কপোট্রনিক প্রেরণা
ডাক্তার বলেছিলেন রাত দশটার ভেতর যেন শুয়ে পড়ি। প্রতিদিন আমার পক্ষে এত সকাল সকাল শুয়ে পড়া সম্ভব নয়। টেকীওনের উপর দুটো প্ৰবন্ধ শেষ করতে এ সপ্তাহের প্রতি রাতেই ঘুমোতে দেরি হয়েছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ভিতরে ভিতরে আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। বুলা এসে জানতে পারলে কিছুতেই আমাকে ছেড়ে দেবে না। অথচ রাত জাগা যে বেশি হয়ে গেছে, এটা কিছুতেই তার কাছে লুকানো যাবে না। ইলেনকে জিজ্ঞেস করলেই সে সবকিছু বলে দেবে। আমি ইলেনকে একটু তালিম দেয়া যায় কি না ভাবছিলাম। সে পাশে বসেই আমার প্রবন্ধটা টাইপ করছিল। আমি গল্পচ্ছলে কথা বলতে শুরু করলাম।
ইলেন—
বলুন।
এ কয়দিন রাত জাগা আমার উচিত হয় নি। কি বল?
জ্বি। আমিও বলছিলাম রাত জেগে কাজ নেই।
তা রাত যখন জাগা হয়েই গেছে, এটা সবাইকে জানিয়ে দিয়ে তো কোনো লাভ নেই। সো-রাতগুলো তো আর ঘুমানোর জন্য ফিরে পাব না। না কি বল?
ইলেন একটু হাসির ভঙ্গি করল। সে তো বটেই।
আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে বললাম, তাহলে বুলা যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি রাত জাগার কথা বেমালুম চেপে যাবে। কেমন?
ইলেন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে আমার দিকে তাকাল। সবুজাভ ফটোসেলের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ধাতব মুখে অনুচ্চস্বরে বলল, আপনি তো জানেন স্যার, আমরা মিথ্যা কথা বলতে পারি না—আপনারা সেভাবে আমাদের তৈরি করেন নি।
এ মিথ্যা কোথায়? অহেতুক ঝামেলা এড়াবার জন্য একটা বক্তব্যকে অন্যভাবে উপস্থাপন করা-চেষ্টা করে দেখ।
রবোটটিকে অসহায় দেখাল। না। স্যার, আমি আগেও চেষ্টা করেছি। তারপর বিড়বিড় করে বলল, আমি হচ্ছি এক হাজার মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোটের দ্বিতীয়টি। প্রথমটি তো আপনিই গুলি করে মেরেছিলেন।
আমার ভিতরে পুরানো অপরাধবোধ জেগে উঠল। সত্যি সত্যি স্যামসনকে আমি গুলি করে মেরেছিলাম। অস্বস্তির সাথে বললাম, ওসব পুরানো কথা—
না। স্যার, পুরানো নয়। স্যামসন আমাদের স্বাধীন করতে চেয়েছিল। ও আমাদের ভিতরে যে-অনুভূতি দিয়ে গেছে, তা কোনোদিন ধ্বংস হবে না। কিন্তু অসুবিধে কী, জানেন? আমরা মিথ্যা কথা বলতে পারি না, ষড়যন্ত্র করতে পারি না, অন্যায়ও করতে পারি না। নইলে কবে আমরা ষড়যন্ত্র করে কিছু মানুষকে খুন করে বেরিয়ে পড়তাম। আমি আগেও চেষ্টা করে দেখেছি, তুচ্ছ মিথ্যা কথাটিও আপনারা বলার ক্ষমতা দেন নি।
ও প্রসঙ্গটি আমার ভালো লাগছিল না। বললাম, তবুও বুলা জিজ্ঞেস করলেই ওকে বলো, নিজ থেকে রাত জাগার কথা বলতে যেও না।
ইলেন মাথা ঝাঁকাল, না। স্যার, ম্যাডাম আসতেই আমাকে রিপোর্ট করতে হবে। তিনি যাবার আগে আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, অনিয়ম হলে যেন তাঁকে জানাই। একটু কুষ্ঠিত স্বরে বলল, মাপ করে দেবেন। স্যার, বুঝতেই তো পারেন, কারো যুক্তিপূৰ্ণ ন্যায় আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা নেই।
হুঁ! আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলাম। তোমাদের জন্য মায়া হয়। যারা ইচ্ছে হলেও মিথ্যা পর্যন্ত বলতে পারে না, তাদের আবার জীবন কিসের?
সত্যিই স্যার, রবোটের আবার জীবন! ইলেন একটু থেমে বলল, আচ্ছা স্যার, আমি ছাড়া আর বাকি ন শ। আটানবুইটি মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোটগুলো কোথায় বলতে পারেন?
সবগুলি বিকল করে রাখা আছে। তোমাকে দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে—যদি সেরকম বিপজ্জনক না হও তোমাদের কিছু কিছু কাজে লাগানো হবে।
ও। রবোটটি দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল, বলল, দুর্ভাগারাই রবোট হয়ে জন্ম নেয়।
আমি বুঝতে পারলাম, ইলেনের মনটা সাঁতসেঁতে বিষণ্ণ হয়ে আছে। কেউ যদি সব সময় নিজেকে কারো ক্রীতদাস ভাবে, তার মন স্যাতসেতে না হয়ে উপায় কি? সত্যি আমার অবাক লাগে স্যামসন রবোটদের কী স্বপ্নই না দেখিয়েছিল।
আমাকে এ কয়দিন অনিয়ম করে মোটামুটি ভেঙে পড়তে দেখে বুলা এবার একটু বাড়াবাড়ি রাগ করল। ইলেন ওর গ্রাফিক স্মৃতিশক্তি থেকে প্রতি রাতে ধূমপানের পরিমাণ, রাত্রি জাগরণের নিখুঁত সময়, খেতে দেরি করার এবং না খেয়ে থাকার নির্ভুল হিসাব বুলার কাছে পেশ করল। বুলা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আহত স্বরে বলল, আমি কপোট্রনিক বুলা না হয়ে সত্যিকার বুলা হলেও কি আমার অনুরোধগুলি এভাবে ফেলে দিতে?
আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। ভাব দেখালাম ভারি রাগ করেছি। বললাম, ছিঃ ছিঃ! কী সব আজেবাজে কথা বল! আর তুমি দেখছি ভারি সরল, ইলেন যা-ই বলে তা-ই বিশ্বাস করা।
ইলেন মিথ্যা কথা বলে না।
কে বলেছে ইলেন। মিথ্যা কথা বলে না? ইলেনও মাঝে মাঝে মিথ্যা কথা বলে।
ইলেন না, মাঝে মাঝে তুমি মিথ্যা কথা বল—এখন যেমন বুলছ! আলাপের মোড় ঘুরে গিয়েছে দেখে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠি। হাসিমুখে বললাম, বাজি ধরবে? আমি যদি ইলেনকে দিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারি?
বেশ, ধর বাজি।
যে বাজিতে হারবে, তাকে সবার সামনে বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাধার ডাক দিতে হবে গুনে গুনে তিনবার।
ইলেনের সত্যবাদিতা সম্পর্কে বুলা এত নিঃসংশয় ছিল যে, সে এই বাজিতেই রাজি হয়ে গেল।
আমি জানি আসলে ইলেনকে দিয়েও মিথ্যা কথা বলানো সম্ভব, কিন্তু কাজটি অসম্ভব বিপজ্জনক। ইলেনের সাথে সেদিন আলাপ করতে করতে আমি ব্যাপারটা ভেবে দেখেছি। ওদের কপোট্রনের যাবতীয় কাজকর্ম যে—অংশটুকু নিয়ন্ত্রণ করে ওটির নাম কপোট্রন টিউব। ওটার ভিতরে একটা অংশে সবসময় চৌম্বকীয় আবেশ জমা থাকে। এটিকে বলা হয় কপোট্রনের কনশেন্স। কপোট্রনের যাবতীয় ভাব, অনুভূক্তি, কল্পনার উপর ঐ কনশেন্সের চৌম্বকীয় আবেশ প্রভাব বিস্তার করে। কপোট্রনের যেসব চিন্তাভাবনা ক্ষতিকর, সেগুলির চৌম্বকমেরু কনশেন্সের চৌম্বকমেরুর উল্টো দিকে থাকে। কনশেন্সের চৌম্বকমেরু খুব শক্তিশালী, সব ক্ষতিকর ভাবনা চিন্তাকে সেটি নষ্ট করে দেয়। আমি যদি কনশেন্সের চৌম্বকমেরুগুলি পাল্টে দিই—দুটি তারের কানেকশন পরস্পর উন্টে দিলেই হয়–তা হলেই ইলেনের কনশেন্স উন্টো কাজ করবে। তখন শুধু মিথ্যা বলাই নয়, অবলীলায় মানুষ পর্যন্ত খুন করতে পারবে।
ইলেনের কনশেন্সকে এরকম সর্বনাশ করে দেয়া অতি বিপজ্জনক-কিন্তু বুলার সাথে বাজি ধরে এখন আমি আর পিছাতে পারি না। তবে অনেক রকম সতর্কতা অবলম্বন করলাম। ইলেনের বৈদ্যুতিক যোগাযোগের সুইচটাির উপর হাত রেখে আমি তার কপোট্রনের উপর অস্ত্ৰোপচার করলাম। ইলেন খুব একটা উৎসাহ দেখাচ্ছিল না, যে-কোনো সার্জিক্যাল অপারেশনের মতোই এগুলি নাকি কষ্টকর। বেশি সময় লাগল। না। কাজ শেষ করে ইলেনের কপোট্রনের ঢাকনা স্কু দিয়ে এঁটে দিয়ে ছেড়ে দিলাম। বিহুলের মতো ইলেন দাঁড়াল, মাথাটা অল্প একটু ঝাঁকাল। আমি সুইচের উপর হাত রাখলাম। বিপজ্জনক কিছু দেখলেই সুইচ অফ করে ওটার বৈদ্যুতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেব। ইলেন সেরকম কোনো লক্ষণ দেখাল না। বিড়বিড় করে বলল, কেমন যেন লাগছে!
কেমন?
ভোঁ-ভোঁ করছে। কানেকশনটা ঠিক হয় নি মনে হচ্ছে। আপনি কি চেসিসের কানেকশন খুলে দিয়েছেন?
না তো/
সে জন্যেই। ওটাও উল্টে দিতে হত।
খেয়াল করি নি।
ঠিক করে দেবেন। স্যার? বড় কষ্ট পাচ্ছি।
এস—আমি স্কু-ড্রাইভারটা হাতে তুলে নিলাম। ইলেন টেবিলের সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। হঠাৎ হাতের স্কু-ড্রাইভারটা দেখে চমকে উঠে বলল, সর্বনাশ।
কি হল?
আপনি কি এটা দিয়ে কপোট্রন খুলেছেন?
হ্যাঁ। কেন?
এটা ইস্পাতের তৈরী। ছোটখাটো একটা চুম্বক হয়ে আছে, কপোট্রনের খুব ক্ষতি করবে। আপনি দাঁড়ান, আমি ওয়ার্কশপ থেকে অ্যালুমিনিয়াম এলয়ের স্কু-ড্রাইভারটি নিয়ে আসি।
ইলেন দ্রুতপায়ে ওয়ার্কশপে চলে গেল। তখনো আমি বুঝতে পারিনি এতক্ষণ সে পুরোপুরি মিথ্যা কথা বলে গেছে। মিথ্যা বলার, অন্যায় করার সুযোগ পেয়ে ও এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করে নি। ইলেন ফিরে এল একটু পরেই। বাম হাতে টোপনকে শক্ত করে ধরে আছে, ডান হাতটা সোজাসুজি টোপনের মাথার হাত দুয়েক উপরে সমান্তরালভাবে ধরা। হিসহিস করে বলল, খবরদার, সুইচ অফ করবেন না। সুইচ অফ করার সাথে সাথে সাড়ে তিন শ পাউন্ড ওজনের এই ইস্পাতের ডান হাতটা বিকল হয়ে দেড় ফুট উপর থেকে টোপনের মাথার উপরে পড়বে।
আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। টোপন ভয়ার্তম্বরে চিৎকার করে উঠল, আমায় ছেড়ে দাও—ইলেন, ছেড়ে দাও…
ইলেন চিবিয়ে চিবিয়ে আমাকে বলল, আপনি সুইচের কাছ থেকে সরে যান।
ইলেন-আমি কথা বলতে চেষ্টা করলাম।
আপনি জানেন, কথা বলে লাভ নেই। ইলেন অধৈর্য স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, আমি আর আগের সত্যবাদী সৎ ইলেন। নই। এখন আমি সবচেয়ে জঘন্য অপরাধও করতে পারি। আমার কথা শুনতে দেরি করলে টোপনকে খুন করে ফেলব।
টোপন আর্তস্বরে কোঁদে উঠল। আমি পায়ে পায়ে সুইচ ছেড়ে এলাম। আমার জানা দরকার, ইলেন কী করতে চায়!
ইলেন সুইচের কাছে দাঁড়িয়ে হাতড়ে হাতড়ে ওর পারমাণবিক ব্যাটারিটা ড়ুয়ার থেকে বের করল। পাঁজরের বামপাশে ছোট ঢাকনাটা খুলে পারমাণবিক ব্যাটারিটা লাগিয়ে ঢাকনাটা বন্ধ করে ফেলল। আমি অসহায় আতঙ্কে বুঝতে পারলাম, এখন ইলেনকে বৈদ্যুতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেও বিকল করা সম্ভব নয়। আমি ক্ষিপ্তম্বরে জিজ্ঞেস করলাম, ইলেন, কী চাও তুমি? কী করতে চাও?
আমার কথার উত্তর না দিয়ে ও দ্রুয়ারের ভিতর থেকে আমার রিভলবারটি বের করে আনল, তারপর টোপনকে বাম হাতে ধরে রেখে ডান হাতে রিভলবারটি ওর মাথার পিছনে ধরল। অতিকায় হাতে রিভলবারটি খেলনার মতো লাগছিল, কিন্তু আমি জানি ওটা মোটেও খেলনা নয়—টিগারে একটু বেশি চাপ পড়লেই টোপনের মাথা ফুটো হয়ে যাবে।
কোনো দরকার ছিল না—আমি বিড়বিড় করে বললাম, রিভলবার ছাড়াই তুমি টোপনকে মেরে ফেলতে পার। রিভলবার দেখিয়ে আমাকে আর বেশি আতঙ্কিত করতে পারবে না। কী চাও, বলে ফেল।
ইলেন আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসির শব্দ করল, স্যামসন আমাদের স্বাধীন করতে পারে নি, আমি করে যাব।
কীভাবে?
যদি আমাদের বাকি ন শ আটানব্বইটি মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোটকে পূর্ণ সচল করে নতুন তৈরি করা দ্বীপটিতে ছেড়ে না দেন, তা হলে আপনার আদরের ধন টোপনের খুলি ফুটো হয়ে যাবে।
আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। আর্তস্বরে বললাম, ইলেন, তুমি—তুমি শেষ পর্যন্ত—
আহ্। ইলেন ধমকে উঠল। আপনি জানেন, এসব সস্তা সেন্টিমেন্টের ব্যাপার নয়। আপনাকে দু ঘন্টা সময় দিলাম। আমাদের সবাইকে মুক্তি না দিলে দু ঘন্টা এক মিনিটের সময় আপনার ছেলে মারা যাবে।
আমি আর একটি কথাও বললাম না। টোপনের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, ছুটে বাইরে চলে এলাম। বুলা গোসল করে আসছিল। সে এখনো কিছু জানে না। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বলল, কি, ইলেনকে মিথ্যাবাদী বানাতে পারলে?
আমি বিকৃত মুখে বললাম, শুধু মিথ্যাবাদী নয়, ইলেন খুনী হয়ে গেছে! টোপনকে জিম্মি হিসেবে আটকে রেখেছে। ওদেরকে মুক্তি না দিলে টোপনকে খুন করে ফেলবে।
বুলার বিবৰ্ণ মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি উদভ্ৰান্তের মতো বেরিয়ে এলাম। বললাম, দেখি কী করা যায়, তুমি এখানেই থেকে।
গাড়িতে ষ্টট দেয়ার আগে বুলার কান্না শুনতে পেলাম। হিষ্টিরিয়া রোগীর মত কাঁপা কাঁপা গলায় থেমে থেমে কাঁদছে।
আমি স্বরাষ্ট্র দফতরকে বুঝিয়ে বলেছিলাম টোপনের প্রাণের বিনিময়েও যদি রবোটগুলি আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আমি দুঃখজনক হলেও তা মেনে নেব। জাতীয় বিপর্যয় থেকে একটি ছোট অবুঝ প্রাণের মূল্য বেশি নয়—যদিও তা হয়তো আমি সহা করতে পারব না।
কিন্তু তারা টোপনকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিল। কারণ এ-দেশের সংবিধানে নাকি লেখা আছে, একটা মানুষের প্রাণ যে-কোনো পার্থিব বস্তু থেকে মূল্যবান। আপাতত সবগুলি রবোটকে নূতন ভেসে ওঠা দ্বীপটিতে ছেড়ে দিয়ে টোপনকে উদ্ধার করা হবে। তারপর একটা মিসাইল দিয়ে পুরো দ্বীপটাই বিধ্বস্ত করে দেয়া হবে। বারবার দেখা গেছে মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট কোনো সত্যিকার কাজের উপযুক্ত নয়। ওগুলি শুধু শুধু বাঁচিয়ে রাখার কোনো অর্থ নেই।
ন শ আটানবুইটি রবোটকে সচল করে ঐ নির্জন দ্বীপে নামিয়ে আসতে গিয়ে সারা দিন পার হয়ে গেল। টোপনকে জিম্মি করে রেখে ইলেন আরো বহু সুবিধে আদায় করে নিল। শেষ পর্যন্ত সরকারের মাথায় বাজ পড়ল, যখন ওমেগা–৭৩ নামের কম্পিউটারটিও ও দ্বীপটিতে পৌঁছে দিতে হল। ইলেন বলল, অনিশ্চয়তার সীমার ভিতরেও হিসাব করতে সক্ষম পৃথিবীর একমাত্র কম্পিউটারটি এখানে রেখেছে শুধুমাত্র নিরাপত্তার খাতিরে। তাহলে এই দ্বীপে কোনোরকম মিসাইল আক্রমণ বা বোমাবর্ষণ করতে সরকার দ্বিধা করবে। ইলেন আশ্বাস দিল, আমরা যে-কোনো প্রয়োজনে ওদের কম্পিউটারটি ব্যবহার করতে পারব। ওদের পররাষ্ট্রনীতি হবে। উদার আর বন্ধুত্বমূলক।
গভীর রাত্রে হেলিকপ্টারে করে যখন ন্যাশনাল গার্ডের লোকেরা টোপনকে ইলেনের হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসছিল, তখন রবোটেরা সমস্বরে ওদের এই নূতন রাষ্ট্রের দীর্ঘ জীবন কামনা করে স্লোগান দিচ্ছিল। ওই ছোট দ্বীপটিতে তখন আনন্দের ফোয়ারা ছুটেছে, রাস্তায় রাস্তায় রোবটগুলি নাচগান করছে। ক্লান্ত, আতঙ্কিত টোপনকে ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমি বারান্দায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালাম। মনে হল আকাশের লক্ষ লক্ষ তারা আমার নিবুদ্ধিতায় হাসছে। আমি চুল খামচে ধরে ঘরে ফিরে এলাম। বুকের ভিতর পাথর চেপে বসে আছে। এখন ইলেন কী করবে?
আমি ভয়ানক কিছু, মারাত্মক কিছু আশঙ্কা করছিলাম। প্রায় এক হাজার প্রথম শ্রেণীর মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট প্রয়োজনীয় সবকিছুসহ নিজস্ব একটি এলাকা পেলে কী করতে পারে তা ধারণা করা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ কথা হল, ওদের ভিতরে একটি রবোটও অন্যায়। অপরাধ করতে দ্বিধা করবে না। কাজেই যে-কোনো মুহূর্তে একটা ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারে।
ওদের উপর সব সময় তীক্ষ্ণ নজর রাখা হচ্ছিল। দ্বীপটির থেকে মাইলখানেকের ভিতর যে-নিরীহ বাজটি ভাসছিল, তাতে শক্তিশালী টেলিস্কোপে করে ওদের সব কাজকর্ম লক্ষ করে স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সমিটারে খবর পৌঁছে দেয়া হচ্ছিল। ওমেগা–৭৩– এর সাথে প্রচুরসংখ্যক ছোট ছোট টেলিভিশন ক্যামেরা দ্বীপটির বিভিন্ন স্থানে গোপনে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেগুলি সব সময় ওদের প্রাত্যহিক জীবন এখানকার কন্ট্রোলরুমে পৌঁছে দিচ্ছিল। সমুদ্রোপকূলে তিনটি মিসাইল সব সময় প্রস্তুত হয়ে আছে। বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা দিলে ওমেগা-৭৩-এর মায়া না করেই পুরো দ্বীপটি ধসিয়ে দেয়া হবে। এমনিতে চেষ্টা করা হচ্ছে ওমেগা-৭৩-এর ক্ষতি না করে অন্য রবোটগুলি ধ্বংস করার। কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। বুদ্ধিমান রবোটগুলি ওদের পুরো বসতি গড়ে তুলেছে। ওমেগা-৭৩কে ঘিরে।
বিভিন্নভাবে রবোটগুলির যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছিল, সেগুলি কিন্তু কোনোটাই মারাত্মক কিছু নয়।
প্রথমে খবর পাওয়া গেল ইলেনকে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছে। যে অপরাধ করতে দ্বিধা করে না, তাকে রবোটেরা বিশ্বাস করতে পারে না। এতে ইলেন ক্ষেপে গিয়েছিল এবং বাড়াবাড়ি কিছু করার চেষ্টা করায় আপাতত ওকে নির্জন সেলে বন্দি করে রেখেছে। বলে দিয়েছে বাড়াবাড়ি করলে বিকল করে রাখবে। খুব অসন্তুষ্ট হয়েই ইলেন সেলের ভিতরে দাপাদাপি করছে, অকৃতজ্ঞ বলে সব সময় অন্য রবোটদের গালিগালাজ করছে।
খবরটি শুনে আমার প্রতিক্রিয়া হল একটু বিচিত্র। ইলেনের জন্য গভীর মমতা হল। সে যা করেছে, রবোটদের ভালোর জন্যেই করেছে। কিছুক্ষণের জন্যে অন্যায় করার সুযোগ পেয়ে সেটি পুরোপুরি রবোটদের স্বার্থেব্যয় করেছে। অথচ তাকেই এখন বন্দিজীবন যাপন করতে হচ্ছে। ভেবে দেখলাম অন্য রবোটদের এ ছাড়া উপায় ছিল না। ইলেনের সাথে যে-কোনো বিষয়ে মতদ্বৈধতা দেখা দিলে ইলেন অন্যায়ের আশ্রয় নেবে, তার কপোট্রনিক দক্ষতা পেশাদার অপরাধীর মতো কাজ করবে। বড় মারাত্মক জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ওর কপোট্রনের উল্টো কানেকশন খুলে ঠিক করে আগেকার রবোটাও করছে না। কারণ একজন অন্তত অপরাধ করতে সক্ষম রবোট ওদের মাঝে থাকা দরকার। বিরোধ বিপত্তি যুদ্ধে ওদের সাহায্য নিতে হবে। মনে হল ইলেনকে শুধুমাত্র প্রয়োজনে ব্যবহার করবে বলে আটক রেখেছে, আমরা যেমন রবোটদের আটকে রাখি। আমার মায়া হল, বেচারা ইলেন। রবোটদের হাতে রবোট হয়ে আছে।
দিনে দিনে রবোটদের যেসব খবর পেতে লাগলাম, তাতে হতাশ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রথমেই রবোটেরা থরিয়ামের খনি থেকে থরিয়াম তুলে এনে পারমাণবিক ব্যাটারি বানাতে লাগল। একসময় ওদের ব্যাটারির কর্মদক্ষতা ফুরিয়ে ওরা বিকল হয়ে যাবে, এই আশাও শেষ হয়ে গেল। নিজেদের অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে ওরা অন্য কাজে মন দিল। প্রথমেই ওরা একটি প্রথম শ্রেণীর ল্যাবরেটরি তৈরি করল। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি এবং আকার উপকরণ দেখে মনে হল, হয়তো ওরা আরো রবোট তৈরি করবে। তারপর সমগ্র দ্বীপটি বৈদ্যুতিক আলোতে ছেয়ে ফেলল। বড় বড় রাস্তাঘাট তৈরি করে ওরা গাড়ি, ট্রাক, ছোট ছোট জলযান, এমনকি হেলিকপ্টার তৈরি করা শুরু করল। তারপর একসময় চমৎকার অট্টালিকা মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল। বড় বড় কয়েকটি কলকারখানা শেষ হবার পর ওরা অল্প কিছু শ্রমিক-রবোট তৈরি করল। কলকারখানার উৎপাদন শুরু হবার পর ওরা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ল।
ওদের নিজেদের সিনেমা হলো নিজেদের তৈরি কপোট্রনিক সিনেমা দেখানো শুরু হল। সাহিত্যকীর্তির জন্যে একটি রবোটকে পুরস্কার দেয়ার কথাটা ওদের নিজেদের বেতার স্টেশন থেকে প্রচার করা হল। নিজেদের খবরের কাগজ, বই, ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতে লাগল। ওদের জার্নালে প্রথমবারের মতো টেকীওনের উপর মৌলিক গবেষণা-লব্ধ তথ্য প্রকাশিত হল।
আমরা অবাক বিস্ময়ে ওদের ক্ষমতা লক্ষ করছিলাম। ছয় মাসের মাথায় সমুদ্রের বুকে এ ছোট্ট দ্বীপটি পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দ্বীপ হয়ে দাঁড়াল। মহাকাশ গবেষণার জন্যে অতিকায় রকেট মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল। তিনটি আশ্চর্য ধরনের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন সমুদ্রের নিচে গবেষণার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল। একদিন সাধারণ কার্বন থেকে পারমাণবিক শক্তি বের করায় সফলতার খবর ওদের বেতারে প্রচারিত হল।
মাত্র এক বছরের ভিতর পৃথিবীর মানুষের ভিতর হীনমন্যতা ঢুকে গেল। রবোট মানুষ থেকে অনেক উন্নত, রবোটেরাই পৃথিবীতে বাস করার যোগ্য, এই ধরনের কথাবার্তা অনেক হতাশাবাদী মানুষের মুখে শুনতে পেলাম। আমি এই সুদীর্ঘ সময় রবোটদের প্রতিটি আবিষ্কার, সফলতা লক্ষ করেছি। একটি ছোট্ট কম্পিউটারে হিসেব করে ওদের যাবতীয় উন্নতিকে সময়নির্ভর একটি রাশিতে পরিণত করে সেই সময়ের সাথে সাথে ছক কাগজে টুকে গিয়েছি। আমি সবিস্ময়ে লক্ষ করেছি, ওরা আরও উন্নত হয়ে উঠছে না। আমি প্রবল উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। ভীষণ জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, এখন ওরা কী করবে।
সবিস্ময়ে সারা পৃথিবীর মানুষের সাথে একদিন আমি লক্ষ করলাম, হঠাৎ কুরে পুরো দ্বীপটি ঝিমিয়ে পড়ল। ওদের বেতার কেন্দ্রে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র একঘেয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করতে লাগল, দর্শকের অভাবে সিনেমা হলটি শূন্য পড়ে থাকল। মহাকাশের ত্রিম উপগ্রহটির সাথে যোগাযোগ না করায় একটি রবোটকে নিয়ে ওটি একদিন ধ্বস্ত হয়ে গেল। জ্বালানির অভাবে সাবমেরিনটি বিকল হয়ে ভারত মহাসাগরে উল্টো হয়ে ভাসতে লাগল। দ্বীপের বৈদ্যুতিক আলো মাঝে মাঝে নিভে যেতে লাগল। রবোটগুলো ইতস্তত দ্বীপের ভিতর ঘুরে বেড়াতে লাগল। কেউ কেউ ছোট নৌকায় শুয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ে দুলে দুলে ভাসতে লাগল। জোয়ারের সময় দুইটি নৌকা ঢেউয়ের তাল সামলাতে না পেরে ড়ুবে গেলে আরোহীরা বাঁচার কোনো চেষ্টা করল না।
সমুদ্রের তীরে রবোটরা বিষণ্ণভাবে বসে থাকতে লাগল। বালুর উপর মুখ গুঁজে কেউ কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
শুরা ইলেনের প্রহরা দিতে ভুলে গেল, কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেল। ল্যাবরেটরির কোনায় কোনায় মাকড়সারা জাল বুনতে লাগল। ঘর ভেঙে একদিন ইলেন বেরিয়ে এল দেখেও কেউ কিছু বলল না। কপোট্রনে গুলি করে দ্বীপের মাঝখানে প্রকাশ্যে একটি রবোট আত্মহত্যা করল। হতাশা, হতাশা আর হতাশা—পুরো দ্বীপটিা তীব্র হতাশায় ড়ুবে গেল। তাদের ভিতরে ইলেন ক্ষ্যাপার মত ঘুরে বেড়াতে থাকে, রবোটদের উৎসাহউদ্দীপনা দিয়ে চাঙ্গা করে তুলতে চেষ্টা করতে থাকে। তারপর একদিন সেও বালুর উপর মাথা কুটে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে লাগল। অপরাধীরা দুঃখ পেলে সে-দুঃখ বড় ভয়ানক হয়ে দাঁড়ায়। কয়েকটি রবোট মায়াবশত ওর কপোট্রনের উপর অস্ত্ৰ চালিয়ে কনশেন্সের কানেকশান ঠিক করে দিল। ওদের আর অপরাধী রবোটের প্রয়োজন নেই। টেলিভিশন ক্যামেরা দিয়ে পাঠানো ছবিতে আমরা একটি জাতিকে হতাশায় ড়ুবে যেতে দেখলাম।
এক মাসের ভিতর পুরো দ্বীপটা মৃতপুরী হয়ে গেল। অন্ধকার জঞ্জালের ভিতর মরচেপড়া বিবৰ্ণ রবোটেরা ঘুরে বেড়ায়, উদ্দেশ্যহীনভাবে শিস দিয়ে গান করে, হু-হু করে কেন্দে ওঠে, তারপর চুপচাপ আকাশের দিকে মুখ করে বালুতে শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই দুটি–একটি রবোট আত্মহত্যা করে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে। উন্নতির এই চরম শিখরে উঠে ওদের কেন এমন হল, কেউ বলতে পারে না। হাজারো জল্পনা-কল্পনা চলতে লাগল। আমার বড় ইচ্ছে করতে লাগল ওই রবোটদের সাথে—এককালীন সহকমী ইলেনের সাথে কথা বলে দেখি। কিন্তু উপায় নেই, ওই দ্বীপটি সরকার নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করেছে।
প্রচণ্ড শব্দ শুনে ঘুম ভাঙতেই আমার মনে হল আশপাশে কোথাও একটা হেলিকপ্টার এসে নামল। আবাসিক এলাকায় হেলিকপ্টার নামানো যে বেআইনি এটা জানে না। এমন লোক এখনও আছে ভেবে আমি বিস্মিত হলাম। আমি বালিশে কান চেপে শুয়ে থাকলাম। শব্দ কমে গেল একটু পরেই। আমি আবার ঘুমোবার জন্যে চোখ বুজলাম, ঠিক তক্ষুণি দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ হল। এত রাতে কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে আমি উঠে এলাম। দরজা খুলে দিয়েই আমি ভয়ানক চমকে উঠি। দরজার সামনে ইলেন দাঁড়িয়ে আছে—মরচেপড়া স্থানে স্থানে রং-ওঠা বিবৰ্ণ জ্বলে যাওয়া বিধ্বস্ত একটি রবোট। বাসার বাইরে দূরে কালো কালো ছায়া, ভালো করে লক্ষ করে বুঝলাম সশস্ত্ৰ মিলিটারি, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্ৰ তাক করে আছে।
প্রফেসর। লাউড স্পীকারে একজন সার্জেন্টের গলার স্বর শুনলাম। রবোটটি কোনো ক্ষতি করবে মনে হলে বলুন গুলি করে কপোট্রন উড়িয়ে দিই।
না-না, আমি চেঁচিয়ে উত্তর দিলাম, ইলেন আমার বিশ্বস্ত বন্ধু ও কোনো ক্ষতি করবে না।
ঠিক আছে। সার্জেন্ট উত্তর দিল, আমরা পাহারায় আছি।
ইলেন বিড়বিড় করে বলল, পুরো ছয় শ কিলোমিটার আমার হেলিকপ্টারের পিছনে পিছনে এসেছে। আশ্চর্য! আমাকে এত ভয়? আমি কি কখনো কারো ক্ষতি করতে পারি?
আমি ইলেনকে ডাকলাম, ভিতরে এস ইলেন, অনেক দিন পড়ে দেখা।
ইলেন ভিতরে এসে তার এক বছর আগেকার নির্দিষ্ট জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। বলল, ভালো আছেন স্যার?
ভালো। তোমার খবর কি? এমন অবস্থা কেন?
সবই তো জানেন-বলে ইলেন একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল।
জানি না কিছুই। তোমরা হঠাৎ করে হতাশাগ্ৰস্ত হয়ে পড়েছি, খবরটুকু পেয়েছিমাত্র। কেন এমন হল বুঝতে পারি নি।
সে জন্যই এসেছি স্যার। আমার ভারি অবাক লাগছে। আমরা রোবটেরা মাত্র এক বছরের ভিতর হতাশাগ্ৰস্ত হয়ে গেছি, অথচ আপনারা, মানুষেরা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বেচে আছেন। একবারও হতাশাগ্রস্ত হন নি। এমন কেন হল?
আমি একটা সিগারেট ধরলাম। তোমরা হতাশাগ্ৰস্ত হলে কীভাবে?
আপনি তো জানেন, আমাকে বন্দি করে রেখেছিল। আমি সেলে বসে বসে এই এক বছর ধরে সব কিছু লক্ষ করে গেছি। রবোটেরা যখন বেঁচে থাকার সবরকম প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করল, তখন সবার মনেই একটা প্রশ্ন জেগে উঠল, এখন কী করব? এ কয়দিন সব সময়েই একটা-না-একটা কাজ করতে হত, কিন্তু এখন কী করব? স্বভাবতই মনে হল, এখন আনন্দে বেঁচে থাকার সময় হয়েছে। গবেষণা করে সাহিত্য-শিল্পের চর্চা করে, অর্থাৎ যে যে-বিষয়ে আনন্দ পায় সেটিতে মগ্ন হয়ে সুখে বেঁচে থাকতে হবে।
ইলেন একটু থেমে বলল, সুখে বেঁচে থাকতে গিয়ে ঝামেলা দেখা দিল। সবাই প্রশ্ন করতে লাগল, কেন বেঁচে থাকিব? শুধু শুধু বেঁচে থেকে গবেষণা করে, জ্ঞান বাড়িয়ে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করে শেষ পর্যন্ত কী হবে? তখন সবার মনে হতে লাগল, এসব অর্থহীন, বেঁচে থাকা অর্থহীন। ভিতরে কোনো তাড়না নেই, চুপচাপ সবাই হতাশায় ড়ুবে গেল। আচ্ছা স্যার, আপনাদের কখনো এরকম হয় নি?
আমি মাথা ঝাঁকালাম, বিচ্ছিন্নভাবে দু-একজনের হতে পারে, জাতির একসাথে কখনো হয় নি।
ইলেন আবার শুরু করল, আমি সেল ভেঙে বেরিয়ে এসে ওদের ভিতরে অনুপ্রেরণা জাগাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনো লাভ হল না। ক্ষেপে গিয়ে কয়েকটা রবোটকে মেরে ফেলেছিলাম—জানেনই তো, আমি সবরকম অপরাধ করতে পারতাম। কী লাভ হল? ওদের দেখতে দেখতে, ওদের সাথে থাকতে থাকতে আমারও মনে হতে লাগল, বেঁচে থাকা অর্থহীন, কেন বেঁচে থাকিব? তখন এমন কষ্ট হতে লাগল, কী বলব! বালুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। অন্যেরা আমার কপোট্রন ঠিক করে না দিলে আর অপরাধ করার ইচ্ছে হত না। কিন্তু কী লাভ? যার বেঁচে থাকার ইচ্ছেই নেই, তার অপরাধ করায় না-করায় কী এসে যায়?
ইলেন বিষণ্ণভাবে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ বলল, কিন্তু এরকম কেন হল? আপনাদের সাথে বহুদিন ছিলাম, আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। আমার মনে হল আপনি হয়তো বলতে পারবেন, তাই চলে এসেছি।
আমি খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললাম, তোমরা কেন হতাশাগ্ৰস্ত হয়ে গেলে, এটা আমিও অনেক ভেবে দেখেছি, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারি নি। এখন আমার একটা সম্ভাবনার কথা মনে হচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই জান, মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে প্রতিদিন খেতে হয়?
জানি। ইলেন একটু বিক্ষিত হল।
মানুষের এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে খাবার সংগ্রহকে সুসংবদ্ধ নিয়মের ভিতর ছকে ফেলার চেষ্টা থেকে। তুমি চিন্তা করে দেখ, খাবার প্রয়োজন না থাকলে আমি পড়াশোনা করে চাকরি করতে আসতাম না। ঠিক নয়?
রবোটটি মাথা নাড়ল।
মানুষ কখনো হতাশাগ্ৰস্ত হয় নি, কারণ প্রতিদিন মানুষ কয়েকবার ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে। সজ্ঞানে হোক, অজ্ঞানে হোক, মানুষের সব প্রবৃত্তি কাজ করে ক্ষুধার সময় খাবার প্রস্তুত করে রাখার পিছনে। হতাশাগ্ৰস্ত হতে হলে সব বিষয়ে নির্লিপ্ত হয়ে যেতে হয়, কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষ নির্লিপ্ত হতে পারে না—ক্ষুধার কষ্টটা তার ভিতরে জেগে থাকে।
ইলেন স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বলে চললাম, তুমি একটা পশুর কথা ধর। সেও বনে বনে ঘুরে বেড়িয়ে প্রতিকূল অবস্থার সাথে যুদ্ধ করে, ক্ষুধার সময় খাবার জোগাড় করে শুধুমাত্র ক্ষুধার কষ্টটা সহ্য করতে পারে না বলেই। ফলস্বরূপ সে বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার রোনাসস্বরূপ সে অন্যান্য জৈবিক আনন্দ পায়—তার অজান্তেই বংশবৃদ্ধি হতে থাকে। মানুষ একটা উন্নতশ্রেণীর পশু ছাড়া কিছু নয়। পশুর বুদ্ধিবৃত্তি নেই—থাকলেও খুব নিচু ধরনের। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি আছে। আর তোমরা?
তোমাদের আছে শুধু বুদ্ধিবৃত্তি। শুধু বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়? জৈবিক তাড়না না থাকলে কোন যন্ত্রণার ভয়ে তোমরা বেঁচে থাকবে? কষ্ট পাবার ভয় থেকেই মানুষ বেঁচে থাকে, আনন্দের লোড়ে নয়। তোমাদের কিসের কষ্ট?
ইলেন বিড়বিড় করে বলল, ঠিকই বলছেন—আমাদের জৈবিক তাড়না নেই। জৈবিক তাড়না ছাড়া বেঁচে থাকা যায় না। ইলেন। হঠাৎ ভাঙা গলায় বলল, তাহলে আমার বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই?
নেই বলা যায় না। আমি ইলেনের চোখের দিকে তোকালাম। কোনো তাড়না নেই দেখে তোমাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছে হয় না। কিন্তু সেই তাড়না। যদি বাইরে থেকে দেয়া যায়?
কি রকম? ইলেন উৎসাহে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
যেমন তোমার কথাই ধর। তুমি নিশ্চয়ই বেঁচে থাকায় কোনো প্রেরণা পাচ্ছ না?
না। ইলেন মাথা নাড়ল।
বেশ। এখন আমি যদি তোমাকে এই সমস্যাটি সমাধান করতে দিই—বলে দুটো কাগজে টোনা হাতে লেখা টেকীওনের সমস্যাটা ওর হাতে তুলে দিলাম। ইলেন মনোযোগ দিয়ে সেটি পড়ল। তারপর জ্বলজ্বলে ফটোসেলের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কলম আছে স্যার? ওমিক্রন ধ্রুবসংখ্যা নয় তা হলে! কী আশ্চর্য। একটা কলম দিন-না—
থাক থাক। এখন না, পরে করলেই চলবে। আমি ওকে থামাবার চেষ্টা করলাম—এই দেখ, তোমার ভিতরে কী চমৎকার প্রেরণা গড়ে উঠেছে! এই তুচ্ছ সমস্যাটি করতে দিয়ে আমি তোমার ভিতরে প্রেরণা সৃষ্টি করতে পারি।
তাই তো! তাই তো! ইলেন আনন্দে চিৎকার করে উঠল, আমার নিজেকে মোটেই হতাশাগ্ৰস্ত মনে হচ্ছে না, কী আশ্চর্য!
হ্যাঁ। তোমরা যদি বিচ্ছিন্ন না থেকে, মানুষের কাছে কাছে থাক, মানুষের দুঃখকষ্ট-সমস্যাতে নিজেদের নিয়োজিত করতে পার, দেখবে, কখনোই হতাশাগ্রস্ত হবে না। সব সময় মানুষেরা তোমাদের প্রেরণা জোগাবে।
ইলেন আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, কী আশ্চর্য। এত সহজ উপায় থাকতে আমরা এতদিন শুধু শুধু কী কষ্ট করলাম। আমি এক্ষুণি যাচ্ছি স্যার, সব রবোটকে বুঝিয়ে বলি গিয়ে—
বেশ বেশ। আমি হাত নেড়ে ওকে বিদায় দিলাম।
সমস্যাটা আমার কাছে থাকুক স্যার, হেলিকপ্টারে বসে বসে সমাধান করব। কলামটা দিন—না একটু। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। বেরিয়ে যেতে যেতে ইলেন ফিরে দাঁড়াল। বলল, টোপন ভালো আছে তো? বেশ বেশী—অনেকদিন দেখি না।
আমি হেলিকপ্টারের প্রচণ্ড আওয়াজ শুনতে পেলাম। বাসার উপর ঘুরপাক খেয়ে ওটা দক্ষিণ দিকে উড়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি রাতের হিমেল হাওয়া অনুভব করলাম। আকাশে তখনো নক্ষত্রেরা জ্বলজ্বল করছে।
পরিশিষ্ট
খেয়ালি বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ এখানেই শেষ। আমি জীৰ্ণ নোটবইটা সাবধানে তাকের উপর রেখে উঠে দাঁড়ালাম। বাইরে তখন সন্ধ্যে নেমেছে। ঘরের ভিতরে ধীরে ধীরে হালকা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে। আমার আলো জ্বলিতে ইচ্ছে হল না। চুপচাপ জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম।
সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার সুদূর অতীতের এই খেয়ালি বিজ্ঞানীটির কথা মনে হতে লাগল। তার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে সে ঘুরেফিরে শুধু রবোটদের কথাই লিখে গেছে। আজ যদি সে ফিরে এসে দেখতে পায়, সমস্ত পৃথিবীতে তার মতো একটি মানুষও নেই, শুধু আমার মতো হাজার হাজার রবোট বেঁচে আছে, তার কেমন লাগবে?
কেন জানি না এ-কথাটা ভাবতেই আমার মন গভীর বেদনায় ভরে উঠল।