কিন্তু দুর্ভাগ্য, দশরথকে আর কোন প্রশ্নাদি করার কিরীটীর কোন সুযোগই হল না পরের দিন।
তার আগেই সে মানুষের সমস্ত প্রশ্নের সর্বপ্রকার নাগালের বাইরে চলে গেল একান্ত আকস্মিক ভাবেই যেন।
অর্থাৎ পরের দিন প্রত্যুষে সরকার ভিলায় যাবার পূর্বে সকলে বসে যখন চা-পান করছে, সংবাদ পাওয়া গেল শ্রীমান দশরথ নিহত।
সংবাদটা শুধু অভাবিতই নয়—আকস্মিক।
শ্রীমান দশরথ নিহত!
থানা থেকে সরকার ভিলা যেতে যে রাস্তাটা তারই মধ্যপথে পড়ে সুশান্তদের বাড়ি মণি লজ।
দশরথের মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে সরেজমিন তদন্ত করতে যাবার পথে তাই বিমল সেন সংবাদটা দিতে ঢুকেছিল সুশান্তদের বাড়িতে।
কি ব্যাপার বিমল? সুশান্তই প্রশ্ন করে।
সরকার ভিলায় যে আবার আর একজন খতম হয়েছে!
সে কি?
হ্যাঁ, পুওর শ্রীমান দশরথ দি পুরাতন ভৃত্য! মধুসূদনবাবু সংবাদ পাঠিয়েছেন—তাই সেইখানেই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম সংবাদটা তোমাকে দিয়ে যাই। শ্ৰীমন্তবাবু আগেই রওনা হয়ে গিয়েছেন।
অতঃপর কিরীটীর পরিচয় পেয়ে বিমল বললে, আপনি যখন এসে গিয়েছেন, চলুন না মিঃ রায়—যাবেন নাকি অকুস্থানে? .
চলুন, আমরাও তো সেখানে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কিরীটী বলে।
সুশান্ত বলে, বিমল, এক কাপ চা হবে নাকি?
হে, আগে চল ওখান থেকে একবার ঘুরে আসি। তারপর ফেরবার পথে হবেখন।
সকলে তখন সরকার ভিলার উদ্দেশ্যে গাত্রোত্থান করল।
সুশান্তদের বাড়ি মণি লজ থেকে সরকার ভিলা খুব দূর নয়।
সামান্যই ব্যবধান।
মণি লজের ছাত থেকে সাদা রঙের সরকার ভিলাটা বেশ পরিষ্কার দেখা যায়।
সরকার ভিলার গেট দিয়ে ঢুকে পারলারের মধ্যে শ্রীমন্ত, মধুসূদন সরকার এবং বৃন্দাবন সরকার পরস্পরের মধ্যে নিম্নস্বরে কি সব আলোচনা করছেন ওরা দেখল। ওদের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে শ্ৰীমন্ত চৌধুরী বললেন, এই যে স্যার, আপনি এসে গিয়েছেন।
কী ব্যাপার? ডেড বডি দেখলেন? গম্ভীর কণ্ঠে বিমল প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, দেখলাম। হুবহু এ কেসটা আগের মতই মনে হল। বোধ হয় সেম্ পয়েজনিংও।
সে কি!
হ্যাঁ, দেখবেন চলুন না। সিমিলার সাইনস, সিম্পটমস।
সুশান্তই মধুসূদন সরকারের সঙ্গে কিরীটীর আলাপটা করিয়ে দিল।
মধুসূদন যেন কিরীটীকে দেখে বেশ খুশীই হলেন বলে মনে হল।
বৃন্দাবন সরকারের দিক থেকে কিন্তু বিশেষ কোন সাড়া পাওয়া গেল না।
কিরীটী বললে চলুন তাহলে ডেড বডিটা একবার দেখে আসা যাক। মিঃ সেন কি বলেন?
হ্যাঁ, চলুন।
সকলে উঠে দাঁড়াল।
নিচের তলাতেই পূবের একখানি ঘর।
দশরথ একা একা থাকত। ঠাকুর ও অন্যান্য ভূত্যদের সঙ্গে ভৃত্যদের মহলে সে থাকত না।
পুরাতন ভৃত্য হিসাবে তার বোধ হয় ঐ স্বাতন্ত্রটুকু ছিল।
ঘরখানি আকারে ছোটই।
ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল।
সর্বাগ্রে বিমল ও তার পশ্চাতে শ্ৰীমন্ত চৌধুরী, সুশান্ত, কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
মধুসূদন ও বৃন্দাবন সরকার ওদের সঙ্গে আসেননি।
ঘরের দক্ষিণ ও পশ্চিমমুখী দুটি জানলা। দুটি জানলাই খোলা ছিল।
প্রচুর আলো ঘরের মধ্যে।
একপাশে একটা কাঠের তক্তপোশ।
তার উপরে মলিন একটা শয্যা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে এবং তার ঠিক নিচেই মেঝেতে নিষ্প্রাণ দশরথের দেহটা উবুড় হয়ে পড়ে আছে।
মৃতদেহের মুখের পেশীতে পেশীতে যেন একটা যন্ত্রণার বিকৃতি এবং বিস্ফারিত ওষ্ঠের ফাঁক দিয়ে গাজলা গড়াচ্ছে তখনও।
পরিধানে একটি মলিন ধুতি ও গায়ে একটা শতছিদ্র মলিন গেঞ্জি।
মৃতের পাশেই একটা কাঁসার গ্লাস উটে পড়ে আছে এবং ঘরের সেইখানকার মেঝেটা জলে ভিজা।
বোঝা গেল গ্লাস থেকে জল সেখানে পড়েছিল, এখনও শুকায়নি।
কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত ভূপতিত নিপ্রাণ দশরথের দেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে কিরীটী ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করল নিঃশব্দে একবার। ঘরের মধ্যে বিশেষ কোন জিনিসপত্র নেই।
এককোণে একটা টিনের তোরঙ্গ, তার গায়ে একটা মিলারের চ্যাপ্টা তালা ঝুলছে, তার পাশেই ছোট একটা জলচৌকি মত, সেটার উপরে একটা ছোট মেজার গ্লাস ও তার পাশে একটা ঔষধের শিশি।
ঘরের এককোণে পেরেকের সাহায্যে দেওয়ালে একটা দড়ি টাঙানো—তার উপর কয়েকটা ধুতি, গোটা দুই জামা ও একটা আলোয়ান ঝুলছে।
আর দেওয়ালে পেরেকের মাথায় ঝোলানো একটা পুরাতন ছাতা। কিরীটী নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে চৌকিটার উপর থেকে ঔষধের শিশিটা তুলে নিল।
শিশিটা কালো রঙের, বেঁটে ও গোল।
গায়ে ইউনিয়ন ড্রাগের পেটেন্ট হজমের ঔষধ ডায়াপেপসিনের একটা লেবেল আঁটা।
কিরীটী শিশিটা হাতে তুলে নিল।
শ্ৰীমন্ত চৌধুরী কিরীটীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে বললে, গোকুল বলে যে চাকরটি এ বাড়িতে কাজ করে তার মুখেই শুনেছিলাম, দশরথের নাকি হজমের গোলমাল ছিল, তাই অনেক দিন থেকেই ঐ ঔষধটা ও খেতে ডাক্তারের নির্দেশে।
কিরীটী অতঃপর শিশিটা চৌকির উপর নামিয়ে রাখতে রাখতে মৃদুকণ্ঠে কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই হললে, হুঁ, একজনের হার্টের ছিল প্যালপিটেশন ও ইনসমনিয়া, অন্যজনের ডিসপেপসিয়া। একজনের কোরামিন ও লুমিনল, অন্যজনের ডায়াপেপসিন। হত্যাকারীর রাস্তাটা বেশ পরিষ্কারই ছিল দেখছি।
কি বললেন মিঃ রায়? প্রশ্ন করে বিমলই।
না, বলছিলাম, দুটো ঘটনা যদি হত্যাই হয়ে থাকে তো হত্যাকারী হার্টের প্যালপিটেশন এবং ইনসমনিয়া ও ডিসপেপসিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল।
তাহলে আপনার ধারণা মিঃ রায়, দুটো ব্যাপারই হত্যা?
আগে সন্দেহ থাকলেও, দশরথের মৃত্যুর পর আর নেই মিঃ সেন। যা, দুটোই হত্যা। প্রথমটার মোটিভ যাই থাকুক না কেন, দ্বিতীয়টির মোটিভ বোঝা যাচ্ছে-প্রথমটার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কিন্তু যাক সে কথা, এখানে এ ঘরে আমার যা দেখবার ছিল দেখা হয়ে গিয়েছে। চলুন সারদাবাবুর লাইব্রেরী ঘরে যাওয়া যাক এবার।