সপ্তম পরিচ্ছেদ—কর্ণবধ
অর্জুন কৃষ্ণের কথা বুঝিলেন, কিন্তু অর্জুন ক্ষত্রিয়, প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিবার জন্য ব্যাকুল। অতএব যাহাতে দুই দিক্ রক্ষা হয়, কৃষ্ণকে তাহার উপায় অবধারণ করিতে বলিলেন।
কৃষ্ণ বলিলেন, অপমান মাননীয় ব্যক্তির মৃত্যস্বরূপ। তুমি যুধিষ্ঠিরকে অপমানসূচক একটা কথা বল, তাহা হইলেই, তাঁহাকে বধ করার তুল্য হইবে। অর্জুন তখন যুধিষ্ঠিরকে অপমানসূচক বাক্যে ভর্ৎসিত করিলেন। কিন্তু কৃষ্ণকে আবার এক বিপদে ফেলিলেন। বলিলেন, আমি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে অপমানিত করিয়া গুরুতর পাপ করিয়াছি, অতএব আত্মহত্যা করিব। এই বলিয়া আবার অসি নিষ্কোষিত করিলেন। কৃষ্ণ তাঁহারও মৃত্যু সোজা ব্যবস্থা করিলেন। বলিলেন, আত্মশ্লাঘা সজ্জনের মৃত্যুস্বরূপ। কথাটা কিছুমাত্র অন্যায় নহে। অর্জুন তখন অনেক আত্মশ্লাঘা করিলেন। তখন সব গোল মিটিয়া গেল।
কৃষ্ণ, অর্জুনের সারথি, কিন্তু যেমন অর্জুনের অশ্বের যন্তা, তেমনি এখন স্বয়ং অর্জুনেরও নিয়ন্তা। কখনও অর্জুনে আজ্ঞায় কৃষ্ণ রথ চালান, কখনও কৃষ্ণের আজ্ঞায় অর্জুন চলেন। এখন কৃষ্ণ, অর্জুনকে কর্ণবধে নিযুক্ত করিলেন।
এই কর্ণবধ মহাভারতের একটি প্রধান ঘটনা। বহুকাল হইতে ইহার সূত্রপাত হইয়া আসিতেছে। কর্ণই অর্জুনের প্রতিযোদ্ধা। ভীমার্জুন নকুল সহদেব চারি জনে যুধিষ্ঠিরের জন্য দিগ্বিজয় করিয়াছিলেন, কর্ণ একাই দুর্যোধনের জন্য দিগ্বিজয় করিয়াছিলেন। অর্জুন দ্রোণের শিষ্য, কর্ণদ্রোণগুরু পরশুরামের শিষ্য। অর্জুনের যেমন গাণ্ডীব ধনু ছিল, কর্ণের তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট বিজয় ধনু ছিল। অর্জুনের কৃষ্ণ সারথি, মহাবীর শল্য কর্ণের সারথি, উভয়ে অনেক দিব্যাস্ত্রে শিক্ষিত। উভয়েই পরস্পরের বধের জন্য বহুদিন হইতে প্রতিজ্ঞাত। অর্জুন ভীষ্মদ্রোণবধে কিছুমাত্র যত্নশীল ছিলেন না, কর্ণবধে তাঁহার দৃঢ় যত্ন। কুন্তী যখন কর্ণকে কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত অবগত করিয়া, তাঁহার নিকট আর পাঁচটি পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাহিলেন, তখন কর্ণ যুধিষ্ঠির ভীম নকুল সহদেবের প্রাণ ভিক্ষা মাতাকে দিয়াছিলেন, কিন্তু কিছুতেই অর্জুনের প্রাণ ভিক্ষা দিলেন না। তাঁহাকে বধ করিবেন, না হয় তাঁহার হস্তে নিহত হইবেন, ইহা নিশ্চিত জানাইলেন।
সেই মহাযুদ্ধে অদ্য অর্জুনকে কৃষ্ণ লইয়া যাইলেন। ইহারই জন্য কৃষ্ণ অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের শিবিরে লইয়া আসিয়াছিলেন। ভীম অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের সন্ধানে যাইতে বলিয়াছিলেন বটে, কিন্তু রণ শেষ না করিয়া অর্জুনের আসিতে ইচ্ছা ছিল না। কৃষ্ণ জিদ করিয়া তাঁহাকে লইয়া আসিয়াছিলেন। ইহাই তাঁহার অভিপ্রেত যে, কর্ণ ক্রমাগত যুদ্ধ করিয়া পরিশ্রান্ত হউন, অর্জুন ততক্ষণ বিশ্রাম লাভ করিয়া পুনস্তেজস্বী হউন। এক্ষণে যুদ্ধে লইয়া যাইবার সময়ে আরও অর্জুনের তেজোবৃদ্ধি জন্য অর্জুনের বীরত্বের প্রশংসা করিলেন, এবং তাঁহার পূর্বকৃত অতিদুর্ধর্ষ কার্য সকল স্মরণ করাইয়া দিলেন। দ্রৌপদীর অপমান, অভিমন্যুর অন্যায়যুদ্ধে হত্যা প্রভৃতি কর্ণকৃত পাণ্ডবপীড়ন বৃত্তান্ত সকল স্মরণ করাইয়া দিলেন। এই বক্তৃতার মধ্য হইতে কোন অংশ উদ্ধৃত করিবার প্রয়োজন নাই। কেবল ইহাই বক্তব্য, কৃষ্ণ বলিতেছেন, “পূর্বে বিষ্ণু যেমন দানবগণকে বিনাশ করিয়াছিলেন,” “পূর্বে দানবগণ বিষ্ণু কর্তৃক নিহত হইলে” ইত্যাদি বাক্যে বুঝিতে পারি যে, কৃষ্ণ এখনও আপনাকে বিষ্ণুর অবতার বলিয়া পরিচয় দেন না। দেবত্বে কোন অধিকার প্রকাশ করেন না, ইহা প্রথম স্তরের একটি লক্ষণ। দ্বিতীয় স্তরে, অন্য ভাব।
পরে কর্ণার্জুনের যুদ্ধ আরম্ভ হইল। তাহার বর্ণনায় আমার প্রয়োজন নাই। কথিত হইয়াছে যে, কর্ণের সর্পবাণ হইতে কৃষ্ণ অর্জুনকে রক্ষা করিয়াছিলেন। অর্জুন উহার নিবারণ করিতে পারেন নাই, অতএব কৃষ্ণ পদাঘাতে অর্জুনের রথ ভূমিতে কিঞ্চিৎ বসাইয়া দিলেন, অশ্বগণ জানু পাতিয়া পড়িয়া গেল। অর্জুনের মস্তক বাঁচিয়া গেল; কেবল কিরীট কাটা পড়িল। অর্জুন নিজে মস্তক অবনত করিলেও সেই ফল হইত। কথাটা সমালোচনার যোগ্য নহে। তবে কৃষ্ণের সারথ্যের প্রশংসা মহাভারতে পুনঃ পুনঃ দেখা যায়।
যুদ্ধের শেষ ভাগে কর্ণের রথচক্র মাটিতে বসিয়া গেল। কর্ণ তাহা তুলিবার জন্য মাটিতে নামিলেন। যতক্ষণ রথচক্রের উদ্ধার না করেন, ততক্ষণ জন্য অর্জুনের কাছে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। অর্জুনও ক্ষমা করিয়াছিলেন দেখা যাইতেছে, কেন না, কর্ণ তাহার পর আবার রথে উঠিয়া পূর্ববৎ যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু কর্ণের দুর্ভাগ্য যে, ক্ষমা প্রার্থনাকালে তিনি অর্জুনকে এমন কথা বলিয়াছিলেন যে, ধর্মতঃ তিনি ঐ সময়ের জন্য কর্ণকে ক্ষমা করিতে বাধ্য; কৃষ্ণ অধর্মের শাস্তা। তিনি কর্ণকে তখন বলিলেন,
“হে সূতপুত্র! তুমি ভাগ্যক্রমে এক্ষণে ধর্ম স্মরণ করিতেছ। নীচাশয়েরা দুঃখে নিমগ্ন হইয়া প্রায়ই দৈবকে নিন্দা করিয়া থাকে; আপনাদিগকে দুষ্কর্মের প্রতি কিছুতেই দৃষ্টিপাত করে না। দেখ, দুর্যোধন, দুঃশাসন ও শকুনি তোমার মতানুসারে একবস্ত্রা দ্রৌপদীরে যে সভায় আনয়ন করিয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন দুষ্ট শকুনি দুরভিসন্ধি-পরতন্ত্র হইয়া তোমার অনুমোদনে অক্ষক্রীড়ায় নিতান্ত অনভিজ্ঞ রাজা যুধিষ্ঠিরকে পরাজয় করিয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন রাজা দুর্যোধন তোমার মতানুযায়ী হইয়া ভীমসেনকে বিষান্ন ভোজন করাইয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি বারণাবত নগরে জতুগৃহমধ্যে প্রসুপ্ত পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করিবার নিমিত্ত অগ্নিপ্রদান করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি সভামধ্যে দুঃশাসনের বশীভূতা রজস্বলা দ্রৌপদীরে, হে কৃষ্ণে! পাণ্ডবগণ বিনষ্ট হইয়া শাশ্বত নরকে গমন করিয়াছে, এক্ষণে তুমি অন্য পতিরে বরণ কর, এই কথা বলিয়া উপহাস করিয়াছিলে এবং অনার্য ব্যক্তিরা তাঁহারে নিরপরাধে ক্লেশ প্রদান করিলে উপেক্ষা করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি রাজ্যলোভে শকুনিকে আশ্রয়পূর্বক পাণ্ডবগণকে দ্যূতক্রীড়া করিবার নিমিত্ত আহ্বান করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি মহারথগণসমবেত হইয়া বালক অভিমন্যুরে পরিবেষ্টন পূর্বক বিনাশ করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? হে কর্ণ! তুমি যখন তত্তৎকালে অধর্মানুষ্ঠান করিয়াছ, তখন আর সময় ধর্ম ধর্ম করিয়া তালুদেশ শুষ্ক করিলে কি হইবে? তুমি যে এখন ধর্মপরায়ণ হইলেও জীবন সত্ত্বে মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হইবে, ইহা কদাচ মনে করিও না। পূর্বে নিষধদেশাধিপতি নল যেমন পুষ্কর দ্বারা দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হইয়া পুনরায় রাজ্য লাভ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ধর্মপরায়ণ পাণ্ডবগণও ভুজবলে সোমদিগের সহিত শত্রুগণকে বিনাশ করতঃ রাজ্যলাভ করিবেন। ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ ভুজবলে অবশ্যই ধর্মসংরক্ষিত পাণ্ডবগণের হস্তে নিহত হইবে।”
কৃষ্ণের কথা শুনিয়া কর্ণ লজ্জায় মস্তক অবনত করিলেন। তার পর পূর্বমত যুদ্ধ করিয়া, অর্জুনবাণে নিহত হইলেন।