চীন-গভর্নমেন্টের কাছ থেকে তারের জবাব এসে গেল দিন-পনেরোর মধ্যেই।
চীন-গভর্নমেন্ট জানিয়েছেন যে, চীনে দুটো দল ছিল। এক দলের নাম কুয়োমিং-তান, আর এক দলের নাম কমুনিস্ট। আর একটি ছোট দলের নেতা হচ্ছে আঃ ওয়াং। কমুনিস্ট ও কুয়ো-মিং-তান দল দুটো ও ডাঃ ওয়াং-এর দল পরে একত্রে সংঘবদ্ধ হয়; কিন্তু ডাঃ ওয়াং-এর চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের জন্য সে তখন আর তাদের সঙ্গে মিলে-মিশে থাকতে পারল না। সে নিজেই একটা পৃথক দল গড়ে তুলল।
কিন্তু এই দল গড়ার পর থেকেই তার যে মূল উদ্দেশ্য, দেশের সেবা করা, তা থেকে ভ্রষ্ট হয়ে গেল ডাঃ ওয়াং। সে আরম্ভ করল একের পর এক হত্যাকাণ্ড।
হত্যা করতে লাগল একের পর কে বিরোধী দলের নেতাদের। এবং তাদের মৃতদেহে কোথাও কোন বিশেষ ক্ষতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, কেবল তাদের গলার চারপাশে কয়েকটা রক্তবিন্দুর মত দাগ দেখা গেছে, আর নিহত লোকদের পকেটে পাওয়া গেছে একখানি করে খাম; তাতে বিষাক্তগন্ধী ভয়ঙ্কর ড্রাগনের ছবি আঁকা ছিল। চীন গভর্নমেন্ট তখন ডাঃ ওয়াং এর দলটাকেই ড্রাগন কোম্পানী নাম দিয়েছিলেন।
চীন গভর্নমেন্ট আরও জানিয়েছে যে, ডাঃ ওয়াং-এর তৎকালীন একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, অর্থ সংগ্রহ করা। এবং বিরোধী দলের নেতারা ছাড়াও দেশের ধনিক সম্প্রদায়ের লোকও কিছু তার হাতে নিহত হয়েছেন। ডাঃ ওয়াং তাদের সকলের কাছ থেকেই ভয় দেখিয়ে বেশ মোটা টাকা রোজগারের চেষ্টা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে সে কৃতকার্য হয়েছিল।
ডাঃ ওয়াং উচ্চশিক্ষিত; রসায়নশাস্ত্র ও প্রাণিবিদ্যায় সে সুপণ্ডিত। চীন গভর্নমেন্টের বিশ্বাস, লোকটা ইচ্ছা করলে হয়ত কাদামাটি দিয়েও কামান-গোলা তৈরী করতে পারে, অথবা কেঁচো বা কৃমিকে দিয়েও অনেক কাজ করিয়ে নিতে পারে।
তাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য চীন গভর্নমেন্ট এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সংবাদ পেয়েছে ডাঃ ওয়াং নাকি এখন দক্ষিণে-আরব দেশে অথবা ভারতবর্ষে পাড়ি জমিয়েছে।
চীন গভর্নমেন্ট সর্বশেষে তার চেহারা ও শিক্ষাদীক্ষার বর্ণনা দিয়ে জানিয়েছে, ডাঃ ওয়াং অতি ভয়ঙ্কর লোক।
ডাঃ ওয়াং-এর সম্বন্ধে এখন সব কিছু জানলেন তো মিঃ রামিয়া? কিরীটী বললে।
একটু হেসে মিঃ রামিয়া বললেন, হ্যাঁ, জানলুম। এখন কি করতে চান মিঃ রায়?
চলুন একবার মিঃ ডিবরাজের বাড়ি যাব,-হয়ত এতদিনে তিনি এসেছেন–
বেশ চলুন–
গাড়িতে যেতে যেতেই মিঃ রামিয়া বললেন, আপনার কথামত মিঃ রায় সেইদিন থেকেই মিঃ ডিবরাজের বাড়ির আশেপাশে পাহারা বসিয়েছি বটে, কিন্তু তিনি তা জানেন না। সাদা। পোশাকে কয়েকটা লোক দিনরাত তার বাড়ির দিকে লক্ষ্য রাখছে।
ডিবরাজ লোকটা একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। শহর হতে একটু দূরে নির্জন সমুদ্রের ধারে একটা নির্জন বাগানবাড়ি তৈরী করে সেখানে থাকেন।
দূরে সমুদ্রতীরে কতকগুলো পাম বা সুপারি-জাতীয় লম্বা গাছের সারি দেখা যায় বাড়ি থেকে।
সমুদ্রের কোল ঘেঁষে জুয়েলার ডিবরাজের বাংলো-ধরনের বাগানবাড়ি।
বাড়ির চারপাশে নানাজাতীয় ফল ও ফুলের গাছ। বাড়ির সীমানার চারপাশে প্রাচীর নয়, দুর্ভেদ্য কাঁটাতারের জালের বেড়া প্রায় মানুষ-সমান। সেই তারের গায়ে গায়ে লতিয়ে উঠেছে ঘন হয়ে আইভিলতা।
মধ্যে মধ্যে ফুল ধরেছে।
গেট পার হয়েই একটু এগুতেই চোখে পড়ল পশ্চিমমুখী বাংলোর পিছন দিকে—দুরে নীল সাগরের অনেকটা। এবং তার সামনেই সার সার নারিকেল গাছ।
বাংলোতে প্রবেশের মুখেই একটিমাত্র লোহার গেট।
গেটের পাঠান দারোয়ান বন্দুকধারী—সে আগে থাকতেই মিঃ রামিয়াকে চিনত বলে কোন বাধা দেয়নি।
এবং তার কাছেই জানতে পেরেছিল ওরা, মিঃ ডিবরাজ গৃহেই আছেন।
বাংলোর সামনে অনেকখানি জায়গা নিয়ে নানা ধরনের ছোট বড় মাঝারি ফুলফলের গাছ-দূরে আউটহাউস।
হঠাৎ একটা কুকুরের ডাক শোনা গেল-তারপরই দেখা গেল বিরাট ধূসর রংয়ের একটা অ্যালসেসিয়ান ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।
ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল।
কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করছে।
হয়ত ওদের আক্রমণই করত কিন্তু তার আগেই বাগানের একাংশ থেকে একটি বাইশতেইশ বছরের তরুণী হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে এল।
সিজার-সিজার-স্টপ্-স্টপ্-
কুকুরটা থেমে গেল।
ওরা নিশ্চিন্ত হয়।
তরুণী আরো একটু এগিয়ে আসে।
রোগা পাতলা চেহারা—গায়ের বর্ণ গৌর—তাতে যেন সামান্য লালচে আভা।
চোখ মুখ যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা।
পরনে সালওয়ার পাঞ্জাবি-বেণীর আকারে মাথার চুল বুকের ওপরে দুলছে। পায়ে চপ্পল।
আপ লোগন কিধার সে আতে হেঁ?
মিঃ ডিবরাজ আছেন? ইংরাজীতে প্রশ্ন করলেন মিঃ রামিয়া।
জী হাঁ-ডাড়ি পারলার মে হ্যায়—
কিরীটী মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল তরুণীর দিকে।
আমি ইনসপেক্টার রামিয়া-মিঃ ডিবরাজের সঙ্গে দেখা করব বলে—
আইয়ে-তরুণী আহ্বান জানাল।
চলিয়ে রায় সারামিয়া ডাকল।
আঁ-হ্যাঁ চলুন—দুজনের চোখাচোখি হল।
মুহূর্তকাল দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থেকে দুজনেই দৃষ্টি নত করল।
আসুন-তরুণী এবারে ইংরাজীতে বললে।
গাড়িবারান্দার সামনে বারান্দা-দুধপ সিঁড়ি-তরুণী আগে আগে চলেছে-সঙ্গে সিজার-আর পিছনে পিছনে মিঃ রামিয়া আর কিরীটী।
পারলারের মধ্যে ওদের নিয়ে তরুণী প্রবেশ করল পর্দা তুলে। ঘরের মধ্যে মিঃ ডিবরাজ একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
তরুণী ডাকল, ড্যাডি–
ইয়েস মাই চাইল্ড—
তোমার সঙ্গে মিঃ রামিয়া পুলিস ইনসপেক্টার দেখা করতে এসেছেন—
মিঃ ডিবরাজ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন, আসুন আসুন ইনসপেক্টার সাহেব—
যার সঙ্গে কথা বলছিলেন তাকে বিদায় দিলেন মিঃ ডিবরাজ।
মিঃ ডিবরাজের বয়স পঞ্চাশের উপরেই হবে।
দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারাটকটকে গৌরবর্ণ। মাথার সামনের দিকে সামান্য টাক–পরিধানে পায়জামা ও পাঞ্চাবি।
চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।
কৃষ্ণা! মিঃ ডিবরাজ ডাকলেন।
ড্যাডি।
ভিতরে গিয়ে কিছু চা-জলখাবার পাঠিয়ে দাও কৃষ্ণা।
কৃষ্ণা যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। কিরীটীর সঙ্গে আবার চোখাচোখি হল। মুহূর্তের জন্য–তারপর ধীরপায়ে সে কক্ষ ত্যাগ করল।
বসুন ইনসপেক্টার–
আলাপ করিয়ে দিই—মিঃ কিরীটী রায়-কলকাতা শহরের একজন নামকরা বেসরকারী গোয়েন্দা-আর ইনিই মিঃ ডিবরাজ।
নমস্তে। ডিবরাজ হাত তুললেন।
নমস্তে। কিরীটী হাত তুলল।
বসুন—be seated please!
ওরা বসল।
মিঃ ডিবরাজ বললেন, আমি ছিলাম না, ব্যবসার ব্যাপারে হংকং গিয়েছিলাম—এসে শুনলাম আপনি আমার খোঁজে এসেছিলেন। অবিশ্যি আপনি আজ না এলেও আপনার ওখানে আজই একটু পরে আমি যেতাম–
মিঃ ডিবরাজ, কিরীটী বললে, কোন চিঠি পেয়েছেন নাকি আপনি? সেই ব্যাপারেই কি–
হ্যাঁ-কিন্তু আপনি জানলেন কি করে মিঃ রায়? কথাটা এখন পর্যন্ত আমি আমার পার্সোন্যাল সেক্রেটারীকেও বলি নি তো!
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, রক্তমুখী ড্রাগনের চিঠি তো?
যা-কিন্তু জানলেন কি করে?
মিঃ রামিয়া বললেন, সেই ব্যাপারেই উনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন—যদি ওঁর দ্বারা আপনার কোন উপকার হয়—অবিশ্যি পুলিসের সব রকম সাহায্যও আপনি পাবেন।
তা জানি পাব—কিন্তু আমি ভাবছিলাম—
কিরীটী শুধাল, কি?
ওদের ডিমাণ্ড আমি মিটিয়ে দেব। সুন্দর দাসের মত—
কত ডিমাণ্ড করেছে ড্রাগন আপনার কাছে? কিরীটী শুধাল।
এক লাখ টাকা।
কবে দিতে হবে?
আগামী পরশুর মধ্যে—
টাকা কে কি ভাবে কালেকশন করবে? কিরীটী শুধাল।
আজ সকালে একটা ফোন পেয়েছি-ডিবরাজ বললেন।
ফোন!
হ্যাঁ, তাতে আবারও আমাকে শাসানো হয়েছে-টাকা না দিলে নাকি সুন্দর দাস বা মিঃ চিদাম্বরমের অবস্থাই আমারও হবে। আর টাকা দিতে রাজী থাকলে পরশু রাত বারোটায় তার নোক এসে টাকা নিয়ে যাবে–
আপনি বলেছেন দেবেন?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে-এবারে যা করবার আমরাই করব।
ঐ সময় কৃষ বেয়ারাকে সঙ্গে করে একটা ট্রলির উপরে চায়ের সরঞ্জাম ও প্রচুর জলখাবার নিয়ে পারলারে এসে ঢুকল।
আবার কিরীটী ও কৃষ্ণার চোখাচোখি হল।
কৃষ্ণাই ওদের চা পরিবেশন করল।
কিরীটী খাবারের দিকে হাত বাড়ায়নি, চায়ের কাপেই চুমুক দিচ্ছিল।
কৃষ্ণা প্যাসট্রির সামনে তুলে ধরে বললে, প্যাসট্রি নেবেন না?
কিরীটী তাকাল কৃষ্ণার মুখের দিকে, তারপর একটা প্যাসট্র প্লেট থেকে তুলে নিল।
মিঃ ডিবরাজ কিরীটীর পরিচয় করিয়ে দিলেন কৃষ্ণার সঙ্গে।
মিঃ রায়, আমার মেয়ে—একমাত্র সন্তান কৃষ্ণা। ও বোম্বাইয়ে ওর মামার কাছে থেকে পড়াশুনা করে। ছুটিতে আমার কাছে এসেছে। কৃষ্ণা, উনি মিঃ কিরীটী রায়-মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন মিঃ ডিবরাজ, কলকাতা শহরের একজন
কৃষ্ণা বললে মৃদু হেসে, ওকে চাক্ষুষ না দেখলেও ওঁর পরিচয় আমার জানা আছে ড্যাডি!
কিরীটী তাকিয়ে ছিল কৃষ্ণার মুখের দিকে।
কৃষ্ণা মৃদু হেসে বললে, আপনাকে আমি জানি—আপনার অনেক কীর্তির কথা আমি জানি।
কিরীটী মৃদু হাসল।
ড্যাডি!
ইয়েস!
মিঃ রায় ও মিঃ রামিয়াকে আজ রাত্রে ডিনারে আসতে বল না?
সে তত ভাল কথা—আসুন না আপনারা।
কিরীটী বললে, মিঃ রামিয়া এলে আমিও আসতে পারি
আসবেন তো তা হলে মিঃ রায়? কৃষ্ণা বললে।
আসব। কিরীটী বললে।
কৃষ্ণা বললে, আর এক কাপ চা দিই আপনাকে মিঃ রায়?
চা!
যা, আপনি তো চা খুব ভালবাসেন।
জানলেন কি করে?
জানি।
বেশ, দিন।
চা ঢেলে দিল আর এক কাপ কৃষ্ণা কিরীটীকে।
ড্যাডি, আমি একটু মার্কেটে বেরুব। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরব—
বেশ তো, যাও।
কৃষ্ণা ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।