ইন্দ্ৰজাল
বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে ইন্দ্ৰজালের একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যজুর্বেদ সংহিতার বহুস্থানে ঐন্দ্ৰজালিক বিশ্বাসের স্পষ্ট বা প্রচ্ছন্ন উল্লেখ রয়েছে, তবে মঙ্গলপ্ৰদ ইন্দ্ৰজাল ও অশুভাপ্রসূ জাদুবিদ্যার মধ্যে ব্যবধান খুব কম, কেননা বহুক্ষেত্রেই অনুষ্ঠানের অনুপুঙ্খগুলি এমনভাবে বিবৃত হয় যে, শক্রকে পর্যুদস্ত করার প্রয়োজনে আরও একটি পাল্টা অনুষ্ঠানের প্রয়োজন দেখা দেয়। যজ্ঞীয় মন্ত্রগুলির অর্ধস্ফুট উপাংশু জপের পদ্ধতি দানব-শক্তির পরাজয়ের সময় আবিষ্কৃত হয়েছিল, এইরূপ ধারণা ব্যক্ত হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যজ্ঞে উপাংশু জপ আবিষ্কৃত না হওয়া পৰ্যন্ত দানবেরা দেবশক্তির সঙ্গে সফলভাবে সংগ্ৰাম করেছিল। বলা বাহুল্য, যজমানের অনুষ্ঠানের প্রণালী গোপন করার এই প্রবণতাকে ইন্দ্ৰজালের সঙ্গেই মূলত সম্পূক্ত ; পুরোহিত সম্প্রদায়ের এই প্রবণতাকে উপযুক্ত প্ৰত্নকথার মাধ্যমে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই ছদ্ম আপাত যুক্তিকে যজ্ঞধর্ম পালনের সমর্থনে সত্য যুক্তিরূপে উপস্থাপিত করার চেষ্টা হয়েছে যাতে আপাত দৃষ্টিতে যুক্তিহীন আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খ ও নৈসৰ্গিক জগতের সঙ্গে কোনো এক কাল্পনিক স্তরে সমন্বিত হতে পারে।
বৈদিক ছন্দের সঙ্গে যজ্ঞ ও যজ্ঞালব্ধ সুফলের অন্তৰ্গঢ় আধ্যাত্মিক সম্পর্ক এবং অতিজাগতিক তাৎপৰ্যযুক্ত ঐন্দ্ৰজালিক গুরুত্ব সম্পর্কে দীর্ঘ বিবৃতি পাওয়া যায়। একটি মৌল বিশ্বাস ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে যে, ইহজগতে আয়োজিত যজ্ঞ প্রকৃতপক্ষে সমগ্র সৃষ্টিতে অদৃশ্যভাবে নিয়ত অনুষ্ঠিত হচ্ছে ; সৃষ্টিকে অক্ষুন্ন রাখার প্রয়োজনে মানুষ বিশ্বসৃষ্টির অন্তর্নিহিত একটা মহাজাগতিক যজ্ঞকেই অনুকরণ ক’রে চলেছে। মানবিক প্রকৃতি এবং মানুষের বিচিত্র সামাজিক বৃত্তিকে প্রায়শই বিভিন্ন প্ৰত্বকথার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
“কিক্কিটা” শব্দটিকে একটি রহস্যময় উপাদান রূপে যজ্ঞীয় পশুর মন, চোখ, কান ও বাক-এর সমপৰ্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। কীথ মনে করেন যে, এই শব্দটির ধ্বনিগত বিন্যাসে গবাদিপশুকে আহ্বানসূচক বিশেষ ধ্বনির প্রতিধ্বনিই রয়েছে। যজুর্বেদ সংহিতায় এই শব্দটিকে জনপ্রিয় ঐন্দ্ৰজালিক বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পূক্ত করা হয়েছে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, বৈদিক ছন্দের মধ্যেও জাদুশক্তির অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হয়েছিল। অক্ষর বা চরণের সংখ্যা প্রাকৃতিক কোনও বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এই সম্পর্ক-কল্পনার মধ্যেই যজ্ঞানুষ্ঠানের রহস্যময় উপযোগিতা বা ছন্দের প্রচ্ছন্ন শক্তি নিহিত। বৈদিক সমাজে এইরূপ ঐন্দ্ৰজালিক বিশ্বাসের অতিপ্ৰাকৃত তাৎপর্য সুস্পষ্ট। সামবেদে এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতর এবং ছন্দোগ্য ব্ৰাহ্মণে তা যথার্থই সর্বাতিগ প্রতীকী তাৎপর্য অর্জন করেছে। পরবর্তী সাহিত্যে সোমযাগের গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছন্দের গৌরবও বর্ধিত হয় এবং সেই সঙ্গে সামবেদের মহিমা উত্তরোত্তর দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সোমযাগকে পরিকল্পিতভাবে রহস্যনিবিড় স্তরে উন্নীত করার প্ৰয়াসের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ক্ষেত্রেই অতিজাগতিক প্ৰতীকায়নের প্রবণতা দেখা দেয়। যৌথ-অবচেতনায় প্রত্নপৌরাণিক যুক্তি অনুযায়ী অগ্নি-ছন্দগুলিকে বন্ত্রের মতো ব্যবহার ক’রে নিজেকে আচ্ছাদিত করেন; সহজ কথায় ছন্দোবদ্ধ মন্ত্রে অগ্নি প্রশংসিত হন ; অগ্নির সঙ্গে ছন্দগুলির এইরূপ সম্পর্কের উপলব্ধির জন্যই উপাসক বস্ত্ৰ লাভের যোগ্যতা অর্জন করেন। মহাকালের সূচনা-পর্ব থেকেই দেবগণ মানবজাতির প্রতি নানা ধরনের কৃপা বর্ষণ করছেন বলে তাদের শক্তি ও সারাৎসার এই প্রক্রিয়াতেই নিঃশেষিত হয়ে যায়। কখনও কখনও এই তথ্যকে দেবতাদের অঙ্গহানির প্রতীকের মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে। দেবতাদের এইসব হারানো অঙ্গ বা শক্তিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য কয়েকটি বিশেষ যজ্ঞানুষ্ঠানের বিধান দেওয়া হয়েছে। যজ্ঞধর্মের সামগ্রিক ভাবাদর্শের উপর এ জাতীয় প্রত্নকথার প্রভাবে যজমােন যেন এক অতিপ্ৰাকৃত তাৎপর্য ও গুরুত্ব অর্জন করেছিলেন, কেননা হারানো শক্তিকে সত্বর পরিপূরণ না করা হলে সৃষ্টির ধ্বংসের আশঙ্কা দেখা দেয়। তাই যজমান যখন পুরোহিতের সাহায্যে যজ্ঞ করে দেবতার অঙ্গহানির প্রতিষেধ করেন, তখন মহাবিশ্বের পটভূমিকায় যজ্ঞক্রিয়াটি তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। সুতরাং ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহের অগ্রগামী যজুর্বেদের পর্যায়েই যজ্ঞ অধ্যাত্মচিন্তার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ধীরে ধীরে সাধারণভাবে যজ্ঞধর্ম ও বিশেষভাবে আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খগুলি সংশয়াতীতভাবে সামাজিক মননের মূল স্রোতে এসে মিশে যায়।
অধিকাংশ প্রত্নকথা তার স্বভাববৈশিষ্ট্যেই হেতুসন্ধানী, কিন্তু প্রায়ই সেসব যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে অধিকতর প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত বিষয়গুলি সংলগ্ন হয়ে থাকে। কদু এবং সুপর্ণীর বিখ্যাত প্ৰত্নকথায় বৈদিক ছন্দগুলির বিশেষ ভূমিকা কল্পিত হয়েছে। অনুরূপভাবে অন্য একটি প্রত্নকথার গন্ধৰ্ব বিশ্বাবসু কর্তৃক অপহৃত সোম উদ্ধারের জন্য দেবতারা বাগদেবীকে প্রেরণ করেন, বাগদেবী গন্ধৰ্বদের সংগীত ও নৃত্যে মুগ্ধ হয়ে নিজ কর্তব্য বিস্মৃত হলেন ; ফলে, এই প্রত্নকথার উপসংহারটি আমাদের প্ৰত্যাশার বিপরীত। যক্ষারোগের উৎস বিষয়ক একটি প্রত্নকথা আমরা পাই বা পরবর্তীকালে মহাভারত এবং পুরাণসমূহে পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এ ধরনের প্রত্নকথায় একই সঙ্গে বহু উদ্দেশ্য সাধিত হয়। যক্ষ্মারোগের হেতুসন্ধান ছাড়াও বহুবিবাহ প্রথার কুফল সম্পর্কে সচেতনতা যেমন ব্যক্ত হয়েছে, তেমনি বাধি থেকে আরোগ্যলাভের প্রয়োজনে আদিত্যদেবের উপাসনার প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে আমরা একদিকে সৌর দেবতাদের সঙ্গে আরোগলিপ্সু ঋগ্বেদীয় সূক্তগুলির সম্পর্কের কথা স্মবণ করতে পারি, অন্যদিকে পরবর্তী সাহিত্যে সূর্যদেবের সঙ্গে চিকিৎসার সম্পর্ক বিষয়েও অবহিত হই।
তৈত্তিরীয় সংহিতায় আমরা সর্বপ্রথম ত্রিপুরদহন বিষয়ক বিখ্যাত দেবকাহিনীটির সন্ধান পাই, যেখানে শিবের একটি মাত্র বাণ নিক্ষেপ তিনটি দৈত্যপুরী যুগপৎ ধ্বংস হওয়ার বিবরণ রয়েছে। এই কাহিনীর সঙ্গে উপসৎ অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বয়েছে এবং এতে সেই সঙ্গে দেবতাদের আশীর্বাদে রুদ্রের ‘পশুপতি’ অভিধা লাভের কাহিনীও বিবৃত হয়েছে। আলোচ্য কাহিনীটির সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রের বরাহবধের কাহিনীও উল্লিখিত : দৰ্ভজাতীয় কুশগুচ্ছের সাহায্যে ইন্দ্ৰ সপ্তপর্বত ভেদ করে দানবকে বধ করেছিলেন এবং যে যজ্ঞ পলায়ন করে পৃথিবীর অভ্যস্তরে প্রবেশ করেছিল বিষ্ণুরূপ ধারণ করে তাকে উদ্ধার করেছিলেন। এই প্রত্নকথার উপসংহারে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য রয়েছে যে পৃথিবী প্ৰাথমিক অবস্থায় অসুবাদেরই করায়ত্ত ছিল,–ইন্দ্ৰ দেবতাদের প্রতিনিধিরূপে অসুর-ভূমিকে সবলে অধিকার করেছিলেন। অর্থাৎ ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসী অসুর বা সিন্ধু-উপতাকা-নিবাসীদের পরাভূত করেই যে আর্যরা নিজেদের বসতি বিস্তার করতে সমর্থ হযেছিলেন, তা একটি রূপকের দ্বারা যেন এখানে বর্ণিত হয়েছে।
শিবকে কেন্দ্র করে বীরত্বমূলক উপাখ্যান ঈঙ্গিতভাবে গড়ে ওঠে নি বলেই সম্ভবত তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার প্রয়োজনে ত্রিপুর-দহনের প্রত্নকথা কল্পিত হয়েছিল। ছলনার মাধ্যমে প্ৰাগাৰ্য জনগোষ্ঠীর ভূ-সম্পদ আৰ্য আক্রমণকারীরা কীভাবে আত্মসাৎ করত তার ইঙ্গিত রয়েছে সালাবৃকী বিষয়ক প্রত্নকথায় ফেল গানে ইন্দ্ৰ সালাবৃকীরূপে দৌড়ে অসুরদের প্রতিশ্রুত ভূমিভাগ অর্থাৎ সমগ্ৰ অসুরভূমি আত্মসাৎ করেন। তেমনি ঐন্দ্ৰজালিক শক্তিপ্রয়োগের নিদর্শন রয়েছে ইন্দ্র কর্তৃক বরাহ-নিধনের উপাখ্যানে। এছাড়া, আমরা একটি বিচিত্র অর্থযুক্ত সংক্ষিপ্ত সৃষ্টিতত্ত্বমূলক কাহিনীর সন্ধান পাই যেখানে অগ্নিদেবের অতিজাগতিক ও সৃজনশীল ভূমিকা বিবৃত হয়েছে। বাস্তবজীবনে সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে অগ্নির অনিবাৰ্য ভূমিকা আৰ্যরা লক্ষ্য করেছিলেন। মানুষের প্রথম ধর্মীয় আচরণের, অর্থাৎ যজ্ঞের, সঙ্গে অগ্নিই একমাত্র নৈসৰ্গিক উপাদানরূপে প্ৰত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। মানুষের বন্ধুরূপে অগ্নির অন্যান্য যে ভূমিকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তা হল নিশ্চিত শস্য সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও বহু সন্তান উৎপাদনে সহায়কের ভূমিকা। প্রথম অগ্নি-উৎপাদনক ও কার্য-বিধায়ক গোষ্ঠীর দৈব প্রতিরূপ হিসাবে ‘সাধ্য’গণ পরিকল্পিত হয়েছিল। একই প্ৰত্নকথায় অগ্নিকে সেই পুরুষের পদবী দেওয়া হয়েছে, যিনি নিজেকে আত্মযজ্ঞে সমৰ্পণ করে বিশ্বসৃষ্টি সম্পাদন করেন।
কোনও প্রাগার্য সংসার-বিমুখ, ভ্ৰমমান সাধক-গোষ্ঠীর প্রতি ইন্দ্রের নিষ্ঠুর বিশ্বাসঘাতকতার আভাস রয়েছে একদল ‘যতি’কে সালাবৃকদের কাছে সঁপে দেওয়ার
নিষ্ঠুর কাহিনীতে।
যজ্ঞীয় আহুতিগুলির মধ্যে ‘ইলা’ বা ‘ইড়া” (যজ্ঞভাগ) বিশেষ পবিত্র বস্তু। দুটি পরস্পর সংবদ্ধ উপাখ্যানের মধ্যে এই পবিত্রতার কল্পনাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। পূষা ভ্ৰান্তিবশে সাধারণ খাদ্য ভেবে কঠিন ইড়াকে চর্বণ ও ভক্ষণ করতে গিয়ে দন্তহীন হয়ে পড়েছিলেন। বৃহস্পতি যজ্ঞের পবিত্ৰশক্তির ধারক ; বিশ্বজগতের সর্বত্রগামী চক্ষু, অর্থাৎ সূর্যের মাধ্যমে তিনি ইলার দিকে দৃষ্টিপাত করেন ও অন্যান্য দেবতাদের মতো অগ্নির মাধ্যমে তাকে গ্ৰহণ করেন। এই প্ৰত্নকথার আহূতির মৌলরূপটি পরিবর্তিত হয়ে একটি সর্বাতিশায়ী দৈব-শক্তির প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের প্রত্নকথার সাহায্যে যজ্ঞ বিষয়ে যথার্থ ও অনুষ্ঠানগতভাবে প্রত্যয়সিদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যেই যজ্ঞ নিত্যনূতন মাত্রা, মর্যাদা ও গৌরব অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে এটাই যজুর্বেদের অন্যতম প্রধান অবদান।
যদিও অধিকাংশ প্রত্নকথাই চরিত্রগতভাবে হেতুসন্ধানী, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব কাহিনীর মধ্যে দেবতাদের প্রতি নুতন এক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ও পাওয়া যায়। এগুলি প্রধানত সাতটি ধারায় বিভক্ত। যেমন-(১) কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসিদ্ধির ক্ষেত্রে একক দেবতার অসামর্থ্যের ফলে একটি বিশেষ বাধা অতিক্রম করার প্রয়োজনে নির্দিষ্ট কোনো অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। সূৰ্য, বরুণ ও অশ্বীদের সম্পর্কে এ জাতীয় কিছু দেবকাহিনী প্রচলিত রয়েছে। (২) কিছু কিছু দেবকাহিনীতে একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে যে, দেবতারা সঙ্ঘবদ্ধভাবে কোনো কাৰ্যসাধনে ব্ৰতী হয়েও ব্যর্থ হলেন, পরে প্রজাপতির কাছে উপদেশ প্রার্থনা করলে তিনি তাদের নির্দিষ্ট একটি যজ্ঞ সম্পাদন করতে নির্দেশ দেন। তবে এ জাতীয় প্ৰত্নকথা এখনও বিরল, ব্ৰাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে এগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। (৩) কোনও কোনও প্রত্নকথা প্ৰায়শ্চিত্তমুলক-যজ্ঞকর্মে ত্রুটিবিচ্যুতি এবং ব্যক্তিগত দুৰ্ভাগ্য ও ভ্ৰাস্তিজনিত পাপক্ষালনের প্রয়োজনে এগুলি রচিত। তবে, পরবর্তী ব্রাহ্মণসাহিত্যে আনুষ্ঠানিক প্ৰায়শ্চিত্তের ভূমিকা যতটা গুরুত্বপূর্ণ যজুর্বেদ সংহিতায় ততটা নয়। (৪) কিছু কিছু নিবৃত্তিমূলক ও স্বস্তিবাচক কাহিনীও গড়ে উঠেছে, মুখ্যত অদিতি, ইন্দ্র ও রুদ্রকে কেন্দ্র করে। (৫) কখনো কখনো অনুষ্ঠান বা যজ্ঞীয় অনুপুঙ্খকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা এ কাহিনীগুলিতে লক্ষ্য করা যায়। আদিত্যদের অঙ্গিরসের দ্বারা অগ্নিচয়ন, দর্শপুর্ণমাস যজ্ঞের আয়োজন ইত্যাদির বিবরণে এর নিদর্শন রয়েছে। (৬) কখনো বা সমস্যা নিরসনের চতুর কৌশলরূপে কোনও কোনও প্রত্নকথা প্ৰযুক্ত হয়। উদাহরণরূপে বিষটু উচ্চারণের সঙ্গে সম্পর্কিত ক্ষুদ্র কাহিনীটির উল্লেখ করা যেতে পারে। (৭) কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অভিনব দৃষ্টিভঙ্গির অভিব্যক্তি বিস্ময়কর কিছু কাহিনীতে পরিস্ফুট হয়েছে। তাই কোথাও বা দেখা যায় যে, সমস্ত দেবতাই বৈরি জনগোষ্ঠীরূপে আকস্মিকভাবে চিত্রিত হয়েছেন যাদের কাজ হ’ল মানুষের প্ৰচেষ্টাকে ব্যাহত করে তাদের বিভ্ৰান্ত করা। সম্ভবত, আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ইতোমধ্যে যজ্ঞানুষ্ঠান ব্যয়ে, জটিলতায় ও নিয়মের ক্রমবর্ধমান বাহুল্যে দুৰ্বহ হয়ে দাঁড়িয়েছে ; কেবলমাত্র অত্যন্ত ধনী ব্যক্তিই তখন যজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারতেন। ফলে, সাধারণ মানুষ নিতান্ত দর্শক হিসেবে দেবতাদের দেখতে পেতেন অত্যাচারী ও মানুষকে পীড়ণ করে হব্য আদায় করার ভূমিকাতে। সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত যজ্ঞও তাদের কাছে ঈঙ্গিত ফলদানে অসমর্থ ব’লে প্ৰতিপন্ন হয়েছিল, কারণ যজ্ঞ করে অভীষ্ট ফললাভের ব্যর্থ মানুষের অভিজ্ঞতায় জমা হচ্ছিল ক্ৰমেই। দেবতাদের যেখানে যজ্ঞের বিধ্বংসী এবং অপহারক রূপে বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে রচয়িতার প্রকৃত অভিপ্ৰায় সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। সম্ভবত, এব মধ্যে আমরা বিচ্ছিন্নতাবোধ, অবিশ্বাস এবং দৈব প্রতারণা সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা লক্ষ্য করতে পারি। যদিও এই অংশটি যে শাস্ত্ৰ সংকলনের সময় বর্জিত হয় নি সেটার বিস্ময় থেকেই যায়। যে সোমযাগ ক্রমশ বর্ধিত গুরুত্ব অর্জন করেছিল, তার সপ্ৰশংস উল্লেখ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল ব’লেই সম্ভবত এই আপাত-বিরোধী অংশটি পরিত্যক্ত হয় নি।
কখনো কখনো প্ৰত্বকথার মধ্য দিয়ে কোনও বিকাশোম্মুখ ভাবাদর্শ বিশ্লেষণের উপযোগী অস্তদৃষ্টি আমরা লাভ করি যা পববতী সাহিত্যে ক্রমে প্রধান আধ্যাত্মিক প্রবণতারূপে পবিণতি লাভ করেছে। যেমন নির্বাণোন্মুখ গার্হপত্য অগ্নির পুনর্নবীকরণের নিয়মাবলী বিধিবদ্ধ করার সময় তাকে জীর্ণ নির্মোকযুক্ত সৰ্পের সঙ্গে সুসংগত একটি প্রত্নকথায় কথিত হয়েছে যে, বদ্রুপুত্র কসর্নীর যথোপযুক্ত ইন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল যার সাহায্যে সে নতুন নির্মোক লাভ করতে পারে। পরবর্তীকালে এই চিত্ৰকল্পই আত্মার দেহান্তর প্রাপ্তির যে তত্ত্বে রূপান্তরিত হয়েছিল, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ রয়েছে ভগবদগীতার একটি বিখ্যাত শ্লোকে। সেখানে আমরা সেই মানুষের মৃত্যুহীন ভাবমূর্তি দেখতে পাই, যে জীর্ণবস্ত্ৰ ত্যাগ করার মতোই মৃত্যুকালে শরীর ত্যাগ করে। ব্যাবিলনীয় মহাকাব্য ‘এপিক অব গিলগামেশ’-এ অনুরূপ রূপটিই ব্যবহৃত হয়েছে। গিলগামেশা মহাকাব্যে মানুষের অমরত্বের জন্য আহৃত অমৃত হঠাৎ পান করে সাপ নির্মোক ত্যাগ করে নবজীবন লাভ করে। বস্তুত, জন্মাস্তরে দেহান্তর-প্ৰাপ্তির কল্পনার পশ্চাতে যে সাপের মোক-মোচনই রয়েছে এতে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং প্রত্নকথাগুলি বিবিধ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে, বহু ভিন্ন ভিন্ন সচেতন ও অবচেতন দাবি-পূরণ করতে গিয়ে, বিচিত্র আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খের আপাত-যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নির্ণয় করেছিল। এই সব প্রত্নকথা সামাজিক আচারকে যুক্তিগ্রাহ্য করে, সামূহিক বা ব্যক্তিগত দুৰ্ভাগ্যকে নিবারণ করে, দেবতাদের সন্তুষ্টি বিধান করে তাদের গোষ্ঠী বা ব্যক্তির প্রতি প্ৰসন্ন করে তোলে, আনুষ্ঠানিক ক্রটি বিচূতির জন্য প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করে এবং ব্যক্তিগত দৈব-দুর্বপাকের প্ৰতিবিধান করে। কখনও বা প্ৰত্বকথার মধ্যে আধ্যাত্মিক উপলব্ধি প্ৰতিফলিত হয়। যমের আধিপত্য, স্বর্ণের অমরতা এবং সত্ৰ, দীক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে যে ভাবনা ব্যক্তি হয়েছে, তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে একটি বস্তুনিষ্ঠ পরিপ্রেক্ষিত।
আনুষ্ঠানিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে প্রত্নকথাগুলি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে তাদের বিচিত্র ভূমিকা পালন করে। কোনও কোনও প্রত্নকথায় যজমান ও পুরোহিতের কাছ থেকে যজ্ঞের পলায়ন এবং যজমান ও পুরোহিতের অন্বেষণ ও পরে শর্তাধীন প্ৰাপ্তি বর্ণিত। প্রতি ক্ষেত্রেই এই প্ৰাপ্তির জন্য অনুষ্ঠিত কোনো একটি অনুপুঙ্খ এর পরে যজ্ঞে সন্নিবেশিত হয়। এইভাবেই কাহিনীর মধ্য দিয়ে যজ্ঞেরা জটিলতা ও নব নব অঙ্গবিন্যাস ঘটে। এটা ঘটে যজ্ঞানুষ্ঠান ক্রমশ জটিল, ব্যয়সাধ্য, বহু পুরোহিত-নির্ভর ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার যুগে। তখন যজীৱীয় পুরোডাশ ও উচ্চ বেদীয় সঙ্গে যথাক্রমে কচ্ছপ ও সিংহীকে উপমিত করা হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, অগ্নি, রুদ্র বা বিষ্ণুর যজ্ঞভূমি থেকে পলায়ন বা যজমানদের কাছ থেকে আত্মগোপন করাও বর্ণিত হয়েছে। যজ্ঞীয় আহুতি প্রদানে বা বিশেষ কিছু মন্ত্র উচ্চারণে বা নির্দিষ্ট ছন্দে মন্ত্র-প্রন্থনায় কিংবা পৃথক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্মান প্রদর্শনের শর্তে সেই দেবতা শেষ পর্যন্ত যজ্ঞে অংশগ্রহণে সম্মতও হয়েছেন। এসব কাহিনীতে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজে সুবিধাভোগী কিছু ব্যক্তির মান-অপমান বোধ ও তাদের প্রতি উদ্দিষ্ট স্তাবকতা। তৃতীয়ত, দেবতা ও অসুরদের চিরকালের সংগ্রাম, অনিবাৰ্যভাবে দেবতাদের পরাজয় এবং শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জয়লাভ সুনিশ্চিত হওয়া ইত্যাদিও কিছু কিছু প্ৰত্নকথায় লক্ষ্য করা যায়। কোনো নবাবিষ্কৃত অনুষ্ঠানের অপরিহার্যতা ও উপযোগিতাকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠার জন্যই এগুলির সৃষ্টি। চতুর্থত, দেবতাদের সঙ্গে অসুর বা অন্যান্য তির্যক-যোনির প্রতিযোগিতাও বর্ণিত হয়েছে-এইসব ক্ষেত্রে কোনো কোনো অনুষ্ঠানের নিয়ামক ভূমিকা লক্ষণীয়। পঞ্চমত, প্রাকৃতিক ঘটনাবলী প্রত্নকথার মাধ্যমে আপাতভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও চোখে পড়ে, যে গৌণ কোনো আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খের সঙ্গে এদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। যষ্ঠত, কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রত্নকথা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে আপাতভাবে অনুষ্ঠানটির যৌক্তিকতা বিধান করে। যেমন বলা হয়েছে, দীক্ষিত ব্যক্তির নিন্দ্ৰামগ্ন হওয়া উচিত নয়, যেহেতু নিদ্ৰিত যজমানকেই রাক্ষসেরা আক্রমণ করে থাকে। সপ্তমত, কিছু কাহিনীর মাধ্যমে সামাজিক আচার ব্যবহারও ব্যাখ্যাত হয়। বহুবিবাহ প্ৰথা, পত্নীকে প্রহার করার প্রচলিত ব্যবস্থা, যজ্ঞে নারীদের যোগদানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক নিষেধ, যজ্ঞের দক্ষিণা, চিকিৎসকদের উপর সামাজিক তাচ্ছিল্যসূচক বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদি নিশ্চিতভাবেই বিবিধ অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক উপাদানেব পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল ; কিন্তু এখন সেইগুলি প্ৰত্নকথার মধ্য দিয়েই যুক্তিযুক্ত বলে প্ৰমাণিত ও জনসমাজে সেগুলিকে গ্ৰহণযোগ্য ও নির্বিচারে আচরণীয় করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে এসব কাহিনীর অবতারণা করে। সামাজিক ও মানবিক স্তর থেকে পবিত্র অনুষ্ঠানের স্তরে উন্নীত করে এই সব ব্যাখ্যাকে চূড়ান্ত ও তর্কাতীত রূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। অষ্টমত, কিছু কিছু শব্দের কাল্পনিক বুৎপত্তিকে সমর্থন করার প্রয়োজনে কিছু কাহিনীর সৃষ্টি হয়েছিল। বহু ক্ষেত্রেই এই সব ব্যুৎপত্তি শেষ পর্যন্ত প্রকৃত সময়সীমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো ধূসর প্রত্ন-পৌরাণিক অতীতে উপনীত হয়েছে। এই প্রবণতার সঙ্গে ঐন্দ্ৰজালিক বিশ্বাসের পরোক্ষ সম্পর্ক অনুমেয়। পরিশেষে বহু-সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাহিনী, উপকাহিনী গড়ে উঠেছিল ভিন্ন ধরনের বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে সাম্য বা একাত্মতা কল্পনার মধ্যে দিয়ে। যেমন রুদ্রই অগ্নি মৃত্যু ব্ৰহ্মরই রূপ যজ্ঞ বেদীতে স্থাপিত অগ্নি প্রকৃতপক্ষে নিত্রিত সিংহ, সিন্ধুরা বরুণের পত্নী, ব্ৰহ্মা দেবতাদের বৃহস্পতি, বরুণই দুর্বাক ইত্যাদি। স্পষ্টতই এ ধরনের সমতা স্থাপনের প্রবণতা মূলত পৌরাণিক এবং নিতান্ত পরোক্ষভাবে আনুষ্ঠানিক।
বিশ্বাসকে স্পষ্ট করাই এগুলির লক্ষ্য। স্বাভাবিকভাবেই সমতা বা একাত্মতা স্থাপনের প্রবণতা সর্বদা একইভাবে উপস্থিত নয়, ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী এবং অনুষ্ঠানে এগুলির রূপও ভিন্ন ভিন্ন। প্রত্নকথাগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য সন্ধান করা বৃথা ; একসঙ্গে একটিমাত্র উদাহরণকে সুস্পষ্ট করার উদ্দেশ্যেই ব্যাখ্যার প্রয়োগ হয় এবং ঠিক তার জন্ম কােনাে স্পিনের জন্য সামবােহের নতুন এক সূত্র সন্ধান অনিবার্য হয়ে পড়ে।
অগ্নিচয়ন অনুষ্ঠানের অন্যতম অংশ রুদ্রহােম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কেননা বিখ্যাত শতরুদ্রীয় এর অন্তর্ভুক্ত। রুদ্রহােম এগারটি অধ্যায়ে বিভক্ত ; শেষের দুটিতে রয়েছে রুদ্রের প্রতি নিবেদিত ঋক ও যজুমন্ত্রসমূহ। প্রথম অধ্যায়ে রুদ্রের প্রসন্নতা অর্জনের উদ্দেশ্য প্ৰধুক্ত মন্ত্র এবং দ্বিতীয় থেকে নবম অধ্যায়ে দুই বা এক অর্ঘ্যযুক্ত রুদ্রপ্ৰশস্তি রয়েছে। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খের মধ্যে রুদ্রের ক্ৰোধ প্রশমনের আকাঙক্ষাই মূর্ত হয়ে উঠেছে—শতরুদ্রীয় সূক্তে রুদ্র শতাধিক নাম বা বিশেষণে ভূষিত হয়েছেন। বস্তুত, সমস্ত প্ৰাচীন প্রত্নপুরাণের সাধারণ চরিত্রলক্ষশই হ’ল অসংখ্য প্ৰায়োগিক গুণ ও নামে অলংকৃত করে পূজাহঁ দেবতার বলদৃপ্ত ও শক্তিমান ভাবমূর্তি রচনার প্রবণতা। বিভিন্ন মন্ত্র বিশ্লেষণ করে রুদ্রদেবের আর্য ও অনাৰ্য উৎসের ইঙ্গিত প্রবল হয়ে ওঠে। যদিও আমাদের কাছে কোনও সুস্পষ্ট নিদর্শন নেই, তবুও অনুমান করতে বাধা নেই যে, ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেও বৈদিক আৰ্য ধর্মবোধ অর্থাৎ বৃহৎ ঐতিহ্যের সঙ্গে অনার্য সংস্কৃতির অর্থাৎ লঘু ঐতিহ্যের সহাবস্থান সম্ভব ছিল। রুদ্রের প্রাথমিক উৎসস্থল অনার্য সংস্কৃতির মধ্যে থাকলেও ঋগ্বেদ এবং যজুর্বেদে যজ্ঞানুষ্ঠানকে নিষ্কণ্টক করার প্রয়োজনে আর্যরা বিশেষভাবে তার প্রসন্নতা কামনা করেছেন। পরবর্তী বহু শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষে যে সংশ্লেষণ ও সমন্বয়ের প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চলছিল, যজুর্বেদে তারই সূচনা লক্ষ্য করি। অন্তরঙ্গ নিদর্শন থেকে মনে হয় যে, রুদ্র জনপদ বা গ্রামের দেবতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন নির্জন অঞ্চল ও দূরবর্তী নদী ও জলস্রোতের দেবতা। সম্ভবত, তিনি মূলত অরণ্য থেকে কাষ্ঠ সমিধা ও জল আহরণকারী শূদ্র এবং ব্রাত্যদের দেবতা। এছাড়া, রুদ্রকে বিভিন্ন আকৃতি ও বর্ণ এবং বহু বিচিত্র জীবিকার ব্যবস্থাপকররূপে বন্দনা করা হয়েছে। এই সব জীবিকার মধ্যে এমন কিছু কিছুও রয়েছে যা আৰ্য ধর্মবোধ অনুযায়ী দেবতার উপযুক্ত নয়–সম্ভবত, আদিম অধিবাসীদের প্রতি আৰ্যদের তাচ্ছিল্য ও ঘূণাই এতে প্ৰকাশিত। আর্যবসতি থেকে দূরে এইসব নীচ, অবহেলিত ও অশুচি বৃত্তিজীবীরা নির্বাসিত হয়েছিল বলেই তাদের দেবতা রুদ্রের বিষয়ে পড়ি যে, তিনি অরণ্যে, পর্বতে ও নির্জন অঞ্চলে চির ভ্ৰমমাণ। আৰ্যমানসে শত্রুর চতুর কৌশল ও নিজেদের সাময়িক কিছু পরাজয়ের স্মৃতি জাগারুক ছিল বলেই এবং জয়ের পরে সমৃদ্ধতির আর্যপল্লীতে প্ৰত্যন্তবাসী প্ৰাগাৰ্য মধ্যে মধ্যে হানা দিত বলে অনাৰ্যদের দাসু, প্ৰতারক, তস্কর ইত্যাদি বিশেষণ দেওয়া হয়েছে। নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে অনাৰ্যরা বাধ্য হয়ে যে লুণ্ঠনের আশ্রয় নিত, তারও ইঙ্গিত রয়েছে বৰ্ণনায়। বহু ক্ষেত্রে রুদ্রের প্রশস্তি-বাচক বিশেষণে যে বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে, তা তাৎপৰ্যপূর্ণ। বিজয়ী আর্যদের নিকট স্বভাবতই পরাজিত জনগোষ্ঠী নামহীন জনতারূপে প্ৰতিভাত হত, যদিও ঋগ্বেদে গোষ্ঠীপতিদের কয়েকটি নাম পাওয়া যায়। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত কয়েকটি জীবিকার উল্লেখ রয়েছে: দ্বারপাল, শিকারী, কুকুর-পালক, দারুশিল্পী, রথনির্মাতা, কুম্ভকার, ধাতুশিল্পী প্রভৃতি। সম্ভবত, এদের মধ্যে সিন্ধু-উপত্যকার উৎকৃষ্ট কারুশিল্পীর পরিচয়ও নিহিত, যাদের প্ৰতি যাযাবর আর্যরা শুধুই তাচ্ছিল্যই প্ৰকাশ করতেন। এছাড়া, আমরা আরও কিছু বৃত্তিজীবী, কৌম সমাজভুক্ত পুজিষ্ঠ ও নিষাদ, শিপিবিষ্ট গোষ্ঠীভুক্ত দেবতা ত্রয়ী অর্থাৎ ভব, শর্ব ও শিপিবিষ্টের কথা উল্লেখ করতে পারি,–এদেরই সমন্বয়ে পরবর্তীকালে রুদ্র-শিব দেবতাটির জন্ম হয়েছিল। এই যুগনন্ধ দেব-কল্পনায় ও দেবতার দেহ বৰ্ণনায় অনাৰ্য জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আৰ্যদের মানসিক প্রতিক্রিয়া অভিব্যক্তি। জাতিগত সংমিশ্রণ ও ধর্মীয় সংশ্লেষণের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন অনার্য ভাবনা যখন কতকটা মৰ্যাদা অর্জন করেছিল, আৰ্যদের ধর্মতত্ত্বে তখনই তাদের জন্য চূড়ান্ত স্থানও নির্দিষ্ট হ’ল। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের সঙ্গে যজুর্বেদও এই যুগের অন্যতম সৃষ্টি।
অনার্যদের দেবতার বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীনতর আর্যদেবতা রুদ্রের নিয়ত উল্লেখও দেখতে পাই ; তিনি মূলত প্ৰসন্ন ভাবমূর্তিরই দেবতা ছিলেন এবং যজুর্বেদের ক্ষেত্রেও তার এই প্ৰসন্নতা অটুট ছিল। তবে, যজুর্বেদে চিত্রিত রুদ্রদেবের ব্যক্তিত্বে হয়ত বিমূর্ত কোনো দেবতার অর্থাৎ আকস্মিক দুর্ঘটনার অধিষ্ঠাতা একটি দেবতার উপযুক্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য গুণাবলী যুক্ত হয়েছিল। সৌর দেব-গোষ্ঠীর প্ৰসন্নতা প্রার্থনা করে যতই প্রশস্তিবচন উচ্চারিত হােক না কেন, তৎকালীন সমাজে তা আকস্মিক দুর্ঘটনার কোনও অভাব ছিল না–গবাদি পশু হঠাৎ মহামারীতে মৃত্যুমুখে পতিত হত, মানব-শিশুর মৃত্যুর হারও অধিক ছিল, বহুবিধ অজ্ঞাত কারণে মানুষ ক্ষুধা, ব্যাধি, বিপদ ও মৃত্যুর আশঙ্কায় পীড়িত হত। বৈদিক রুদ্রদেবের নেতিমূলক এবং অশুভসূচক ব্যক্তিত্বটি এইসব ধ্বংসকারী শক্তির সমন্বয়েই গড়ে উঠেছিল। বস্তুত, সকল দেবতাই মূলগতভাবে দ্বৈত চরিত্রযুক্ত-ৰ্তাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রার্থনাতেও তাই দ্বিবিধ তাৎপৰ্য-দেবতার ব্যক্তিত্বে নিহিত সমস্ত অশুভের দূরীকরণ এবং আকাঙক্ষাপূরণের জন্য আশীর্বাদলাভ। আর্যদের দৃষ্টিকোণ থেকে অনাৰ্যরা য়েহেতু অমঙ্গলের মূর্ত রূপ বলেই গণ্য হ’ত, তাই অনার্য উৎসজাত দেবতাও ভয়ংকর ও অশুভ বলে চিত্রিত হতেন। বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে যখন রুদ্রের জটিল ভাবমূর্তি স্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করেছিল, এই দ্বৈত বোধই হয়ে উঠল তার শক্তির উৎস। তাই, অগ্নিচয়নের মতো প্রধান ও গাম্ভীর্যপূর্ণ যাগের অনুষ্ঠানের স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করেও রুদ্রদেবের প্রসন্নতা লাভের জন্য প্রশান্তি ও প্রার্থনা নিবেদিত হ’ল। আর্য ও অনার্য উপাদানের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের প্রক্রিয়ার একটি অত্যন্ত তাৎপৰ্যপূর্ণ স্তরের নিদর্শন শতরুদ্ৰীয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে। যজুর্যেদের প্রত্নকথাগুলির সৃষ্টির পশ্চাতে যে সামাজিক প্রেরণা সক্রিয় ছিল, তার চরিত্র অনুধাবন করা খুব কঠিন নয়। বিবাহসূত্রে অনাৰ্যরা যখন আর্যদের জীবনধারার সঙ্গে সম্পূক্ত হয়ে আর্য ধর্ম-ভাবনার মৌল প্রবণতাগুলি আত্মসাৎ করে নিচ্ছিল, তখন নতুন উপাসনা পদ্ধতি গ্রহণের সমর্থনে ধীরে ধীরে তাদের যৌথ অবচেতনায়সুসঙ্গত প্রত্নপৌরাণিক উপাখ্যান সৃষ্টি হ’ল। তৈত্তিরীয় সংহিতার বিভিন্ন প্রত্নকথার ক্ষেত্রে এই প্রবণতাই অক্ষ-স্বরূপ।
চূড়ান্ত বিচারে একথাই বলা যায় যে, যজ্ঞের মহিমা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞানুষ্ঠানের দক্ষিণার গুরুত্বও বহুগুণ বর্ধিত হ’ল। এই দক্ষিণার বর্ধিত গৌরব থেকে প্রমাণিত হয় যে, পুরোহিত শ্রেণীর ক্রমিক উত্থানের সঙ্গলে তারা সমাজের অগ্রগামী অংশে পরিণত হয়েছিল। ইতোমধ্যে আক্রমণকারী আর্যরা ভারতভূমিতে কৃষিজীবীরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজেদের আয়-বৃদ্ধির প্রয়োজনে গোসম্পদ উন্নয়ন, প্রাথমিক কারুশিল্প এবং কিছু কিছু বাণিজ্য জীবিকা ও বৃত্তি হিসাবে অবলম্বন করেছিল। সুনির্দিষ্ট হ’ল ; মৃগয়া ও পশুপালনের যুগে যা সম্ভব ছিল না, কৃষিব্যবস্থার যুগে বর্ষাকালেও খাদ্য সঞ্চয় করা সম্ভব হল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও শ্রেণীগত বিভাজনের ফলে কৃষিকার্যের দায়িত্ব বৈশ্য ও শূদ্ৰদের উপর ন্যস্ত হ’ল, যাতে উদ্ধৃত্তি সম্পদ সৃষ্টি হয় এবং তারই কল্যাণে সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের মুষ্টিমেয় কিছু লোক উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পায়। এই পরিশ্রমভোগী শ্রেণীর লোকেরাই কৃষিকার্যের পক্ষে অত্যাবশ্যক বর্ষপঞ্জী আবিষ্কার করল এবং এরাই জ্ঞানে, অভিজ্ঞতায়, যুক্তি, বিদ্যা ও সাধারণী করণের ক্ষেত্রে অনেক উন্নত ছিল। সমাজের পক্ষ থেকে এরা প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতেই শুধু সাহায্য করত না, সমাজের আধ্যাত্মিক অভিভাবকের ভূমিকা অর্জন করে নিল এবং এরাই যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাও ব্যাখ্যা করেছিল। শাসন বা জাদু-পুরোহিত এবং জাদুকর সম্প্রদায়ের প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি রূপে তাদের গ্ৰহণ করা যেতে পারে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের বহু প্ৰাচীন রীতি অর্থাৎ সম্পদের প্রতীকরূপে আদিম পশুচারী যুগের সরল পশুবলি প্ৰথাকে। এঁরা নূতন জটিল এক স্তরে পুনরুজ্জীবিত বা পুন:প্রচলিত করলেন এবং অগ্নির উদ্দেশে তার প্রত্যেকটি অঙ্গ অৰ্পণ করে জনগণের কাছে এই অনুষ্ঠানের প্রত্যাশিত ফলগুলি বিবৃত করলেন। এইভাবে কৃষিজীবী যুগে পশুবলি নুতন ভূমিকায় ও নূতন মহিমায় পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হ’ল।
এই প্রাচীন প্ৰথাকে সাহিত্যগত ও আনুষ্ঠানিকভাবে সুসমন্বিত করার প্রক্রিয়ার প্রত্যক্ষ ফসলররূপেই যজুর্বেদ জন্ম নিয়েছিল ; সুষম ও সুস্থির খাদ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা এবং তার ফলস্বরাপ উৎপাদনের স্তরে জনসাধারণের একটি অংশের শ্রমসাধ্য কর্ম থেকে অব্যাহতি লাভের ফলে এটা সম্ভব হয়ে উঠেছিল। উৎপাদন প্রক্রিয়াকে নির্বিয়ে ও উৎপাদন প্রচুর পরিমাণ করে তোলার প্রয়োজনে প্রাগুক্তি সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ কল্পনা করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে এই প্রত্যয়ও সুদৃঢ় হয়েছিল যে, বিধিমত যজ্ঞক্রিয়া সম্পাদন করলে মানুষের সকল প্রচেষ্টা প্ৰকৃতির দাক্ষিণ্য লাভ করবে, দানব শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করবে: না এবং দেবতারা তাদের উপর আশীর্বাদ বর্ষণ করবেন। এইগুলি যেহেতু মৌলিক প্রক্রিয়ারূপে গণ্য হত, পুরোহিত্য-তন্ত্র গৌরবান্বিত হ’ল, পুরোহিতের সংখ্যাবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিততর হল। যজ্ঞানুষ্ঠানগুলি দীর্ঘতর, জটিলতর, ব্যাপকতর ও অগণ্য হয়ে উঠল এবং যজ্ঞের দক্ষিণা বহুগুণে বৃদ্ধি পেল।
নূতন উৎপাদন-ব্যবস্থা ও অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নূতন নূতন জীবিকার আবির্ভাবও আমরা লক্ষ্য করি। বৎসর জ্ঞাপক ‘বর্ষ’ শব্দের মধ্যে স্পষ্টতই বার্ষিক বৃষ্টিপাত বা বর্ষার প্রভাব রয়েছে। নক্ষত্র, রাশি ইত্যাদি সম্বন্ধে নবজাত কৌতুহল সম্ভবত নৌ-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত যেহেতু বিভিন্ন নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়া তৎকালীন নাবিকদের পক্ষে অত্যাবশ্যক ছিল। সরল স্থাপত্যের সঙ্গে চিত্রকল্পের ব্যবহার থেকে বোঝা যায় যে, কৃষিজীবী সমাজের মধ্যে ক্রমে স্থায়ী বাসগৃহ নির্মাণের বিদ্যা বিকশিত হয়েছিল। পরবর্তী যুগের ব্রাহ্মণ সাহিত্যে অতিপাল্পবিত যজ্ঞধর্মের যে বিস্তারিত বর্ণনা আমরা পাই, তারই অব্যবহিত পূৰ্ববতী যজ্ঞপ্রিক্রিয়াগুলি যজুর্বেদে বিবৃত হয়েছে। যজুর্বেদ-সংহিতার শেষ পনেরোটি অধ্যায় (২৬-৪০) পরবর্তীকালে সংযোজিত বলেই নবগঠিত রাজ্যসমূহের প্রশাসক রাজাদের দ্বারা পালনীয় সৌত্রামণী, পুরুষমেধ, সর্বমেধ ও প্রবর্গের মতো যজ্ঞ সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ছাব্বিশ অধ্যায়ের প্রথম ছয়টি মন্ত্র অর্থাৎ : ‘শিবসংকল্প’ সূত্রটি আপন স্বভাব-বৈশিষ্ট্যে উপনিষদের সঙ্গে তুলনীয় এবং এ সংহিতার শেষতম অধ্যায়টিই ঈশোপনিষদ। সুতরাং এই পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে স্পষ্টত নবোদগত ক্ষত্রিয় ও রাজকীয় যজ্ঞানুষ্ঠানের উপযোগী মন্ত্র এবং ঔপনিষদিক বিষয়বস্তু সংযুক্ত করে যজুর্বেদ সংহিতাকে সার্বভৌম রূপ দেওয়ার সচেতন চেষ্টা হয়েছিল। এভাবে যজুর্বেদের মধ্যে যজ্ঞানুষ্ঠানের ক্রমাগত জটিলতা অর্জনের প্রক্রিয়া এমন একটি কালের পরিপ্রেক্ষিতে বিবৃত হয়েছে। যখন উত্তরভারতে সুদূরপ্রসারী সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। প্রাচীন ভারতীয় আর্যের ধর্মভাবনার নিদর্শনরূপে যজুর্বেদের বিরাট ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য ; নিরন্তর বৃদ্ধি, পরিবর্তন ও উন্নতির উপযোগী গতিশীলতার সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত এর মধ্যে রয়েছে ; বিশেষত শেষের কয়েকটি অধ্যায়ের পরবর্তী বৈদিক যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপাদানের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই।