০৭. খাবার টেবিলে আব্বু বললেন

খাবার টেবিলে আব্বু বললেন, “কালকে সবাই মিলে ঢাকা যাব।” টোটন আনন্দের মতো শব্দ করল আর তিতুনি যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল। ঢাকা শহর টোটনের খুবই পছন্দ, তার একটা কারণ ঢাকা গেলে তারা সাধারণত বড় ফুপুর বাসায় ওঠে আর বড় ফুপুর বড় ছেলে ঠিক টোটনের বয়সী। স্বভাবও ঠিক টোটনের মতো। বড় ফুপুর সব ছেলে-মেয়েগুলোই জানি কী রকম আঠা আঠা, কথা বলে না, হাসে না। যখন হাসে তখন মুখটা জানি কী রকম বাঁকা করে হাসে, দেখেই তিতুনির মেজাজ গরম হয়ে যায়। ঠিক কী কারণ কে জানে বড় ফুপুর সব ছেলে-মেয়ে মিলে সব সময় টোটনকে নিয়ে তিতুনির উপর চড়াও হয়। তাকে জ্বালাতন করে, টিটকারি মারে, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তা ছাড়া ঢাকায় ফুপুর সেই অ্যাপার্টমেন্টে তিতুনির দম বন্ধ হয়ে আসে, চারিদিকে বিল্ডিং আর বিল্ডিং, কোথাও এতটুকু ফাঁকা জায়গা নেই। ফুপুর ছেলে-মেয়েরা কখনো অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয় না, সবার গায়ের রং ইটের নিচে চাপা পড়ে থাকা ঘাসের মতো ফর্সা, সবাই গোলগাল, নাদুসনুদুস। সবাই চব্বিশ ঘণ্টা কম্পিউটারে গেম খেলে না হয় টিভি দেখে দেখে তাই সবার চোখে চশমা।

আব্বু বললেন, “অনেক দিন ঢাকা যাই না। একটু ঘুরে আসি। বুবুর সাথে একটা কাজও আছে।”

টোটন টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক। আমরা কেন এই জঙ্গলে পড়ে থাকি আব্ব? আমরা কেন বড় ফুপুর মতো ঢাকা থাকতে পারি না?” ।

আব্বু বললেন, “ঢাকা থাকা কী মুখের কথা নাকি? লিভিং কস্ট কত জানিস? সেখানে গেলে তোরা কোন স্কুলে পড়বি? কী করবি?”

তিতুনি বলল, “আমি ঢাকা যেতে চাই না।”

টোটন বলল, “তুই হচ্ছিস গেরাইম্যা মেয়ে। তুই কেন শহরে যেতে চাইবি?”

তিতুনি বলল, “আমি সেটা বলি নাই।”

“তাহলে কী বলেছিস?” “আমি বলেছি আমি কালকে ঢাকা যেতে চাই না।”

আম্মু বললেন, “ঢাকা যেতে চাই না মানে?”

“আমার ঢাকা যেতে ভালো লাগে না। এত ভিড়, এত মানুষ—”

আব্বু বললেন, “তোর বড় ফুপু তোদের কত আদর করে।”

“বড় ফুপুকে বলো এখানে চলে আসতে।”

“সে কত ব্যস্ত, কীভাবে সময় পাবে?”

তিতুনি যদিও মুখে এই কথাগুলো বলছে কিন্তু তার মাথায় সারাক্ষণ এলিয়েন তিতুনির কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তার পুরো জীবনটা এখন এলিয়েন তিতুনির হাতে। এত বড় একটা ব্যাপার অথচ ব্যাপারটা কাউকে জানাতে পারছে না-ঠিক কেন জানাতে পারছে না সেটাও বুঝতে পারে না। এলিয়েন তিতুনি যদি দেখতে অন্য রকম হতো তাহলে ব্যাপারটা কত সোজা হতো, কিন্তু শুধু যে দেখতে হুবহু এক তা-ই নয়, তার কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা তার মতো, তার পুরো মগজটাও সে কপি করে নিজের মাথায় রেখেছে, সে যেটা জানে অন্য তিতুনিও সেটা জানে। মাঝে মাঝে তার সন্দেহ হতে থাকে আসল তিতুনি কোনজন, সে নাকি অন্যজন!

কাজেই যখন ঢাকা যাওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তখন তিতুনির মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য-তিতুনির কথা। সে এখন কী করবে? তাদের সাথে যাবে নাকি এখানে একা একা থেকে যাবে?

তিতুনি অন্যমনস্কভাবে চিন্তা করছিল, তখন হঠাৎ শুনল আব্বু বলছেন, “খুব ভোরে রওনা দিব। একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করেছি। চারজন একেবারে হাত-পা ছড়িয়ে যেতে পারব।”

টোটন বলল, “ফ্যান্টাস্টিক।”

তিতুনি বলল, “আমি যেতে চাই না।”

আম্মু একটু গরম হয়ে বললেন, “বাসায় তুই একা একা থাকবি নাকি?”

তিতুনির ইচ্ছে হলো বলে, “আমি মোটেও একা থাকব না। আমার সাথে থাকবে একটা এলিয়েন। তোমরা আমাকে যতটুকু দেখে-শুনে রাখবে এই এলিয়েন আমাকে তার থেকে একশ গুণ বেশি দেখে-শুনে রাখবে। ফাক্কু স্যারের মতো মানুষকে সে সাইজ করে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু সত্যি সত্যি তো আর সেটা বলতে পারে না, তাই চুপ করে রইল।

আম্মু বললেন, “খাওয়ার পর ছোট একটা ব্যাগে দুই দিনের জামা-কাপড় গুছিয়ে নিস। সকালে যেন দেরি না হয়।”

তিতুনি কোনো কথা বলল না, একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল। আজকে স্কুল থেকে ফেরার পর অন্য-তিতুনির সাথে তার দেখা হয়নি। কোথায় আছে কে জানে। আজকে কোন কায়দায় বাসায় ঢুকবে, ঢুকে আবার কোন ঝামেলা পাকাবে সেটাই বা কে জানে! স্কুলে ফাক্কু স্যারকে সাইজ করার জন্য ক্লাশে সে একটা বড় কিছু অঘটন ঘটিয়েছে টের পেয়েছে, অঘটনটা ঠিক কী সেটাও তিতুনি জানে না। না জানা পর্যন্ত সে খুব অস্বস্তিতে আছে, কারণ ক্লাশের সবাই ধরেই নিয়েছে। ঘটনাটা ঘটিয়েছে সে।

তিতুনি চুপচাপ খেয়ে নিজের ঘরে ফিরে এসে চমকে উঠল। বিছানায় লম্বা হয়ে অন্য-তিতুনি শুয়ে আছে। তিতুনি চমকে উঠে ফিসফিস করে বলল, “তুমি?”

অন্য-তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমি।”

“কেমন করে ঢুকেছ?”

অন্য-তিতুনি বলল, “জানালা দিয়ে।”

“জা-জানালা দিয়ে?”

“হ্যাঁ।”

“দোতলার জানালায় উঠেছ কেমন করে?”

“হ্যাচড়-পাঁচড় করে, খামচা-খামচি করে।”

“জানালার শিকের ভেতর দিয়ে ঘরে ঢুকেছ কেমন করে?”

“শিক বাঁকা করে নিয়েছি।”

তিতুনি জানালার দিকে তাকাল, শিক কোনোটাই বাঁকা নয়। অন্য-তিতুনি দাঁত বের করে হাসল, বলল, “আবার সোজা করে রেখেছি।”

তিতুনি চোখ বড় বড় করে তাকাল, এই মোটা মোটা লোহার শিক কেমন করে বাঁকা করল? কেমন করে আবার সোজা করল? অন্য-তিতুনি বলল, “আজকে তোমার কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি খেয়ে এসেছি।

“খেয়ে এসেছ? কোথা থেকে খেয়ে এসেছ?”

 “ঐ তো!” বলে অন্য-তিতুনি বিষয়টা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল। তিতুনি চাপা গলায় যতটুকু সম্ভব কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কোথা থেকে খেয়ে এসেছ?”

তিতুনির কঠিন গলায় কথা বলার কারণ আছে, কারণ সে যেখান থেকেই খেয়ে আসুক সবাই ধরে নিয়েছে এটা তিতুনির কাজ। তিতুনি আবার চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “বলো কোথায় খেয়ে এসেছ?”

অন্য-তিতুনি একটু লাজুক মুখে বলল, “মাহতাব চাচার বাসা থেকে।”

তিতুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “মা-হ-তা-ব চা-চা-র বাসা থেকে, তুমি মাহতাব চাচার বাসায় গিয়েছিলে? ভাত খেতে?”

“জোর করে খাইয়ে দিলেন। চাচি খুবই সুইট। মাহতাব চাচার ছোট বাচ্চাটা খুবই কিউট।”

তিতুনির তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, সে চোখ দুটো কপালে তুলেছিল সেগুলো কপালে রেখেই বলল, “তুমি শুধু ভাত খেতে মাহতাব চাচার বাসায় চলে গেলে? তোমার লজ্জা করল না?”

মেয়েটা আবার দাঁত বের করে হাসল, “লজ্জা করবে কেন? আমার জায়গায় তুমি হলে তুমিও চলে যেতে।”

ঠিক তখন দরজা খুলে আম্মু ঘরের ভেতর ঢুকলেন, তিতুনি ঘুরে আম্মুর দিকে তাকাল, এখন আম্মু নিশ্চয়ই একটা ভয়ংকর চিৎকার করে উঠবেন, কিন্তু আম্মু চিৎকার করলেন না, হাতে ধরে রাখা একটা ব্যাগ তিতুনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নে, এইখানে তোর জিনিসগুলি রাখ।”

তিতুনি তার বিছানার দিকে তাকাল, এক সেকেন্ড আগেও সেখানে অন্য-তিতুনি লম্বা হয়ে শুয়েছিল, এখন সেখানে কেউ নেই। কোথায় গেল মেয়েটা?

আম্মু তার ঘরের চারিদিকে তাকালেন, বললেন, “ঘরের কী অবস্থা করে রেখেছিস? একটু পরিষ্কার করতে পারিস না?”

তিতুনি চোখের কোনা দিয়ে মেয়েটাকে তখনো খুঁজে যাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছে। মেয়েটা বিছানায় গড়িয়ে এক পাশে চলে গিয়ে চাঁদরের নিচে ঢুকে গেছে, তাই চোখের সামনে নেই। আম্মু বিছানার দিকে ভালো করে তাকালেই দেখতে পাবেন বিছানার এক কোনায় এলোমেলো চাঁদরের নিচে একজন মানুষ। কিন্তু আম্মু সেদিকে তাকালেন না, তাকালেও দেখলেন না। একজন মানুষ যেটা দেখবে বলে আশা করে না সেটা মনে হয় দেখেও দেখে না।

ব্যাগটা তিতুনির হাতে দিয়ে বললেন, “একটা-দুইটা ভালো জমা নিবি। খালি রং ওঠা টি-শার্ট নিয়ে রওনা দিবি না।”

তিতুনি দুর্বলভাবে বলল, “টি-শার্ট পরতে আরাম–”

“এত আরামের দরকার নাই। খুব সকালে উঠতে হবে। এখন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়।”

আম্মু নিজের মনে গজগজ করতে করতে বের হয়ে গেলেন। তখন চাঁদরের নিচ থেকে মাথা বের করে অন্য-তিতুনি উঁকি দিল, চোখ পিটপিট করে আসল তিতুনির দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করল।

তিতুনি ফিসফিস করে বলল, “তোমাকে আম্মু দেখলেন কেন?”

“অনেক তাড়াতাড়ি সরে গেছি তো, তাই।”

“অনেক তাড়াতাড়ি সরেছ তো কী হয়েছে? সরতে দেখা যাবে কেন?”

“যখন ফ্যানের পাখা ঘুরতে থাকে তখন তুমি সেটা দেখো?”

তিতুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “তুমি ফ্যানের পাখার মতো তাড়াতাড়ি যেতে পারো?”

অন্য-তিতুনি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কেমন জানি ঘাড় ঝাঁকাল। উত্তর দিতে না চাইলে আসল তিতুনি যেভাবে ঘাড় আঁকায়।

চাঁদরের নিচ থেকে বের হয়ে মেয়েটা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কাল ঢাকা যাচ্ছ?”

তিতুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি যেতে চাই না।”

মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “জানি।”

“কিন্তু না যেয়ে উপায় কী? যেতেই হবে।”

মেয়েটা আবার মাথা নাড়ল, বলল, “জানি।”

“তোমাকে এই দুই দিন একা একা থাকতে হবে। তুমি তো আর আমাদের সাথে মাইক্রোবাসে ঢাকা যেতে পারবে না।”

মেয়েটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “জানি।”

“যখন আমি নাই তখন তোমার বাইরে ঘোরাঘুরি করা ঠিক হবে। পরিচিত কেউ দেখে ফেললে অবাক হয়ে যাবে।”

মেয়েটা আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “জানি।”

তিতুনির তখন তাদের স্কুল এবং ফাক্কু স্যারের কথা মনে পড়ল। জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আজকে ক্লাশে কী হয়েছিল? তুমি ফাক্কু স্যারকে টাইট করেছ?”

“নাহ্ সে রকম কিছু না। শুধু ব্রেনের ভেতর আকার-উকার বলার অংশটা মুছে দিয়েছি। এখন ঠিক করে কথা বলতে পারছে না।”

তিতুনি বলল, “আমি যখন বললাম হোম ওয়ার্কের কথাটা ব্রেন থেকে মুছে দিতে তখন রাজি হলে না, এখন পুরো আকার-উকার মুছে দিয়েছ? এখন কোনো দোষ হয়নি?”

“এটা অন্য ব্যাপার। আকার-উকার মুছে দিলেও ক্ষতি নাই। আস্তে আস্তে আবার শিখে নিবে। একটা স্মৃতি মুছে দিলে সেটা আর ফেরত আসবে না। আমি সেটা করতে পারব না।”

“তোমার ঢং দেখে আমি বাঁচি না।”

মেয়েটা তিতুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার সমস্যাটা কি জানো?”

“কী?”

“তোমার মনে থাকে না যে আমি দূর গ্যালাক্সি থেকে আসা একটি এলিয়েন। তুমি মনে করো আমিও বুঝি তোমার মতো বোকাসোকা একটা মেয়ে।”

তিতুনি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “আমি বোকালোকা?”

অন্য-তিতুনি ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে এখন ঘুমাও। মনে আছে তোমার খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে?”

তিতুনি বলল, “আগে আমার ব্যাগ গোছাতে হবে।”

“সেটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি তোমার ব্যাগ গুছিয়ে দেব।”

“তুমি পারবে?”

“এইটা হচ্ছে তোমার দুই নম্বর সমস্যা। তুমি ভুলে যাও যে আমি হচ্ছি তুমি। একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট তুমি। বলা উচিত হান্ড্রেড অ্যান্ড টেন পারসেন্ট তুমি!

“সেইটাই হচ্ছে সমস্যা।”

তিতুনি বালিশে মাথা রাখতেই ঘুমিয়ে গেল। এটা কী তার নিজের সত্যিকারের ঘুম নাকি অন্য-তিতুনি কোনো একটা কায়দা করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল সে বুঝতে পারল না।

.

ঠিক যত সকালে তার ঘুম থেকে ওঠা উচিত তিতুনির ঘুম ভাঙল তার থেকে পরে। ঘুম থেকে উঠে সে বাসার ভেতরে অন্যদের কথা শুনতে পেল, এবং রীতিমতো আঁতকে উঠল। শুনল আম্মু বলছেন, “টোটন, তুই তোর ঘরের জানালা বন্ধ করেছিস?”

“করেছি আম্মু।”

“মনে আছে একবার জানালা খুলে রেখে গেলি, বৃষ্টিতে ঘরবাড়ি ভেসে গেল। আমার এত দামি টেবিল ক্লথের বারোটা বাজিয়ে দিলি।”

টোটন বলল, “না আম্মু, এইবার জানালা বন্ধ করে এসেছি।”

তখন আম্মু বললেন, “তিতুনি। তুই?”

তিতুনি নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনল, অন্য-তিতুনি বলছে, “জি আম্মু, আমার ঘরের জানালা বন্ধ।”

তার মানে অন্য-তিতুনি আম্মু, আব্বু আর টোটনের সাথে ঢাকা যাচ্ছে। তাকে এখানে একা ফেলে রেখে। এখন সে কী করবে? চিৎকার করে বলবে, “আমি আসল তিতুনি? আমাকে নিয়ে যাও।”

তিতুনি শুনল আব্বু বলছেন, “সবাই বের হও। মাইক্রোবাস অপেক্ষা করছে। ট্রাফিক জ্যাম শুরু হবার আগে পৌঁছে যেতে হবে।”

টোটন বলল, “চলো আব্বু।”

তিতুনি শুনল অন্য-তিতুনি বলছে, “আমি রেডি।”

তারপর মনে হলো সবাই দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে গেল। এখন সে কী করবে? চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বের হবে? বলবে, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমাকে নিয়ে যাও।” সবাই তখন হাঁ করে তার দিকে তাকাবে? অন্য-তিতুনি তখন সবার ব্রেনে ঢুকে সবকিছু মুছে দেবে? তখন কে যাবে? সে নাকি অন্য-তিতুনি?

তিতুনি সাবধানে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। বাসার সামনে হালকা নীল রঙের একটা মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে। পিছনের হুড খুলে সব ব্যাগ রাখা হচ্ছে। ব্যাগ ওঠানোর পর ড্রাইভার হুড বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। আবু আর আম্মু উঠলেন। টোটন সামনে বসতে চাচ্ছিল আব্বু বসতে দিলেন না, মুখ ভোঁতা করে সে পিছনে বসল। তার সাথে অন্য-তিতুনি। আসল তিতুনি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, কত বড় ধড়িবাজ মেয়ে! তাকে ফেলে রেখে নিজে আসল তিতুনি সেজে ঢাকা চলে যাচ্ছে।

তিতুনি কী করবে ঠিক করার আগেই ড্রাইভার গাড়িতে উঠে মাইক্রোবাসটা স্টার্ট করে রওনা দিয়ে দিল। দেখতে দেখতে সেটা বাসার সামনের সড়কে উঠে যায়, তারপর সড়ক ধরে ছুটতে থাকে। কয়েক মিনিটের মাঝে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

তিতুনির প্রথম অনুভূতিটা হলো ভয়ের, তার বাসার সবাই তাকে ঘরের ভেতর তালা মেরে চলে গেছে। তিতুনির মনে হলো অনেক দিন পর তার আব্বু-আম্মু বাসায় এসে দেখবে সে বাসায় না খেতে পেয়ে মরে পড়ে আছে। তখন তার মনে পড়ল বাসার ফ্রিজে অনেক খাবার, সে আর যেভাবেই হোক না খেয়ে মারা যাবে না। তখন মনে হলো এই বাসার ভেতরে তালাবদ্ধ হয়ে থেকে সে পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবে। তখন মনে পড়ল বাসার সামনের দরজায় তালা দেয়া আছে সত্যি কিন্তু সে ইচ্ছে করলেই বাসার পিছনের দরজার ছিটকিনি খুলে বের হতে পারবে। তখন মনে হলো রাত্রি বেলা যখন একা একা ঘুমাতে হবে তখন ভূতের ভয়ে সে হয়তো হার্টফেল করে মরে যাবে। চিন্তা করেই এই সকালবেলা দিনের আলোতেই তার হাত-পা কাঁপতে থাকে।

জোর করে সে মাথা থেকে চিন্তাটা দূর করে দেয়। তিতুনি প্রথমে বাথরুমে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করে হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে বাসার ভেতরে এলো। ফ্রিজ খুলে দেখল খাওয়ার কী আছে। এমনিতে সকালবেলা তার কিছু খাওয়ার ইচ্ছা করে না। যেহেতু আজকে সে জানে খাবার ব্যবস্থা নেই, তাই খিদেয় পেট চো চো করতে শুরু করেছে।

তিতুনি এক স্লাইস রুটি, একটা কলা আর আধ গ্লাস দুধ মাত্র খেয়ে শেষ করেছে ঠিক তখন বাসার বাইরে সে মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পেল।

তিতুনি অবাক হয়ে জানালার কাছে গিয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকায়, ঠিক তাদের বাসার সামনে বেশ কয়েকজন মানুষ। তার মাঝে একজন টিশটাশ মেয়ে। দুইজন বিদেশি, একজনের মাথার চুল পাকা অন্যজনের মাথায় ধুধু টাক। বিদেশি দুইজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যেরা বাসার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। টিশটাশ মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, “এইটা সেই বাসা?”

জিনস আর টি-শার্ট পরা একজন বলল, “হ্যাঁ, এইটা সেই বাসা।”

“তুমি কেমন করে জানো?”

“আমি জানি। স্পেসশিপ ট্র্যাকিং ডাটা থেকে দেখেছি এই বাসার ঠিক পিছনে এলিয়েন স্পেসশিপ ল্যান্ড করেছে।”

“কেউ টের পেল না কেমন করে?”

“সবাই টের পেয়েছে কিন্তু সবাই মনে করেছে মাইল্ড ট্রেমার। ভূমিকম্প। এটা যে একটা স্পেসশিপ ল্যান্ড করেছে কেউ বুঝতে পারেনি।”

“ও।”

জিন্স আর টি-শার্ট পরা মানুষটা তিতুনিদের বাসাটার উপরে নিচে তাকিয়ে বলল, “এলিয়েনটা স্পেসশিপ থেকে বের হয়ে এই বাসায় ঢুকেছিল।”

“তুমি কেমন করে জানো?”

“আমাদের ডাটা থেকে আন্দাজ করছি।”

“এই বাসায় কে থাকে?”

“ছোট একটা ফ্যামিলি। হাজব্যান্ড, ওয়াইফ, একটা ছেলে আর মেয়ে।”

টিশটাশ মেয়েটা বলল, “বাসায় তো তালা মারা।”

“হ্যাঁ। পুরো ফ্যামিলি আজ সকালে বের হয়ে গেছে। মনে হয় একটা ট্রিপে গিয়েছে।”

“বাসাটা তাহলে ফাঁকা?”

“হ্যাঁ ফাঁকা। কেউ নেই।”

“গুড। আমরা নিরিবিলি কিছু ইনভেস্টিগেট করতে পারব।”

“হ্যাঁ। এই ফাঁকে সব যন্ত্রপাতি সেটআপ করে ফেলি।”

তারপর জিন্স আর টি-শার্ট পরা মানুষটা হেঁটে হেঁটে বিদেশি লোক দুজনের কাছে গেল, তাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল। বিদেশি লোক দুজন তখন খুবই উত্তেজিত হয়ে হাত-পা নেড়ে কথা বলতে থাকে। দূর থেকে তাদের কথা শোনা যাচ্ছিল না, শোনা গেলে তিতুনি কিছু বুঝত কি না সন্দেহ। বিদেশিদের ইংরেজি খুবই অদ্ভুত, গলার ভেতর থেকে কী রকম একটা শব্দ বের করে কথা বলে।

শুধু একটা কথা শুনতে পেল, “এবারে এই এলিয়েনটাকে ধরতেই হবে। এটা হচ্ছে সারা পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র সুযোগ।”

অনন্যরাও মাথা নাড়ল, বলল, “ধরতেই হবে।” তিনি জানালা থেকে সরে এলো, তার হাত-পা কাঁপছে। এবারে এলিয়ান তিতুনিকে ওরা ধরে ফেলবে। ভুল করে যদি তাকে ধরে ফেলে? তখন কী হবে?