০৭. কাকাবাবু আর জোজো মুখোমুখি

বেশ কিছুক্ষণ কাকাবাবু আর জোজো মুখোমুখি বসে রইল চুপ করে।

তারপর কাকাবাবু দুহাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে বললেন, সবকিছুরই একটা ভাল দিক থাকে। এরা আমাদের হাত-পা বাঁধেনি। বাঁধতেও তো পারত। তার মানে, এরা ঠিক ডাকাত নয়, অন্য কিছু। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারও নয়, মশাল জ্বলছে। ক্রাচদুটোও দিয়ে গেছে দেখছি।

জোজো বলল, এরা খেতে দেবে কি? খিদে পাচ্ছে!

কাকাবাবু বললেন, সে কী! এর মধ্যেই খিদে পাবে কেন, আমরা তো রাত্তিরের খাবার খেয়ে নিয়েছি।

জোজো বলল, ও তাই তো। ভুলে গিয়েছিলাম। সকালে ব্রেকফাস্ট দেবে?

কাকাবাবু বললেন, এতবড় হোটেল, দেওয়াই তো উচিত! জোজো, তুমি গুহার মুখটা দেখে এসো তো, সেখানে কী অবস্থা?

জোজো দৌড়ে চলে গেল। ফিরে এল একটু পরেই। মুখটা বিবর্ণ।

সে বলল, কাকাবাবু, সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। মুখটা একেবারে বন্ধ। আমরা যে ভেতরে আছি, তা বাইরে থেকে কেউ বুঝতেই পারবে না। কী হবে?

কাকাবাবু বললেন, অত ঘাবড়াবার কী আছে! বাংলায় বলে, যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। যতক্ষণ নিশ্বাস পড়ে, ততক্ষণ আশা ছাড়তে নেই। সন্তু তো বাইরেই আছে। সে কি আমাদের ভুলে যাবে?

জোজো বলল, সন্তু লোকটাকে কী জোর আছাড় মারল! ইস, সেই সময় যদি রিভলভারটা তুলে নেওয়া যেত!

কাকাবাবু বললেন, সিনেমায় এসব খুব সহজ মনে হয়। কিন্তু এইসব ক্রিমিনাল, তারা কি বোকা? তারা সবসময় তৈরি থাকে। ওই লোকটা এমন গুলি চালাল, আমার কাঁধের কাছে ছুঁয়ে গেছে। ও ইচ্ছে করলে আমার বুকেও মারতে পারত!

আচ্ছা কাকাবাবু, ওই লোকটা আসলে কে? আপনি তো ওকে চিনতে পেরেছেন?

তোমরা যে ওকে কেন চিনতে পারোনি, সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। আমরা তো একই সঙ্গে ওর ছবি দেখেছি!

ছবি?

মণিকরণে একটা বাড়ির দেওয়ালে ওর ছবি সাঁটা ছিল, মনে নেই? সেই যে, একটা লোক হারিয়ে গেছে, যার সন্ধান পেলে দশ হাজার ডলার দেওয়া হবে। তা নিয়ে কত কথা হল।

কিন্তু সে-লোকটা তো বিদেশি। মানে, ক্যানেডিয়ান!

বিদেশিরা কি এদেশি সাজতে পারে না? আমাদের দেশের কত লোক তো সাহেব সাজে! বিদেশিরাও ভারতীয় সাজতে পারে!

এখানে আসার সময় সন্তু বলছিল বটে যে, ধরমবীর সিংকে ঠিক ভারতীয় মনে হয় না। ওর ইংরিজি অন্যরকম। আমি তখন বললাম, দেবলীনার বাবা তো জানিয়েই গেছেন যে, ধরমবীর সিং, ছোটবেলায় বিলেতে ছিল, তাই ইংরিজি তো অন্যরকম হতেই পারে।

ও বিলেতেও থাকেনি, ওর নামও ধরমবীর সিং নয়। ও ক্যানেডিয়ান। ওর নামটা মনে আছে?

কী যেন, কী যেন, চিরাক, তাই না?

কারও নাম দেখলে, ছবি দেখলে, ভাল করে লক্ষ রাখতে হয়। তুমিই তো বলেছিলে ওকে খুঁজে বের করে দশ হাজার ডলারের পুরস্কার নিতে হবে?

মনে পড়েছে। মনে পড়েছে, চার্লস চিরাক!

চিরাক নয়। শিরাক। তা হলে আর চার্লস হবে না, শার্ল! ফরাসি দেশের এক রাষ্ট্রপতির নাম ছিল শিরাক। ক্যানাডার একদিকেও অনেক ফরাসি আছে। সেইজন্যই আমার মনে হয়েছিল, শার্ল শিরাক যার নাম, সে নিশ্চয়ই ফরাসি ভাষা জানবে! লোকটির চোখ দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। মেলার ভিড়ের মধ্যে আমি ইচ্ছে করে ওর গায়ে ঢলে পড়ে দু-একটা ফরাসি ভাষায় কথা বলেছিলাম। জানো তো, মানুষকে হঠাৎ তার মাতৃভাষায় কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে, বা যে-কোনও কথা বললে সে মাতৃভাষাতেই উত্তর দেয়। তুমি পৃথিবীর যে-কোনও দেশেই যাও, হঠাৎ যদি কেউ বাংলায় তোমায় জিজ্ঞেস করে, তুমি কেমন আছ? তুমি সঙ্গে সঙ্গে বাংলাতেই উত্তর দেবে, ভাল! তাই না? আমার ফরাসি কথা শুনে ওই লোকটাও কিছু না ভেবেই ফরাসিতে উত্তর দিয়েছিল। একটু পরে খেয়াল হতেই পালিয়ে গেল। তখনই আমি বুঝে গেলাম, লোকটা আসলে কে!

ছবিটা তা হলে ও নিজেই লাগাবার ব্যবস্থা করেছে?

নিশ্চয়ই তাই। যাতে লোকের ধারণা হয় যে, ও মরেই গেছে। এতদিন পরে কেউ ওকে খুঁজবে না।

এরকম ছদ্মবেশ ধরার কী কারণ থাকতে পারে?

দুটো কারণ থাকতে পারে। হয় ও আগে কোনও বড় ধরনের অপরাধ করেছে, যেজন্য পুলিশ ওকে খুঁজবে। তাই চেহারাটা বদলে ফেলেছে। অথবা, ছদ্মবেশ ধরে ও সাঙ্ঘাতিক কোনও কাণ্ড করে আবার সাহেব সেজে যাবে। যতদূর মনে হচ্ছে, মাণ্ডির জেলখানা ভাঙার ব্যাপারের সঙ্গে ওর কোনও যোগ আছে। জেল থেকে যারা পালিয়েছে, তাদের অধিকাংশই বিদেশি!

কাকাবাবু একটা হাই তুললেন। তারপর বললেন, অনেক রাত হল, এখন একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক।

জোজো বলল, এই অবস্থায় আপনার ঘুম আসবে?

কাকাবাবু বললেন, আমি দুটো জিনিস মানি। এইরকম অবস্থায় পড়লেও সামনে যদি কিছু খাবার থাকে, খেয়ে নেবে। আর হাতে সময় থাকলে ঘুমিয়ে নেবে। কেন না, পরে খেতে পাবে কি না, ঘুমোতে পারবে কি না, তার তো কিছু ঠিক নেই। এখন তো কিছু দরকার নেই, ঘুমনোই ভাল।

কাকাবাবু কোটটা খুলতে গিয়ে চমকে গেলেন। একটা পকেট চাপড়ে বললেন, আরে! নরেন্দ্রর মোবাইল ফোনটা রয়ে গেছে। ফেরত দিতে ভুলে গেছি। নরেন্দ্রও চায়নি। এটাতেই তো খবর দেওয়া যায়।

তিনি ফোনটা চালু করে বোতাম টিপলেন। তার কাছে চারটে নম্বর আছে।

জোজো ব্যগ্রভাবে তাকিয়ে রইল। তার মুখে হাসি ফুটেছে। নরেন্দ্র ভার্মাকে খবর দেওয়া গেলে আর কোনও চিন্তা নেই। এই ফোনগুলো কী দারুণ কাজে লাগে!

কাকাবাবু সবকটা নম্বর টিপলেন। কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। বাজলই না। তিনি বললেন, যাঃ, এ কী হল! কিছু শোনা যাচ্ছে না।

জোজোর মুখ আবার শুকিয়ে গেছে। সে আস্তে-আস্তে বলল, একটা বিশেষ এলাকার বাইরে চলে গেলে এই ফোন কাজ করে না।

কাকাবাবু বললেন, তা হতে পারে। অনেকে রাত্তিরবেলা বন্ধ করে রাখে। দূর ছাই! ওরা আমার রিভলভারটা কেড়ে নেওয়ার পরে আর পকেট সার্চ করেনি। এই ফোনটা থেকেও কোনও লাভ হল না।

জোজো বলল, ওরা আমার পকেটও সার্চ করেনি। আমার কাছে একটা ছুরি আছে।

জোজো সেটা পকেট থেকে বের করে দেখাল, ছোট ছুরি।

কাকাবাবু বললেন, ওইটুকু ছুরি দিয়ে তো পাথর কাটা যাবে না। তবু যা হোক একটা অস্ত্র সঙ্গে রইল!

এর পর কাকাবাবু বেঞ্চে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। ঘুমও এসে গেল।

কয়েক ঘণ্টা পরে তার ঘুম ভেঙে গেল মানুষের গলার আওয়াজ শুনে। কেউ যেন তাকে ডাকছে, রাজাবাবু, রাজাবাবু, উঠুন!

মশালটা নিভে গেছে এর মধ্যে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। ডাকটা কোনদিক থেকে আসছে, বোঝা যাচ্ছে না।

আবার কেউ ডাকল, রাজাবাবু, শিগগির উঠুন!

শব্দটা আসছে গুহার ছাদের দিক থেকে।

কাকাবাবু বললেন, কে?

সে বলল, আমি নৃপেন। আমি একটা দড়ি ফেলে দিচ্ছি, সেটা ধরে ওপরে উঠে আসুন।

কাকাবাবু বললেন, কেন, ওপরে উঠব কেন?

নৃপেন বলল, এই গুহা থেকে বেরুবার আর কোনও উপায় নেই। সামনের মুখটা বন্ধ। এইদিকে উঠে এলে আপনারা বেঁচে যাবেন।

কাকাবাবু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, আমাদের বাঁচাবার জন্য তোমার এত আগ্রহ কীসের? তুমি তো একটা বিশ্বাসঘাতক ছুঁচো। ওদের দলে যোগ দিয়েছ। আমাদের ওখানে তুলতে চাইছ কী মতলবে?

নৃপেন বলল, আমি সার পয়সার জন্য ওদের হয়ে কাজ করেছি। কিন্তু বাঙালি হয়ে কি বাঙালিদের মেরে ফেলতে পারি?

কাকাবাবু বললেন, অনেক বাঙালিই বাঙালিকে মারে। পয়সার লোভে মানুষ শয়তান হয়ে যেতে পারে।

নৃপেন এবার কাতর গলায় বলল, বিশ্বাস করুন সার, আমি আপনাদের বাঁচাতেই এসেছি। মা-কালীর দিব্যি! মা-দুর্গার দিব্যি। আমার নিজের মায়ের দিব্যি! দেরি করবেন না। তা হলে সব বানচাল হয়ে যাবে।

জোজোও এর মধ্যে উঠে বসেছে। কাকাবাবু হাতড়ে হাতড়ে দড়িটা ধরে ফেললেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, আমিই আগে উঠছি। জোজো, আমার ক্রাচদুটো তুমি তুলে দিয়ো।

দড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতে, গুহার দেওয়ালে পা রেখে রেখে উঠে এলেন ওপরে। গুহায় ছাদের একপাশে একটা মস্তবড় ফাটল, সেখান থেকে একটা মানুষ গলে যেতে পারে। তবে দড়ি না থাকলে এত ওপরে এমনি এমনি কারও পক্ষে ওঠা সম্ভব নয়।

ওপাশে খানিকটা সমান জায়গা। সেখানে বসে আছে নৃপেন।

কাকাবাবু উঠে আসতেই সে কাকাবাবুর পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, আমাকে ক্ষমা করুন সার। লোভের বশে ওদের হয়ে কাজ করেছি। কিন্তু মানুষ মারাটারা… ওরে বাপরে বাপ, আমার দ্বারা তা কখনও হবে না। আপনি বিখ্যাত লোক, বাংলার গর্ব, আপনাকে ওরা মেরে ফেলতে চাইলে আমি তা সহ্য করব? তবে সার, আপনি এই হোটেলে না এলেই পারতেন, তা হলে আপনাদের কোনও বিপদ হত না।

কাকাবাবু জোজোর জন্য দড়িটা নামিয়ে দিতে দিতে নৃপেনকে জিজ্ঞেস করলেন, ভূতেশ্বরের মূর্তিটা তুমিই চুরি করেছিলে?

নৃপেন জিভ কেটে বলল, আমি ঠাকুর-দেবতা চুরি করব! আমার পাপের ভয় নেই? ওটা ওরাই চুরি করিয়েছে। তবে কী জানেন, ওটা স্রেফ পুলিশের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য। মূর্তিটার দাম বড়জোর তিন-চার হাজার টাকা, তার জন্য এরা হাত গন্ধ করবে কেন? এই সাহেবদের কোটি কোটি টাকার কারবার। মূর্তিটা চুরি করা হয়েছিল, যাতে পুলিশ ওই নিয়ে ব্যস্ত থাকে!

কাকাবাবু বললেন, জেলখানার দেওয়াল ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার খবর শুনে আমারও মনে হয়েছিল মুর্তি চুরিটা শুধু পুলিশকে ধোকা দেওয়ার জন্যই।

নৃপেন বলল, ওটা যে ফেরত দেওয়া হবে, সেটাও আগে থেকে ঠিক করা ছিল। ধরমবীর বলেছিল, ওটা একেবারে পুলিশের বড়কর্তার বাড়ির সামনে রেখে আসতে। আমিই ওদের বললাম, বরং মূর্তিটা রায়চৌধুরীবাবুর বারান্দায় পৌঁছে দাও। একই তো ব্যাপার। আপনি কেসটা নিয়েছিলেন, আপনার হাত দিয়ে উদ্ধার হলে আপনার সম্মান বাড়বে, বাঙালি হিসেবে আমি তো সেটাই চাই। তারপর আপনারা আজ সন্ধেবেলা মানালির দিকে রওনা দিলেন, আমি ভাবলাম, যাক, ঝামেলা চুকে গেল। এর মধ্যে যে আপনি আবার বাঘের গুহায় ঢুকে পড়বেন সাধ করে, তা কে জানত!

কাকাবাবু বললেন, তুমি মূর্তি চুরি করোনি, তা হলে তুমি এদের হয়ে কী কাজ করেছ? খবরাখবর দেওয়া?

নৃপেন বলল, তা খানিকটা করতে হয়েছে ঠিকই। তবে আসল কাজটা শুনলে আপনি নির্ঘাত অবাক হয়ে যাবেন। আমাকে সর্বমোট পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছে, বারোজন সাহেবকে বাঙালি সাজিয়ে দেওয়ার জন্য।

কাকাবাবু সত্যিই অবাক হয়ে বললেন, বাঙালি সাজিয়ে দেবার জন্য? নৃপেন বলল, হ্যাঁ সার। জেল থেকে তো বারোজন সাহেব পালিয়েছে। এখন ওরা রাস্তায় বেরোলেই ধরা পড়বে। পুলিশ সব সাহেবের ছবি মিলিয়ে দেখছে। পাসপোের্ট দেখছে। তাই ওরা বাঙালি সেজে পালাচ্ছে। এখানে অনেক বাঙালি টুরিস্ট আসে, তাদের ভিড়ে মিশে গেলে কেউ ওদের সন্দেহ করবে না। পাসপোর্টও দেখতে চাইবে না। সবারই মুখে, হাত-পায়ে একটু একটু কালো রং মাখানো হয়েছে। ধুতি, পাঞ্জাবি আনিয়ে রাখা হয়েছিল আগে থেকে। শাল, মাঙ্কিটুপি, তাও জমা করা ছিল। এর আগে আমি দুজন অন্য সাহেবকে বাঙালি সাজিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। তারা রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে, কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। বাঙালি সাজা এই বারোজন কোনওরকমে বর্ডার পেরিয়ে নেপালে পালাবে।

প্রথমে ক্রাচদুটো, তারপর জোজোকে তুলে আনা হয়েছে। কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের ওই ধরমবীরই নাটের গুরু?

নৃপেন বলল, হ্যাঁ, সার, তারই তো সব প্ল্যান। দুমাস ধরে সব ব্যবস্থা হয়েছে। সবই তো ঠিকঠাক মিলে গিয়েছিল, যদি আপনি মাঝখানে এসে না পড়তেন! এখন এই পাহাড়ের উলটো দিক দিয়ে নেমে যান, বড় রাস্তায় গিয়ে পড়বেন, ভোর তো হয়ে এল। রাস্তায় গাড়ি পেয়ে যাবেন।

কাকাবাবু বললেন, নেমে যাব মানে? সন্তু কোথায়?

নৃপেন বলল, তাকে তো হোটেলের একটা ঘরে আটকে রেখেছে। হোটেলে ঢোকা এখন ডেঞ্জারাস ব্যাপার। সাহেবরা দুজন-তিনজন করে বেরুবার জন্য তৈরি হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, সন্তুকে না নিয়ে আমরা যাব নাকি?

জোজো বলল, কিছুতেই না। নৃপেন বলল, ঠিক আছে, আপনারা এগোন। আপনার তো নামতে সময় লাগবে। আমি দেখছি যদি ছেলেটাকে বের করে আনতে পারি। তাকে বোধ হয় তিনতলায় রেখেছে।

কাকাবাবু বললেন, শুধু তোমার ভরসায় ছেড়ে দিতে পারি না। আমাকেও যেতে হবে।

কাকাবাবু এগোতে শুরু করলেন।

একটু একটু করে আলো ফুটছে। পাহাড়ের আড়ালে সূর্য দেখা যাচ্ছে না। হোটেলটা দেখা যাচ্ছে আবছাভাবে। কাকাবাবু জোজোকে বললেন, বড় বড় পাথরের পাশ দিয়ে পাশ দিয়ে চলো, যেন কেউ দেখতে না পায়।

হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে একজন লোক বেরিয়ে কী যেন ফেলে দিয়ে আবার ভেতরে ঢুকে গেল।

কাকাবাবু দেওয়াল ঘেঁষে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর আবার এগোলেন সেই দরজার দিকে। নৃপেন এর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

হাতে কোনও অস্ত্র নেই বলে কাকাবাবু খানিকটা অসহায় বোধ করছেন। আছে শুধু ক্রাচদুটো। সাবধানে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন, কেউ নেই। ঢুকে পড়লেন ভেতরে।

বারান্দাটা এখনও অন্ধকার। ডান পাশেই সিঁড়ি।

কাকাবাবু ফিসফিস করে জোজোকে বললেন, প্রথমে তিনতলাটাই দেখা যাক। কেউ যেন টের না পায়।

কাকাবাবুর ক্রাচের তলায় রবার বসানো, তাই ঠকঠক শব্দ হয় না। কিন্তু একটু না একটু শব্দ তো হবেই। তিনি উঠতে লাগলেন এক পা এক পা করে, থেমে থেমে।

সিঁড়ির বাঁক ঘোরার মুখেই একটা লোক একেবারে সামনা সামনি এসে গেল। তার হাতে বন্দুক। সেই বন্দুকটা তুলে গুলি চালাবার আগেই কাকাবাবু ক্রাচ দিয়ে তাকে মারলেন প্রচণ্ড জোরে।

লোকটা মাটিতে পড়ে গিয়েও বন্দুকটা ছাড়ল না। কাকাবাবু আবার মারলেন তার হাতে। এবারে লোকটা বন্দুকটা ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে এসে গলা চেপে ধরল কাকাবাবুর। শুরু হল ধস্তাধস্তি।

লোকটা সিঁড়ির ওপরের ধাপে, কাকাবাবুনীচে, তাই লোকটার সুবিধে বেশি। সে কাকাবাবুকে প্রায় ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। জোজো পেছনদিক থেকে এসে লোকটার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল। কাকাবাবু কোনওক্রমে বললেন, বন্দুকটা…

লোকটা সঙ্গে সঙ্গে কাকাবাবুকে ছেড়ে বন্দুকটা তুলতে যেতেই কাকাবাবু একটা জোর লাথি কষালেন তার পেছনে। লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। কাকাবাবু আবার ক্রাচ দিয়ে মারলেন তার ঘাড়ে। লোকটা আর নড়ল না।

কাকাবাবু নিচু হয়ে তাকে উলটে দিয়ে নাকের কাছে আঙুল নিয়ে নিশ্বাস পড়ছে কি না দেখলেন।

তারপর বললেন, অজ্ঞান হয়ে গেছে। মরেনি। এ যে দেখছি সেই হু-হু বাবু!

জোজো বলল, তাই তো! আমি তখনই বলেছিলাম, ও পাগল নয়!

কাকাবাবু বললেন, ও থাক এখানে পড়ে! আর একটু হলে আমাকে ফেলে দিচ্ছিল আর কী!

বন্দুকটা হাতে নিয়ে খুশি হয়ে বললেন, অটোমেটিক রাইফেল! কাজে লাগবে।

ক্রাচদুটো নামিয়ে রেখে বললেন, আমাকে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে হবে। ক্রাচ নিয়ে বন্দুক চালানো যাবে না। জোজো, তুমি একটা হাতে রাখতে পারো, লাঠির মতন ব্যবহার করবে।

দোতলায় উঠেই শুনতে পেলেন, একটা গাড়ির স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ। সামনের বারান্দা থেকে উঁকি মেরে কাকাবাবু দেখলেন, একটা স্টেশন ওয়াগন স্টার্ট নেওয়ার চেষ্টা করছে, পাশে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালিবাবু, একজনের মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ।

জোজো বলল, কাকাবাবু, ওরাই সেই ছদ্মবেশী সাহেব। পালাচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, আমি গুলি করে থামাতে পারি। কিন্তু ওরা যদি সত্যিকারের বাঙালি হয়? এ-হোটেলে অন্য কেউ আছে কি না তা তো জানি না। এমন সেজেছে, চেনাই যাচ্ছে না।

কাকাবাবু গাড়িটার চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালালেন।

সঙ্গে সঙ্গে লোক তিনটি শুয়ে পড়ল মাটিতে। তাদেরও একজন গুলি চালাল বারান্দার দিকে।

কাকাবাবু জোজোকে নিয়ে দেওয়ালের আড়ালে বসে পড়ে বললেন, লড়াই শুরু হয়ে গেল। খুব সাবধান।

ঠিক তক্ষুনি তার কোটের পকেটে রুনুঝুনু শব্দ করে বেজে উঠল মোবাইল ফোন।

কাকাবাবু বললেন, আরে, এটা বাজছে দেখছি!

কানের কাছে নিয়ে শুনলেন নরেন্দ্র ভার্মার গলা। তিনি বললেন, গুড মর্নিং, রাজা। এত সকালে ঘুম ভাঙালাম? কাল রাত্তিরে ঠিক সময়ে মানালি পৌঁছে ছিলে তো? কোনও অসুবিধে হয়নি। সেই খবর নিচ্ছি।

কাকাবাবু বললেন, শোনো নরেন্দ্র, আমরা মানালিতে নেই। সেই রাস্তার মাঝপথে, একটা পাহাড়ের ওপর হিল ভিউ লজ হোটেল। এক গাড়ি পুলিশ নিয়ে সেখানে এক্ষুনি চলে এসো। জেলভাঙা কয়েদিরা সব এখানে রয়েছে। কাছাকাছি কোনও থানা থাকলে খবর দাও, যাতে তারা আগে চলে আসে। এক মিনিটও সময় নষ্ট করলে চলবে না। জীবন-মরণের প্রশ্ন। হারি আপ, প্লিজ হারি আপ!

দোতলার ঘরের একটা দরজা খুলতেই কাকাবাবু ফোনটা ফেলে সেদিকে একটা গুলি চালালেন। তারপর চেঁচিয়ে বললেন, কেউ কোনও ঘর থেকে এখন বেরোবেন না। বেরোলে তাঁর জীবনের দায়িত্ব আমি নিতে পারব না।

অন্যদিকের একটা দরজার ফাক দিয়ে একজন মুখ বাড়াল। কাকাবাবু সেদিকেও একটা গুলি চালালেন।

একতলায় চ্যাঁচামেচি, হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেছে।

কাকাবাবু এমন একটা জায়গায় দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছেন, যেখান থেকে দোতলার বারান্দাটা পুরো দেখা যায়, একতলার সিঁড়ি আর তিনতলার সিঁড়িও দেখা যায়। তলা থেকে কেউ উঠে এলে কিংবা ওপর থেকে কেউ নামতে চাইলেই গুলি খাবে।

ওপর থেকে কেউ এল না, কিন্তু একতলা থেকে দুজন উঠতে চেষ্টা করল একসঙ্গে। কাকাবাবু একঝক গুলি চালালেন তাদের দিকে। তারা পিছু হটে গেল।

হঠাৎ দোতলার ঘরের একটা দরজা ঝট করে খুলে গেল, একজন লোক বেরিয়ে এসে একটা ছুরি ছুড়ে মারল কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবুর একটু দেরি হয়ে গেল, লোকটির ছুরিটাই প্রথম এসে লাগল তার বা কাঁধে। কাকাবাবুর গুলি খেয়ে লোকটা ঘুরে পড়ে গেল।

কাকাবাবু বললেন, ইস, মরেই গেল নাকি লোকটা? আমি কাউকে একেবারে মেরে ফেলতে চাই না।

জোজো ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে বলল, কাকাবাবু, আপনার লেগেছে! রক্ত বেরোচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ লেগেছে বটে, কিন্তু অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মরব না।

জোজো বলল, পুলিশ কখন আসবে। আমরা কতক্ষণ লড়াই করব!

কাকাবাবু বললেন, যতক্ষণ না আসে, ততক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। থামার তো উপায় নেই।

ছুরিটা কাঁধে গেঁথে আছে, একটানে সেটা তিনি তুলে ফেললেন। রক্ত বেরুল গলগল করে। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে চেপে ধরলেন সেখানে।

তারপর বললেন, জোজো, তিনতলা থেকে কেউ নামবার চেষ্টা করেনি। ওখানে এদের কেউ নেই মনে হয়! একতলা থেকে কেউ ওঠবার চেষ্টা করলে আমি আটকাব। দোতলার ঘরের দরজা খুলে আর কেউ বেরুচ্ছে কি না তুমি ভাল করে লক্ষ রাখো৷

কথা বলতে-বলতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে গুলি চালাতে লাগলেন হোটেলের বাইরের গাড়িগুলো লক্ষ্য করে। সবকটা গাড়ির চাকা ফেঁসে গেল।

সেখান থেকেও একঝক গুলি ছুটে এল, কিন্তু ততক্ষণে কাকাবাবু আবার বসে পড়েছেন। সন্তুষ্টভাবে বললেন, গাড়ি নিয়ে আর পালাতে পারবে না।

একটু আগে যে লোকটা গুলি খেয়েছে, সে মরেনি। উপুড় হয়ে কাতরাচ্ছে।

মিনিট পাঁচেক পরে আবার দুটো ঘরের দরজা খুলে গেল এক সঙ্গে। দুটো লোক বেরিয়ে এল, দুজনেরই হাতে দুটো ডাণ্ডা। কাকাবাবু এবার তৈরি ছিলেন, বন্দুকের নলটা মুহূর্তের মধ্যে ঘুরিয়ে দুজনকেই আহত করে দিলেন। তারা আবার ঘরে পালিয়ে গেল।

কাকাবাবু বললেন, সর্বনাশ!

জোজো বলল, কী হল?

কাকাবাবু বললেন, গুলি ফুরিয়ে গেল যে!

জোজো সাঙ্ঘাতিক ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, অ্যাঁ এখন কী হবে? এখনও পুলিশ এল না।

কাকাবাবু বললেন, কত কাছে থানা আছে, তা তো জানি না। খবর পেয়ে তারা তৈরি হয়ে আসবে। এসে পড়বে আশা করছি।

জোজো বলল, নরেন্দ্ৰকাকাকে আবার ফোন করুন।

কাকাবাবু বললেন, আর ফোন করে কী হবে। এতক্ষণে তার বেরিয়ে পড়ার কথা। সন্তুর কী হল বুঝতে পারছি না। নীচের তলা থেকে নিশ্চয়ই কেউ আমাদের ওপর নজর রেখেছে। আমরা তিনতলায় উঠতে গেলে পেছনদিক থেকে গুলি চালাবে!

জোজো ছটফট করতে করতে বলতে লাগল, কখন পুলিশ আসবে? কখন পুলিশ আসবে!

কাকাবাবু বললেন, দোতলায় আর কেউ নেই মনে হচ্ছে। বাকি সবাই। একতলায়। এবার কি সত্যিই ধরা দিতে হবে। এবার ধরতে পারলে ওরা আর সময় নষ্ট করবে না।

কিছুক্ষণের জন্য সব চুপচাপ। তারপর একতলায় সিঁড়ির পাশ দিয়ে একটা রিভলভার সমেত হাত বেরিয়ে এসে এলোপাথাড়ি গুলি চালাল দুটো। কাকাবাবু তার উত্তর দিতে পারলেন না বলে এবার মানুষটাও বেরিয়ে এল। ধরমবীর ওরফে চার্লস শিরাক।

এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সে বলল, জানতাম, গুলি একসময় ফুরোবেই। এবার কী করবে রায়চৌধুরী?

কাকাবাবু মুখ তুলে দেখলেন, তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে নৃপেন আর সন্তু। নৃপেনের জামা রক্তে ভেজা, সন্তুরও কপালে লেগে আছে রক্ত। পাহারাদারের সঙ্গে খুব একচোট মারামারি হয়েছে বোঝা গেল।

ধরমবীরকে রিভলভার হাতে উঠতে দেখেই সন্তু আবার উঠে গেল তিনতলায়।

ধরমবীর বলল, রায়চৌধুরী, তোমার সঙ্গে আমাদের কোনও শত্রুতা ছিল। তোমাকে ছেড়েও দিতে চেয়েছিলাম। তবু তুমি শুধু শুধু মরতে এলে।

কাকাবাবু বললেন, যারা ক্রিমিনাল, তারা সব মানুষেরই শত্রু। তোমার সঙ্গীরা সবাই ধরা পড়েছিল, তুমি ছদ্মবেশ ধরে পুলিশের চোখ এড়িয়েছিলে। জেল ভেঙে তাদের উদ্ধার করার প্ল্যানও করেছিলে বেশ। সব ফেঁসে গেল তো!

ধরমবীর আর-এক সিঁড়ি উঠে এসে বলল, কিছুই ফাঁসেনি। শুধু তুমি ঝঞ্ঝাট পাকিয়ে একটু দেরি করিয়ে দিলে। তুমি বলেছিলে, কেউ তোমাকে মারতে পারে না। এবার তোমায় কে বাঁচাবে?

কাকাবাবু বললেন, এখনও তো মারতে পারোনি।

ধরমবীর বলল, আগেরবার দয়া করেছিলাম। এবার আর দয়ামায়া নেই। আমি ঠিক তিন গুনব। এক, দুই-

ধরমবীরের আর তিন গোনা হল না। ওপর থেকে একটা চেয়ার এসে পড়ল তার মাথায়। তারপরই সন্তু রেলিং বেয়ে সরসর করে নেমে এল। ধরমবীর উঠে দাঁড়াবার আগেই সন্তু লাফিয়ে একটা জোড়া পায়ের লাথি মারল তার মুখে।

জোজোও নেমে গিয়ে একটা ক্রাচ দিয়ে ধড়াম ধড়াম করে পেটাতে লাগল তাকে।

কাকাবাবু বললেন, জোজো, ওর রিভলভারটা আমাকে দাও।

সেটা হাতে পেয়ে তিনি একই জায়গায় বসে থেকে বললেন, সন্তু, জোজো, এবার তোমরা সরে যাও।

ধরমবীর উঠে দাঁড়িয়ে অবাক ভাবে সন্তু আর জোজোকে একবার দেখল।

তারপর কাকাবাবুকে বলল, ওটা পেয়েও তোমার বিশেষ কিছু লাভ হবে। ওতে আর মাত্র চারটে গুলি আছে। তা দিয়ে তুমি কতক্ষণ লড়বে? তুমি কিছুতেই নীচে নেমে পালাতে পারবে না। অন্তত দশজন নীচে তোমার জন্য তৈরি হয়ে আছে।

কাকাবাবু বললেন, আপাতত আমার নীচে যাওয়ার ইচ্ছেও নেই। তুমিও যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। নীচ থেকে অন্য কেউ উঠে আসার চেষ্টা করলে তোমাকেই প্রথম মরতে হবে!

ধরমবীর বলল, রায়চৌধুরী, তুমি কত টাকা চাও?

কাকাবাবু বললেন, একশো কোটি। দিতে পারবে?

ধরমবীর বলল, একশো কোটি? এ তো পাগলের মতন কথা। এক কোটি টাকাই এদেশে অনেক টাকা। তোমাকে এক কোটি টাকা দিতে পারি।

কাকাবাবু ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, মাত্র এক কোটি? ছছাঃ! অত সামান্য টাকা নিয়ে কী করব!

ধরমবীর বলল, তুমি যতই চালাকি করো, এখান থেকে তোমার বেরোবার কোনও রাস্তা নেই। আমাকে মেরে ফেললেও অন্যরা তোমায় ছাড়বে না!

কাকাবাবু বললেন, আমাকে নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। তোমার। খেলা শেষ। আজ থেকে তুমি আবার শার্ল শিরাক। তোমার জায়গা হবে। জেলে। আর বেশি ধৈর্য ধরারও দরকার নেই। জোজো দেখো তো, গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে মনে হল।

জোজো বাইরের দিকে উঁকি মেরে লাফাতে লাফাতে বলল, এসে গেছে! এসে গেছে! দুখানা পুলিশের গাড়ি!