০৭. অনাহুত আগন্তুক

০৭. অনাহুত আগন্তুক

কন্ট্রোলরুমে আবছা অন্ধকার, সিডিসি ধ্বংস করে দেয়ার পর সিসিয়ানে একটা বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে। মহাকাশযানের জটিল কাজকর্মগুলি দূরে থাকুক, বাতাসের চাপ বা তাপমাত্রা ঠিক রাখার মতো ছোটখাট জিনিসগুলি করতে গিয়ে পর্যন্ত সই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেবার পরেও কিছুতেই মূল দায়িত্বগুলিও পালন করা যাচ্ছে না। কন্ট্রোলরুমে সবাই যখন সিসিয়ানকে মূল কক্ষপথে ধরে রাখার চেষ্টা করছিল, তখন হঠাৎ দরজায় কার ছায়া পড়ে। সুশান আতঙ্কে নীল হয়ে গিয়ে ভাঙা গলায় বলল, কে, কে ওখানে?

ছায়ামূর্তি কোনো কথা না বলে আরো এক পা এগিয়ে আসে। সিসিয়ানে এখন। আলো খুব বেশি নেই, এগিয়ে আসার পরও তার চেহারা ভালো দেখা গেল না। সুশানের মনে হল, ট্রাইটনের বংশধর বুঝি মানুষের আকার নিয়ে চলে এসেছে। ভয়পাওয়া গলায় বলল, কে, কে ওখানে?

ছায়ামূর্তি খসখসে গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে, আমি জিজ্ঞেস করতে পারি, কে ওখানে?

লম্বা ছায়া ফেলে একজন মাঝবয়সী লোক এগিয়ে আসে, পরনে আধময়লা কাপড়, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। লোকটা চোখ পিটপিট করে বলল, আমি কোথায়?

এটি কোন জায়গা?

লু হঠাৎ করে বুঝতে পারে লোকটা কে এবং হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়েছে। ডান হাতে একটা থ্রটল চেপে ধরে গলা উঁচিয়ে বলল, এটি মহাকাশযান সিসিয়ান।

সত্যি যদি এটা একটা মহাকাশযান হয়, তা হলে এটা এত অন্ধকার কেন? এরকম এলোমেলোভাবে ঘুরছে কেন? তাপমাত্রা এত কম কেন? বাতাসের চাপ কি ঠিক করা হবে, নাকি এরকমভাবে রেখে একসময় ফুসফুসটাকে ফাটিয়ে দেওয়া হবে?

কিম জিবান গলা নামিয়ে লুকে জিজ্ঞেস করে, লোকটা কে?

নিশ্চয়ই শীতল-ঘরে ছিল। সিডিসি যাবার আগে জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়ে গেছে, সিডিসি ছাড়া তো আর জীবন্ত কাউকে শীতল রাখা যায় না।

কোথায় যাবার কথা ছিল ভদ্রলোকের?

জানি না, আমাদের জানার কথাও না। সিডিসি জানত।

লোকটি আরো এক পা এগিয়ে এসে রুক্ষ স্বরে বলল, গুজগুজ করে ওখানে কী কথা হচ্ছে? আমাকে কি কেউ কিছু-একটা বলবে?

লু কিম জিবানের হাতে টলটা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যায়। বলছি। আমার নাম লু, আমি এখানকার দলপতি।

এটি কী জিনিস?

এটি একটা মহাকাশযান, আসলে বলা উচিত এটি কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত একটা মহাকাশযান ছিল।

এখন কী হয়েছে?

লু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, একটা খুপরি, একটা ভাঙা ঘর, একটা উপগ্রহ, যা ইচ্ছে হয় বলা যায়।

কেন?-এ অবস্থা হল কেমন করে?

আমাদের মূল কম্পিউটারটি ধ্বংস হয়ে গেছে।

লোকটি অবাক হয়ে বলল, ধ্বংস হয়ে গেছে?

লু একটু ইতস্তত করে বলল, আসলে আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি।

লোকটার খানিকক্ষণ সময় লাগে বিশ্বাস করতে, খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে বলল, ধ্বংস করে ফেলেছ? ইচ্ছে করে?

হ্যাঁ।

কেন?

সেটা অনেক বড় ইতিহাস, এখন শুনে কাজ নেই। তা ছাড়া তুমি নিশ্চয়ই এইমাত্র ফ্রিজিং ক্যাপসুল থেকে উঠে এসেছ, বিশ্রাম নেয়া দরকার। আমাদের মূল কম্পিউটার নেই বলে ঠিক ঠিক সবকিছু করতে পারব না, সবাই কোনো-না-কোনো কাজে ব্যস্ত। আমাদের একজন সময় পেলেই–

লোকটা বাধা দিয়ে বলল, তার আগে শুনি, কেন কম্পিউটারটাকে ধ্বংস করেছ।

লু শান্ত গলায় বলল, শোনার অনেক সময় পাবে, এখন আমার কথা শুনে–

লু, কিম জিবান উচ্চস্বরে ডাকল, তাড়াতাড়ি আস, আর সামলাতে পারছি না।

লু কথার মাঝখানে থেমে প্রায় ছুটে কিম জিবানের পাশে গিয়ে থ্রটলটা চেপে ধরে। সময়ে-অসময়ে সে কম্পিউটারের কাজগুলি নিজে নিজে করার চেষ্টা করত বলে এসব ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা অন্যদের থেকে অনেক বেশি। কখনো সেটা কোনো কাজে আসবে চিন্তা করে নি। লোকটা লুয়ের পিছু পিছু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে, বলবে?

লু মনিটর থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, সত্যি এখনি শুনতে চাও?

হ্যাঁ।

নীষা, তুমি ভদ্রলোককে একটু গুছিয়ে বলবে? আমি খুব ব্যস্ত এখানে।

নীষা নিজেও খুব ব্যস্ত, সিডিসির সাথে সাথে সিসিয়ানের প্রায় চার হাজার কম্পিউটারের সবগুলি অচল হয়ে গিয়েছে, সেগুলি আলাদা আলাদাভাবে কাজ করার জন্যে তৈরি হয় নি। নীষা চেষ্টা করছে সে-রকম একটা দু’টা কম্পিউটারকে চালু করতে, ওদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে তা হলে। একটা কম্পিউটারের অসংখ্য ডাটা লাইনগুলি সাবধানে ধরে রেখে সে লোকটাকে অল্প কথায় ওদের অবস্থাটা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ট্রাইটনের কথা শুনে লোকটি খুব বেশি বিচলিত হল বলে মনে হল না, কিন্তু যেই মুহূর্তে সে সিডিসিকে ধ্বংস করে দেয়ার কথাটি শুনল, সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে নিজের চুল খামচে ধরে বলল, কী বললে তুমি? তোমরা নিজের ইচ্ছায় ২১১২ নম্বরের তৃতীয় মাত্রার একটা কম্পিউটার ধ্বংস করে দিয়েছ? ২১১২ নম্বরের কম্পিউটারের কত বড় ক্ষমতা, তুমি জান? তাও তৃতীয় মাত্রার। পৃথিবীতে ফিরে গেলে তোমাদের নামে খুনের অপরাধ দেয়া হবে, খেয়াল আছে?

তৃতীয় মাত্রার হলে দেয়া হত। আমি যে-কম্পিউটারের কথা বলছি, সেটা তার পরবর্তী পর্যায়ের, সেটি চতুর্থ পর্যায়ের।

লোকটি কোনো কথা বলতে পারে না, খানিকক্ষণ লাগে তার ব্যাপারটা বুঝতে। একটু পরে সে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, কী বললে? চতুর্থ পর্যায়?

হ্যাঁ।

কিন্তু চতুর্থ পর্যায় তো মানুষ থেকে বেশি ক্ষমতা রাখে, এটি একমাত্র কম্পিউটার, যেটাকে মানুষ থেকে বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, নিজেকে বাঁচানোর জন্যে এটার মানুষ খুন করার অনুমতি আছে।

জানি।

তা হলে?

তা হলে কী?

কী ভাবে ধ্বংস করলে সেটাকে?

তোমাকে একবার বলেছি, তুমি শোন নি। আবার বলছি, আমরা এখন একটা মহাবিপদে আছি, পৃথিবীর অস্তিত্ব এর সাথে জড়িত। মূল কম্পিউটার সিডিসি থাকলে ট্রাইটনের আমাদের কারো প্রয়োজন নেই, তাই সিডিসিকে চলে যেতে বলা হয়েছে।

কিন্তু কেন সে গেল, তার যাবার কোনো প্রয়োজন নেই, মানুষ থেকে সে বেশি মূলবান—

কিন্তু পৃথিবী থেকে সে বেশি মূল্যবান নয়। তা ছাড়া সিডিসি আমাদের ভালবাসত, আমাদের বিশ্বাস করত। আমাদের বাঁচানোর জন্যে তার প্রাণ দেয়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

লোকটা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ইস, কী দুঃখের ব্যাপার। চতুর্থ সিরিজের একটা ২১১২। চতুর্থ সিরিজের। আমি কত গল্প শুনেছি, কখনো চোখে দেখি নি।

নীষা একটু অবাক হয়ে লোকটাকে দেখে, চতুর্থ সিরিজের কম্পিউটারকে নিয়ে এরকম উচ্ছাস বিচিত্র নয়, কিন্তু তাই বলে এরকম অবস্থায়? সে জিজ্ঞেস না করে পারল না, তুমি মনে হয় ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছ না। আমরা খুব বিপদের মাঝে আচ্ছি—

তা বুঝেছি, কিন্তু বিপদ তো মানুষের সব সময়েই থাকে। আমার কয়েকটা হিসেব করার ছিল। জিটা নিউট্রিনোর ভরের সাথে সুপারসিমেট্রিক বোজনের একটা হিসেব। ভালো কম্পিউটারের অভাবে করতে পারি নি, এখন যদি সিডিসিকে পেতাম, আহা—সে দশ সেকেন্ডে করে দিতে পারত।

বিস্ময়ে নীষার চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। এরকম পরিবেশে যে অঙ্ক কষার জন্যে একটা কম্পিউটার খুঁজতে পারে, তার মাথাটা কি পুরোপুরি খারাপ নয়? নীষার চোখে চোখ পড়তেই লোকটা হঠাৎ থতমত খেয়ে থেমে গেল, একটু লজ্জা পেয়ে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল, আমি একজন পদার্থবিজ্ঞানী, পঞ্চম বিজ্ঞান সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেখানে জিটা নিউট্রিনোর ভরের উপর একটা সমস্যা ছিল, সেটা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটু আগে যখন ঘুম ভাঙল, হঠাৎ একটা সমাধানের কথা মনে হল। একটা ভালো কম্পিউটার পেলে একবার চেষ্টা করে দেখতাম সমাধানটা বের করা যায় কি না।

আমি খুব দুঃখিত, এখন এখানে ভালো খারাপ কোনো কম্পিউটারই নেই।

তাই তো দেখছি।

লোকটা বিমর্ষ ভঙ্গিতে এক কোনায় গিয়ে বসে। নীষা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম?

লুকাস। ইউরী লুকাস। ইউরী বলে ডাকতে পার।

 

ইউরী কোনো কথা না বলে নিজের মাথা চেপে ধরে চুপচাপ বসে থাকে। এরকম অবস্থায় জিটা নিউট্রিনোর সুপার সিমেট্রিক বোজনের ভর বের করতে না পেরে কারো এত আশাভঙ্গ হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না। লোকটিকে দেখে লুয়ের একটা আশ্চর্য হিংসা হয়, জ্বালা-ধরানো আক্রোশের মতো একটা হিংসা। সেও যদি সবকিছু ভুলে এই লোকটার মতো কোনো একটা জটিল অঙ্কের সমস্যা নিয়ে বসে থাকতে পারত।

ইউরী দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে এক সময় নীয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, এই পুরো গ্রহটা একটা প্রাণী বলে দাবি করছ?

হ্যাঁ।

তার মানে এর আকার অনেক বড়। সম্ভবত এর ক্ষমতাও অনেক বেশি। কিন্তু এটা মানুষ থেকে বেশি উন্নত, সেটা কিভাবে বুঝতে পারলে?

নীষা একটু অবাক হয়ে বলল, পল কুম আমাদের মতো একজন মানুষ, তাকে খুলে সে আবার নূতন করে তৈরি করেছে—

সেটা তো বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রমাণ হল না। বুদ্ধিমান প্রাণী হল পল কুমের অনবরণ করে নূতন কিছু তৈরি করত।

নীষা হঠাৎ করে ইউরীর কথার কোনো উত্তর দিতে পারে না। ইউরী আস্তে আস্তে বলল, একটা ধাটি শিম্পাঞ্জীকে দেখলে একটা মানবশিশু থেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে মানবশিশু শিম্পাঞ্জী থেকে অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে। এখানেও কি এধরনের ব্যাপার হচ্ছে?

লু কিম জিবানের হাতে গ্লুটুলটা ধরিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসে, তুমি ঠিকই ধরেছ, ক্ষমতা বেশি হওয়া মানেই বুদ্ধি বেশি, তা ঠিক নয়। কিন্তু ক্ষমতা যখন এত বেশি হয়ে যায়, যে, আমাদের সেটা অনুভব করার পর্যন্ত শক্তি থাকে না, তখন বুদ্ধি কম না বেশি তাতে আর কিছু আসে-যায় না। আমরা সম্ভবত কোনোদিন ঠিক করে জানতেও পারব না, তার বুদ্ধিমত্তা কোন স্তুরের।

ইউরী ভুরু কুঁচকে বলল, সত্যি?

এখানে যখন এসেছ, দেখবে।

গ্রহটার সাথে যোগাযোগ করেছ?

চেষ্টা করেছিলাম, লাভ হয় নি। আমাদের সাথে তার যোগাযোগ করার কোনো ইচ্ছে নেই। আমরা মোটামুটিভাবে তার হাতের মুঠোয়, কাজেই তার যোগাযোগ করার কোনো প্রয়োজনও নেই।

যোগাযোগ করতে পারলে মন্দ হত না।

কেন?

যদি জিটা নিউট্রিনোর ভরের সমস্যাটা বুঝিয়ে দিতে পারতাম, সমাধানটা হয়তো করে দিতে পারত।

ল খানিকক্ষণ ইউরীর দিকে তাকিয়ে থেকে ফিরে গেল, লোকটার সম্ভবত সত্যি মাথা খারাপ। হয়তো তাকে কোনো একটা পাগলা গারদে পাঠানো হচ্ছিল।

ইউরী লুয়ের পিছনে পিছনে এগিয়ে আসে, জিজ্ঞেস করে, কোনো কি উপায় নেই যোগাযোগ করার?

একেবারে নেই তা হতে পারে না, কিছু-একটা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সিডিসিকে ধ্বংস করে দেয়ার পর এখন আমাদের আর চেষ্টা করার কোনো উপায় নেই।

ও। ইউরী অত্যন্ত বিরস মুখে এক কোনায় বসে থাকে, তার মুখ দেখে মনে হয় একটা ভালো কম্পিউটারের অভাবে তার বেঁচে থাকা পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে গেছে।

 

সিসিয়ানকে মোটামুটি আয়ত্তের মাঝে আনার পর দলের দু’একজন প্রথমবারের মতো একটু বিশ্রাম নেবার সুযোগ পায়। সেই সময় কিম জিবানের চোখে পড়ে, দেয়ালের এক কোনায় একটা লাল বাতি একটু পরে পরে জ্বলছে এবং নিভছে। কাছে গিয়ে সে একটা আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করে। লাল বাতিটির উপরে ছোট ছোট করে লেখা, তোমরা যদি বিপদগ্রস্ত হয়ে থাক, তা হলে এই সুইচটি চেপে ধর।

কিম জিবান সুইচটি চেপে ধরার আগে লুকে ডেকে আনে। লু খানিকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আশ্চর্য ব্যাপার, আমি ভেবেছিলাম, মহাকাশকেন্দ্রে বুঝি সবকিছু শেখানো হয়, এই জিনিসটা আমাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছে। দেখা যাক কী আছে ভিতরে।

লু সুইচটা চেপে ধরতেই একটা চ্যাপ্টা ধরনের বাক্স খুলে গেল। ভিতরে ছোট ছোট করে লেখা, তোমাদের মূল কম্পিউটার ধ্বংস হয়ে গেছে, এটি অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপার, মহাকাশ অভিযানের সুদীর্ঘ ইতিহাসে মাত্র একবার এধরনের একটা ব্যাপার। ঘটেছিল। তোমরা নিশ্চয়ই অত্যন্ত বিপদের মাঝে রয়েছ, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের কোনো ধরনের সাহায্য প্রয়োজন। মূল কম্পিউটার ধ্বংস হয়ে গেছে বলে এই মুহূর্তে তোমাদের পক্ষে যোগাযোগ করা অসম্ভব। এই গোপন বাক্সটিতে যোগাযোগের জন্যে একটি অত্যন্ত প্রাচীন যন্ত্র দেয়া হল। এটি একটি নিউট্রিনো জেনারেটর, কোনোরকম সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি বা অভিজ্ঞ মানুষ ছাড়াই এটি চালু করা সম্ভব। যন্ত্রটির সুইচ টিপে নিউট্রিনোর সংখ্যা বাড়ানো এবং কমানো যায় এবং যন্ত্রটির নলটি যেদিকে মুখ করে রাখবে, নিউট্রিনোগুলি সেদিকে বের হবে। কাজেই তোমাদের দায়িত্ব মহাকাশকেন্দ্রের দিকে নলটি ঘুরিয়ে এটি চালু করা এবং নিউট্রিনোর সংখ্যা বাড়িয়ে কমিয়ে সেখানে কোনো ধরনের সংকেত পৌছানোর ব্যবস্থা করা। সময় নষ্ট না করে এই মুহূর্তেই তোমরা এটি ব্যবহার শুরু করে দাও। মনে রেখো, তোমরা অত্যন্ত বিপদের মাঝে রয়েছ এবং তোমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য শুনা শূন্য তিন কিংবা আরো কম।

বাক্সের নিচে একটা ছেলেমানুষি যন্ত্র। লু খানিকক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিম জিবান উত্তেজিত স্বরে বলল, বেঁচে গেলাম তা হলে আমরা। লু তাড়াতাড়ি চালু কর এই ব্যাটাকে।

নীষা শান্ত স্বরে বলল, এত তাড়াতাড়ি নয়, আগে একটু ভেবে দেখা দরকার। সিডিসি বেঁচে থাকতেই ট্রাইটন আমাদের সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছিল, এখন সিডিসিও নেই। এটা চালু করতেই যদি ট্রাইটন বুঝে ফেলে বন্ধ করে দেয়?

লু মাথা নেড়ে বলল, মনে হয় না এটা ট্রাইটন বুঝতে পারবে, আমি নিউট্রিনো সম্পর্কে খুব বেশি জানি না, কিন্তু যেটুকু জানি তা থেকে এটুকু বলতে পারব, লক্ষ লক্ষ নিউট্রিনো ট্রাইটনের ভিতর দিয়ে চলে যাবে, ট্রাইটন টের পর্যন্ত পাবে না।

ইউরী কখন ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ দেখে নি। তার চাপা হাসি শুনে সবাই ঘুরে তাকাল। লু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কি, আমি ভুল বলেছি?

না। কিছু ভুল বল নি। এটা ধরে নেয়া মোটেও ভুল নয় যে ট্রাইটন তার শক্তির জনো উইক ইন্টারঅ্যাকশান ব্যবহার করে না।

তা হলে হাসছ কেন?

ইউরী আঙুল দিয়ে ছেলেমানুষি যন্ত্রটাকে দেখিয়ে বলল, ওটা দেখে। ওটা দেখে হাসার কী হয়েছে?

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখুন পদার্থবিজ্ঞান ক্লাসে আমার এইরকম একটা যন্ত্র ব্যবহার করে একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়েছিল।

তাতে কী হয়েছে?

এটা একটা ছেলেমানুষি জিনিস, ল্যাবরেটরিতে কমবয়সী ছাত্রেরা এসব দিয়ে কাজ করে, এটার কোনো ব্যবহারিক গুরুত্ব নেই। কেউ–একজন ঠাট্টা করে এটা এখানে রেখেছে।

ইউরী সত্যি বলছে, না ঠাট্টা করছে, তারা বুঝতে পারল না। কিম জিবান একট রেগে বলল, বাজে কথা বলো না, এরকম ব্যাপার নিয়ে কেউ ঠাট্টা করে না।

দেখতেই পাচ্ছ কেউ কেউ করে।

তুমি বলতে চাইছ, এটা কাজ করে না?

না, কাজ করবে না কেন, অবশ্যি করে।

তা হলে?

কাজ করলেই তো হয় না, যেটার যে-কাজ, সেটা তার থেকে বেশি তো করতে পারে না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কত নিউট্রিনো আছে, জান? এই মুহূর্তে তোমার শরীর দিয়ে সেকেন্ডে অন্তত এক বিলিয়ন নিউট্রিনো যাচ্ছে, তুমি টের পাও না, কারণ সেগুলি তোমার শরীরের সাথে কোনোরকম বিক্রিয়া করছে না। এই নিউট্রিনো জেনারেটরটা সেকেন্ডে খুব বেশি হলে মিলিয়নখানেক নিউট্রিনো তৈরি করতে পারে, সেটা কি কয়েক বিলিয়ন মাইল দূর থেকে কেউ ধরতে পারবে? বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে মানি, কিন্তু সব কিছুরই তো একটা মাত্রা আছে।

সুশান একটু সন্দেহ নিয়ে ইউরীর দিকে তাকিয়ে ছিল, ইউরী সেটা লক্ষ করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হল না?

কেউ তার কথার উত্তর দিল না। ইউরী মাথা ঘুরিয়ে একবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি পদার্থবিজ্ঞানের লোক, সারা জীবন আমি নিউট্রিনো নিয়ে কাজ করে এসেছি।

সবাই চুপ করে ইউরীর দিকে তাকিয়ে থাকে, ইউরী একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, তোমরা এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ, যেন দোষটা আমার। আমি তো কিছু করি নি। একটা মিথ্যা আশা নিয়ে থাকা থেকে সত্যি কথাটা জানা কি ভালো নয়?

নীষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারলাম না, এরকম একটা অযৌক্তিক ব্যাপার কেন করা হবে? কেন একটা মহাকাশযানে একটা খেলনা নিউট্রিনো জেনারেটর রাখা হবে?

সেটা আমাকে খুব অবাক করছে না, লু একটু হেসে বলল, মানুষ প্রথম যখন মঙ্গল গ্রহে গিয়েছিল, তারা সাথে কী নিয়ে গিয়েছিল জান?

কী?

রিভলবার। সেটা কখন কোথায় কী ভাবে ব্যবহার করবে কেউ জানত না, তবু নিয়ে গিয়েছিল। কাজেই অযৌক্তিক জিনিস মানুষের কাছে আশা করা এমন কিছু বিচিত্র ব্যাপার নয়। এখানেও হয়তো সেরকম কিছু-একটা হয়েছে। এই নিউট্রিনো জেনারেটরটা হয়তো সেই রিভলবারের মতো কাজ করে, কিন্তু কোনো কাজে আসে না।

সুশান আস্তে আস্তে বলল, মনে হয় একটু মিথ্যে আশা দেয়ার জন্যে এটা রাখা হয়েছে। দেখা গেছে, মানুষকে অল্প একটু আশা দিয়ে অনেক আশ্চর্য কাজ করিয়ে নেয়া যায়।

কিম জিবান শুল্কমুখে বলল, তাহলে আমরা কি এটা ব্যবহার করব না?

ব্যবহার করব না কেন, অবশ্যি ব্যবহার করব, তবে এর থেকে কিছু আশা করব না। নেহায়েত যদি আমাদের ভাগ্য খুব ভালো হয়, খুব কাছে দিয়ে যদি একটা মহাকাশযান যায়, হয়তো আমাদের সংকেত শুনে আমাদের সাহায্য করতে আসবে।

ইউরী হাসি গোপন করার কোনো চেষ্টা না করে বলল, এর থেকে একটা রিভলবার দিয়ে কয়েকবার ফাঁকা আওয়াজ করা ভালো, শব্দ শুনে কারো আসার সম্ভাবনা মনে হয় একটু বেশি হতে পারে।

কথাটি একটি রসিকতা মাত্র, কিন্তু যুক্তিসঙ্গত কারণেই কেউই সেই রসিকতাটুকু উপভোগ করতে পারল না।

খানিকক্ষণ আলোচনা করে নীষাকে এই নিউট্রিনো জেনারেটরটি চালু করার ভার দেয়া হল, সে চারদিকে বিপদগ্রস্ত মহাকাশযানের সংকেত পাঠাতে থাকবে। নিউট্রিনো রশ্মি সেই সংকেত সত্যি সত্যি নিয়ে যাবে বিলিওন বিলিওন মাইল দূরে, কেউ সেটা পাবে কিনা, কে বলতে পারে? ইউরী বলছে পাবে না, বিজ্ঞানের বর্তমান উৎকর্ষতায় পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু কেউ তো পেতেও পারে, আশা করতে তো দোষ নেই, মানুষের আশা যদি না থাকে, তা হলে তারা বেঁচে থাকবে কী নিয়ে?

 

নীষা ধৈর্য ধরে নিউট্রিনো রশ্মি পাঠাতে থাকে, চেষ্টা করছে চারদিকে পাঠাতে, বিশেষ করে যেদিকে মহাকাশকেন্দ্র রয়েছে, সেদিকে। খুব সাবধানে সে ট্রাইটনকে এড়িয়ে চলছিল, যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই অবস্থায় সে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। নীষা এবং অন্য সবাই আশা করেছিল যে, ইউরীর ধারণা সত্যি নয় এবং নিউট্রিনো রশ্মি চালু করা মাত্রই দূর মহাকাশ কেন্দ্র থেকে সাহায্য এসে যাবে। কিন্তু তাদের ধারণা সত্যি নয়, দেখতে দেখতে সময় কেটে যেতে থাকে, কিন্তু কোনো মহাকাশযানই তাদের উদ্ধার করার জন্যে হাজির হয় না। যতই সময় যাচ্ছে ততই তারা বুঝতে পারছে, আসলে ইউরীর কথাই সত্যি, এই নিউট্রিনো জেনারেটরটি একটি খেলনা ছাড়া আর কিছু নয়।

 

লু নিজের ঘরে মাথা চেপে বসে আছে, এখন কী করবে সে? ট্রাইটন তার বংশধরকে সিসিয়ানে পাঠিয়ে দিয়েছে, এখন তাকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাবার কথা। সিসিয়ানে সিভিসি নেই, কাজেই এখন ফিরে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। সিসিয়ানকে চালিয়ে নেবার জন্যে ট্রাইটনের এখন কী পরিকল্পনা, কে জানে? লু চিন্তা করার চেষ্টা করে, সে ট্রাইটন হলে কী করত? প্রথমত, নিশ্চিত করার চেষ্টা করত বাইরের কেউ যেন জানতে না পারে এখানে ট্রাইটনের বংশধর রয়েছে, যাকে এখন পৃথিবীতে নেয়ার কথা। কাজেই চেষ্টা করত সবাইকে মেরে ফেলতে, তার বংশধর খুব সহজেই সেটা করতে পারে, কিন্তু করছে না। কাজেই ধরে নেয়া যায়, ট্রাইটন সেটা চাইছে না। চাওয়ার কথাও নয়, কারণ তাহলে সিসিয়ান ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সিসিয়ানকে এখন পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতে চাইবে, কী ভাবে সেটা সম্ভব? ট্রাইটন এখন তাদের বাধ্য করবে বাইরের কোনো জীবিত প্রাণীর সাথে যোগাযোগ না করে তাদের পৃথিবীতে পাঠানোর। কী ভাবে করবে সে?

এই সময় দরজায় কার জানি ছায়া পড়ে, লু তাকিয়ে দেখে, নীষা ফ্যাকাশে মুখ দাঁড়িয়ে আছে।

 

কি হয়েছে নীষা?

ইউরী–

কী হয়েছে ইউরীর?

আমাকে এসে বলেছে ট্রাইটনে একটা খবর পাঠাতে। আমি রাজি হই নি, তখন কোথা থেকে একটা রিভলবার জোগাড় করে এনে আমার মাথায় ধরেছে।

মাথায়? লু চমকে উঠে বলল, কেন?

বলেছে নিউট্রিনো জেনারেটরটি ট্রাইটনের দিকে মুখ করে ধরতে।

ট্রাইটনের দিকে?

হ্যাঁ।

কেন?

ইউরী ট্রাইটনের কাছে খবর পাঠাতে চায়, ওর নাকি জিটা বোজানের উপরে কী একটা সমস্যা আছে।

লু তার জীবনে কখনোই হঠাৎ করে রেগে ওঠে নি, কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হল, হঠাৎ করে তার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। সে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাড়িয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, কোথায় সেই বদমাশ?

লু।

কি?

ওর কাছে একটা রিভলবার আছে।

রিভলবারের নিকুচি করি আমি—লু ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। সিসিয়ান ছাড়া ছাড়াভাবে দুলছিল, তার মাঝে তাল সামলে লু হেঁটে যেতে থাকে। কোনার ঘরটাতে ইউরী দরজা বন্ধ করে আছে, লু লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে।

ইউরী উবু হয়ে যেন কি করছিল, লুকে দেখে চমকে উঠে দু’হাতে রিভলবারটি চেপে তুলে ধরে, ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলে, সাবধান, গুলি করে দেব।

লু ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা এগিয়ে যায়, উদ্যত রিভলবারটি পুরোপুরি উপেক্ষা করে সে ইউরীর কলার চেপে ধরে বলে, তুমি আমাকে গুলির ভয় দেখাও? কর দেখি গুলি, তোমার কত বড় সাহস।

ইউরী একেবারে হকচকিয়ে যায়, নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু-একটা বলতে চাইছিল, লু তাকে সুযোগ না দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধমকে ওঠে, তুমি ট্রাইটনে খবর পাঠাতে ঢাইছ আমার অনুমতি ছাড়া? তুমি জান এটা একটা মহাকাশযান, আর আমি এই মহাকাশযানের দলপতি? আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে ট্রাইটনে ছুড়ে দিতে পারি? কাউকে আমার কৈফিয়ত পর্যন্ত দিতে হবে না?

ইউরী নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে, রিভলবারটা একপাশে সরিয়ে রেখে বলল, আমি খুব দুঃখিত, তোমরা যে ব্যাপারটা এভাবে নেবে, আমি বুঝতে পারি নি।

বুঝতে পার নি? তুমি একজনের মাথায় রিভলবার ধরে ভয় দেখিয়ে কাজ করিয়ে নেবে আর আমরা সেটা সহজভাবে নেব?

ইউরী দুর্বলভাবে হেসে বলল, রিভলবারে গুলি নেই, তয় দেখানো ছাড়া এটা আর কোনো কাজে আসে না। আমি মেয়েটাকে বললাম, চল, ট্রাইটনে একটা খবর পাঠানোর চেষ্টা করে দেখি, মেয়েটা রাজি হল না—

তাই তুমি তার মাথায় রিভলবার চেপে ধরলে?

বলেছি তো গুলি নেই, একটু ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিলাম। কী করব বল, এমনিতে রাজি না হলে আমি কী করব?

তোমার ট্রাইটনের সাথে যোগাযোগ করার এত কী প্রয়োজন?

এই নিউট্রিনো জেনারেটর দিয়ে তোমরা দূরে কোথাও যোগাযোগ করতে পারবে, একমাত্র যোগাযোগের চেষ্টা করতে পার ট্রাইটনের সাথে, সে কাছে আছে, মাত্র হাজার কিলোমিটার। তার সাথে যোগাযোগ করতে কোনো ক্ষতি তো নেই। যদি সত্যি বুদ্ধিমান প্রাণী হয়, মুখোমুখি কথা বলতে ক্ষতি কী, হয়তো তাকে কিছু একটা বোঝাতে পারব।

পেরেছ?

না। তাকে বলেছি সে যদি আমাদের সংকেত বুঝতে পারে তা হলে যেন বড় লাল বৃত্তটি আস্তে আস্তে ছোট করে ফেলে।

করেছে?

না, করে নি।

ও। লু কি বলবে বুঝতে পারে না, খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, ইউরী তাকে ডাকল, লু।

কি হল।

আমি কি ট্রাইটনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে পারি?

লু একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার ইচ্ছে।

করিডোর ধরে হেঁটে যেতে যেতে লু দেখল, নীষা একটা গোল জানালার পাশে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। লুকে দেখে আস্তে আস্তে বলল, ট্রাইটনকে দেখেছ?

কী হয়েছে?

বড় লাল বৃত্তটি কেন জানি আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে।