এর পরে যা ঘটল তাকে অসম্ভব বা অলৌকিক বলা যেতে পারে। ঠিক যেন একটা রূপকথা।
ইংগামার স্মেন্ট মারা যাননি, জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, একথা জানিবার পর পুরো পাঁচ ঘন্টা ধরে পুরো এলাকাটা তন্ন-তন্ন করে খুঁজে দেখা হল। নদীর দুধারে প্রতিটি ইঞ্চিও দেখা বাকি রইল না। কিন্তু জীবিত বা মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল না ইংগামার স্মেল্টকে।
এর মধ্যে স্পিডবোটের ডিজেল ফুরিয়ে গিয়েছিল, পুলিশের লঞ্চ থেকে নেওয়া হয়েছিল ডিজেল। ভাড়া করা লঞ্চটাকেও খোঁজার কাজে লাগানো হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।
বেলা দুটোর সময় রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, নাঃ! লেটুস কল ইট এ ডে! আর খুঁজে লাভ নেই!
বিমান বলল, জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেও, এত স্রোত, তাছাড়া এই নদীতে কামঠ আছে। সাহেবের প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। সাহেবের বয়েসও তো হয়েছিল অনেক, তাই না কাকাবাবু?
কাকাবাবু ক্লান্তভাবে বললেন, হ্যাঁ। প্রায় চুয়াত্তর! চলো, তাহলে ফেরা যাক! সাহেব জলে মরতে চেয়েছিলেন, জলেই প্ৰাণ গেছে।
স্পিডবোটটা তখন প্রায় সমুদ্রের মোহনার কাছে। ফেরার জন্য স্পিডবোটের চালক কাশেম এমনই ব্যস্ত হয়ে গেল যে, প্রচণ্ড স্পিড তুলে দিল। আর মোটরের আওয়াজ হতে লাগল। এত জোরে যে, কারুর কোনও কথা বলার উপায় নেই। সবাই নিস্তব্ধ।
কিন্তু রণবীর ভট্টাচার্য বেশিক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। তিনি বুকে পড়ে কাশেমের পিঠে হাত রেখে বললেন, ওহে, একটু আস্তে চালাও! আমাদের মেরে ফেলতে চাও নাকি?
কাশেম মুখ ফিরিয়ে বলল, অ্যাঁ? কী বলছেন স্যার? অ্যাঁ?
একটু আস্তে চালাও!
অ্যাঁ? অ্যাঁ?
তার পরেই কিসে প্ৰচণ্ড এক ধাক্কা লেগে উল্টে গেল স্পিডবোটটা। সবাই ছিটকে পড়ে গেল জলে।
কামঠের ভয়ের চেয়েও সন্তুর বেশি ভয় হল কাকাবাবুর জন্য। কাকাবাবু বলেছিলেন, তিনি সাঁতার কাটতে পারবেন না। সে এদিক-ওদিক চেয়ে কাকাবাবুকে খুঁজতে লাগল।
ওদের মহা সৌভাগ্য এই যে, স্রোতের টান নেই একেবারে। সময়টা জোয়ার আর ভাটার ঠিক মাঝখানে। এই সময়ে জল প্ৰায় স্থির থাকে, কোথাও অবশ্য ঘূর্ণি হয়।
একটা বড় গাছ ভেসে আসছিল, কাশেম অন্যমনস্ক হওয়ায় সেই গাছেই ধাক্কা লেগে উল্টে গেছে স্পিডবোটটা।
একটু দূরে কাকাবাবুর মাথাটা একবার দেখতে পেয়ে সন্তু ড়ুবসাঁতারে কাছে চলে গিয়ে কাকাবাবুকে ধরতে গেল। কাকাবাবু মুখ উঁচু করে বললেন, আমি ঠিক আছি। আমি পেরে যাচ্ছি।
পুলিশের লঞ্চটা কাছেই ছিল। তারা স্পিডবোটটা উল্টে যাওয়া দেখতে পেয়েছে। তারা অমনি আসতে লাগল। এদিকে। লঞ্চের ঢেউয়ে কাকাবাবু আরও সহজে ভেসে যেতে লাগলেন পাড়ের দিকে।
তীর থেকে বোটটা খুব বেশি দূরে ডোবেনি। একটুক্ষণের মধ্যেই সবাই পৌঁছে গিয়ে গাছের শিকড় ধরল।
রণবীর ভট্টাচার্য হেসে বললেন, কেলেংকারি ব্যাপার! আমিই বোধহয় ডোবালাম বোটটাকে, তাই না? আমি যদি কাশেমকে না ডাকতুম—
কাশেম এবারে আর পুলিশের বড়সাহেবকে খাতির করল না। বেশ রাগতভাবে বলল, আপনিই তো স্যার আমায় অন্যমনস্ক করে দিলেন। আমি ঠিকই চালাচ্ছিলুম!
রণবীর ভট্টাচার্য সেইরকম হাসিমুখে বললেন, যাক, এ যাত্রায় অনেক কিছুই তো হল, জলে ডোবাটাই বা বাকি থাকে কেন? সবই হয়ে গেল! আমরা সবাই তো বেঁচে গেছি।
উঠে দাঁড়িয়ে তিনি পুলিশের লঞ্চের উদ্দেশে খুব জোরে চেঁচিয়ে বললেন, আমরা সবাই ঠিক আছি। তোমরা স্পিডবোটটাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করো?
স্পিডবোটটা উল্টো হয়ে ভেসে চলেছে দুলতে দুলতে।
কাশেম কাকাবাবুকে দেখিয়ে বলল, ভাগ্য ভাল, নদীর জলে এখন টান ছিল না। নইলে এই বাবুর খুব অসুবিধে হত।
কাকাবাবু অন্যমনস্কভাবে বললেন, হুঁ!
তারপরই উৎকৰ্ণভাবে বললেন, ওটা কিসের শব্দ? জঙ্গলের মধ্যে তোমরা একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছ?
সবাই একসঙ্গে মনোযোগ দিল। একটা ক্ষীণ আওয়াজ সত্যিই শোনা যাচ্ছে। গাছের পাতায় হাওয়ার শব্দ? তার চেয়ে যেন কিছুটা অন্যরকম। তীক্ষ্ণ শিসের মতন। কিন্তু একটানা আর সুরেলা।
কাশেম বলল, ওটা স্যার সাপের ডাক। মাঝে-মাঝে জঙ্গলে শোনা যায়। গোখরো সাপে ওরকম ডাকে।
কাকাবাবু খাড়া হয়ে বসে বললেন, সাপের ডাক? যতসব গাঁজাখুরি কথা। সাপ কখনও ডাকে নাকি? আমার ক্রাচ দুটো ভেসে গেছে। এখন আমি কী করে যাব?
বিমান বলল, কোথায় যাবেন? এখন?
কাকাবাবু বললেন, ওটা কিসের আওয়াজ দেখতে হবে না? আমার মনে হচ্ছে, রুমানিয়ান বাঁশির আওয়াজ। আমি রুমানিয়ায় গিয়ে এই বাঁশি শুনেছি। দেখতে ছোট হারমোনিকার মতন, কিন্তু ঠিক বাঁশির সুর বেরোয়।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, সুন্দরবনে রুমানিয়ান বাঁশি?
কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সন্তু আর বিমান, আমার দুদিকে দাঁড়া তো। তোদের কাঁধে ভর দিয়ে চল যাই, একটু দেখে আসি।
কাশেম কাকাবাবুর হাত চেপে ধরে ভয়ার্তা গলায় বলল, যাবেন না, বাবু! এ জঙ্গল বড় খারাপ! বাঘ থাকতে পারে। সাপ তো আছেই!
কাকাবাবু শান্ত গলায় বললেন, আমায় যেতেই হবে, কাশেম। তুমি এখানে বসে থাকো।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, চলুন, আমিও যাই। এ-যাত্রায় বাঘ আর সাপটাই বা দেখা বাকি থাকে কেন?
ঘন জঙ্গল ঠেলে খানিকটা যেতেই এক অপরূপ দৃশ্য দেখা গেল। একটা বড় গরান গাছের নীচে শুয়ে আছে। একজন মানুষ। লোকটিকে দেখলে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ মনে হয়। মাথায় ধপধপে সাদা চুল মুখেও ধপধাপে সাদা দাড়ি। তবে লোকটি পরে আছে একটি নীলরঙের প্যান্ট আর একটা ঢোল জামা। আপন মনে একটা মাউথ অগানের মতন জিনিস বাজাচ্ছে।
এত লোকের পায়ের শব্দ শুনে বৃদ্ধ বাজনা থামিয়ে চুপ করে চেয়ে রইলেন। খুব একটা অবাক হলেন না, কোনও কথা বললেন না।
কাকাবাবু হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে কম্পিত গলায় বললেন, আপনি নিশ্চয়ই ইংগামার স্মেল্ট! আপনি আমাদের শ্রদ্ধা গ্ৰহণ করুন। আপনি আমাদের দেশে দস্যুদের হাতে পড়েছিলেন। তবু যে আপনি বেঁচে আছেন, সে আমাদের পরম সৌভাগ্য। আমরা আপনাকে উদ্ধার করতে এসেছি। আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন।
ইংগামার স্মেল্ট খুব ধীরে ধীরে কোমল গলায় বললেন, হে ভারতীয় বন্ধুগণ, আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ। আপনারা এত কষ্ট করে কেন এই গভীর বনে এসেছেন? আমি এখানে বেশ আছি। আমার মেরুদণ্ডে খুব জোর চোট লেগেছে, আমার আর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই।
কাকাবাবু বললেন, আমরা আপনাকে বহন করে নিয়ে যাব।
বৃদ্ধ বললেন, না, না, তার কোনও দরকার নেই। আপনারা মহানুভব, আমার জন্য আপনাদের কোনও কষ্ট করতে হবে না।
এবারে রণবীর ভট্টাচার্য এগিয়ে গিয়ে বললেন, না, আপনার কথা শুনব না। আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে চলুন। আমাদের একটু সেবা করার সুযোগ দিন।
বৃদ্ধ বললেন, তবে আপনারা শুধু আমাকে আমার লঞ্চে ফিরিয়ে দিয়ে আসুন।
বিমান আর রণবীর ভট্টাচার্য দুদিক থেকে ধরে বৃদ্ধকে তুলে দাঁড় করালেন। বৃদ্ধের মুখে একবার মাত্র কষ্টের রেখা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, কী আশ্চর্য কথা এই জঙ্গলে সাপ আছে, বাঘ আছে, অথচ আপনি এখানে ছদিন ধরে শুয়ে আছেন? মিরাকল আর কাকে বলে?
বৃদ্ধ বললেন, আমি একবার বাঘের ডাক শুনেছি। হয়তো আমি অশক্ত, বৃদ্ধ বলে তারা অনুগ্রহ করে আমায় ভক্ষণ করেনি। আপনারা বিশ্বাস করুন, অনেক মানুষ যত হিংস্ৰ হয়, বনের পশুরা তত হিংস্র হয় না কখনও। তারা অনেক সভ্য আর ভদ্র। বৈজ্ঞানিকদের অস্ত্ৰ যত মানুষ মেরেছে, তার চেয়ে কি পশুরা বেশি মানুষ মারতে পারে! আবার আপনাদের মতন মানুষও তো আছে!
এই কথা বলে তিনি দুঃখ-মেশানো মধুর হাসি হেসে সকলের মুখের দিকে তাকালেন।