এখুনি চলে যেতে হবে?
হ্যাঁ।
আপনার জন্মদিন-উৎসব কাল থেকে। কত লোকজন আসবে, কত খাওয়া-দাওয়া নাচগান হবে-আর এ সময় আমাকে আপনি তাড়িয়ে দেবেন রাণীমা?
সুধন্যর কথাটা হঠাৎ যেন চিত্রাঙ্গদার মনকে নাড়া দেয়। মনে হয়, সত্যিই তো, এই উৎসবের মুখে লোকটাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন! কিন্তু পরীক্ষণেই মনে হয়। আবার, ওর মত একটা জঘন্য প্রকৃতির লোক বুঝি তার সে অনুকম্পােরও যোগ্য নয়।
চুপ করে থাকেন চিত্রাঙ্গদা দেবী।
থাকি না দুটো দিন?
না।
কতদিন ভালমন্দ দুটো খাইনি রাণীমা—
আর আপত্তি করতে পারলেন না চিত্রাঙ্গদা দেবী। বললেন, ঠিক আছে, থাক। কিন্তু মাত্র দুদিন, তার বেশি নয়।
বেশ, তাই।
কিন্তু বাড়ির ভেতরে আসবে না, বাইরে বাগানে তাঁবুতে থাকবে।
তাই থাকব।
যাও, এখন তাহলে নীচে যাও।
সুধন্য ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুধন্য ঘর থেকে চলে যাবার পর চিত্রাঙ্গদা ঘরের দেওয়ালে টাঙানো তাঁর স্বামী জিতেন্দ্রর বিরাট অয়েল-পেন্টিংটার দিকে তাকান।
জিতেন্দ্ৰ যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটমিটি হাসছেন।
চিত্রাঙ্গদার চোখ দুটো যেন জ্বলতে থাকে।
উঃ, কি লজ্জা, কি লজ্জা! তাঁর জন্মমুহূর্ত থেকে যে লজ্জা তাঁর সমস্ত জীবনের সঙ্গে একেবারে ওতপ্রোত হয়ে গেছে, তার হাত থেকে বুঝি সত্যিই কোন দিনই আর মুক্তি নেই।
এতকাল বয়ে এসেছেন সে লজ্জা, এবং যতদিন বাঁচবেন তাঁকে টেনে যেতে হবে।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, জিতেন্দ্রর দোষ কি? তার জন্মের জন্য তো জিতেন্দ্ৰ দায়ী নন?
দায়ী যদি কেউ হন তা তার জন্মদাতা। —তাঁর বাবা হরপ্রসাদ। যার জঘন্য লালসা এক।
হঠাৎ মনে পড়ে, পাশের ঘরে কিরীটী আর জয়ন্ত এখনো তার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু এই মুহুর্তে আর তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না চিত্রাঙ্গদা দেবীর।
চিত্রাঙ্গদা ডাকে, সুরতিয়া!
সুরতিয়া ঘরে এসে ঢুকল, ডাকছিলে রাণীমা?
হ্যাঁ শোন, ওঘরে গিয়ে জয়ন্তকে বলে দে, শরীরটা ভাল লাগছে না। আমার, আজ আর ও ঘরে যাব না।
সুরতিয়া মাথা হেলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
পাশের ঘরে গিয়ে যখন ঢুকল, জয়ন্ত আর কিরীটী তখনো গল্প করছে।
রাণীমা বললেন, তার শরীরটা ভাল লাগছে না, এখন আর আসবেন না।
জয়ন্ত আর কিরীটী পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল নিঃশব্দে।
সুরতিয়া সংবাদটা দিয়ে আর অপেক্ষা করে না, ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
কিরীটী জয়ন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তাহলে চলুন মিস্টার চৌধুরী, ওঠা যাক।
হ্যাঁ, চলুন।
জয়ন্ত উঠে দাঁড়াল।
পূর্বের সেই সিঁড়িপথেই পুনরায় দুজনে নীচে নেমে এল। এবং কিরীটীকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে জয়ন্ত চলে গেল।
কিরীটী পাইপটা ধরিয়ে একটা আরাম-কেদারার ওপর গা ঢেলে দিল—মনের মধ্য তখন তার একটি মুখ বার বার ভেসে ভেসে উঠছে।
সুধন্য!
কে ওই ছেলেটি? চিত্রাঙ্গদা দেবীর কাছ থেকে বোঝা গেল প্রায়ই এসে কিছু কিছু টাক নিয়ে যায়, চিত্রাঙ্গদা দেবীও ওকে টাকা দেন।
মুখে দেবো না বললেও শেষ পর্যন্ত ওকে দেন।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর মত লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে—কোন গুঢ় কারণ না থাকলে নিশ্চয়ই চিত্রাঙ্গদা দেবী ওকে আমন করে বার বার টাকা দিতেন না।
কোন দেন ওকে চিত্রাঙ্গদা দেবী টাকা?
ভয়ে যে টাকা দেন না, তা বোঝা যায়। ভয় পাবার স্ত্রীলোক চিত্রাঙ্গদা দেবী নন। তাঁকে ভয় দেখিয়ে অর্থাৎ ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিচ্ছে সুধন্য, মনে হয় না কিরীটীর।
কিন্তু তার কারণটা কি? কি কারণ থাকতে পারে?
আর একটা মুখও মধ্যে মধ্যে কিরীটীর মনের পাতায় আনাগোনা করছিল। চিত্রাঙ্গদা। দেবীর বসবার ঘরে দেওয়ালে টাঙানো ওঁর স্বামী জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ফটোর মুখখানা।
জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী জেনেশুনেই চিত্রাঙ্গদা দেবীকে একদিন বিবাহ করেছিলেন। এক বাঈজী কন্যার ঔরসজাত চিত্রাঙ্গদা দেবী-কথাটা হরপ্রসাদ গোপন করেননি জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর কাছে। লোকটাও একেবারে শান্তশিষ্ট গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসী পাতাটি ছিলেন না। গানবাজনার শখের সঙ্গে নারীপ্রীতিও ছিল তাঁর—প্রীতি না বলে নারীর প্রতি দুর্বলতা বললেই বোধ হয় ভাল হয়। তার প্রমাণ এখনো ইন্দ্ৰালয়েই রয়েছে-ওই বিগত যৌবনা ভূপৎ সিংয়ের স্ত্রী সুরতিয়া-রাজপুতানী।
এখনো যার দেহের গড়ন আমন, সে যে যৌবনে সত্যিকারের আকর্ষণীয় ছিল বুঝতে কষ্ট হয় না। জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ওর যৌবনের প্রতি আকর্ষণ হওয়াটা এমন কিছু বিচিত্র নয়।
কে জানে ওই সুরতিয়া শেষ পর্যন্ত জিতেন্দ্র ও চিত্রাঙ্গদা-স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের কারণ কিনা!
হঠাৎ-হঠাৎই যেন একটা সম্ভাবনা কিরীটীর মনের পাতায় উঁকি দেয়। আশ্চর্য! হ্যাঁ— সত্যিই তো, আশ্চর্য রকমের একটা মিলও আছে দুটো মুখে। তবে—তবে কি ওইটাই কারণ?
গণেশ এসে ঘরে ঢুকল।
বাবুজা!
কে?
খাবার দেব কি?
খাবার? রাত কটা হল?
রাত সোয়া নটা।
তাহলে একটু পরে।
গণেশ কিন্তু তথাপি ঘর থেকে যায় না, দাঁড়িয়েই থাকে।
কিছু বলবে গণেশ?
আজ্ঞে—কোন ড্রিঙ্ক দেব কি?
ড্রিঙ্ক!
হ্যাঁ।
হুইস্কি আছে?
আছে।
দাও এক পেগ। সোডা দিয়ে দিও।
গণেশ চলে গেল।
পরের দিন কিরীটীর ঘুম ভাঙল সানাইয়ের শব্দে। ভৈরো রাগে সানাই বাজছে। মনে পড়ল।রাণীমার জন্মতিথি-উৎসব আজ থেকেই।