গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

০৭. অপ্রত্যাশিত উপসংহার

এ কাহিনীর একটু অপ্রত্যাশিত উপসংহার আছে।

ঘনাদার সেদিনকার অন্য সব কীর্তির মোটামুটি কিছুটা ব্যাখ্যা পেলেও পল্টুবাবুর মোটরের ট্যাঙ্কের অতখানি তেল মাত্র দমদম এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেতেই কেমন করে তিনি ফুরিয়ে এলেন, সেই ব্যাপারটা আমাদের কাছে মস্ত একটা ধাঁধা হয়ে ছিল।

আর যাই করুন, ঘনাদা তেলটা কাউকে বিক্রি নিশ্চয়ই করেননি।

তা হলে কি দান-খয়রাত করে এসেছেন?

না, ওরকম উদারতা করে এসে থাকলে সেটার এক কড়া এতক্ষণে পাঁচকাহন হয়ে উঠত নিশ্চয়। ”

তেল খরচের রহস্যটা অমন আশাতীতভাবে আমাদের কাছে ফাঁস হয়ে যাবে তা ভাবিনি।

হল অবশ্য ঘনাদারই চরিত্র মহিমায়।

পঞ্চম গেম-এ কাপভের ভুল চালগুলো কৰ্চনয়ের বদলে ফিশার বা সে নিজে থাকলে কী করত, তাই আমাদের বোঝাচ্ছে শিবু, আর শিশির তার প্রতিবাদে ফিশার থাকলে কাপভের কাছে যে তুলোধোনা হয়ে যেত গলার জোরে তা প্রমাণ করে আমাদের আড্ডাঘর সরগরম করে তুলেছে, এমন সময় ভগ্নদূতের মতো দরজায় বনোয়ারির আবির্ভাব।

হাতে কোনও খাবার-দাবারের খালি প্লেট ছাড়া নিরস্ত্র নিরাভরণ বনোয়ারির আবির্ভাব আমাদের এ ঘরে বড় একটা হয় না।

হলে সংবাদটা কিছু গুরুতর বা চমকপ্রদই হয়ে থাকে।

এবারের সংবাদটা গুরুতর, না শুধু চমকপ্রদ, প্রথম শুনে ঠিক বোঝা গেল না।

বনোয়ারির সংবাদ হল, ড্রাইভারজি আসিছে।

ড্রাইভারজি! আমরা তো অবাক। কে এই ড্রাইভারজি?

সন্দেহ ভঞ্জন হতে দেরি হল না। বনোয়ারির ঘোষণার পরেই দরজায় ড্রাইভারজিকে দেখতে পাওয়া গেল।

প্রথমটা সত্যি চিনতে পারিনি। চেনা একটু শক্তও বটে। ড্রাইভারজিকে আর আমরা কতটুকু দেখেছি? আর যাও বা দেখেছি তা অন্য বেশে-পরিবেশে।

ড্রাইভারজির বেশভূষা এখন আলাদা। ড্রাইভার-মার্কা ধরাচূড়ার বদলে গায়ে পাঞ্জাবি ধরনের কোর্তা, পরনে পাজামা, মাথায় মারাঠি টুপি।

ড্রাইভারজি দরজার ভেতর একটু ঢুকে দাঁড়িয়ে আমাদের সেলাম করে একটু কুণ্ঠিতভাবে রাষ্ট্র প্রাদেশিক মেশানো ভাষায় হেসে জানালে, বড়া বাবুকে সেলাম দেনে আসছি।

ব্যাপারটা যখন প্রায় বুঝে ফেলেছি, ড্রাইভারজির পরের কথায় তখন মাথাটা আবার একটু গুলিয়ে গেল।

আমাদের বোঝবার একটু সুবিধে করে দেবার জন্যে ড্রাইভারজি তার উল্লেখটা একটু বিস্তারিত করলে, যো বড়াবাবুকে ও দিন কোল্যানি লিয়ে গেলাম।

বড়াবাবু যে স্বয়ং ঘনাদা তা বুঝতে তখন আর বাকি নেই, কিন্তু কল্যাণীতে নিয়ে যাবার কথা কী বলছে ড্রাইভারজি?

সে বিভ্রমের চেয়ে একটা শঙ্কিত সন্দেহই গোড়ায় প্রবল হয়ে উঠল।

ঘনাদা নিজেই কবুল করেছেন যে, ড্রাইভারজির কাছে তিনি কিছু ধার নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পল্টুবাবুও নিজেই সে দেনা সম্বন্ধে তাকে ও আমাদের নিশ্চিন্ত হবার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

ঘনাদার সেই ধার শোধের ব্যাপারেই কিছু গলতি হয়ে গেছে নাকি পল্টুবাবুর?

ড্রাইভারজি তারই তাগাদায় এসেছে?

উদ্বিগ্ন হয়ে তাই জিজ্ঞাসা করতে হল আমাদের, বড়াবাবুকে যা দিয়েছিলে তোমার সে টাকা কি–

কথাটা শেষ করা গেল না। ওইটুকু বলা হতেই ড্রাইভারজি লজ্জিতভাবে জিভ কেটে বলল, রাম! রাম! বড়াবাবু সে রুপয়া তো হমার কোম্পানির বাবুর মারফত ভেজে দিয়েছে ওই দিনেই। আর না দিলে ভি ও রুপয়া কাছে! একটু থেমে একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে বললে, কাল রামনবমী, তাই আমি আসিয়েছে।

রামনবমী! তাই এসেছে ড্রাইভারজি! আমরা হতভম্ভ হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।

রামনবমীর নামে আসা মানে বখশিশের আশায় যে আসা নয় তা তো ড্রাইভারজির আগের আলাপেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।

তা হলে?

ড্রাইভারজির পরের কথায় রহস্যটা একসঙ্গে কিছুটা পরিষ্কার ও রীতিমত ঘনীভূত হয়ে উঠল।

কালসে তুলসীদাসজির পূজায় অখণ্ড রামায়ণ পাঠ হোবে কিনা, উস লিয়ে বড়াবাবুকে বোলাতে এসেছি।

মাথায় এবার চরকিপাক লাগা অন্যায় কিছু নয় নিশ্চয়। রামনবমীতে তুলসীদাসের সম্মানে অখণ্ড রামায়ণ পাঠ হবে, তার সঙ্গে ঘনাদার কী সম্বন্ধ?

সম্বন্ধটা ড্রাইভারজির ব্যাখ্যাতেই ভাল করে জানা গেল।

ঘনাদার অনেক আশ্চর্য গুণাগুণ আর ক্ষমতার কথা আমরা জানি, কিন্তু তিনি যে একজন অসামান্য অপরূপ রামায়ণ গায়ক, সারা তুলসীদাসের সপ্তকাণ্ড রামচরিতমানসই যে তাঁর প্রায় মুখস্থ, এই অবিশ্বাস্য খবরটা ড্রাইভারজির কাছেই প্রথম পেলাম। তেল ফুরোবার পর দমদম থেকে প্রায় সমস্ত রাস্তাটাই ভাড়াটে লোক দিয়ে গাড়ি মেস পর্যন্ত ঠেলে আনবার সময় ঘনাদা নাকি তুলসীদাসী রামচরিতমানস-এর শ্লোক গেয়ে শুনিয়েই ড্রাইভারজি আর ঠেলাদারদের পর্যন্ত মুগ্ধ করে রেখেছিলেন। আসন্ন রামনবমী উৎসবে অখণ্ড রামায়ণ পাঠের ভার নিতেও সেদিন তিনি নাকি রাজি হয়েছিলেন।

ড্রাইভারজি তাঁর সেই প্রতিশ্রুতি অনুসারে আজ তাঁকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছে।

সেদিন দায়ে পড়ে ঘনাদা যা করেছেন ও বলেছেন তা যতই অদ্ভুত ও চমকদার হোক আজ তার জের টানতে তিনি উৎসাহী হবেন বলে তো বিশ্বাস হয় না। কী ভাগ্য তিনি এখন তাঁর সরোবর-সভা সান্ধ্য বৈঠকে গেছেন। তাঁকে বাঁচাবার জন্য গৌরই বুদ্ধি করে বলল, সব তো ঠিক ছিল ড্রাইভারজি, কিন্তু বড়ি আফশোস কি বাত যে বিলাইত সে এক সাহাব অচানক আকে উনকো দূর কাঁহা টহলমে লিয়ে গেছে! কব যে লৌটেঙ্গে কুছ ঠিক নহি। তাই তোমাদের অখণ্ড রামায়ণ পাঠ উনি আর এবার করতে পারলেন না।

ড্রাইভারজি একটু হতাশ হয়েই তারপর চলে গেল।

ঘনাদার ভাগ্য ভাল যে, তিনি এ সময়ে যথারীতি তাঁর সরোবরসভায় গিয়েছেন।

তাঁর ভাগ্য ভাল বলব, না আমাদের ভাগ্যটাই মন্দ?

ঘনাদা বাহাত্তর নম্বরে এখন উপস্থিত থাকলে ড্রাইভারজিকে সামলাবার হয়ত আর-একটা কাহিনী শোনার ভাগ্য আমাদের হত!