[প্রথমবার আমেরিকায় অবস্থানকালে জনৈক পাশ্চাত্য শিষ্যের প্রশ্নের উত্তরে লিখিত]
জগতের সমতা নষ্ট হইয়াছে; বিনষ্ট সাম্যাবস্থার দৃষ্টান্ত এই সমগ্র বিশ্ব। জগতের সব গতিকেই এই সাম্যাবস্থা ফিরিয়া পাইবার প্রয়াস বলা যায়; সেইজন্য ইহাকে ‘গতি’ আখ্যা দেওয়া চলে না। অন্তর্জগতের সাম্যাবস্থা এমন একটি জিনিষ, যাহা আমাদের চিন্তার অতীত; কারণ চিন্তা নিজেই গতিবিশেষ। প্রসার মানে পূর্ণ সমতার দিকে অগ্রসর হওয়া; আর সমগ্র জগৎ সেইদিকেই ধাবমান। কাজেই পূর্ণসাম্যাবস্থা কখনই লাভ করা যায় না—এ-কথা বলিবার অধিকার আমাদের নাই। সাম্যাবস্থায় কোনরূপ বৈচিত্র্য থাকা অসম্ভব, উহাকে বৈচিত্র্যহীন হইতেই হইবে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত মাত্র দুটি পরমাণু থাকিবে, ততক্ষণ উহারা পরস্পরকে আকর্ষণ-বিকর্ষণ করিয়া সাম্যভাব নষ্ট করিবে। সাম্যাবস্থা—একত্ব, স্থিতি ও সাদৃশ্যের অবস্থা। অন্তর্জগতের দিক্ হইতে এই সাম্যাবস্থা চিন্তাও নয়, শরীরও নয়, এমন কি যাহাকে আমরা গুণ বলি, তাহাও নয়। নিজের স্বরূপ বলিতে যাহা বুঝায়, এ অবস্থায় একমাত্র তাহাই থাকে; ইহাই সৎ-চিৎ-ও আনন্দ-স্বরূপ।
একই কারণে এই অবস্থা কখনও দুই প্রকার হইতে পারে না। ইহা অদ্বিতীয়। এখানে তুমি-আমি প্রভৃতি সর্ববিধ কৃত্রিম বৈচিত্র্য অন্তর্হিত হইবেই; কারণ বৈচিত্র্য পরিবর্তন বা অভিব্যক্তির অবস্থা, উহা মায়ার অন্তর্গত। অবশ্য বলিতে পার, আত্মার এই অভিব্যক্ত অবস্থা দেখিয়া আত্মা পূর্বে স্থির ও মুক্ত ছিল, এ-কথা মনে হইলেও বর্তমান ভেদপূর্ণ অবস্থাই উহার প্রকৃত স্বরূপ; যাহা হইতে আত্মা এই পরিবর্তনশীল অবস্থায় আসিয়াছে, তাহা আত্মার আদিম অপরিণত অবস্থা; সে অবস্থায় আবার ফিরিয়া যাওয়া মানে অধঃপতন। এ-কথা বলিতে পার বটে, তবে এ-কথার কোন মূল্য বা গুরুত্ব নাই; থাকিত, যদি প্রমাণিত হইত যে, আত্মার একরূপতা ও নানাধর্মিতা নামক অবস্থাপ্রাপ্তি মাত্র একবারই ঘটে। কিন্তু তাহা তো নয়, যাহা একবার ঘটে, বার বার তাহার পুনরাবৃত্তি হইবেই। স্থিতিকে অনুসরণ করে পরিবর্তন—জগৎ। স্থিতির পূর্বে পরিবর্তন নিশ্চয়ই ছিল, এবং পরিবর্তনের পর স্থিতি আবার আসিবেই; বার বার এরূপ ঘটিবে। এ-কথা চিন্তা করা হাস্যকর যে, একদা নিরবচ্ছিন্ন স্থিতি ছিল এবং তারপর নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন আসিয়াছে। প্রকৃতির প্রতিটি কণা দেখাইতেছে যে, ক্রমান্বয়ে স্থিতি ও পরিবর্তনের ভিতর দিয়া উহা নিয়মিতভাবে চলিতেছে।
দুইটি স্থিতিকালের মধ্যবর্তী ব্যবধানের নাম কল্প। কাল্পিক স্থিতি একটি পূর্ণ সমজাতীয় অবস্থা হইতে পারে না; হইলে ভাবী বিকাশের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ-কথা বলা অযৌক্তিক যে, বর্তমান পরিবর্তনের অবস্থা পূর্বের স্থিতি অবস্থার তুলনায় উন্নততর; কারণ তাহা হইলে ভাবী স্থিতি-অবস্থার কাল পূর্ববর্তী পরিবর্তন-অবস্থার কাল অপেক্ষা অধুনাতন হওয়ার জন্য সে অবস্থা পূর্ণতর হইবে! প্রকৃতি একই রূপ বারেবারে দেখাইতেছে; নিয়ম বলিতে বস্তুতঃ ইহাই বুঝায়। জীবাত্মাদের বেলা কিন্তু (বিভিন্ন কল্পে ক্রমশঃ) উন্নততর অবস্থাপ্রাপ্তি ঘটে; অর্থাৎ জীবাত্মারা কল্প হইতে কল্পান্তরে নিজ স্বরূপের অধিকতর নিকটবর্তী হয়; এভাবে ক্রমোন্নত হইতে হইতে প্রতি কল্পেই অনেক জীবাত্মা মুক্ত হইয়া যায়, আর তাহাদের সংসার-চক্রে আবর্তিত হইতে হয় না।
বলিতে পার, জীবাত্মা তো জগৎ ও প্রকৃতির অংশ, জগৎ ও প্রকৃতির মত সেও তো বার বার পুনরাবর্তন করিবে, তাহার মুক্তি হইতে পারে না; জগতের ধ্বংস না হইলে তাহার মুক্তি হইবে কিরূপে? উত্তরে বলা যায়, জীবাত্মা মায়ার কল্পনা মাত্র, স্বরূপতঃ সেও যথার্থ সত্তা বা ব্রহ্ম।
জীবাত্মাই নির্বিশেষ ব্রহ্ম। প্রকৃতির ভিতর যাহা সৎ বস্তু, তাহাই ব্রহ্ম; মায়ার অধ্যাসের জন্য তিনিই এই নানাত্ব বা প্রকৃতি বলিয়া প্রতীত হইতেছেন। মায়া দৃষ্টিবিভ্রম মাত্র; সেইজন্য মায়াকে ‘সৎ’ বলা যাইতে পারে না। তথাপি মায়া এই দৃশ্য-জগৎ সৃষ্টি করিতেছে। যদি বল, মায়া নিজে অসৎ হইয়া সৃষ্টি করে কিরূপে? তাহার উত্তরে বলা যায়—যাহা সৃষ্ট হয়, তাহাও যে অজ্ঞান (অসৎ), কাজেই স্রষ্টা তো অজ্ঞানী (অসৎ) হইবেই। জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞান সৃষ্ট হইতে পারে কিভাবে? কাজেই বিদ্যা ও অবিদ্যা—এই দুই রূপে মায়া কার্য করিতেছে। অবিদ্যা বা অজ্ঞানকে নাশ করিয়া বিদ্যা নিজেও বিনষ্ট হয়। এভাবে মায়া নিজেকে নিজেই বিনাশ করে; যাহা বাকী থাকে, তাহাই সচ্চিদানন্দ—ব্রহ্ম। প্রকৃতির ভিতর যাহা সৎবস্তু, তাহাই ব্রহ্ম। প্রকৃতি তিনটি রূপে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়—ঈশ্বর, চিৎ বা জীব, এবং অচিৎ বা জড়বস্তু। এ-সবেরই প্রকৃত স্বরূপ ব্রহ্ম। মায়ার ভিতর দিয়া দেখি বলিয়া তিনি নানারূপে প্রতিভাত হন। তবে ঈশ্বর-দর্শন করাই—চরম সত্তাকে ঈশ্বররূপে দর্শন করাই চরম সত্তার সবচেয়ে নিকটবর্তী হওয়া, এবং ইহাই সর্বোত্তম দর্শন। সগুণ ঈশ্বরের ভাবই মানবীয় ভাবের সর্বোচ্চ অবস্থা; প্রকৃতির গুণগুলি যে অর্থে সত্য, ঈশ্বরে আরোপিত গুণগুলিও সেই অর্থে সত্য। তথাপি এ-কথা যেন আমরা কখনও ভুলিয়া না যাই যে, নির্গুণ ব্রহ্মকে মায়ার ভিতর দিয়া দেখিলে যেরূপ দেখায়, তাহাই সগুণ ঈশ্বর।