোন তৈরি করা কোন সমস্যাই নয়। সেই মানবগোষ্ঠী হবে অনেক ক্ষমতাধর, অনেক শক্তিমান।

আমি তো এই চাওয়াতে কোন অন্যায় দেখছি না।

অন্যায় দেখা না দেখা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। ওরাও নিশ্চয়ই কোন অন্যায় দেখছে না। কিন্তু আমি দেখছি।

বুঝিয়ে বল।

এদের তৈরি নতুন মানবগোষ্ঠীর জন্যে এরাই আশ্ৰয় খুঁজে বের করবে সেই আশ্ৰয় অবশ্যই পৃথিবী। কারণ নতুন মানবগোষ্ঠীর শারীরিক গঠন পৃথিবীরই উপযুক্ত। কাজেই তাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে পৃথিবীর আগের মানুষগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই কাজটা তারা করবে ঠাণ্ডা মাথায়। যারা অতিজ্ঞানী তাদের কাছে ভবিষ্যতের মঙ্গলই প্রধান। ভবিষ্যতে কল্যাণকর হবে এই ভেবে বর্তমানের অমঙ্গল তারা উপেক্ষা করবে।

তুমি যা বলছ সবই অনুমাননির্ভর।

অনেকটা অনুমান, তবে সবটা না। রা সম্পর্কিত একটি তথ্য আপনাকে দেয়া হয় নি—তারা ক্লোনসম্প্রদায়। তাদের মধ্যে একসময় পুরুষ বা নারী ছিল। এখন নেই। এখন সবাই পুরুষ বা সবাই নারী। তাদের চিন্তা চেতনা সব একই রকম।

এই তথ্য কোত্থেকে পাওয়া?

এই তথ্য রা সম্প্রদায়ই আমাদের দিয়েছে। লগবুকে রেকর্ড করা আছে। শুরুতে আপনাকে এই তথ্য জানানো হয় নি, কারণ বিজ্ঞান কাউন্সিল এই তথ্যকে ক্লাসিফায়েড ঘোষণা করেছে।

ক্লাসিফায়েড ঘোষণা করার কারণ কী? রা সম্প্রদায় শুধু যে ক্লোন-সম্প্রদায় তাই নয় তারা দেখতে অতি কদাকার। অনেকটা পৃথিবীতে কুৎসিত প্রাণী বলে বিবেচিত মাকড়সার মতো। তাদের প্রকাণ্ড এক মস্তিষ্ক। এগারোটি পা বা হাত সেই মস্তিষ্কের ভর বহন করে। বিজ্ঞান কাউন্সিল ভেবেছে এই জাতীয় প্রাণীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার ব্যাপারে পৃথিবীর মানুষ উৎসাহিত হবে না। কাজেই তারা এই তথ্য গোপন রাখতে বলেছে। আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?

করছি।

ক্লোন-সম্প্রদায় চাইবে নিজেদের মতো ক্লোন-সম্প্রদায় সৃষ্টি করতে। সেটাই স্বাভাবিক। তাদের কাছে যা স্বাভাবিক মনে হয়েছে আমার কাছে তা স্বাভাবিক মনে হয় নি। মানবগোষ্ঠীর বিকাশ ক্লোনের মাধ্যমে হওয়া ঠিক হবে না। কাজেই আমাকে একটা কৌশল ভেবে বের করতে হয়েছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি আমার কৌশল ধরতে পেরেছেন।

হ্যাঁ ধরতে পেরেছি। আমি মহাকাশযানের বিজ্ঞানীদের কাছে টানেল-কর্মী হিসেবে পরিচয় দিলাম। তুমি বললে আমি ইয়ায়ু। তুমি সত্যি কথাই বললে–কিন্তু এই সত্যি কথাটি মিথ্যার মতো উপস্থিত করলে। তুমি ভেবেছিলে যখন মহাকাশযানের বিজ্ঞানীরা জানবেন একটি মানুষকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন মিশন বাতিল হয়ে যাবে।

হ্যাঁ তাই।

তোমার পরিকল্পনা কাজ করে নি—তারা আমাকে ঠিকই নিয়ে যাচ্ছে।

হ্যাঁ যাচ্ছে। তাদের সামনে আছে হাইপার ডাইভ পদ্ধতির লোভনীয় প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির কাছে সাধারণ একজন মানুষের জীবন কিছুই না।

সিডিসি!

জ্বি বলুন।

এত মানুষ থাকতে ইয়ায়ু ভলেন্টিয়ার হতে রাজি হল কেন?

সে রাজি হয় নি—তাকে জোর করে রাজি করানো হয়েছে। বিজ্ঞান কাউন্সিল অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। ইয়ায়ুর বিশেষ ধরনের ডি.এন.এ-র কারণে জন্মের পর থেকেই বিজ্ঞান কাউন্সিলের বিশেষ তত্ত্বাবধানে ছিল।

তোমাকে আমার শেষ প্রশ্ন ইমা কি আমাকে রাদের কাছে পাঠানোর ব্যাপারে কোন ভূমিকা পালন করেছে?

হ্যাঁ। সে সেই দায়িত্ব খুব ভালভাবেই পালন করেছে।

রাদের মহাপরিকল্পনা পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়ার কোন পথ কি এখনো খোলা আছে?

হ্যাঁ আছে। আপনার শরীরের প্রতিটি কোষ নষ্ট করে দিতে হবে। যেন একটি জীবিত কোষও না থাকে। শান্তি-রোবট আপনার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আপনি যদি তাকে বলেন—সে আপনার শরীরে ভেনাডিয়াম সিরাম ঢুকিয়ে দেবে। যা শরীরের প্রতিটি কোষ নষ্ট করে দেবে।

তুমি শান্তি-রোবটকে বলে দাও।

মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে আমি যুক্ত হতে পারি না। সেই মৃত্যু সমগ্র মানবগোষ্ঠীর কল্যাণ নিয়ে এলেও না। এই কাজটি আপনাকেই করতে হবে। অবশ্যি আপনি যদি ভাবেন এই কাজটি করা প্রয়োজন।

ভেনাডিয়াম সিরাম শরীরে ঢোকার কতক্ষণ পর আমার মৃত্যু হবে?

ধরুন কুড়ি মিনিট। প্রতিটি কোষ ধ্বংস হবে বলে সময় বেশি নেবে। মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হবে সবার পরে। কাজেই আপনি প্রায় কুড়ি মিনিট চিন্তা করার সময় পাবেন।

কী চিন্তা করব?

যে চিন্তাই করুন-না কেন তা হবে বিশুদ্ধ চিন্তা। কুড়ি মিনিট বিশুদ্ধ চিন্তার জন্যে অনেক সময়।

আমি শান্তি-রোবটের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি আমার শরীরে ভেনাডিয়াম সিরাম ঢুকিয়ে দাও। ঘরের বাতি নিভিয়ে দাও-আলো চোখে লাগছে।

 

আমি লম্বা হয়ে শুয়ে আছি। ভেনাডিয়াম সিরাম নামের ভয়ংকর কোন বিষ আমার শরীরে ঢুকে গেছে। বিষ তার কাজ করতে শুরু করেছে। শরীরে কোষ নষ্ট করে দিচ্ছে। তীব্র ব্যথা বোধ করার কথা, তা হচ্ছে না। ব্যথা বোধ করার সিগন্যাল মস্তিষ্কে পৌঁছতে পারছে না। আমার কাছে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর আমি যেন বিশ্রাম নেবার জন্যে ঠাণ্ডা কোন ঘরে শুয়ে আছি। ঘরটা শুধু যে ঠাণ্ডা তা না, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। আমার শরীর কাঁপছে। একবার ইচ্ছা হল। সিডিসিকে বলি গায়ের উপর কম্বল দিয়ে দিতে। তারপরই মনে হল হাজারও কম্বল দিয়েও কোন লাভ হবে না। এই শৈত্যের জন্য আমার শরীরে কোষের কেন্দ্রবিন্দুতে। উষ্ণতার সেখানে পৌছার কোন উপায় নেই।

সিডিসি আমাকে বলেছে বিশুদ্ধ কোন চিন্তা করতে। বিশুদ্ধ চিন্তা বলতে সে কী বোঝাতে চায়? সুন্দর চিন্তাগুলিই কি বিশুদ্ধ চিন্তা? মানুষ কী? এই অনন্ত নক্ষত্ৰবীথিতে সে কেন এসেছে? সে কোথায় যাবে? এইসব চিন্তা কি বিশুদ্ধ চিন্তা?

না কি ইমাকে নিয়ে চিন্তাটাই হবে বিশুদ্ধ চিন্তা? মানুষের কোষের কেন্দ্রে দুটি ডি.এন.এ জড়াজড়ি করে থাকে। একটি এসেছে তার বাবার কাছ থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে সে পুরুষ। অন্যটি মার কাছ থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে সে মেয়ে। সেই অর্থে আমরা কি ধরে নিতে পারি না যে সন্তানের প্রতিটি কোষের কেন্দ্রে তার পিতা ও মাতা গভীর ভালবাসায় জড়াজড়ি করে থাকেন?

ইমার সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হত যদি আমাদের একটি সন্তান হত তাহলে তার শরীরের প্রতিটি কোষের কেন্দ্রে আমি এবং ইমা জড়াজড়ি করে থাকতে পারতাম।

সিডিসি!

জ্বি।

আমার হাতে আর কতক্ষণ সময় আছে?

উনিশ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড।

সেকি মাত্র বিশ সেকেন্ড পার হয়েছে। আমি বিশ সেকেন্ডে এত কিছু ভেবে ফেলেছি?

বিশ সেকেন্ড অতি দীর্ঘ সময়।

মহান সুরার সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছা করছে।

কথা বলুন। কিন্তু তাকে এখানে আসতে বলা ঠিক হবে না।

 

পর্দায় সুরার মুখ ভেসে উঠল। তিনি অবজারভেশন ডেকে বসে আছেন। ভুরু কুঁচকে আছে তাঁর। হয়ত কোন জটিল বিষয় নিয়ে চিন্তা করছেন। আমি কথা বলে মহান পদার্থবিদের চিন্তায় হয়ত বাধা সৃষ্টি করব? শাস্তিমূলক কোন অপরাধ করে ফেলব।

মহান স্রুরা।

তিনি চমকে তাকালেন, এবং হাসলেন। আমি যে বিচিত্র ভঙ্গিতে শুয়ে আছি। তা বোধহয় তার চোখে পড়ল না। চোখে পড়লেও কৌতূহলী হলেন না। মহানপর্যায়ের বিজ্ঞানীদের সাধারণ বিষয়ে কৌতূহল থাকে না।

ও তুমি!

আপনি কি ডিটেকটিভ উপন্যাসটা শেষ করেছেন?

হ্যাঁ শেষ করেছি। খুবই মেজাজ খারাপ হয়েছে।

শেষটা ভাল হয় নি?

লেখক শেষের দিকে এসে সবকিছু এলোমেলো করে ফেলেছেন।

সমাধানটা কে চুরি করেছে?

যে সমীকরণের সমাধান করেছে সেই পদার্থবিদই করেছে। মাছই চুরি করেছে মাছের ডিম।

কেন?

আমিও তো তাই বলছি কেন? এতটা সময় বইয়ের পেছনে দিয়েছি। তারপর এই অবস্থা। এই লেখকের অবশ্যই জরিমানা হওয়া উচিত।

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, মহান সুরা আপনাকে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি।

হ্যাঁ কর।

বুদ্ধি আসলে কী?

বুদ্ধির সংজ্ঞা জানতে চাচ্ছ?

হ্যাঁ।

বুদ্ধির নানান সংজ্ঞা আছে। যে-সব প্রাণীদের হাতে প্রযুক্তি আছে, তাদের বুদ্ধিমান বলা হয়। প্রকৃতির রহস্য যারা বুঝতে পারে তাদের বুদ্ধিমান বলা হয়। প্রকৃতিকে যারা বুঝতে চেষ্টা করে তাদেরও বুদ্ধিমান বলা হয়।

আমি আপনার সংজ্ঞা জানতে চাচ্ছি।

আমি এইসব নিয়ে ভাবি না।

আপনি কি নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করেন?

না মনে করি না। কারণ কি জান? কারণ মাঝে মাঝে আমি কিছু বুদ্ধির কাজ করে ফেলে নিজে খুবই বিস্মিত হই। যে বুদ্ধিমান সে নিজের বুদ্ধিতে বিস্মিত হবে না। বোকারাই হবে। এই ধর তিন মিনিট আগে দারুণ বৃদ্ধির একটা কাজ করেছি।

কাজটা কি আমি জানতে পারি?

হ্যাঁ পার। রা সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য তিন মিনিট আগে আমি ধরতে পেরেছি। তিন মিনিট আগে আমার মাথায় দপ করে একশ পাওয়ারের একটা বাহু জ্বলে উঠল। আমি মনে মনে বললাম, তাইতো। তোমাকে বুঝিয়ে বলি। রা সম্প্রদায় সবসময় বলেছে মানবমস্তিষ্ক হাইপার ডাইভ পদ্ধতির জন্যে প্রস্তুত না। তারপর হঠাৎ তারা বলল মানবগোষ্ঠীকে এই প্রযুক্তি গ্রহণের উপযোগী করে দেবে। এবং এই প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে। এর মানে কী এই নয় যে তোমার ডি.এন.এ ব্যবহার করে তারা ক্লোন-সম্প্রদায় সৃষ্টি করবে? প্রযুক্তি হস্তান্তর হবে তাদের হাতে। তোমার ডি.এন.এ তে বিশেষ কিছু আছে তা তো আমাদের বলা হয়েছে। দুইএ দুই-এ চার মিলে যাচ্ছে না!

হ্যাঁ মিলে যাচ্ছে।

আমি লিলিয়ানকে আমার ধারণার কথা বলেছিলাম। সে জরুরি অধিবেশন ডেকেছে। এইসব অধিবেশন আমার খুব অপছন্দ বলেই আমি অবজারভেশন ডেকে বসে আছি। তবে আমার ধারণা কাউন্সিল আমার যুক্তি গুরুত্বের সঙ্গে নেবে। এবং আমি নিশ্চিত যে মিশন বাতিল হয়ে যাবে। আমরা রওয়ানা হব পৃথিবীর দিকে। পৃথিবীতে ফিরে আমি কি করব জান?

না।

ডিটেকটিভ বইয়ের লেখককে খুঁজে বের করব এবং এমন সব কঠিন কথা বলব যা তার ইহজীবনে শোনে নি।

মহান সুরা আপনি মানুষটা খুবই অদ্ভুত।

খুব না সামান্য অদ্ভুত। আমরা সবাই অদ্ভুত।

আমি এখন আপনার কাছে থেকে বিদেয় নিচ্ছি।

 

আমার শীত-ভাব আরো বেড়েছে। শীতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্লান্তি। সীমাহীন ক্লান্তি। যেন কয়েকশ বছর ধরে আমি ঘুমুচ্ছি না—সব ঘুম একসঙ্গে আমার চোখে নেমে আসছে। সিডিসি কিছুক্ষণ আগে আমাকে জানিয়েছে যে মিশন বাতিল হয়েছে। মহাকাশযান ফিরে যাচ্ছে পৃথিবীতে। এবং সিডিসিকে সব তার পূর্ণ ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।

আমি বললাম, খুব আনন্দময় একটি সংবাদ তাই না সিডিসি?

সিডিসি বলল, হ্যাঁ আনন্দময় এবং মঙ্গলময়।

তুমি যা চেয়েছিলে তাই হল।

হ্যাঁ তাই হয়েছে। তবে আমি এভাবে চাই নি।

আমার হাতে আর কতক্ষণ আছে?

এখনো সাত মিনিট আছে।

অনেক সময় তাই না?

হ্যাঁ। অনেক সময়।

বুদ্ধি সম্পর্কে তোমার ধারণাটা কী? তোমার ধারণাটা জানতে ইচ্ছা করছে। কাদের তুমি বুদ্ধিমান প্রাণী বলবে?

সিডিসি উত্তর দিতে সময় নিল। তার মতো ক্ষমতাবান কম্পিউটারের এত সময় নেবার কথা না। একসময় নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, আমার মতে যে প্রাণীগোষ্ঠীর ভালবাসার ক্ষমতা যত বেশি সেই গোষ্ঠী তত বুদ্ধিমান।

তোমার মাপকাঠিতে মানুষের বুদ্ধি কেমন?

ভালবাসার মাপকাঠিতে এই অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী নেই।

আমি হাসতে-হাসতে বললাম, মানুষ তোমাকে বানিয়েছে বলেই হয়ত মানুষের প্রতি তোমার এই পক্ষপাতিত্ব।

হতে পারে। মহান লিলিয়ান আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চান। তিনি সরাসরি এখানে আসতে চাচ্ছেন। আমি কি তাকে আসতে দেব?

তিনি কি আমার অবস্থা জানেন?

হ্যাঁ তাকে জানানো হয়েছে। তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছেন।

অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছেন এটা তুমি কি করে বলছ? দুঃখ মাপার কোন যন্ত্র তো তোমার কাছে নেই।

আপনার ব্যাপারটা তাঁকে বলার পর থেকে তিনি নিতান্তই শিশুদের মতো কাঁদছেন। এই থেকেই বলছি। আমি কি তাকে আসতে দেব?

হ্যাঁ দাও।

 

লিলিয়ান আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সিডিসি ভুল বলে নি—এই মেয়েটি সত্যি-সত্যি কেঁদে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, পৃথিবীর সবচে রূপবতী পদার্থবিদ, আপনি কেমন আছেন?

লিলিয়ান আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে এসেছি।

আমি হাসিমুখে বললাম, ক্ষমা প্রার্থনা করার মতো কোন অপরাধ আপনি করেন নি। আপনাদের দীর্ঘ কাউন্সিল অধিবেশনে আপনি আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন—এই অপরাধটুকু আপনি করেছেন। সেই অপরাধের জন্যে অনেক আগেই আপনাকে ক্ষমা করেছি।

লিলিয়ান কোমল গলায় বললেন, আমি কি আপনার মাথায় আমার হাত রাখতে পারি?

আমি বললাম, না। অনেককাল আগে আমি ইমা নামের একটি মেয়েকে কথা দিয়েছিলাম বাকি জীবনে আমি কোন মেয়েকে আমার শরীর স্পর্শ করতে দেব না। আমি এই প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে চাই না। ইমার ভালবাসাটা ভালবাসা ছিল না, ভালবাসার অভিনয় ছিল। তাতে কী? আমার ভালবাসায় কোন খাদ ছিল না। আমি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করব।

আমি লক্ষ করলাম আমার শরীর থেকে শীত-ভাবটা হঠাৎ চলে গেছে। অকল্পনীয় এক প্রশান্তি আমার উপর ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। গভীর এক আনন্দ অনুভূতি। এখন আর চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চোখের কোষগুলি হয়ত মরতে শুরু করেছে। আমি বোধহয় মৃত্যুর দ্বিতীয় এবং শেষ পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছি।

সিডিসি।

জ্বি।

আমার একটা চন্দ্রগীতি শুনতে ইচ্ছা করছে।

কোটা শুনতে চান?

তোমার পছন্দের একটা চন্দ্রগীতি হলেই হবে। সিডিসি শোন-আমি যদি বিজ্ঞান কাউন্সিলের মেম্বার হতাম তাহলে তোমাকে মানুষের মর‍্যাদা দেবার কথা কাউন্সিলে বলতাম।

সিডিসি বিষাদমাখা গলায় বলল, আমার অবর্ষণের কোন ক্ষমতা নেই। আমার যদি অশ্রুবর্ষণের ক্ষমতা থাকত তাহলে অবশ্যই আপনার এই আবেগপূর্ণ কথায় অবর্ষণ করতাম।

চন্দ্রগীতি শুরু হয়েছে। আহা কী অপূর্ব সুর! এই সুর মানুষের সৃষ্টি, এই অপূর্ব জাদুকরী কণ্ঠও মানুষেরই। মানবগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে চন্দ্রগীতি শুনে অহংকারে আমার হৃদয় সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলে উঠেছে।

অপূর্ব একটি সংগীত শুনতে-শুনতে আমার জীবনের ইতি হবে এরচে সুখের মৃত্যু আর কী হতে পারে?

(চন্দ্ৰগীতি)
তুমি যা কর তাই আমার ভাল লাগে।
তুমি প্ৰচণ্ড ঘৃণা নিয়ে যখন তাকাও।
তখন সেই ঘৃণাটাকেও মধুর মনে হয়।
এ আমার কেমন অসুখ হল?
হে চন্দ্ৰ! তুমি তো সব অসুখ সারিয়ে দাও,
দয়া করে এই অসুখটা সারিও না।
এই অসুখেই যেন আমার মৃত্যু হয়।

লিলিয়ান এখনো কাঁদছেন। লিলিয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এলা, এলার পাশে শান্তি-রোবট। শান্তি-রোবটের কদাকার মুখটাও এখন সুন্দর লাগছে। সুন্দরের পাশে যে দাড়ায় তাকেও সুন্দর লাগে।

আমি লিলিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম, মহান পদার্থবিদ লিলিয়ান! আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করব যদি আপনি আমার কপালে হাত রাখেন।