৭৯তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের প্রতিজ্ঞারক্ষার্থ শ্রীকৃষ্ণের উপাবিধান
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! তখন বাসুদেব ধনঞ্জয়ের অপ্রতিম ভবনে প্রবিষ্ট হইয়া উদকস্পর্শপূর্ব্বক সুলক্ষণসম্পন্ন স্থণ্ডিলে বৈদুর্য্যসন্নিভ কুশ সমূহে প্রস্তুত মঙ্গল শয্যা বিস্তৃত করিয়া সমুচিত বিধান অনুসারে মঙ্গল মাল্য, লাজ ও গন্ধ দ্বারা অলঙ্কৃত এবং উত্তম উত্তম আয়ুধে পরিবৃত করিলেন। অনন্তর পরিচারকগণ বিনীত ভাবে রাত্রি কর্ত্তব্য ও ত্রৈয়ম্বক বলি সম্পাদন করিল। তখন ধনঞ্জয় উদকস্পর্শ করিয়া প্রীতিচিত্তে গন্ধ মাল্য দ্বারা বাসুদেবকে অলঙ্কৃত করিয়া রাত্রির সমুচিত উপহার প্রদান করিলেন। বাসুদেৰ ঈষৎ হাস্য করত অর্জ্জুনকে কহিলেন, অর্জ্জু! তোমার কল্যাণ হউক; তুমি শয়ন কর; আমি চলিলাম।
অর্জ্জুনের প্রিয়ঙ্কর ভগবান বিষ্ণু তাঁহাকে এই কথা বলিয়া দ্বারদেশে গৃহীতাস্ত্র রক্ষকগণকে নিযুক্ত করিয়া দারুকসমভিব্যাহারে স্বীয় শিবিরে প্রবিষ্ট হইলেন এবং ভূরি ভূরি কর্ত্তব্য চিন্তা করত শুভ্র শয্যায় শয়ন করিয়া পার্থের হিতের নিমিত্ত যোগাবলম্বন পূর্ব্বক তেজোদ্যুতিবিবর্দ্ধন শোক দুঃখাপহ উপায়বিধান করিতে লাগিলেন।
হে মহারাজ! সেই রাত্রিতে পাণ্ডবগণের শিবিরে কেহই নিদ্রিত হন নাই; সকলেই জাগরিত থাকিয়া এই চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, মহাত্মা গাণ্ডীবধন্বা পুত্রশোকে সন্তাপিত হইয়া সহসা সিন্ধুরাজকে বধ করিবার যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন; তাহা কি প্রকারে সফল করিবেন। তিনি অতি দুষ্কর বিষয়ে অধ্যবসায় করিয়াছেন। রাজা জয়দ্রথ সামান্য বীর নন। বিশেষত দুর্য্যোধন তাঁহাকে অসংখ্য সৈন্য ও মহাবল পরাক্রান্ত স্বীয় ভ্রাতৃগণকে প্রদান করিয়াছেন। যাহা হউক, এক্ষণে মহাত্মা অর্জ্জুন পুত্রশোকাধিকাতর হইয়া যে দুস্তর প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, সিন্ধুরাজ ও অন্যান্য অরাতিগণকে সংহার পূর্ব্বক তাহা হইতে উত্তীর্ণ হইয়া পুনরাগমন করুন। তিনি যদি কালি জয়দ্রথকে সংহার করিতে না পারেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই হুতাশনে প্রবিষ্ট হইবেন; কদাচ আপনার প্রতিজ্ঞা মিথ্যা করিতে পারিবেন না। মহারাজ যুধিষ্ঠির জয়ের নিমিত্ত অর্জ্জুনের উপর নির্ভর করিয়া আছেন; যদি ধনঞ্জয় প্রাণ পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে তাঁহার কি অবস্থা হইবে। যদি আমরা কোন সৎকর্মের অনুষ্ঠান বা অগ্নিতে আহুতি প্রদান করিয়া থাকি, তাহা হইলে সেই সকলের ফলে সব্যসাচী অরাতিগণকে পরাজয় করুন। পাণ্ডবপক্ষীয়গণ এইরূপ জয় বিষয়ক কথোপকথনে অতি কষ্টে সেই রজনী অতিবাহিত করিল।
এ দিকে মহাত্মা বাসুদেব সেই রজনী মধ্যেই জাগরিত হইয়া পার্থের প্রতিজ্ঞা স্মরণ পূর্ব্বক দারুককে কহিলেন, দারুক! অর্জ্জুন পুত্র বিয়োগে কাতর হইয়া, ‘কালি জয়দ্রথকে সংহার করিব’ বলিয়া, প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন। দুর্য্যোধন পার্থের প্রতিজ্ঞা শ্রবণে যাহাতে জয়দ্রথ নিহত না হয়, মন্ত্রিগণের সহিত তদ্বিষয়িণী মন্ত্রণা করিবে। দুৰ্য্যোধনের সেই অনেক অক্ষৌহিণী সেনা ও সৰ্বাস্ত্রবেত্তা সপুত্র দ্রোণাচার্য্য জয়দ্রথের রক্ষায় নিযুক্ত হইবেন। দ্রোণাচার্য্য যাহাকে রক্ষা করেন, দৈত্য ও দানবগণের দর্পহারী অদ্বিতীয় বীর ইন্দ্রও তাঁহাকে বিনাশ করিতে সমর্থ নন; কিন্তু ধনঞ্জয় যাহাতে সূর্যাস্তের পূর্ব্বে জয়দ্রথকে সংহার করিতে পারেন, আমি অবশ্যই কালি তাহার উপায় করিব। কি দারা, কি মিত্র, কি জ্ঞাতি, কি বান্ধবগণ, অর্জ্জুন অপেক্ষা কেহই আমার প্রিয়তর নয়। আমি মুহূৰ্ত্ত মাত্রও অর্জ্জুন শূন্য পৃথিবী অবলোকন করিতে সমর্থ হইব না। ফলত ধনঞ্জয় অবশ্যই কালি সংগ্রামে জয় লাভ করিবেন। আমি স্বয়ং অর্জ্জুনের হিতার্থে অসংখ্য নাগাশ্বসমবেত বীরগণকে, কর্ণ ও দুর্য্যোধনের সহিত পরাজয় ও সংহার করিব। ত্রিলোকের লোক কালি মহাযুদ্ধে আমার বল বিক্রম নিরীক্ষণ করুক। কালি সহস্র সহস্র ভূপাল, শত শত রাজপুত্র এবং অসংখ্য অশ্ব, হস্তী ও রথ সংগ্রাম হইতে পলায়ন করিবে। আমি তোমার সমক্ষে পাণ্ডবগণের হিতার্থে ক্রুদ্ধ হইয়া সেই সমস্ত কৌরব সৈন্যচক্র দ্বারা প্রমথিত ও নিপাতিত করিব। কালি দেব, গন্ধৰ্ব্ব, পিশাচ, উরগ ও রাক্ষসগণ প্রভৃতি সকলেই অবগত হইবেন যে, আমি সব্যসাচীর কি রূপ সুহৃৎ। যে ব্যক্তি অর্জ্জুনের দ্বেষ করে, সে আমার দ্বেষ্টা এবং যে ব্যক্তি অর্জ্জুনের বশী ভূত হয়, সে আমারও বশীভূত। ফলত তুমি অর্জ্জুনকে আমার শরীরার্দ্ধ বলিয়া স্থির করিয়া রাখ।
হে দারুক! এই রাত্রি প্রভাত হইলে তোমাকে পূর্ব্বের ন্যায় আমার উৎকৃষ্ট রথ সুসজ্জিত করিয়া আমার সমভিব্যাহারে লইয়া গমন করিতে হইবে। তুমি রথ মধ্যে ছত্র, দিব্য কৌমোদকী গদা, শক্তি, চক্র, ধনু, শর প্রভৃতি সর্ব্ব প্রকার উপকরণ সংস্থাপিত এবং রথোপস্থে রথশোভী, বীৰ্য্যশালী গরুড়ের ধ্বজস্থান পরিকল্পিত করিয়া সূৰ্য্যাগ্নিসদৃশ প্রভাসম্পন্ন বিশ্বকর্ম্মবিরচিত দিব্য কাঞ্চন জালে বিভূষিত বলাহক, মেঘপুষ্প, শৈব্য ও সুগ্রীব এই চারি অশ্ব রথে সংযোজনপূর্ব্বক স্বয়ং কবচধারী হইয়া অবস্থান করিও। ঋষভ রাগ পরিপূরিত পাঞ্চজন্য শঙ্খের ভৈরব রব শ্রবণ মাত্র সত্বরে আমার নিকট আগমন করিবে। আমি এক দিনেই পৈতৃস্বস্রেয়ের ক্রোধ ও দুঃখ সমুদায় দূরীকৃত করিব। ধনঞ্জয় যাহাতে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের সমক্ষে জয়দ্রথকে বধ করিতে পারেন, আমি সৰ্ব্বপ্রকার উপায় অবলম্বন পূর্ব্বক তদ্বিষয়ে যত্নবান্ হইব। হে সারথে! আমি কহিতেছি, ধনঞ্জয় যে যে ব্যক্তিকে সংহার করিতে যত্ন করিবেন, সেই সেই ব্যক্তিকেই মৃত্যু মুখে নিপতিত হইতে হইবে।
দারুক কহিলেন, হে পুরুষোতম! আপনি যাঁহার সারথ্য গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহার অবশ্যই জয় লাভ হইবে, কখনই পরাজয়ের সম্ভাবনা নাই। এক্ষণে আপনি যে প্রকার আজ্ঞা করিতেছেন, আমি তাহাই করিব। আজি অর্জ্জুনের জয় লাভের নিমিত্তই বিভাবরী সুপ্রভাত হইল।