ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সর্বপ্রথম কিরীটীর দিকে চেয়ে এবারে আমিই প্রশ্ন করলাম, আজকের ব্যাপারের অনেক কিছুই যেন তুমি এখনো চেপে রাখছ বলে মন হচ্ছে কিরীটী? একটা সূত্র অবিশ্যি পাওয়া যাচ্ছে, মিঃ শুভঙ্কর মিত্র নেশা করতেন!
কিরীটী মৃদু হেসে বলে সেটা এমন বিশেষ একটা সূত্র নয়। কিন্তু এই case সম্পর্কে আপাতত যতটা জানতে পেরেছ, তাতে করে তোমার মতামতটা কী সুব্রত? যতটুকু জেনেছ বা শুনেছ। এর মধ্যে কোন অসামঞ্জস্য বা অবিশ্বাস্য মনে হয় কী?
একটা অসামঞ্জস্য খুব মোটা ভাবেই চোখে পড়েছে।
ডাঃ চট্টরাজ বাধা দিলেন, এক মিনিট সুব্রতবাবু! বলে হঠাৎ কিরীটীর দিকে চেয়ে বললেন, হ্যাঁ, একটা কথা রায়, তোমার ধারণা বোধ হয়। স্যার দিগেন্দ্ৰই কারও ছদ্মবেশে আজ রাত্রের উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন?
যদি বলি ডাঃ চট্টরাজ তাই! এমন কোন বিশেষ ব্যক্তির ছদ্মবেশ নিয়ে তিনি এখানে আজ হয়েতো এসেছেন, যার সঙ্গে মিঃ মিত্রের বেশ ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তা ছাড়া কোন নিমন্ত্রণ-বাড়ির একটা কার্ড যোগাড় করে এখানে আসাটা এমন বিশেষ কিছুই একটা কঠিন ব্যাপার বলে কি মন হয় ডাঃ চট্টরাজ?
না। কিন্তু তাহলে তুমি স্থিরনিশ্চিত যে, স্যার দিগেন্দ্ৰই কারও ছদ্মবেশে এসে আজ রাত্রে হতভাগ্য শুভঙ্কর মিত্রকে খুন করেছেন? কিন্তু—
মৃদু হেসে সহজ স্বাভাবিক স্বরে কিরীটী জবাব দিল, নিশ্চয়ই। এতে আমার দ্বিমত নেই।
কিন্তু বন্ধু, এক্ষেত্রে মিঃ মিত্রের মত একজন তৃতীয় ব্যক্তিকে স্যার দিগেন্দ্রের খুন করবার কী এমন সার্থকতা থাকতে পারে সেটাই যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। অবিশ্যি কুমারসাহেবকে হত্যা করলেও না হয় বোঝা যেত; কেননা তাঁর মুখে শুনেছি স্যার দিগেন্দ্র প্রায় তিন-চারখানা চিঠিতে একাধিকবার কুমারসাহেবকে শাসিয়েছেন তার প্রাণ নেবেন বলে। এবং যে কারণেই হোক কুমারসাহেবের ওপরে তাঁর একটা আক্রোশও আছে।
কিরীটী এবার বলে, জানেন কিনা আপনারা জানি না—গতকাল রাত্রে কুমারসাহেব শেষ চিঠি পেয়েছেন স্যার দিগেন্দ্রর কাছ থেকে এবং সেই সঙ্গে আমাদের সেক্রেটারী সাহেবও একখান চিঠি পেয়েছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, বলতে বলতে একখানা চিঠি পকেট থেকে টেনে বের করে কিরীটী চিঠিটা পড়তে শুরু করে ঃ আমাদের সাত পুরুষের সঞ্চিত অৰ্থ নিয়ে তুমি যে এই দানধ্যানের ছেলেখেলায় মেতে উঠেছ, এর সকল ঋণ কালই তোমার আপন বুকের রক্ত দিয়ে কড়ায়গণ্ডায় পরিশোধ করত হবে। বুকের রক্ত ঢেলে অর্জিত এ অর্থ অপব্যবহার করে যে পাপ করেছ, তা বুকের রক্তেই শেষ হয়ে যাক। আঃ, তাজা টুকটুকে লাল রক্ত ফিনকি দিয়ে ঠাণ্ডা মাটির বুকের ওপর ঢেউ খেলে যাচ্ছে! কী আনন্দ! লাল—লাল রক্ত I love it! I like it.
ইতি—
তোমার একান্ত শুভার্থী
কাকা দিগেন্দ্রনারায়ণ
তারপর এই হচ্ছে সেক্রেটারীবাবুকে যে চিঠি লেখা হয়। সেখানা, পড়ি শুনন ঃ পরের অর্থে পোদ্দারী করতে খুব আনন্দ, না? অন্যের বুকের রক্ত ঢেলে উপার্জন করা অর্থে হাসপাতাল গড়ে তুলতে চলেছ! Idea টা চমৎকার বন্ধু! বোকা ভাইপোটির মাথায় হাত বোলাবার চমৎকার উপায় একটি বের করেছ তো! প্রস্তুত থেকে, কাল তোমারও তামাম শোধের দিন ধার্য করেছি। —রক্তলোভী ‘দিগেন্দ্রনারায়ণ।
চিঠি দুখানা পড়া শেষ করে, আবার সে দুটো ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে কিরীটী বলে, এখন বোধ হয় সুব্রত বুঝতে পারছি, এখানে আসবার সময় কেন লোকজন সঙ্গে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলাম! এই চিঠি দুখানা আজ দুপুরেই কুমারসাহেব আমাকে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন।
বটে! এই ব্যাপার! ডাক্তার বলতে লাগলেন, ব্যাপারটা তো তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে মিঃ শুভঙ্কর মিত্রের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল রাত্রি সাড়ে নটায়। তারপর তিনি কফি চেয়ে পাঠান, এবং ঠিক রাত্রি সাড়ে নটায় তিনি কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে পূর্ববর্ণিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করতে গিয়ে উপস্থিত হন। কেমন তো?
হ্যাঁ, এবং তারই অল্পক্ষণ পরে ঘণ্টা বেজে ওঠে, সে কথাটা ভুলবেন না যেন। কিরীটী বলে ওঠে ওঁর কথার মধ্যে বাধা দিয়ে।
না, ঘণ্টা বেজেছিল তা ভুলিনি। খুনী ঘণ্টা বাজবার আগে থেকেই সে ঘরে উপস্থিত ছিল এবং তলোয়ারটা খুন করবার জন্য তৈরী করেই বড় সোফাটার নীচ লুকিয়ে রেখেছিল। Everything was kept ready – পূর্বপরিকল্পিত।
হ্যাঁ, কিন্তু এখন বলুন তো ডাক্তার, কোন দরজা দিয়ে খুনী তাহলে ঘরে গিয়ে ঢুকল?
কেন, দুটা দরজার যে কোনটা দিয়েই তো ঢুকতে পারে… ভুলে যাচ্ছ কেন এ কথাটা যে আমি বলেছি যে, খুনী ঢের আগে থেকেই সে ঘরে উপস্থিত ছিল।
বেশ। কিন্তু এবার বলুন তো ডাক্তার, তাহলে ঘরের কোন দরজা দিয়ে খুনী খুন করে বেরিয়ে গেল? কারণ যখন দেখতে পাচ্ছি। খুনের ঠিক পরই আমরা কেউ তাকে সে ঘরে গিয়ে খুঁজে পেলাম না!
কিরীটীর প্রশ্নে সহসা ডাক্তার চুপ করে গেলেন। মনে হল যেন তিনি অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়েছেন। তাঁর এই বিব্রত ভাব দেখে আমি বললাম, ডাঃ চট্টরাজ, আমি এই কথাটাই আপনাকে তখন বলতে চাইছিলাম কিন্তু।
দাঁড়ান! দাঁড়ান! ডাক্তার অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠলেন, খুনী হলঘরের সঙ্গে ওই ঘরে যাতায়াত করবার জন্য যে দরজা আছে, সে দরজা দিয়ে বের হয়নি; কারণ যেখানে আপনার নিযুক্ত লোক প্রহরায় ছিল এবং সেখানে থেকেই সে সর্বদা হলঘরের নজর রেখেছিল, কেমন এই তো আপনার যুক্তি?
খুনী এই ঘর অর্থাৎ এই ড্রয়িংরুমের দরজা দিয়েও বাইরে যায়নি। কারণ যেহেতু এ দরজার ওপর আমি নজর রেখেছিলাম, ঠিক যে মুহুর্তে আমি শুভঙ্কর মিত্রকে ঘরে ঢুকতে দেখি তারপর থেকেই সর্বক্ষণ, কেমন তো? আচ্ছা, তাহলে ডাক্তার এমন কি হতে পারে না যে, এই ব্যাপারটার মধ্যেই অর্থাৎ দরজার ওপর আমাদের নজর থাকা সত্ত্বেও একটা রীতিমত গোলমাল বা রহস্য লুকিয়ে আছে যা আপাতত আমাদের কারও দৃষ্টিতে আসছে না! কিন্তু আমি সত্যই আশ্চর্য হচ্ছি—এমন সহজ গোলমালটা আপনাদের বা সুব্রতর চোখে পড়ছে না কেন? কেন আপনার ধরতে বা বুঝতে এত কষ্ট হচ্ছে?
আমরা কিরীটী কথায় কোন জবাবই দিলাম না।
হাসতে হাসতে কিরীটী বলতে লাগল, তবে শুনুন। আপনারা জানেন ঐ ঘরে যাতায়াত করবার দু-ঘর দিয়ে দুটি দরজা আছে। একটি হলঘর দিয়ে, অন্যটি এই ঘর অর্থাৎ এই ড্রয়িং রুম দিয়ে, কেমন তো? এখন একটা দরজায় পাহার দিচ্ছিল হরিচরণ, অন্যটায় আমি নিজে। নিজেকে আমি যতটা বিশ্বাস করি, আমার সহকারী হরিচরণকে বা তার কথাও ঠিক ততখানিই আমি বিশ্বাস করি। ঐ দুটো দরজার কোনটি দিয়েই কেউ বের হয়ে গেলে, আমার বা হরিচরণের চোখকে ফাঁকি দেবার তার সাধ্য ছিল না। তাছাড়া ঐ প্রাইভেট ঘরের একটিমাত্র জানলাও আমি পরীক্ষা করে দেখেছি খুব ভাল করেই। নীচেই তার ট্রাম রাস্তা, এখনও হয়েতো সে পথে লোকজন যাতায়াত করছে, তখন তো করছিলেই। জানালার নীচে যে ধূলার পরত। জমে আছে, তাও আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। কোন সামান্য এতটুকু দাগ বা চিহ্ন পর্যন্ত সেখানে দেখতে পাইনি। আর বিশেষ করে জানালা থেকে ঘরের ব্যবধান প্রায় চল্লিশ ফিট হবে বলে মনে হয়। মানুষ তো দূরের কথা কোন বানরের পক্ষেও এই পথ দিয়ে যাতায়াত করা একেবারেই দুঃসাধ্য। অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। এবং ঘরেও কেউ লুকিয়ে ছিল না, সে তো আমারা নিজ চক্ষেই পরীক্ষা করে দেখেছি। অথচ সব চাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে খুনী অন্যের অলক্ষ্যে ঘরে প্রবেশ করে, তারপর খুন করে আবার অন্যের অলক্ষ্যেই বেমালুম গা-ঢাক দিয়ে ঘর থেকে চলে গেল; ঠিক যেমন আজ সন্ধ্যায় কুমারসাহেবকে আবছা ছায়ার মত ভয় দেখিয়েই স্যার দিগেন্দ্ৰ হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেলেন—অনেকটা সেই রকম। এর পরেও কি ডাক্তার আপনি বলবেন বা আপনার স্থিরবিশ্বাস যে এই ব্যাপারটাও একটা কল্পনাপ্রসূত ছায়াছবি মাত্র, অর্থাৎ আপনাদের ডাক্তারী ভাষায় haliucination!
উঃ অসহ্য, ক্ষোভে দুঃখে ডাক্তার বলে উঠলেন, অসহ্য! কিন্তু আমিও নিশ্চয় করে বলছি। রায়, খুনী নিশ্চয়ই ঘরের মধ্যে লুকিয়েছিল। এবং আপনার অগাধ বিশ্বাসের পাত্র হরিচরণ হয় আসল ব্যাপার দেখতে পায়নি বা মিথ্যা বলছে, আর তা যদি না হয় বা আপনি তা মেনে নিতে না চান, তবে I must say, ঐ ঘরে নিশ্চয়ই কোন গুপ্তদ্বার আছে যে পথ দিয়ে সে ঘরের মধ্যে ঢুকে খুন করে চলে গেছে।
না উত্তেজিত হবেন না ডাক্তার। ধীর গভীর আচঞ্চল স্বরে কিরীটী বললে, খুনী লুকোয়নি আদপেই। আমি যা দেখছি তাও যেমন মিথ্যা নয়, হরিচরণের কথাও মিথ্যা নয়; এবং ঐ ঘরে কোন গুপ্তদ্বার থাকাও একেবারেই সম্ভবপর নয়। আমার কথায় বিশ্বাস না হয় নিজে গিয়ে ভাল করে দেখে আসতে পারেন। আর একবার। ঘরের এক দিকে রাস্তা, আর একদিকে হলঘর, ওপরে তিনতলার ঘর, তার ওপরে খোলা ছাদ। এদিকে এই ড্রয়িং রুম, অন্যদিকে খাবার ও রান্নাঘর। তবে এর মধ্যে ভেবে দেখুন কোন গুপ্তপথ থাকা সম্ভব কিনা। এক কথায় ঘরের মধ্যে কোন গুপ্তপথ নেই। এবং সে জানলাপথেও পালায়নি, হলঘরের দরজা বা এই ড্রয়িংরুমের কোনটা দিয়েই বের হয়ে যায়নি। এবং এখনও ঘরের মধ্যে খুনী লুকিয়ে নেই। আসল কথা কি জানেন?
কিরীটীর মুখের দিকে সোৎসুকভাবে চেয়ে একই সঙ্গে আমরা দুজনেই উদ্গ্ৰীব কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, কী?
তবে শুনুন, আমরা যখন এখানে আসি তার ঢের আগেই খুনী তারকাজ শেষ করে গা-ঢাকা দিয়ে চলে গেছে। তাই আমরা কেউ তাকে দেখতে পাইনি ও-ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। এবং দেহ ও মণ্ডর position টা দেখে এটাও বুঝতে পারা কঠিন নয় যে, ব্যাপারটা আন্দীে আত্মহত্যা নয়। সহজ ও প্রাঞ্জল খুন—a murder! …হ্যাঁ খুন!
পরে অবশ্য বুঝেছিলাম কিরীটীর কথাটা কতখানি সত্য! …এবং কত কঠিন সত্য!
কিন্তু এ কি নিদারুণ বিস্ময়! চোখের ওপর যেন ভাসতে থাকে একটা অশরীরী ছায়া, যে ছায়া এ বাড়ির প্রতিটি লোকের কাছে সুপরিচিত। যাকে তিলমাত্র কেউ সন্দেহ করে না। যে যেন একটা মুখোশ এটে এই হৃদয়হীন কাজটা করে গেল। দয়া নেই, মায়া নেই। নেই। এতটুকু বিবেক বিবেচনা। নির্মম খুন। পাশবিক লালসা। কে, কে? অথচ এই সমস্ত পরিচিতের মধ্যেই সেও একজন। কিরীটী বলেছে সকলেরই পরিচিত সে। তবে সে কে? আমি? কিরীটি? ডাঃ চট্টরাজ? কুমারসাহেব নিজে? ম্যানেজারবাবু? বিকাস মল্লিক? দিনতারণ চৌধুরী? না প্রফেসর শর্মা? কে? কে? কে?
এমন সময় হরিচরণ ঘরে এসে প্রবেশ করল। কয়েকটা খোলা কাগজ ও একটা বই তার হাতের মধ্যে ধরা আছে। হরিচরণ বললে, এই নিন স্যার, এখানে আজ যাঁরা উপস্থিত। আছেন তাদের সকলেরই জবানবন্দি এই কাগজে টুকে এনেছি, এমন কি চাকরিবািকরদেরও। আর এই নিন বই। বাবুজীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু সেও বলতে পারল না কে এই বইটা সেখানে ফেলে রেখে গেছে। কিন্তু একথা সে বললে হলফ করে যে বিকালে এই বই সে ঘরে দেখেনি। আমন্ত্রিত ভদ্রলোকদের এবারে আপনি ছেড়ে দিতে পারেন স্যার। আমার মনে হয় তাদের কাছ থেকে আর বিশেষ কোন খবর পাওয়া যাবে না।
হুঁ। আশ্চর্য! কিরিটী গম্ভীরভাবে বলতে লাগল, কিন্তু এই ছোট-একটা ‘রূপকথা’ কে এখানে নিয়ে এল? ভাল কথা হরিচরণ, এই বইটা যাঁরা এখানে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন তাঁদের কারও কিনা জিজ্ঞাসা করে একবার দেখেছিল কী?
হ্যাঁ, তাও করেছিলাম স্যার। কেউই বললেন না যে, এটা তার বই বা বইটা কেউ সঙ্গে করে এখানে নিয়ে এসেছেন!
অন্যমনস্ক ভাবে কিরীটী বইয়ের পাতাগুলো ওল্টাতে লাগল। কলকাতার ৫নং কলেজ স্কোয়ারের, আশুতোষ লাইব্রেরী কর্তৃক ছাপা বইয়ের প্রথম পাতায় যেন কার নাম হিন্দীতে লেখা ছিল; কিন্তু তারপর রবার দিয়ে ঘষে ঘষে আবার সেটা যেন বেশ যত্ন সহকারেই মুছে ফেলা হয়েছে।
সহসা ডাক্তারের দিকে ঝুকে পরে কিরীটী বললে, ডাক্তার, আপনি তো হিন্দী জানেন? দেখুন তো কি নাম লেখা ছিল বইটাতে? ইতিমধ্যে হরিচরণের জবানবন্দি নেওয়া কাগজগুলো একটু আমি উল্টেপাল্টে দেখে নিই।
কিরীটী হরিচরণের হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে মনোযোগের সঙ্গে পড়তে লাগল এবং মাঝে মাঝে নোট-বুকটা বের করে কী সব তাতে নোট করে নিতে লাগল। ডাক্তারের দিকে চেয়ে দেখলাম, ডাক্তার গভীর হয়ে চশমার ভিতর দিয়ে বইয়ের প্রথম পাতায় মুছে দেওয়া অস্পষ্ট নামের লেখাটাকে উদ্ধার করবার বৃথা চেষ্টা করছেন। ক্রমে যেন মনে হচ্ছিল একটা বিস্ময়ের ভাব তার চোখে-মুখে ফুটে উঠছে একটু একটু করে। তারপর সেই পাতাটা উল্টে কী যেন মনোযোগের সঙ্গে পাতার দিকে দেখতে লাগলেন।
কিরীটীর কাগজটা দেখা হয়ে গিয়েছিল, হরিচরণের দিকে চেয়ে বললে, হরিচরণ, আজি এখানে যাঁরা উপস্থিত আছেন, তাদের প্রত্যেকের ওপরেই একজন করে লোক যেন আমার দ্বিতীয় আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত নজর রাখে। আর এখুনি একজন লোকের বন্দোবস্ত কর, টালার শুভঙ্কর মিত্রের বাড়িতে পাহারা দেবার জন্য। চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা থাকবে। কোনক্রমেই কোন লোককে সে বাড়িতে যেন ঢুকত বা বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া না হয়। কেউ যদি ঢুকতে চায় বা বের হতে চায় বাধা দেবে। বাধা না শুনলে গ্রেপ্তার করবে।
হরিচরণ মাথা হেলিয়ে বলল, তাই হবে স্যার।
এইবার কিরীটী তার এতক্ষণ লেখা নোটটা আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরলা, তাতে এইরূপ লেখা আছে ঃ
৮-১০ মিঃ রাত্ৰি—মিঃ শুভঙ্কর মিত্র, কুমারসাহেব, প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা, দীনতারণ চৌধুরী—এঁরা সকলে কুমারসাহেবের সয়নঘরে কী একটা পরামর্শ করছিলেন। বয় কফি দিয়ে আসতে গিয়ে দেখেছিল। ওঁদের সকলকেই ও ঘরে।
৮-২০ মি- রাত্ৰি-দীনতারণ চৌধুরী এখান থেকে চলে যান; ম্যানাজারবাবু ও দারোয়ান তাকে দেখেছে।
৮-২৫ মিঃ—৮-৫৫ মিঃ—মিঃ শুভঙ্কর মিত্র ও প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা দুজনে খাবার ঘরে বসে গোপনে কী সব কথাবার্তা বলছিলেন, বাবুর্চি তাদের দেখেছিল। কারণ সে সময় বেয়ারা না থাকায় বাবুর্চিই নিজে তাদের গরম কফি দিতে গিয়েছিল!
৮-৫০ কি ৫২ মিঃ—কুমারসাহেবের সঙ্গে সিঁড়িতে ম্যানেজারবাবুর দেখা হয়। ম্যানেজারবাবুই একথা বলেছেন আমাদের।
৮-৫০ মিঃ—৯-২৫ মিঃ—ম্যানেজারবাবু একাই ওপরের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিলেন, ম্যানেজারবাবুর স্বীকারোক্তি থেকে জানতে পারা যায়!
৮-৫৫ মিঃ-৯-৫৫ মিঃ মিত্র খাবার ঘরে থেকে বের হয়ে আসেন। সাক্ষী—বাবুর্চি ও প্রফেসার শর্মা।
৮-৫৫ মিঃ—৯-৩০ মিঃ—প্রফেসর শর্মা খাবার ঘরে উপস্থিত ছিলেন; সাক্ষীপ্রফেসর শর্মা নিজে। তাছাড়া একজন বয়ও সে কথা বলেছে।
৯-১৫ মিঃ সময়ে নাকি এক কাপ কফি বয় নিজে গিয়ে প্রফেসর শর্মাকে দিয়ে আসে। ৯-১৮ মিঃ রাত্রি-কুমারসাহেব নিজে আমাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। সাক্ষী—আমরা সকলে।
৯-৩০ মিঃ রাত্ৰি—মিঃ মিত্ৰ কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে ঢোকেন আমাদের সকলেরই চোখের সামনে দিয়ে।
৯-৩০ মিঃ রাত্রি-প্রফেসর শর্মা হরিচরণের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এবং প্রফেসর শর্মা যখন হরিচরণকে সময় সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, হরিচরণ জবাব দেয় এবং তারই কিছু আগে সে ঐখানে আমার আগেকার নির্দেশমত পাহারা দিতে উপস্থিত হয়। সাক্ষী-হরিচরণ ও ম্যানেজারবাবু, কেননা উনি ঐ সময় সিঁড়ির ওপরেই দাঁড়িয়েছিলেন!
৯-৩০—৯-৩৬ মিঃ রাত্রি-প্রফেসর শর্মার সঙ্গে প্রাইভেট রুমের দরজার সামনে হরিচরণের দেখা ও কথাবার্তা হয়।
৯-৩৭ মিঃ রাত্রি-প্রফেসার শর্মা ড্রয়িংরুমে আমাদের সঙ্গে এসে আলাপ করেন। খুনের ব্যাপারটা বেয়ারার চিৎকার শুনে এ ঘরের সবাই আমরা জানতে পারি।
মতামত বা টীকা ১নং -এমন কোন লোকই পাওয়া যাচ্ছে না। যিনি অন্ততঃ স্মরণ করে বলতে পারেন যে, ঐ উপরিউক্ত ভদ্রলোকের মধ্যে কাউকেও ৮-২০ মিঃ থেকে ৯-৩০ মিনিটের মধ্যে অর্থাৎ এই এক ঘণ্টারও বেশী সময়ের মধ্যে ওপরের হলঘরে দেখেছেন। কিনা। আশ্চর্য!
২নং-এ বাড়িতে উপস্থিত যাঁরা আছেন তাদের কেউ বলেত পারছেন না যে, তারা কেউ মিঃ শুভঙ্কর মিত্ৰকে রাত্রি ৮-৫৫ মিঃ (যখন তিনি খাবার ঘর থেকে প্রফেসর শর্মার কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসেন তখন কিংবা ৯-৩০ মিনিটের মধ্যে প্রাইভেট রুমে ঢুকতে দেখেছেন কিনা। এটাও আশ্চর্য!
৩নং —এটা হয়তো খুবই সম্ভব যে, এ বাড়ির পিছন দিকে অর্থাৎ ট্রাম-রাস্তার দিকে এ বাড়িতে প্রবেশের কোন গুপ্তপথ আছে, এবং সেই প্রবেশপথের কথা আমার নিযুক্ত লোক খুনের আগে পর্যন্ত অবগত না হওয়ার জন্য পাহারা দিতে পারেনি সেখানে।
কিরীটী হাসতে হাসতে নোট-খাতাটা ডাঃ চট্টরাজের দিকে এগিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বললে, এবারে বের করুন ডাক্তার, হত্যাকারী কে? যা কিছু জানিবার বা বোঝাবার সব এর মধ্যেই আছে।
এমন সময় একজন পুলিস এসে জানাল, পুলিস সার্জেন্ট এসেছেন। আমরা সকলে হলঘরের দিকে অগ্রসর হলাম।