॥ ৭ ॥
সকালে কাঁধ ধরে ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখি ফেলুদা। তার মুখের ভাব দেখেই বুঝলাম একটা কোনো গুরুতর ব্যাপার ঘটেছে।
‘মিঃ মল্লিক খুন হয়েছেন।’
‘অ্যাঁ!’
এবার আমার চীৎকারে লালমোহনবাবুরও ঘুম ভেঙে গেল।
‘কাল মাঝরাত্তিরে’, বলল ফেলুদা। ‘বুকে ছুরি মেরেছে। শুধু তাই না, খুনটাকে আরো পাকা করার জন্য মাথায়ও একটা ভারী কিছু দিয়ে মেরেছে। সব মিলিয়ে বিশ্রী ব্যাপার।’
এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। লালমোহনবাবুও উঠলেন। গায়ে দুটো গরম কাপড় চাপিয়ে দুজনেই তাঁবুর বাইরে চলে এলাম। ফেলুদা আমাদের খবরটা দিয়েই আবার বেরিয়ে গেল। মিঃ মল্লিক খুন! আমার ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনের মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে। যাচ্ছে।
বাইরে গিয়ে দেখি সকলেই প্রায় তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, সকলেরই মুখ কালি। কথাবার্তায় বুঝলাম বিজয়বাবু পুলিশকে খবর দিতে গেছেন। এখান থেকে শহর বেশি দূর না, তাই পুলিশ আসতে বেশি সময় লাগা উচিত না।
ডাঃ মজুমদারই সকালে উঠে প্রথমে ব্যাপারটা দেখেন। বিছানার চাদর রক্তাক্ত। সেটা ছুরির আঘাতের ফলে, কারণ মাথায় বিশেষ রক্তপাত হয়নি। অস্ত্রটা অবশ্য পাওয়া যায়নি। মনে মনে বললাম, এমন চমৎকার লিদর নদী থাকতে অস্ত্র ফেলার জায়গার অভাব কোথায়? নদী এখন সে ছুরিকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে কোথায় নিয়ে গেছে কে জানে?
তবে শুধু যে খুন তা নয়; তার সঙ্গে চুরিও আছে। মিঃ মল্লিকের ডানহাতের অনামিকায় একটা বহুমূল্য হীরের আংটি ছিল—তাঁর এক গুজরাটি মক্কেলের দেওয়া। খুনী সেইটিও খুলে নিয়ে গেছে।
ফেলুদা ডাঃ মজুমদারকে প্রশ্ন করছিল।
‘কাল রাত্রে ভদ্রলোক শুয়েছেন কখন?’
‘আমাদের অনেক আগে। উনি ন’টার মধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়তেন।’
‘আপনি ত ডাক্তার, দেখে বুঝতে পারছেন না কখন খুনটা হয়েছে?’
‘মনে হয় রাত দুটো আড়াইটে নাগাদ; তবে সেটা পুলিশের ডাক্তার এলে আরো সঠিকভাবে বলতে পারবে।’
‘রাত্রে কোনো শব্দটব্দ শোনেননি? ঘুমের কোনো ব্যাঘাত হয়নি?’
‘উঁহু। আমার সচরাচর এক ঘুমে রাত কাবার হয়ে যায়। আমি একটু তাড়াতাড়ি উঠি। সাড়ে ছটায় উঠেই দেখি এই কাণ্ড। আমার আগে প্রয়াগ উঠেছিল, কিন্তু ও এই দুর্ঘটনাটা লক্ষ্য করেনি। ও উঠেই তাঁবুর বাইরে চলে গিয়েছিল।’
‘কে খুন করতে পারে সে সম্বন্ধে আপনার কোনো ধারণা আছে?’
‘একেবারেই না।’
একটা পুলিশের জীপ এসে তাঁবুর কাছে থামল। বিজয়বাবু নামলেন, তাঁর পিছনে একজন ইনস্পেক্টর। ইনস্পেক্টরটি এগিয়ে গেলেন মিঃ মল্লিকের তাঁবুর দিকে বিজয়বাবুর নির্দেশ অনুযায়ী।
‘আমার নাম ইনস্পেক্টর সিং’, বললেন ভদ্রলোক। আমি এই কেসটার চার্জ নিচ্ছি। হোয়্যার ইজ দ্য ডেডবডি?’
বিজয়বাবু মিঃ সিংকে নিয়ে তাঁবুর ভিতর ঢুকলেন। আমরা বাইরেই রয়ে গেলাম।
ইনস্পেক্টরের পিছন পিছন কয়েকজন কনস্টেবল, ফোটোগ্রাফার ইত্যাদি এসব ব্যাপারে যেমন হয়ে থাকে ঠিক তেমনি ভাবেই কাজ শুরু করে দিল। এ জিনিস অনেকবার দেখেছি, তাই কৌতূহল মিটে গেছে। আর মিঃ মল্লিকের মৃতদেহ দেখবার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। খালি মনে হচ্ছিল—কী আশ্চর্য, এই মল্লিক কতজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, আর হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর হত্যাকারীরও মৃত্যুদণ্ড হবে।
ফেলুদা একা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে দেখে লালমোহনবাবু তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার বলুন ত?’
ফেলুদা বলল, ‘আমার মনের ভিতরের জটটা আরো বেশ ভাল করে পাকিয়ে গেল—এই ত ব্যাপার! এখন পুলিশ যদি কিছু করতে পারে।’
‘আপনি নিজে কি হাল ছেড়ে দিলেন?’
‘তা কি হয়? আমি ত প্রথম থেকে সবগুলো ঘটনাই দেখেছি; পুলিশ ত আর তা দেখেনি। অবিশ্যি ঘটনাগুলোর পরস্পরের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। আমাকে যে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল, আর বিজয়বাবুকে যে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল, দুজনেই কি এক লোক? আর সেই লোকই কি এই খুনটা করেছে? হীরের আংটি চুরি যদি মোটিভ হয়ে থাকে তাহলে হয়ত বাইরের থেকে খুনটা করে থাকতে পারে। কিন্তু আমার—’
ফেলুদা চুপ করে গেল। তারপর কিছুক্ষণ পরে বলল, ‘ডাকাতির আইডিয়াটাকে অবিশ্যি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু আমার বিশ্বাস আমাদের চেনা লোকই কুকীর্তিটা করেছে।’
‘চেনা লোক বলতে—?’
‘মিঃ মল্লিকের সঙ্গে যারা এসেছেন। ইনক্লুডিং মিঃ সরকার। কারণ তাঁর ডান হাতের আঙুলে ‘S’ লেখা আংটিটার কথা ভুললে চলবে না।’
ইনস্পেক্টর সিং তাঁবু থেকে বাইরে বেরোলেন। ভদ্রলোক তিনটে তাঁবুর দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই সবগুলোই কি একই পার্টির তাঁবু?’
বিজয়বাবু বললেন, ‘না; এই দুটো আমাদের, আর ওইটা মিঃ মিত্তিরদের।’
‘মিঃ মিত্তির?’
‘হি ইজ এ ওয়েলনোন প্রাইভেট ইনভেসটিগেটর ফ্রম ক্যালকাটা।’
মিঃ সিং ভ্রূকুঞ্চিত করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি রাজগড়ের খুনের কেসটা সল্ভ করেছিলেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
মিঃ সিং হাত বাড়ালেন করমর্দনের জন্য।
‘ইনস্পেক্টর বাজপাই ইজ এ ভেরি গুড ফ্রেণ্ড অফ মাইন। তার কাছে আপনার খুব প্রশংসা শুনেছি। আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হলাম।’
ফেলুদা বলল, ‘আমি কিন্তু এখানে ঘটনাচক্রে এসে পড়েছি। কোনো কেস-টেস সল্ভ করতে নয়। আপনি আপনাদের কাজ চালিয়ে যান।’
‘আমি ত চালিয়ে যাবই আমার কাজ, কিন্তু আপনিই বা চুপচাপ বসে থাকবেন কেন, বিশেষ করে এই ফ্যামিলির সঙ্গে যখন আপনার আলাপ হয়েছে। খুনটা ত বাইরের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। ছুরি যে বসিয়েছে সে ত লেফট হ্যান্ডেড; এখানে ত সবাই দেখছি রাইট হ্যান্ডেড। যাই হোক, ইউ আর ফ্রী টু ক্যারি অন ইওর ওন ইনভেস্টিগেশন।’
‘অনেক ধন্যবাদ। আসলে আমার উপরও একটা অ্যাটেমট হয়েছিল, কাজেই আমি ব্যাপারটাকে খুব ঠাণ্ডা মাথায় নিতে পারছি না।’
‘ভাল কথা’, মিঃ সিং বিজয়বাবুর দিকে ফিরলেন। ‘ডেড বডির কী হবে? ওটা কি আপনি কলকাতায় নিয়ে যেতে চান?’
‘তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। আমি ছাড়া ত বাবার আর কেউ নেই। মা মারা গেছেন, দাদা বিলেতে ছিলেন, দাদাও মারা গেছেন।’
‘ভেরি ওয়েল, তাহলে এখানেই সৎকার হোক। তবে, বুঝতেই পারছেন, আপনাদের এখনো কিছুদিন পাহালগামে থাকতে হবে। অন্তত যতদিন না কেসটার সুরাহা হচ্ছে ততদিন। কারণ ইউ আর অল আণ্ডার সাসপিশন। আমি একে একে প্রত্যেককেই জেরা করতে চাই।’