কিরীটী কিন্তু প্রথমটা রাজী হয়নি।
রাত আটটা নাগাদ সোমনাথ ভাদুড়ী তার গড়িয়াহাটার বাড়িতে একাই এসেছিলেন কিরীটীর সঙ্গে দেখা করতে। কিরীটী বলেছিল, না ভাদুড়ীমশাই, ওসব ঘাঁটাঘাঁটি করতে এ বয়সে আর ভাল লাগে না, আপনারা বরং সুব্রতর কাছে যান। আমার মনে হয় সে কেসটা ঠিক ট্যাক্স করতে পারবে।
—তা জানি, মৃদু হেসে সোমনাথ বললেন, তবু কিরীটীবাবু আপনি হলে—
—আমিও বিশ্বাস করি অ্যাড়ভোকেট সোমনাথ ভাদুড়ী যখন এ মামলা হাতে নিয়েছেন তখন কোন অবিচার হবে না, দোষী ঠিকই চিহ্নিত হবে।
হাসতে হাসতে সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন, কিন্তু আপনি ছাড়া মামলার সমস্ত সূত্র গুছিয়ে আমার হাতে তুলে দেবে কে কারণ ব্যাপারটা সত্যিই আমার কাছে জটিল মনে হচ্ছে রায়মশাই। তাছাড়া সুরজিৎ ঘোষাল সমাজের একজন গণমান্য ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। অবিশ্যি রক্ষিতার ব্যাপারটা তার জীবনে একটা কলঙ্ক। কিন্তু আজকের দিনে হাতে যাদের প্রয়োজনের বেশী পয়সা আছে, প্রায়ই তাদের মধ্যে ঐ ধরনের দখা দেয়।
কিরীটী এবারে হেসে উঠল।
—হাসছেন রায়মশাই, আমার ঐসব সো-কলড় হাই সোসাইটির কিছু কিছু ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার কিছু কিছু ব্যাপার-স্যাপার জানবার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যা-ই বলুন হয়েছে, এমন demoralised হয়ে গেছে সব
আস্তে ভাদুড়ী মশাই, আস্তে। কিরীটী পূর্ববৎ হাসতে হাসতেই বলল, আপনি যাঁদের কথা বলছেন তারা ওই সব ব্যাপারকে কোন ব্যাধি, পাপ বা অন্যায় কিছু বলে মনে করেন না। তাছাড়া ওটা এ যুগের একটা কালচারের সামিল।
-কালচারই বটে। সে যাক, আপনাকে কিন্তু সুরজিৎ ঘোষালের কেসটা হাতে নিতে হবে।
—আপনার কাছ থেকে রেহাই পাবো না বুঝতে পেরেছি, বলুন সব ব্যাপারটা–আপনি যতদূর জানেন।
সোমনাথ ভাদুড়ী বলে গেলেন সব কথা। কিরীটী নিঃশব্দে শুনে গেল, কোন মন্তব্য। করল না। সোমনাথ ভাদুড়ীর কথা শেষ হলে পাইপে টোবাকো ঠাসতে ঠাসতে কিরীটী বলল, তাহলে এখানেও সেই এক নারী ও তিনটি পুরুষের সংযোজন। ট্রায়াঙ্গুলার ব্যাপার। মালঞ্চ দেবীর স্বামী সুশান্ত মল্লিক আর দুজন-সুরজিৎ ঘোষাল ও দীপ্তেন ভৌমিক। তিনজনই চাইত এক নারীকে। সুশান্ত মল্লিক মানে ঐ মালঞ্চর স্বামীটা তো একটা ফুল—নচেৎ স্ত্রীকে একজনের রক্ষিতা হিসাবে allow করে সেই রক্ষিতার আশ্রয়েই থাকতে পারে। তার পয়সায় নেশা করতে পারে! কে জানে, হয়তো সে সত্যি সত্যিই মালঞ্চকে ভালবাসত
–ভালবাসত! না না, ও একটা অপদার্থ।
—তবু তাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারেন না ভাদুড়ীমশাই, এবং বর্তমান মামলায় যে মোটিভ বা উদ্দেশ্য সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সেটা ওর দিক থেকে বেশ strong থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। প্রত্যেক হত্যার ব্যাপারেই আপনি তো জানেন আমাদের সর্বাগ্রে তিনটি কথা চিন্তা করতে হয়। প্রথমত, হত্যার উদ্দেশ্য, দ্বিতীয়ত, এক বা একাধিক ব্যক্তি সেই হত্যার আশেপাশে থাকলে হত্যা করার ব্যাপারে কার কতটুকু possibility বা সম্ভাবনা থাকতে পারে ও তৃতীয়ত, probability, ওদের মধ্যে কার পক্ষে হত্যা করার সবচাইতে বেশী সুযোগ ছিল।
—তাহলে তো রায়মশাই ওদের তিনজনই
—সেইজন্যেই তো বলছিলাম ভাদুড়ীমশাই, যে বাড়িতে হত্যা সংঘটিত হয়েছে ওদের তিনজনের মধ্যে একজন সেখানে থাকত ও অন্য দুজনের সেখানে সর্বদা যাতায়াত ছিল। কাজেই ওদের তিনজনেরই মালঞ্চকে হত্যা করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল বলে ওদের যে কোন একজনের পক্ষে হত্যা করা সম্ভবও ছিল। আর এই মামলায় আপনার সর্বাপেক্ষা বড় সূত্র এইটিই হবে, তাই সর্বাগ্রে আপনাকে ঐ তিনটি মহাপুরুষের সমস্ত সংবাদ in details সংগ্রহ করতে হবে।
-আর কিছু?
—একটা কথা ভুলে যাবেন না ভাদুড়ীমশাই, দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে প্রথমে দীপ্তেন ভৌমিক ও তার পরে সুরজিৎ ঘোষাল মালঞ্চর কাছে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, আপাতত যা আমরা জেনেছি সুশান্ত মল্লিক সে রাত্রে ঐ বাড়িতে যে উপস্থিত ছিল না সেটা তার সম্পূর্ণ একটা মিথ্যে বয়ান যেমন হতে পারে তেমনি সেটা তার পক্ষে একটা alibiও হতে পারে।
কিরীটী বলতে লাগল, সুতরাং সন্দেহের তালিকা বা সম্ভাব্য হত্যাকারীর তালিকা থেকে ঐ তিন মহাত্মার একজনকেও আপনি বাদ দিতে পারছেন না আপাতত। All spotted, ওদের প্রত্যেকেরই মালঞ্চকে হত্যা করবার ইচ্ছা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক, যদিও অবিশ্যি তার কারণটা একজন থেকে অন্যের পৃথক হতে পারে। তাহলেও একটা কথা আমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, যা কিছু ঘটেছে তা ঐ একটি নারীকেই কেন্দ্র করে। কি জানেন ভাদুড়ীমশাই, তাস খেলতে বসে রংয়ের টেক্কা কে হাতছাড়া করতে চায় বলুন। না, ভাদুড়ীমশাই, আমার তো মনে হচ্ছে আপনি যতটা ভাবছেন ব্যাপারটা হয়তো ততটা জটিল মানে complicated নয়।
-নয় বলছেন?
—হ্যাঁ। কারণ এ মামলায় মোটিভটা যেদিক থেকেই বিচার করুন না কেন, তিনজনের যে কোন একজনের অ্যাঙ্গেল থেকেই, দেখবেন শেযটায় হয়তো এটাই প্রমাণিত হবে, পাল্লার কাঁটাটা একদিকেই ঝুঁকছে—towards that woman, আসলে কি জানেন ভাদুড়ী মশাই, সুরজিৎ ঘোষালের মত একজন মানী গুণী সমাজে প্রতিষ্ঠাবান পয়সাওয়ালা ব্যক্তি যদি এই হত্যার সঙ্গে দুর্ভাগ্যক্রমে জড়িত হয়ে না পড়তেন এবং তার সঙ্গে একটা কলঙ্কের ব্যাপার না থাকত তাহলে ব্যাপারটা নিয়ে যেমন এত হৈচৈ হত না, তেমনি সরকারও এত তেল পোড়াত না।
–কি বলছেন আপনি রায়মশাই?
–আমি মিথ্যা বলিনি ভাদুড়ীমশাই, একটু ভেবে দেখলেই আপনিও বুঝতে পারবেন—সমাজে কি আর কারও রক্ষিতা নেই-নাকি কারও রক্ষিতাকে হত্যা করা হয়নি ইতিপূর্বে? ব্যাপারটা সুরজিৎ ঘোষালের মত এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বলেই মনে হচ্ছে ব্যাপারটার মধ্যে না জানি কত রহস্যই আছে। অবিশ্যি এও আমি বলব, হত্যা হত্যাই, its a crime and crime must be punished.
-রায়মশাই, যতটুকু শুনলেন তাতে করে সুরজিৎ ঘোষালকে আপনার–
—দোষী না নির্দোষী কি মনে হয়, তাই না আপনার প্রশ্ন ভাদুড়ীমশাই—সেটা তো এই মুহূর্তে কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয়, কারণ আমরা আপাতত যে মোটিভ ভাবছি। হত্যার হয়তো সে মোটিভ আদৌ ছিল না। আর সেটার যদি কোন হদিস পাই তাহলে হয়তো দেখব তিনজনের মধ্যে দুজন সহজেই eliminated হয়ে গিয়েছে, আর সেরকম হলে হয়তো হত্যার ব্যাপারটাই একটা সম্পূর্ণ অন্য রূপ নেবে, কাজেই সবটাই এখন তদন্ত সাপেক্ষ।
–তা ঠিক, তবে আপনাকে ঐ কথাটা জিজ্ঞাসা করার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল—
-আপনি black sheep-কে ব্যাক করছেন কিনা, তাই না ভাদুড়ীমশাই?
—তাই—
কিরীটী বললে, সে আরো পরের কথা, আপনি ডিফেন্স কৌঁসুলী, এগিয়ে যেতে হবে, আপনি দিন কতক বাদে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। অবিশ্যি তেমন কিছু জানতে পারলে আমিও আপনার কাছে যেতে পারি।
—তাহলে আজ আমি উঠি—
—আসুন, আর যুধাজিৎবাবুকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবেন।
–ঠিক আছে। কিছুদিন যাবৎ কিরীটীর মধ্যে যে নিষ্ক্রিয়তা চলছিল, সোমনাথ ভাদুড়ী চলে যাবার পর মালঞ্চর হত্যার ব্যাপারটা চিন্তা চিন্তা করতে করতে সেটা যেন তার অজ্ঞাতেই আপনা থেকে সক্রিয়তার দিকে মোড় নেয়। এবং প্রথমেই যেটা তার মনে হয়, আঞ্চলিক থানার ও. সি. সুশীল চক্রবর্তীর সাহায্যই তার সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
সুশীল চক্রবর্তী কিরীটীর একেবারে অপরিচিত নয়, তাছাড়া কিরীটী জানে তার মাথার মধ্যে কিছু বস্তু আছে, তার মস্তিষ্কের গ্রে সেলগুলো সাধারণের চাইতে একটু বেশীই সক্রিয়, তার প্রমাণও কিছুদিন আগে একটা হত্যা মামলার ব্যাপারে পেয়েছিল কিরীটী।
কিরীটী আর দেরী করে না, জংলীকে ডেকে হীরা সিংকে গাড়ি বের করতে বলে দিল।
গায়ে জামা চড়াচ্ছে কিরীটী, কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকল।—বেরুচ্ছ নাকি কোথাও?
রাত্রি তখন প্রায় দশটা। কিরীটী বললে, হ্যাঁ, একবার থানায় যাচ্ছি, সুশীল চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করতে হবে।
-মালঞ্চর হত্যা মামলাটা তাহলে তুমি accept করলে?
–কি করি, ভাদুড়ীমশাইকে না করতে পারলাম না।
—তা কাল সকালে গেলেই তো হয়।
—তা হয়, তবে এখন হয়তো তাকে একটু ফ্রি পাবো।
আসলে কিন্তু কৃষ্ণা খুশিই হয়েছে। ইদানীং তার স্বামীর ঐ ধরনের নিষ্ক্রিয়তা কৃষার আদৌ যেন ভাল লাগছিল না। মানুষটার হাতে যখনই কোন কাজ থাকে না তখনই তার মুখে এক বুলি কিরীটী রায় বুড়ো হয়ে গিয়েছে।
কৃষ্ণা প্রতিবাদ জানায়, চুল পাকলেই মানুষ কিন্তু বুড়িয়ে যায় না।
কিরীটী হাসতে হাসতে বলে, বয়স হলে বুড়িয়েই যায়।
—কত বয়েস হয়েছে তোমার?
–হিসাব করে দেখ সজনী, চৌষট্টি—সিক্সটি ফোর।
—তাহলে আমিও তো বুড়ি হয়ে গিয়েছি, আমারও তো বয়েস—
কিরীটী বলে উঠেছে, না, তোমার বয়স আমার চোখে বাড়েনি—
—আমার চোখেও তুমি বুড়ো হয়ে যাওনি, বুঝেছ—
কৃষ্ণা বললে, বেশী রাত কোরো না কিন্তু।
—না, তাড়াতাড়ি ফিরব।