৭৯তম অধ্যায়
পুরোহিতের পরিচয়–তপস্যার গৌরব
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ঋত্বিক্গণের কিরূপ স্বভাব হওয়া উচিত এবং উঁহাদের কর্ত্তব্যই বা কি?”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! বেদ ও মীমাংসাশাস্ত্র অবগত হইয়া মৈত্ৰাদিদ্বারা চিত্তপ্রসাদন [হৃদয়ের প্রসন্নতা] ও অতিশয় অভিনিবেশ[মনোযোগ]পূর্ব্বক কার্য্যানুষ্ঠান করাই ঋত্বিক্গণের কৰ্ত্তব্য। তাঁহারা নিরন্তর রাজার প্রতি অনুরক্ত, বীরগণের প্রিয়বাদী, পক্ষপাতনিরপেক্ষ, অনৃশংস ও সত্যপরায়ণ হইবেন। কুশীদদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ করিবেন না। যে ক্ষত্রিয় অভিমানশূন্য বুদ্ধিমান, সত্যবাদী, শান্তপ্রকৃতি, অহিংস্রক, কামদেষবিরহিত, শাস্ত্রজ্ঞ, সদ্বংশপ্রসূত, সচ্চরিত্র এবং ক্ষমা ও ইন্দ্রিয়দমন প্রভৃতি গুণসম্পন্ন, তিনি ইহলোকে সম্মান ও পরলোকে ব্রহ্মলোকলাভ করিয়া থাকেন।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! বেদে যে পরিমাণে দক্ষিণাদান করিবার বিধি আছে, প্রায় কেহই ত’ তাহার অনুবর্ত্তী হয় না; শাস্ত্রের শাসনও লোকের সামর্থসাপেক্ষ নহে। আর বেদে ইহাও নির্দিষ্ট আছে যে, শ্রদ্ধাবান ব্যক্তিরই যজ্ঞানুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য; কিন্তু শ্রদ্ধাসহকারে মিথ্যাচারপরিপূর্ণ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলে তাহাতে কি ফল দর্শিতে পারে?”
ভীষ্ম কহিলেন, “যুধিষ্ঠির! লোক যে বেদবিধিলঙ্ঘন, শঠতাবলম্বন ও মায়াজালবিস্তারপূর্ব্বক মহত্ত্বলাভে অধিকারী হয়, ইহা কদাপি বিবেচনা করিও না। দক্ষিণা যজ্ঞের অঙ্গস্বরূপ ও বেদের গৌরববৃদ্ধিকর। দক্ষিণাশূন্য যজ্ঞ কদাচ মনুষ্যের উদ্ধারসাধনে সমর্থ নহে। অক্ষম ব্যক্তির পক্ষে যজ্ঞে পূর্ণপাত্ৰদান কি অন্যান্য দক্ষিণাদানের তুল্য নহে? বৰ্ণত্রয়ের যথাবিধানে যজ্ঞানুষ্ঠান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। বেদে নির্দিষ্ট আছে যে, সোমরস ব্রাহ্মণের ভূপতিস্বরূপ; অতএব জীবিকানির্ব্বাহাৰ্থ সোমরস বিক্রয় করা নিতান্ত অকর্ত্তব্য। কিন্তু উহা বিক্রয় করিয়া যে ধনলাভ হয়, তারা যজ্ঞানুষ্ঠান করিলে উহা নিন্দনীয় হয় না। পুরুষের ন্যায়পরায়ণ হওয়া এবং ন্যায়ানুসারে যজ্ঞানুষ্ঠান ও সোমরস প্রস্তুত করা অবশ্য কর্ত্তব্য। পুরুষ ন্যায়পরায়ণ না হইলে কি আপনার, কি পরের কাহারই হিতানুষ্ঠানে সমর্থ হয় না। ব্রাহ্মণ অতিকষ্টে আপনার জীবিকানির্ব্বাহপূর্ব্বক ধন উদ্বৃত্ত করিয়া তদ্বারা যে যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, তাহা শুভজনক নহে। বেদবিধানানুসারে তপস্যা যজ্ঞ হইতেও শ্রেষ্ঠ। এক্ষণে সেই তপস্যার বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। অহিংসা, সত্য, অনৃশংসতা ও দয়াই যথার্থ তপস্যা। কেবল শরীরপোষণ করিলেই তপস্যা করা হয় না। দেবগণের অস্তিত্বে অবিশ্বাস, শাস্ত্র-উল্লঙ্ঘন ও উজ্জ্বল-ব্যবহার আত্মবিনাশের নিদান সন্দেহ নাই; যে মহাত্মারা তপস্যারূপ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, তাঁহাদের যোগই স্রুক, চিত্তই আজ্য এবং জ্ঞানই পবিত্রস্বরূপ হয়। শঠতা মৃত্যুলাভের ও সরলতা ব্ৰহ্মপদপ্রাপ্তির প্রধান কারণ।”