[১৯০০ খ্রীঃ ৯ এপ্রিল আমেরিকায় সান ফ্রান্সিস্কো শহরে প্রদত্ত। সাঙ্কেতিক লিপিকার ও অনুলেখিকা আইডা আনসেল যেখানে স্বামীজীর বক্তৃতার কোন কথা বুঝিতে পারেন নাই, সেখানে … চিহ্ন দেওয়া আছে। ( ) বন্ধনীর মধ্যেকার অংশ অনুলেখিকা কর্তৃক স্বামীজীর বাক্যের পরিপূরক হিসাবে বসান হইয়াছে।]
মানব-প্রকৃতির যে দিক্টি অধিকতর বিশ্লেষণাত্মক, আমরা উহার আলোচনা করিতেছিলাম।২এখন আমরা আবেগ-প্রধান দিক্টি দেখিব। … পূর্বেরটি মানুষকে গ্রহণ করে একটি সীমাহীন সত্তারূপে—নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্ব হিসাবে; অপরটিতে মানুষ একটি সীমাবদ্ধ জীব; … কয়েক ফোঁটা চোখের জল বা কয়েকটি দীর্ঘশ্বাসের জন্য প্রথমটির অপেক্ষা করিবার সময় নাই; দ্বিতীয়টি কিন্তু ঐ অশ্রুবিন্দু না মুছিয়া দিয়া, ঐ বেদনার ক্ষত আরোগ্য না করিয়া অগ্রসর হইতে পারে না। প্রথমটি বৃহৎ—এত বৃহৎ ও চমৎকার যে, সময়ে সময়ে ঐ বিস্তার আমাদিগকে স্তম্ভিত করে। অপরটি অতি সাধারণ, কিন্তু তবুও বড় সুন্দর এবং আমাদের হৃদয়গ্রাহী। প্রথমটি আমাদিগকে এত উঁচুতে লইয়া যায় যে, আমাদের ফুসফুস যেন ফাটিয়া যাইবার উপক্রম হয়। সেই বায়ুমণ্ডলে আমরা নিঃশ্বাস লইতে পারি না। অপরটি যেখানে আমরা আছি, আমাদিগকে সেইখানেই রাখিয়া দেয় এবং জীবনের নানা বিষয়ে (সীমায়িতভাবে) দেখিবার চেষ্টা করে। একটি কোন কিছুই গ্রহণ করিবে না, যতক্ষণ না উহাতে বুদ্ধির দেদীপ্যমান ছাপ দেওয়া হইতেছে; অন্যটি দাঁড়াইয়া আছে বিশ্বাসের উপর; যাহা সে দেখিতে পায় না, তাহা সে মানিয়া লয়। দুইটিরই প্রয়োজন আছে। পাখি কখনও একটি মাত্র ডানায় উড়িতে পারে না।
আমরা এমন মানুষ দেখিতে চাই, যিনি সামঞ্জস্যপূর্ণ-ভাবে গড়িয়া উঠিয়াছেন … উদারহৃদয়, উন্নতমনা (কর্মে নিপুণ)। প্রয়োজন এইরূপ ব্যক্তির, যাঁহার অন্তঃকরণ জগতের দুঃখ-কষ্ট তীব্রভাবে অনুভব করে। … আর (আমরা চাই) এমন মানুষ, যিনি শুধু অনুভব করিতে পারেন তাহা নয়, পরন্তু বস্তুনিচয়ের অর্থ ধরিতে পারেন, যিনি প্রকৃতি এবং বুদ্ধির মর্মস্থলে গভীরভাবে ডুব দেন। (আমাদের দরকার) এমন মানুষের, যিনি সেখানেও থামেন না, (কিন্তু) যিনি (সেই অনুভবকে বাস্তব কর্মে) রূপায়িত করতে ইচ্ছুক। মস্তিষ্ক, হৃদয় এবং হাত—এই তিনটির এই প্রকার সমন্বয় আমাদের কাম্য। জগতে অনেক লোক-শিক্ষক আছেন, কিন্তু দেখিতে পাইবে—(তাঁহাদের অধিকাংশই) একদেশী। কাহারও দৃষ্টি বুদ্ধিবৃত্তির প্রখর মধ্যাহ্নসূর্যের উপর, অন্য কিছুই তাঁহার চোখে পড়ে না। অপর কেহ বা শুনেন প্রেমের সুমধুর গীতি এবং ইহা ছাড়া আর কিছুতে কান দিতে পারেন না। আবার আর একজন আছেন কাজে (ডুবিয়া), তাঁহার অনুভূতি বা চিন্তার সময় নাই। এরূপ একজন মহামানব কেন (চাও) না—যিনি যেমন কর্মী, তেমনি জ্ঞানী, আবার সমানভাবে প্রেমিক? ইহা কি সম্ভব?—নিশ্চয়ই নয়। ভবিষ্যতের মানুষ হইবেন এই প্রকৃতির। বর্তমানকালে (কেবল মাত্র) অল্প কয়েকজনই এইরূপ আছেন। (ইঁহাদের সংখ্যা বাড়িয়া চলিবে) যতদিন না সারা পৃথিবী এই ধরনের মানুষে পূর্ণ হয়।
আমি তোমাদিগকে এতদিন মেধা (এবং) বিচারের সম্বন্ধে বলিয়াছি। সমগ্র বেদান্ত আমরা শুনিলামঃ মায়ার যবনিকা টুটিয়া যায়, ঘন মেঘ সরিয়া গিয়া সূর্যালোক আমাদের উপর দীপ্তি পায়। এ যেন হিমালয়ের উত্তুঙ্গদেশ অধিরোহণের চেষ্টা, মেঘের রাজ্যের ওপারে অদৃশ্য যে শৃঙ্গগুলি রহিয়াছে—সেখানে পৌঁছিতে হইবে। এখন আমরা অন্য দিক্টি পর্যবেক্ষণ করিতে চাই—অতি সুরম্য উপত্যকাগুলি—প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য! (আমরা আলোচনা করিব) ভালবাসা—যাহা সংসারের জ্বালাযন্ত্রণা সত্ত্বেও আমাদিগকে ধরিয়া রাখে, সেই প্রেম—যাহার জন্য আমরা দুঃখের শিকল গড়িয়াছি, যাহার জন্য মানুষ অনন্তকাল স্বেচ্ছায় বরণ করিয়া লইয়াছে আত্মবলিদান এবং সন্তুষ্টচিত্তে সহ্য করিয়া চলিয়াছে উহার কষ্ট। সেই অনন্ত অনুরাগ, যাহার জন্য মানুষ নিজের হাতে বন্ধন পরে, দুর্গতি ভোগ করে—তাহাই এখন আমাদের অনুসন্ধানের বিষয়। অপরটি আমরা যে ভুলিয়া যাইব, তাহা নয়। হিমালয়ের হিমবাহ কাশ্মীরের ধান্যক্ষেত্রের সহিত মিতালি করুক। বজ্রের গুরুগর্জনের সহিত মিশিয়া যাক পাখির কাকলি।
যাহা কিছু অতি পরিপাটি ও মনোহর, তাহা লইয়াই আমাদের বর্তমান আলোচনা। পূজাপ্রবৃত্তি তো সর্বত্রই আছে, প্রত্যেক জীবে। প্রত্যেকেই ভগবানের আরাধনা করে। যে নামই দেওয়া যাক না কেন, তিনি সকলের পূজা পাইতেছেন। পৃথিবীর কর্দমে—যেমন সুন্দর পদ্মফুলের, যেমন জীবনের আরম্ভ, উপাসনার আদিও সেইরূপ। … (প্রথমে) খানিকটা ভয়ের ভাব থাকে, পার্থিব লাভের দিকে আকাঙ্ক্ষা থাকে। ভিখারীর পূজা। এগুলি পূজাবৃত্তির প্রারম্ভিক। (উহার অবসান) ঈশ্বরকে ভালবাসিয়া এবং মানুষের মধ্যে ভগবানকে উপাসনা করিয়া।
ভগবান্ আছেন কি? এমন একজন কেহ আছেন কি, যাঁহাকে ভালবাসা যায়, যিনি ভালবাসা গ্রহণ করিতে সমর্থ? পাথরকে ভালবাসিয়া বেশী কিছু লাভ নাই। আমরা তাহাই ভালবাসি, যাহা ভালবাসা বুঝতে পারে, যাহা আমাদের অনুরাগ আকর্ষণ করিতে পারে। উপাসনার বেলাও এইরূপ। আমাদের এই পৃথিবীতে কেহ একখণ্ড শিলাকে (শিলা বলিয়া) পূজা করিয়াছে, এমন কথা কখনও বলিও না। সে সর্বদাই উপাসনা করিয়াছে (পাথরটির মধ্যে সর্বব্যাপী সত্তাকে)।
আমাদের ভিতর সেই বিশ্বপুরুষ রহিয়াছেন, আমরা সন্ধান পাই। (কিন্তু) তিনি যদি আমাদের হইতে পৃথক্ না হন, তাহা হইলে আমরা উপাসনা করিব কিভাবে? আমি তো শুধু ‘তোমাকে’ পূজা করিতে পারি, ‘আমাকে’ নয়। কেবল ‘তোমারই’ নিকট প্রার্থনা করিতে পারি, ‘আমার’ কাছে নয়। ‘তুমি’ বলিয়া কেহ আছে কি?
একই বহু হন। আমরা যখন এককে দেখি, তখন মায়ার মধ্য দিয়া প্রতিবিম্বিত সঙ্কীর্ণ যাহা কিছু সব অদৃশ্য হইয়া যায়, কিন্তু বহুত্ব যে অর্থহীন নয়, ইহাও সম্পূর্ণ ঠিক। বহুকে অবলম্বন করিয়াই আমরা একে পৌঁছাই। …
ব্যক্তি-ঈশ্বর কেহ আছেন কি—যে-ঈশ্বর চিন্তা করেন, বুঝিতে পারেন, আমাদিগকে চালিত করেন?—আছেন। নির্বিশেষ ঈশ্বরের এই-সব গুণের কোনটিই থাকিতে পারে না। তোমরা প্রতেক্যেই এক-একটি ‘ব্যক্তি’। তুমি চিন্তা কর, ভালবাসো, ঘৃণা কর; (তুমি) ক্রুদ্ধ বা দুঃখিত হও ইত্যাদি; কিন্তু তবুও তুমি হইতেছ নৈর্ব্যক্তিক, সীমাহীন। একাধারে (তুমি) সগুণ এবং নির্গুণ। ব্যক্তি এবং ব্যক্তিহীন-দুটি দিক্ই তোমার রহিয়াছে। ঐ (নৈর্ব্যক্তিক সত্তা) ক্রোধ প্রকাশ করিতে পারে না, (কিংবা) দুঃখিত (বা) ক্লিষ্ট হইতে পারে না, এমন কি দুঃখকষ্টের চিন্তাও করিতে পারে না। নৈর্ব্যক্তিক সত্তা চিন্তা করিতে পারে না, জানিতে পারে না। উহা স্বয়ং জ্ঞানস্বরূপ। পক্ষান্তরে ব্যক্তিসত্তার জ্ঞান আছে, চিন্তা, মৃত্যু প্রভৃতি আছে। যিনি সর্বগত পরম, স্বভাবতই তাঁহার দুইটি দিক্ থাকিতে বাধ্য। একটি বস্তুসমূহের অনন্ত সত্তার (নির্ণায়ক), অপরটি তাঁহার ব্যক্তিভাব—আমাদের সকলের আত্মার আত্মা। তিনি সকল প্রভুর প্রভু। তিনিই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করিতেছেন, তাঁহারই নির্দেশে ইহা বর্তমান রহিয়াছে। …
সেই অনন্ত—চিরশুদ্ধ, চির (মুক্ত) … তিনি কিন্তু বিচারক নন। ভগবান্ কখনও (একজন) বিচারপতি হইতে পারেন না। তিনি সিংহাসনের উপর বসিয়া ভাল এবং মন্দের বিচার করেন না। … তিনি শাসক নন, সেনাপতি নন, (কিংবা) অধিনায়কও নন। অসীম করুণাময়, অনন্ত প্রেমময় তিনি—সগুণ (ঈশ্বর)।
অপর একটি দিক্ হইতে দেখ। তোমার দেহের প্রতি জীবকোষে (cell) একটি আত্মা রহিয়াছে, যাহা জীবকোষটি সম্বন্ধে সচেতন। উহা একটি পৃথক্ বস্তু। উহার নিজস্ব একটি ইচ্ছা আছে, স্বকীয় একটি ছোট কর্মক্ষেত্র আছে। সমস্ত (জীবকোষ) মিলিয়া গোটা ব্যক্তিটি গঠিত। (অনুরূপভাবে) বিশ্বজগতের যিনি সগুণ ঈশ্বর, তিনি হইলেন এই-সব (বহু ব্যক্তির) সমষ্টি।
আর একদিক্ দিয়া বিচার কর। তুমি—অর্থাৎ আমি যেমন তোমায় দেখি—হইলে তোমার পরম সত্তার যেটুকু আমার দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ হইয়া অনুভূত, সেইটুকু। আমার চোখ এবং ইন্দ্রিয়নিচয় দিয়া তোমাকে দেখিব বলিয়া তোমাকে আমি খণ্ডিত করিয়া লইয়াছি। তোমার যেটুকু আমার চোখের দ্বারা দেখা সম্ভব, ততটুকুই আমি দেখি। আমার মন তোমার যতটা ধারণা করিতে পারে, ততটুকুই আমি ‘তুমি’ বলিয়া জানি, তাহার বেশী নয়। এইভাবেই আমি সর্বগত নৈর্ব্যক্তিককে অনুশীলন করিতে গিয়া (তাঁহাকে সগুণরূপে দেখি), যতক্ষণ আমাদের দেহ আছে, মন আছে, ততক্ষণ আমরা সর্বদা এই ত্রি-সত্তাকে দেখি—ঈশ্বর, প্রকৃতি এবং আত্মা। এই তিন সর্বদাই এক অবিভাজ্য সত্তায় থাকিতে বাধ্য … প্রকৃতি রহিয়াছে, মানবাত্মাসমূহ রহিয়াছে; আবার রহিয়াছেন তিনি—যাঁহাতে প্রকৃতি এবং মানবাত্মাসমূহ (অবস্থিত)।
বিশ্বাত্মা শরীর ধারণ করিয়াছেন। আমার আত্মা হইল ঈশ্বরের একটি অংশ। ঈশ্বর আমাদের চক্ষুর চক্ষু, প্রাণের প্রাণ, মনের মন, আত্মার আত্মা। ইহাই সগুণ ঈশ্বর সম্বন্ধে আমাদের ধারণাযোগ্য উচ্চতম আদর্শ।
তুমি যদি দ্বৈতবাদী না হইয়া একত্ববাদী হও, তাহা হইলেও তোমার ব্যক্তি-ঈশ্বর থাকিতে পারে। … এক অদ্বিতীয় রহিয়াছেন। সেই এক নিজেকে ভালবাসিতে চাহিলেন। সেই কারণে এক হইতে তিনি সৃষ্টি করিলেন (বহু)। … বৃহৎ ‘আমি’-কে—সত্য ‘আমি’-কে পূজা করিতেছে ক্ষুদ্র ‘আমি’। অতএব সব মতেই ‘ব্যক্তি’ (ঈশ্বর) রাখা চলে।
কেহ কেহ এমন অবস্থার মধ্যে জন্মগ্রহণ করে যে, তাহারা অন্যান্য অপেক্ষা সুখী হয়। ন্যায়পরায়ণ কাহারও রাজত্বে এইরূপ কেন হইবে? পৃথিবীতে মৃত্যু রহিয়াছে কেন? এই-সকল কঠিন প্রশ্ন আমাদের মনে উঠে। (এই সমস্যাসমূহের) কখনও সমাধান হয় নাই। কোন দ্বৈতভূমি হইতে উহাদের মীমাংসা হইতে পারে না। বস্তুসমূহ যথার্থই যেভাবে আছে, ঠিক সেভাবেই ঐগুলি দেখিবার জন্য আমাদিগকে দার্শনিক বিচারে ফিরিয়া যাইতে হইবে। আমরা আমাদের নিজেদের কর্ম হইতেই কষ্ট ভোগ করিতেছি। এজন্য ঈশ্বর দায়ী নন। আমরা যাহা করি, তাহা আমাদেরই দোষ, অন্য কাহারও নয়। ঈশ্বরকে দোষারোপ কেন? …
অমঙ্গল কেন রহিয়াছে? যে একটিমাত্র উপায়ে (এই সমস্যার) মীমাংসা করিতে পার, তাহা হইল—(এই কথা বলা যে, ঈশ্বর) ভাল ও মন্দ দুই-এরই কারণ। সগুণ ঈশ্বরবাদের একটি প্রকাণ্ড সমস্যা এইঃ যদি বল ভগবান্ শুধু সৎ—তিনি অসৎ নন, তাহা হইলে তুমি নিজেই তোমার নিজের যুক্তির ফাঁদে আটকাইয়া পড়িবে। কি করিয়া জানিলে—(একজন) ভগবান্ আছেন? বলা হয় (যে, তিনি) এই বিশ্বজগতের পিতা; আরও বলা হয়—তিনি মঙ্গলময়। কিন্তু পৃথিবীতে অমঙ্গলও তো রহিয়াছে, তবে তিনি অমঙ্গলস্বরূপই বা হইবেন না কেন? … সেই সমস্যা।
ভাল বলিয়া কিছু নাই, মন্দও নাই। আছেন শুধু ভগবান্। … ভাল কি, তাহা তুমি কিরূপে জান? তুমি নিজে (উহা) অনুভব কর। (মন্দ কি, তাহারও জ্ঞান কি ভাবে হয়?) যদি মন্দ আসে, তুমি উহা অনুভব কর। … ভাল এবং মন্দ আমাদেরই অনুভব দ্বারা আমরা জানিয়া থাকি। এমন কেহ নাই যে, শুধু ভালই অনুভব করে—তাহার অনুভূতি শুধু সুখকর। এমন কেহও নাই, যে শুধু অপ্রীতিকর ভাবগুলিই অনুভব করে। …
অভাব এবং উদ্বেগই সকল দুঃখের কারণ, সুখেরও। অভাব কি বাড়িয়া চলিতেছে, না কমিতেছে? জীবন কি সহজ না জটিল হইতেছে? নিশ্চয়ই জটিল। অভাবসমূহ ক্রমাগত বাড়িয়া চলিতেছে। যাঁহারা তোমাদের প্রপিতামহ ছিলেন, তাঁহাদের তোমাদের মত এত পোষাক বা অর্থের দরকার ছিল না। তাঁহাদের বৈদ্যুতিক গাড়ী ছিল না, রেলরাস্তাও তাঁহারা দেখেন নাই। আর এইজন্যই তাঁহাদের পরিশ্রম করিতে হইত কম। যখন এই-সব জিনিষের প্রয়োজন হয়, সঙ্গে সঙ্গে অভাবও আসে, খাটুনিও বাড়ে। আকাঙ্ক্ষা যত বাড়ে, প্রতিযোগিতাও ততই বাড়ে।
অর্থসংগ্রহ খুবই শ্রমসাধ্য। অর্থ রক্ষা করা আরও কঠিন কাজ। কিছু বিত্তসঞ্চয়ের জন্য তোমাদিগকে সারা পৃথিবীর সহিত যুদ্ধ করিতে হইবে, (আর) উহা রক্ষা করিতে সমস্ত জীবন ধরিয়া চলিবে সংগ্রাম। (অতএব) গরীবের চেয়ে ধনীর দুশ্চিন্তা বেশী। … এই তো ব্যাপার!—
জগতের সর্বত্রই ভাল ও মন্দ রহিয়াছে| কখনও কখনও মন্দের মধ্য দিয়া ভাল আসে সত্য, কিন্তু অন্য সময়েও আবার মন্দ হইয়া দাঁড়ায়। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি কোন-না-কোন সময়ে অমঙ্গল সৃষ্টি করে। কোন ব্যক্তি মদ্যপান আরম্ভ করুক। (প্রথমে) কিছু খারাপ হয় না, কিন্তু সে যদি ক্রমাগত মদ্যপান করিতে থাকে, তবে তাহার অনিষ্ট হইবে। … কেহ ধনী পিতামাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করিল; বেশ ভাল। কিন্তু সে বুদ্ধিহীন হইল, কখনও তাহার শরীর বা মস্তিস্ক খাটাইল না। ইহা শুভ হইতে অশুভের উৎপত্তি। আবার জীবনের প্রতি আমাদের যে নিবিড় ভালবাসা, সেই কথা চিন্তা কর। আমরা কতই না ছুটাছুটি—লাফালাফি করি! কয়েক মুহূর্তের তো জীবন! কত কঠোর পরিশ্রম করি! একেবারে অসমর্থ শিশু হইয়া আমরা জন্মিয়াছি। জিনিষগুলি বুঝিয়া উঠিতে আমাদের বহু বৎসর কাটিয়া যায়। অবশেষে ষাট বা সত্তর বৎসরে আমাদের চোখ খোলে এবং তখন আদেশ আসে— ‘বেরিয়ে যাও!’ এই তো অবস্থা!
আমরা দেখিলাম—ভাল ও মন্দ আপেক্ষিক শব্দ। যাহা আমার কাছে ভাল, তাহা তোমার পক্ষে মন্দ। আমার যাহা নৈশ আহার, তুমি যদি তাহা খাও তো কাঁদিতে আরম্ভ করিবে, আর আমি হাসিয়া উঠিব। … আমরা দুজনে (হয়তো) নাচিতেছি, কিন্তু আমি আনন্দের সঙ্গে—আর তুমি যাতনার সহিত। … একই বস্তু আমাদের জীবনের কোন এক সময়ে শুভ, অন্য সময়ে অশুভ। কি করিয়া বলিতে পার, ভাল ও মন্দ সবই পূর্ব হইতে প্রস্তুত থাকে এবং এটি সর্বৈব ভাল আর ঐটি সর্বৈব মন্দ?
এখন প্রশ্ন এই, ভগবান্ যদি চিরদিন সৎই হন, তাহা হইলে এই-সব অশুভের জন্য দায়ী কে? খ্রীষ্টান এবং মুসলমানগণ বলেন, শয়তান বলিয়া একজন ভদ্রলোক আছেন। কিন্তু কি করিয়া বল—দুইজন ভদ্রলোক কাজ করিতেছেন? একজনেরই থাকা চাই; যে-আগুনে শিশু পুড়িয়া যায়, তাহাতে খাবারও তৈরী হয়। কি করিয়া বলিবে, আগুন ভাল বা মন্দ? কি করিয়া বলিবে, উহা দুই ব্যক্তির সৃষ্টি? (তথাকথিত) সমস্ত অশুভ তবে কে সৃষ্টি করিল? অন্য কোন সমাধান নাই। তিনি পাঠাইতেছেন মৃত্যু ও জীবন, মড়ক ও মহামারী এবং সবকিছু। ঈশ্বর যদি এইরূপ হন, তাহা হইলে তিনিই শুভ, তিনিই অশুভ; তিনিই সুন্দর, তিনিই ভীষণ; তিনিই জীবন এবং তিনিই মৃত্যু।
এইরূপ ঈশ্বরকে কি করিয়া উপাসনা করা যাইবে? আমরা ক্রমশঃ (বুঝিতে) পারিব, মানুষ ভীষণের পূজা কীভাবে শিখিতে পারে; তখনই মানুষ শান্তি পাইবে। মনের শান্তি যদি নষ্ট হইয়া থাকে, দুশ্চিন্তার হাত হইতে নিষ্কৃতি যদি না পাইয়া থাক তো সর্বপ্রথম কর্তব্য—ঘুরিয়া দাঁড়ানো এবং ভীষণের সম্মুখীন হওয়া। উহার মুখোস ছিঁড়িয়া ফেলো, দেখিতে পাইবে—সেই একই (ঈশ্বর) রহিয়াছেন। তিনিই সগুণ ঈশ্বর—যাহা কিছু ভাল (প্রতীয়মান) এবং যাহা কিছু মন্দ (আপাতপ্রতীতিতে)। আর কেহ নাই। দুই জন প্রভু যদি থাকিতেন, তাহা হইলে প্রকৃতি এক মুহূর্তও টিকিয়া থাকিতে পারিত না। প্রকৃতিতে অপর কেহ নাই | সবই একতান। ঈশ্বরের লীলা একদিকে, আর শয়তানের অপরদিকে—এরূপ হইলে সমগ্র সৃষ্টির ভিতর একটি চরম (বিশৃঙ্খলা) উপস্থিত হইত। নিয়ম ভাঙিবার সাধ্য কাহার আছে? এই গ্লাসটি যদি আমি ভাঙিয়া ফেলি, ইহা পড়িয়া যাইবে। একটি পরমাণুকে যদি কেহ স্থানচ্যুত করিতে সমর্থ হয়, অপর প্রত্যেকটি পরমাণুর স্থিতিবৈষম্য ঘটিবে। … নিয়ম কখনও লঙ্ঘন করা যায় না। প্রত্যেকটি পরমাণু নিজ স্থানে রহিয়াছে। প্রত্যেকটির ওজন করিয়া, মাপ করিয়া বসান আছে এবং নিজ নিজ (উদ্দেশ্য) পূর্ণ করিতেছে। ঈশ্বরের বিধানে বাতাস বহিতেছে, সূর্য কিরণ দিতেছে। তাঁহার শাসনে জগৎসমূহ যথাযথ সন্নিবিষ্ট রহিয়াছে। তাঁহারই আদেশে মৃত্যু পৃথিবীতে শিকারসন্ধানে রত। একবার ভাবিয়া দেখ তো দুই বা তিন জন ঈশ্বর জগতে মল্লযুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামিয়াছেন। ইহা হইতেই পারে না।
আমরা এখন দেখিতে পাইলাম—আমাদের জগৎস্রষ্টা সগুণ ঈশ্বর থাকিতে পারেন, তিনি দয়াময় এবং নিষ্ঠুরও। … তিনি মঙ্গল, তিনিই অমঙ্গল। তাঁহার স্মিত হাস্য দেখিতে পাই, আবার ভ্রূকুটিও দেখিতে পাই। আর তাঁহার বিধান অতিক্রম করিবার ক্ষমতা কাহারও নাই। তিনি হইলেন এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা।
সৃষ্টির অর্থ কি? শূন্য হইতে কি কোন কিছুর আবির্ভাব হইতে পারে? ছয় হাজার বৎসর আগে ঈশ্বর স্বপ্নোত্থিত হইয়া জগৎ সৃষ্টি করিলেন (এবং) তাহার পূর্বে কিছুই ছিল না—ইহা কী? ঈশ্বর তখন কী করিতেছিলেন? তিনি কি আরামে ঘুমাইতেছিলেন? ভগবান্ হইলেন জগৎ-কারণ, আর কার্য দেখিয়া আমরা কারণকে জানিতে পারি। কার্য যদি না থাকে, তাহা হইলে কারণ কারণই নয়। কারণ সর্বদা কার্যের মধ্য দিয়াই পরিজ্ঞাত। … সৃষ্টি অনন্ত। … কাল বা দেশের মাধ্যমে সৃষ্টির আদি চিন্তা করা যায় না।
কেন তিনি এই সৃষ্টি করেন? কারণ তিনি ইহা পছন্দ করেন—কারণ তিনি মুক্ত। … তুমি আমি নিয়মের অধীন, কেন-না আমরা (শুধু্) কতিপয় নির্দিষ্ট পথেই কাজ করিতে পারি, অন্য পথে নয়। ‘হাত না থাকিলেও তিনি সবকিছু ধরিতে পারেন, পদবিহীন হইয়াও দ্রুত চলিয়া যান’।৩ দেহ নাই, তথাপি তিনি সর্বব্যাপী।
‘চক্ষু যাঁহাকে দেখিতে পায় না, কিন্তু চক্ষু যাঁহা দ্বারা দেখে, তাঁহাকেই ব্রহ্ম বলিয়া জানিবে।৪ তোমরা অন্য কিছুর উপাসনা করিতে পার না। সর্বশক্তিমান্ ঈশ্বরই এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ধরিয়া আছেন। যাহাকে বলা হয় ‘নিয়ম’, উহা তাঁহার ইচ্ছার অভিব্যক্তি। নিয়মসমূহ দ্বারা তিনি জগৎ পরিচালনা করিতেছেন।
এ পর্যন্ত (আমরা আলোচনা করিয়াছি) ঈশ্বর ও প্রকৃতি—শাশ্বত ঈশ্বর, চিরন্তন প্রকৃতি। কোন আত্মারই (কখনও) সৃষ্টি হয় নাই। আত্মার বিনাশও নাই। কেহই তাহার নিজের মৃত্যু কল্পনা করিতে পারে না। আত্মা অসীম, নিত্য বর্তমান। উহা মরিবে কিরূপে? উহা শরীর পরিবর্তন করে। যেমন কোন ব্যক্তি তাহার পুরাতন জীর্ণ পরিচ্ছেদ ছাড়িয়া দিয়া নূতন অব্যবহৃত পোষাক পরিধান করে, ঠিক সেইরূপ শীর্ণ শরীর ছুঁড়িয়া ফেলিয়া একটি নূতন দেহ গ্রহণ করা হয়।৫
আত্মার স্বরূপ কি? আত্মা সর্বশক্তিধর সর্বব্যাপী। চৈতন্যের দৈর্ঘ্যও নাই বা প্রস্থ কিংবা ঘনত্বও নাই। … উহা এখানে বা সেখানে—ইহা কি করিয়া বলা যায়? এই শরীরটি নষ্ট হইলে (আত্মা) অপর একটি দেহের (মাধ্যমে) কাজ করিবে। আত্মা যেন একটি বৃত্ত, যাহার পরিধি কোথাও নাই, কিন্তু উহার কেন্দ্র হইল দেহে। ঈশ্বর এমন একটি বৃত্ত, যাহার পরিধি কোথাও নাই বটে, কিন্তু কেন্দ্র সর্বত্র। আত্মা স্বভাবতই আনন্দময়, শুদ্ধ, পূর্ণ; উহার প্রকৃতি যদি অশুচি হইত, তাহা হইলে উহা কখনও শুদ্ধ হইতে পারিত না। … আত্মার স্বরূপই হইল নিষ্কলুষ; এই জন্যই তো মানুষের পক্ষে পবিত্র হওয়া সম্ভব। আত্মা (স্বভাবতই) আনন্দঘন; তাই বলিয়াই তো উহা আনন্দ লাভ করিতে পারে। আত্মা শান্তিস্বরূপ; (এই কারণেই উহার পক্ষে শান্তি অনুভব করা সম্ভবপর)। …
আমাদের মধ্যে যাহারা নিজেদের এই দেহবুদ্ধির স্তরে দেখিতেছি, তাহাদের সকলকেই ঈর্ষা, কলহ ও কষ্টের সহিত জীবিকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করিতে হয়, আর তারপর আসে মৃত্যু। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, আমাদের যাহা হওয়া উচিত, আমরা তাহা নই। আমরা স্বাধীন নই, সম্পূর্ণ শুদ্ধ নই, ইত্যাদি। আত্মা যেন অবনত হইয়াছেন; অতএব আত্মার প্রয়োজন—বিস্তার। …
কিভাবে ইহা করা যায়? উহা নিজে নিজেই সিদ্ধ করিতে পারিবে কি?—না। কোন ব্যক্তির মুখ যদি ধূলিধূসরিত হইয়া থাকে, উহা কি ধূলি দিয়া পরিষ্কার করা চলে? মাটিতে একটি বীজ পুঁতিলাম, উহা হইতে গাছ হইল, গাছ হইতে আবার বীজ, বীজ হইতে অন্য একটি গাছ—এইরূপ চলিতে থাকিবে। মুরগী হইতে ডিম, আবার ডিম হইতে মুরগী। যদি কিছু ভাল কাজ কর, উহার ফল তোমাকে পাইতে হইবে—পুনরায় জন্মগ্রহণ ও দুঃখভোগ। এই অন্তহীন শৃঙ্খলে যদি একবার আটকাইয়া যাও, আর থামিতে পারিবে না। ঘুরিতেই থাকিবে, … উপরে এবং নীচে, ঊর্ধ্বলোক এবং অধোলোকের (দিকে) এবং এই-সব (দেহসমূহ)। নিষ্কৃতির পথ নাই।
তবে এই-সকল হইতে ত্রাণের উপায় কি এবং এখানে কিই বা তোমার চাই? একটি ভাব হইল—দুঃখ হইতে অব্যাহতি। আমরা প্রত্যেকেই দুঃখ হইতে নিস্তার পাইবার জন্য দিবারাত্র চেষ্টা করিতেছি। … কর্মের দ্বারা ইহা হইবার নয়। কর্ম কর্মই বাড়ায়। যদি এমন কেহ থাকেন, যিনি নিজে মুক্ত এবং আমাদিগকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত, তবে ইহা সম্ভবপর। প্রাচীন ঋষির ঘোষণা—‘হে মর্ত্যলোকবাসী ও ঊর্ধ্বলোকনিবাসী অমৃতের সন্তানগণ তোমরা সকলে শোন— আমি রহস্য আবিষ্কার করিয়াছি। যিনি সকল অন্ধকারের পারে, আমি তাঁহাকে জানিয়াছি। এই সংসার-মহাসমুদ্র আমরা পার হই কেবল তাঁহারই কৃপায়।’৬
ভারতবর্ষে জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ধারণা এইরূপঃ স্বর্গ আছে, নরক আছে, মর্ত্যলোক আছে; কিন্তু এইগুলি চিরন্তন নয়। যদি আমার নরকে গতি হয়, উহা নিত্যকালের জন্য নয়। যেখানেই থাকি না কেন, একই যন্ত্রণা চলিতে থাকিবে। সমস্যা হইল—এই-সব যন্ত্রণা অতিক্রম করা যায় কিরূপে? যদি আমি স্বর্গে যাই, হয়তো কিছু বিশ্রাম মিলিবে। কিন্তু হয়তো কোন অপকর্ম করিয়া বসিলাম, তখন তো শাস্তি পাইতে হইবে, স্বর্গবাস চিরস্থায়ী হইতে পারে না। … ভারতীয় আদর্শ স্বর্গে যাওয়া নয়। এই পৃথিবী হইতে মুক্তি লাভ কর। নরকেও পড়িও না, স্বর্গকেও তুচ্ছ কর। লক্ষ্য কি?—মুক্তি। তোমাদের প্রত্যেককেই মুক্ত হইতে হইবে। আত্মার মহিমা আবৃত হইয়া আছে। উহাকে পুনরায় অনাবৃত করিতে হইবে। আত্মা তো আছেনই—সর্বত্রই আছেন। কোথায় যাইবেন? … কোথায়ই বা যাইতে পারেন? যদি এমন কোন স্থান থাকিত, যেখানে আত্মা নাই, তবেই তো সেখানে যাইবার কথা উঠিত। ইনি সদা-বর্তমান—(এইটি) যদি হৃদয়ঙ্গম কর, তাহা হইলে চিরকালের জন্য পরিপূর্ণ সুখ (আসিবে)। আর জন্ম মৃত্যু নয়। … আর রোগ নয়, দেহ নয়। দেহ (টি) নিজেই তো কঠিনতম ব্যাধি। …
আত্মা আত্মা (-রূপে) দাঁড়াইয়া থাকিবেন। চৈতন্য চৈতন্যরূপে জীবিত থাকিবেন। ইহা কিভাবে সম্পাদন করা যাইবে? যিনি স্বভাবতই নিত্যবর্তমান, শুদ্ধ ও পূর্ণ, আত্মার (মধ্যে সেই পরমেশ্বরকে) আরাধনা করিয়া। এই জগতে সর্বশক্তিমান্ দুইজন থাকিতে পারেন না। (কল্পনা কর) দুই বা তিনজন ঈশ্বর (আছেন); একজন সংসার সৃষ্টি করিবেন, অপর জন বলিবেন, ‘আমি সংসার ধ্বংস করিব।’ ইহা কখনও ঘটিতে (পারে না)। ভগবান্ একজনই হওয়া চাই। আত্মা যখন পূর্ণতা লাভ করেন, তখন তিনি প্রায় সর্বশক্তিমান্ (ও) সর্বজ্ঞ (হইয়া যান)। ইনিই উপাসক। উপাস্য কে?—সেই পরমেশ্বর স্বয়ং, যিনি সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ ইত্যাদি। আর সর্বোপরি তিনি প্রেম-স্বরূপ। (আত্মা) কিরূপে এই পূর্ণতা লাভ করিবে?—উপাসনা দ্বারা।