০৭. অগ্রবর্তী গাড়িটা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে

অগ্রবর্তী গাড়িটা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। হাত পনেরো-কুড়ির ব্যবধানে ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে সুব্রতও ট্যাক্সি থেকে নামল।

ইধার ঠারিয়ে, আভি হাম আতে হে—

সুব্রত ইতিমধ্যে ড্রাইভারকে বলেছিল সে পুলিসের একজন অফিসার।

ড্রাইভার সুব্রতর প্রস্তাবে কোন আপত্তি জানায় না।

দূর থেকেই দেখতে পেল সুব্রত-বাড়ির দরজা খুলে গেল, একজন সুটপরা লোক কিরীটীকে ভিতরে ডেকে নিল, দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। গাড়িটা পিছনের দিকে চলে গেল।

সুব্রত আবার এগিয়ে যায়। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় কিন্তু দরজার গায়ে ঠেলা দিয়ে বুঝতে পারে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

যেমন করে হোক সুব্রতকে বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই হবে কিন্তু কেমন করে ঢুকবে বুঝতে পারে না। বাড়িটার চারপাশে একবার ঘুরে দেখা যাক—অন্য কোন প্রবেশপথ পাওয়া যায় কিনা। সুব্রত বাড়ির পিছনদিকে এগুলো।

বাড়িটা বোধ হয় মাত্র কিছুদিন হলো শেষ হয়েছে। চারিদিকে এখনো রাবিশ, ভাঙা ইটের টুকরো, লোহার রড, স্টোন-চিপস ছড়ানো। অন্ধকার রাত, ভাল কিছু দেখাও যায় না।

সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে এগোয় সুব্রত।

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।

হাত-দশেক দূরে সেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে—খোলা একটা দরজা-পথে বাইরে আলো এসে পড়ছে খানিকটা।

গাড়ির সামনে বোধ হয় ড্রাইভারটা দাঁড়িয়ে। কি এখন করা যায় ভাবছে সুব্রত, এমন সময় হঠাৎ ওর নজরে পড়লো দুজন লোক দুপাশ থেকে একজন সুট পরিহিত

ভদ্রলোককে ধরে গাড়ির সামনে নিয়ে এলো।

লোকটি মনে হয় ঠিক সুস্থ নয়, কেমন যেন টলছে!

পাশেই গ্যারেজ-মত একটা ঘর-সুব্রত এগিয়ে গেল—নিঃশব্দে গ্যারেজের পিছনে।

ড্রাইভার ও অন্য দুজন তোক সেই লোকটিকে গাড়ির মধ্যে তুলতে ব্যস্ত—এই সুযোগে সুব্রত চকিতে এগিয়ে গিয়ে খোলা দরজা-পথে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। সামনে সরু একটা প্যাসেজ-মত—তারপরই পাশাপাশি দুটো ঘর—দুটো ঘরের দরজাই বন্ধ।

আরো একটু এগিয়ে দোতলায় উঠবার সিঁড়িটা ওর নজরে পড়ল। সিঁড়ির নীচে। জমাট অন্ধকার।

কাদের যেন পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

ওরা হয়ত ফিরে এলো। সুব্রত চট করে সিঁড়ির নীচে আত্মগোপন করল। দুজনের পায়ের শব্দ।

সুব্রত বুঝতে পারে কাজ শেষ করে ওরা ফিরে এলো। ক্রমে পায়ের শব্দ সরু। প্যাসেজের অন্য প্রান্তে মিলিয়ে গেল।

শব্দ মিলিয়ে যাবার পরও মিনিট পাঁচ-সাত সুব্রত সিঁড়ির নীচে অন্ধকারের মধ্যে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কোনদিকে কোন আর শব্দ নেই।

সুব্রত সিঁড়ির নীচ থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে উপরে উঠে যায়। শেষ। ধাপে সবে পা ফেলেছে নজরে পড়ল ওর, একটা ঘরের ভেজানো দ্বারপথে ঈষৎ আলোর আভাস।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে সুব্রত এগিয়ে যায়।

কিরীটীর গলা ওর কানে আসে—আপনাদের অফারটাই শুনি।

কে যেন বললে, দশ হাজার—

কিরীটীর জবাব—মাত্র!

সুব্রতর বুঝতে আর বাকী থাকে না, কিরীটী শত্রুর ফাঁদে পা দিয়েছে।

দরজার গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়ায় সুব্রত–প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ললাডেড পিস্তলটার ট্রিগারটা চেপে ধরে। ভাগ্যে সে পিস্তলটা সঙ্গে এনেছিল!!

কিরীটীর গলার স্বরটা কানে আসে, নট ব্যাড়, কিন্তু এই ঠাণ্ডায় কাশ্মীরে, অন্য কোথাও গেলে হতো না ম্যাডাম?

রঞ্জিৎ কাপুরের গলার স্বর, শুনুন মিঃ রায়, আপনার সঙ্গে জোক করবার মত প্রচুর সময় আমাদের হাতে নেই। আমরা আমাদের অফার আপনাকে দিয়েছি—নাউ ইউ ডিসাইড

দড়াম করে ঘরের ভেজানো দরজাটা খুলে গেল।

চকিতে সেই শব্দে রঞ্জিৎ কাপুর, সেই ভদ্রমহিলা ও কিরীটী ফিরে তাকাল দরজার দিকে।

দরজার উপরে দাঁড়িয়ে সুব্রত—হাতে ধরা তার পিস্তল।

ডোন্ট ট্রাই টু মুভ মিঃ কাপুর—এটার ছটা চেম্বারই ভর্তি!

ঘটনার আকস্মিকতায় সেই মহিলা ও রঞ্জিৎ কাপুর দুজনাই বিমূঢ় বিহুল—বোবা যেন।

কিরীটী ওদের বডি সার্চ করে দেখ, কোন আগ্নেয়াস্ত্র আছে কিনা।

রঞ্জিৎ কাপুরের পকেটে পিস্তল পাওয়া গেল।

আগে সুব্রত বের হয়ে এলো, পশ্চাতে কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে চকিতে ঘরের দরজা বাইরে থেকে টেনে লক করে দেয়—ইয়েল লক সিস্টেম, চাবিটা পকেটে ফেলে দেয় দরজা থেকে খুলে।

তারপর দুজনে ছুটে নীচে এসে ট্যাক্সিতে চেপে বসতে পাঁচ মিনিটও লাগালো না।

 

রায়সিনহা রোডে যখন ওরা ফিরে এলো রাত তখন পৌনে এগারোটা।

দেবেশকে বাইরের ঘরেই পাওয়া গেল।

একটা সোফার উপরে সে শুয়ে-পাশে একজন ডাক্তার। রামলালও সেখানে। উপস্থিত।

আপনারা? ডাক্তার প্রশ্ন করেন।

রামলাল বলে, সাহেবের দোস্ত—

আই সী!

কি ব্যাপার, ডাক্তার?

মিঃ দাশকে কোন ঔষধ খাওয়ানো হয়েছিল বা ইনজেক্ট করা হয়েছিল রামলালের টেলিফোন পেয়ে যখন এলাম দেখি হি ওয়াজ ইন এ সেমিকনসাস স্টেজ। পা খুব ফিবল।

এখন কেমন আছেন?

এখন অনেকটা ভাল—আপাতত এখানেই থাকুন, আরো কিছুক্ষণ পরে নিয়ে গিয়ে বেডরুমে শুইয়ে দেবেন। আর এক কাপ গরম দুধ দেবেন।

 

পরের দিন দেবেশের মুখ থেকেই ওরা সব শুনলোলা।

অফিস থেকে সোয়া পাঁচটা নাগাদ সে বেরুতে যাবে, এমন সময় মিনিস্টারের জরুরী ফোন আসে তার বাড়ি থেকে।

তারপর?

বাইরে থেকে দেখি আমার গাড়িটা নেই। কি করি, জরুরী কল, তাড়াতাড়ি একটা ট্যাক্সি ঐ দিকে আসতে দেখি, আসতে দেখে তাতেই উঠে বসি।

অ্যান্ড ইউ অয়ার ইন দি ট্র্যাপ দেবেশ, কিরীটী বললে।

একজাক্টলি! ট্যাক্সিতে উঠতেই একজন অ্যাট দি পয়েন্ট অফ এ গান আমাকে চুপচাপ থাকতে বলে। এবং আমাকে নিয়ে একটা বাড়িতে গিয়ে তোলে। সেখানে আবার দুজন লোক ছিল, তারা অ্যাট দি পয়েন্ট অফ এ গান আমাকে দিয়ে তোকে ফোন করায়। কিন্তু তুই গেলে যে সেখানে বিপদে পড়বি, কথাটা বলতে পারলাম না বুঝতেই পারছিস আমার তখন কি অবস্থা! তুই গিয়েছিলি নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ। ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথাবার্তাও হয়েছে।

ভদ্রমহিলা!

হ্যাঁ, ম্যাডাম–

তারপর?

তারপর আর কি মোটা টাকার অফার—

বলিস কি?

ডকুমেন্টটা যে রীতিমত মূল্যবান ছিল, সেটা ভুলে যাস কেন? পঁচিশ পর্যন্ত উঠেছিল, হয়ত পঞ্চাশেও রাজী হতো–তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি।

কি?

ডকুমেন্টটার রুপ্রিন্টটা এখনো পাচার করতে পারেনি ওরা ভারতবর্ষ থেকে।

কি করে বুঝলি?

নচেৎ অত টাকা কি অফার করে, না আমাকেই ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে?

কিরীটী?

কি?

আমার একটা কথা শুনবি?

কি কথা!

এ কেসটা ছেড়ে দে।

পাগল নাকি!

ওসব গ্যাঙ বড় সাংঘাতিক।

হতে পারে, তবে ওরাও জানে কিরীটীকে। ভয় নেই বন্ধু, চল্ আজ একবার তোর গাড়ি নিয়ে গতরাত্রের পাড়াটা ঘুরে আসি।