যুধিষ্ঠির যুবরাজ, সুখী সর্ব্বজন।
স্থানে স্থানে বিচার করয়ে প্রজাগণ।।
ধর্ম্মশীল যুধিষ্ঠির দয়ার সাগর।
পুত্রভাবে দেখে প্রজা অমাত্য কিঙ্কর।।
যুধিষ্ঠির রাজা হৈলে সবে থাকি সুখে।
রাজার নন্দন, রাজ্য সম্ভবে তাহাকে।।
ভীষ্ম রাজা না হলেন সত্যের কারণ।
ধৃতরাষ্ট্র না হইল অন্ধ দ্বিনয়ন।।
পূর্ব্বেতে ছিলেন রাজা পাণ্ডু মহাশয়।
বিধি এই আছে, রাজপুত্র রাজা হয়।।
বিশেষ রাজার যোগ্যপাত্র যুধিষ্ঠির।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় সুবুদ্ধি গভীর।।
চলহ যাইব প্রজা আছি যে যতেক।
যুধিষ্ঠিরে রাজা কর করি অভিষেক।।
হাট বাট নগরে চত্বরে এই কথা।
দুর্য্যোধন শুনিয়া পাইল বড় ব্যথা।।
বিরস-বদনে গেল রাজার গোচর।
দেখিল, জনক বসি আছে একেশ্বর।।
সকরুণে পিতারে বলয়ে দুর্য্যোধন।
অবধানে শুন যাহা, কহে প্রজাগণ।।
নগরে শুনিনু আমি আশ্চর্য্য বচন।
অবধান কর রাজা করি নিবেদেন।।
অবজ্ঞায় অনাদর করিল তোমারে।
রাজা ইচ্ছা করে সবে কুন্তীর কুমারে।।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ সেই রাজযোগ্য নয়।
যুধিষ্ঠিরে রাজা কর, সে রাজ-তনয়।।
এইমত বিচার করয়ে সর্ব্বজন।
রাজপুত্র যুধিষ্ঠির হইবে রাজন।।
তাহার নন্দন হৈলে হবে সেই রাজা।
আমা সবাকারে আর না গণিবে প্রজা।।
বৃথাই জীবন ধরি, বৃথা জন্ম মোর।
বৃথা বহন করি এ হেয় কলেবর।।
এ ছার জীবনে আর নাহি প্রয়োজন।
নিশ্চয় মরিব আমি তব বিদ্যমান।।
অকারণে জন্মে যেই পর-ভাগ্যজীবী।
অকারণে আমারে ধরিল এ পৃথিবী।।
পুত্রের শুনিয়া রাজা এতেক বচন।
হৃদয়ে বাজিল শেল চিন্তিত রাজন।।
কি করিব, কি হইবে, চিন্তে মনে মন।
হেনকালে আসে তথা দুষ্ট মন্ত্রিগণ।।
দুঃশাসন কর্ণ আর শকুনি দুর্ম্মতি।
বিচারিয়া কহে কথা অন্ধরাজ প্রতি।।
পাণ্ডবের ভয় রাজা তবে দূর হয়।
বাহির করিয়া দেহ করিয়া উপায়।।
ক্ষণেক চিন্তিয়া বলে অম্বিকা-নন্দন।
কিমতে বাহির করি পাণ্ডুপুত্রগণ।।
যখন আছিল পাণ্ডু পৃথিবীতে রাজা।
সেবকের প্রায় মম করিত সে পূজা।।
নাম মাত্র রাজা সেই আমি দিলে খায়।
নিরবধি সমর্পয়ে যথা যাহা পায়।।
মম আজ্ঞাবর্ত্তী হৈয়া ছিল অনুক্ষণ।
ভাই হয়ে কারো ভাই না হয় এমন।।
তাহার অধিক হয় তার পুত্রগণ।
আজ্ঞাবর্ত্তী হৈয়া মম থাকে অনুক্ষণ।।
দেবপ্রায় আমারে সে সেবে যুধিষ্ঠির।
কোন্ দোষ দিয়া তারে করিব বাহির।।
অবিচার করি যদি আমি তার সনে।
অবশ্য ফলিবে মোরে, শুন মন্ত্রিগণে।।
অহিংসক জনেরে হিংসয়ে যেই জন।
অবশ্য তাহার হয় নরকে পতন।।
হিংসা সম পাপ নাহি জান সর্ব্বজন।
দয়া বিনা ধর্ম্ম নাহি এ তিন ভুবন।।
বিশেষে বলিষ্ঠ হয় পঞ্চ সহোদর।
তার অনুগত যত আছয়ে কিঙ্কর।।
পিতৃ পিতামহ তার পুষিল সবারে।
কার শক্তি হয় বহিষ্কার করিবারে।।
দুর্য্যোধন বলে, যাহা কহিলে প্রমাণ।
পূর্ব্বে আমি জানিয়া করিলাম বিধান।।
যত রথী মহারথী আছে ভ্রাতৃগণ।
সবারে করিব বশ দিয়া বহুধন।।
সেবকগণেরে প্রতি নাহিক বিচার।
চিত্তেতে বুঝিয়া কার্য্য কর আপনার।।
এক বাক্য কহি, পিতা কর অবধান।
আছয়ে অপূর্ব্ব অতি অনুপম স্থান।।
নগর বারণাবত দেশের বাহির।
ভ্রাতৃ-মাতৃসহ তথা যাক যুধিষ্ঠির।।
হেথা আমি নিজরাজ্য স্ববশ করিলে।
এ স্থানে আসিবে পুনঃ কত দিন গেলে।।
ধৃতরাষ্ট্র বলেন, করিলা যে বিচার।
নিরবধি এই চিত্তে জাগয়ে আমার।।
পাপকর্ম্ম বলি ইহা প্রকাশ না করি।
গুপ্তে রাখিলাম লোকাচারে বড় ডরি।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ বিদুরের ধর্ম্মচিত।
এ কথা স্বীকার না করিবে কদাচিত।।
এই চারি জনা যদি নহিবে স্বীকার।
কার্য্যসিদ্ধি হইবেক কিমত তোমার।।
এত শুনি পুনরপি বলে দুর্য্যোধন।
তাহার যেমন ভীষ্ম আমার তেমন।।
অধর্ম্ম নাহিক হয়, ধর্ম্মার্থ বিচার।
ইহাতে নাহিক পাপ শুন কহি সার।।
অশ্বত্থামা গুরুপুত্র মম অনুগত।
দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা আমার সম্মত।।
বিদুর সর্ব্বাংশে সেবা করে পাণ্ডবেরে।
হইলে সহজে একা কি করিতে পারে।।
ত্বরিতে চিন্তহ পিতা উপায় ইহার।
পাণ্ডব থাকিতে নিদ্রা নাহিক আমার।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, যদি করি বহিষ্কার।
অপযশ ঘুষিবেক সকল সংসার।।
এমন উপায় করি করহ মন্ত্রণা।
আপন ইচ্ছায় যায় নগর বারণা।।
এত শুনি দুর্য্যোধন চলিল সত্বর।
নানারত্ন লৈয়া গেল মন্ত্রিগণ-ঘর।।
তবে দুর্য্যোধন দিয়া বিবিধ রতন।
ক্রমে ক্রমে বশ করে সম মন্ত্রিগণ।।
শিখাইল মন্ত্রিগণে কপট করিয়া।
নগর বারণাবত উত্তম বলিয়া।।
অনুব্রত কহে সবে সম্মুখে বিমুখে।
নগর বারণা সম নাহি ইহলোকে।।
দুর্য্যোধন-সম্মতি পাইয়া মন্ত্রিগণে।
সেইমত বলিতে লাগিল অনুক্ষণে।।
কত দিনে হৈল শিবরাত্রি চতুর্দ্দশী।
রাজার নিকটে বলে মন্ত্রিগণ বসি।।
নগর বারণাবত পুণ্যক্ষেত্র গণি।
প্রত্যক্ষে বৈসেন তথা দেব শূলপাণি।।
আর মন্ত্রী বলে, সে জগতে মনোরম।
নগর বারণাবত ভুবনে উত্তম।।
আর মন্ত্রি বলে, তার নাহিক তুলনা।
অমর কিন্নর তথা থাকে সর্ব্বজনা।।
মহাতীর্থ মহাস্থান ভুবন-মোহন।
নিত্যকৃত্য আসি করে যত দেবগণ।।
হেনমতে মন্ত্রিগণ বলিল বচন।
বিধির লিখন কর্ম্ম না যায় খণ্ডন।।
যুধিষ্ঠির বলেন, সে পুণ্যক্ষেত্রবর।
দেখিব বারণাবত কেমন নগর।।
এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র আনন্দিত-মন।
হৃদয়ে কপট, মুখে অমৃত- বচন।।
ইচ্ছা যদি হয় তথা করিতে বিহার।
সঙ্গে করি লৈয়া যাহ যত পরিবার।।
জননী সহিতে তথা পঞ্চ সহোদর।
যথাসুকে বিহরহ বারণানগর।।
ধনরত্ন সঙ্গে লহ যেই মন লয়।
কত দিন বঞ্চিয়া আইস নিজালয়।।
এত যদি ধৃতরাষ্ট্র বলে বারে বার।
বিস্মিত হইল রাজা ধর্ম্মের কুমার।।
দেখিবারে ইচ্ছামাত্র হইল আমার।
এখন যাইতে বলে সহ পরিবার।।
ধৃতরাষ্ট্র-আজ্ঞাবহ ধর্ম্মের নন্দন।
তাঁর আজ্ঞা কখন না করেন লঙ্ঘন।।
যাইব বারণাবত করি অঙ্গীকার।
ধৃতরাষ্ট্র-চরণে করেন নমস্কার।।
বিজ্ঞ মন্ত্রিগণে তবে করিয়া সম্ভাষ।
যুধিষ্ঠির চলিলেন জননীর পাশ।।
দেখি দুর্য্যোধন হৈল হরিষ অন্তর।
পুরোচন মন্ত্রী বলি ডাকিল সত্বর।।
জাতিতে যবন, দুর্য্যোধনের বিশ্বাস।
একান্তে আনিয়া তারে কহে মৃদুভাষ।।
তোমার সমান নাহি মন্ত্রীর ভিতরে।
পরম বিশ্বাসী তেঁই ডাকি হে তোমারে।।
তোমার সহিত আমি করি যে বিচার।
অন্য-জন-মধ্যে ইহা না হয় প্রচার।।
নগর বারণাবতে পাণ্ডুপুত্র যায়।
নগর বারণাতে পাণ্ডুপুত্র যা।
তারা না যাইতে আগে যাইবা তথায়।।
খচর সংযোগ রথে করি আরোহন।
অতি শীঘ্র তুমি তথা করহ গমন।।
উত্তম দেখিয়া স্থল করিবা আলয়।
অগ্নিগৃহ বিরচিবা যেন ব্যক্ত নয়।।
স্তম্ভ নির্ম্মি গর্ভ তার ঘৃতে পূরাইবে।
শণ আর জাউ দিয়া প্রাচীর রচিবে।।
মধ্যে মধ্যে দিবে বাঁশ ঘৃতে পূর্ণ করি।
যেই মতে অগ্নি দিলে নিবাইতে নারি।।
এমত রচিবা, কেহ লক্ষিতে না পারে।
নানা চিত্র বিরচিবা লোক মনোহরে।।
জতুগৃহ বেড়িয়া করিবে অস্ত্রঘর।
মঞ্চ বিরচিয়া অস্ত্র রাখিবে ভিতর।।
জতুগৃত হইতে কদাচিত হয় ত্রাণ।
অস্ত্রগৃহে অস্ত্রে বাজি হারাইবে প্রাণ।।
তার চতুর্দ্দিকে তবে খুদিবে গভীর।
লাফে যেন পার নাহি হয় ভীম বীর।।
সময় বুঝিয়া অগ্নি দিবে সে আলয়।
একত্র থাকিবা তবে সমস্ত সময়।।
ত্বরিতে চলিয়া যাহ, না কর বিলম্ব।
শীঘ্রগতি কর গিয়া গৃহের আরম্ভ।।
দুর্য্যোধন আজ্ঞা পেয়ে মন্ত্রী পুরোচন।
বাহন যুড়িল রথে পবন-গমন।।
ক্ষণেকে পাইল গিয়া বারণানগর।
গৃহ বিরচিতে নিয়োজিত অনুচর।।
যেমন করিয়া কহিলেন দুর্য্যোধন।
ততোধিক গৃহ বিরচিল পুরোচন।।
ভ্রাতৃ সহ যুধিষ্ঠির সহিত জননী।
সহ বৃদ্ধগণে যান মাগিতে মেলানি।।
বাহ্লীক গাঙ্গেয় দ্রোণ কৃপ সোমদত্ত।
গান্ধারী সহিত গৃহে নারীগণ যত।।
একে একে সবা স্থানে লইয়া বিদায়।
পুরোহিত বিপ্রগণে প্রণমিল রায়।।
পাণ্ডবে বিদায় লৈতে দেখি দ্বিজগণ।
ধৃতরাষ্ট্রে নিন্দে বহু করি কুবচন।।
দুষ্টবুদ্ধি ধর্ম্মশীল পাণ্ডু-পুত্রগণ।
বাহির করিয়া দেয় দুষ্ট দুর্য্যোধন।।
হেন ছার নগরে রহিতে না যুয়ায়।
যথা যান যুধিষ্ঠির, যাইব তথায়।।
কুরুকুলে মহাপাপী এই নৃপবর।
ইহার পাপেতে হৈবে সকল সংহার।।
ধৃতরাষ্ট্র করে যদি হেন দুরাচার।
কেমনে করেন ইহা গঙ্গার কুমার।।
তারা সবে সহিবেক, সবে দুষ্ট চিত।
মোরা সবে না সহিব, যাইব নিশ্চিত।।
এত বলি দ্বিজগণ চলিল সুমতি।
দারা পুত্র পরিবার লইয়া সংহতি।।
আগুসরি বিদুর গেলেন কত দূরে।
যুধিষ্ঠিরে কহিলেন কূট ভাষাচারে।।
বারণাবতেতে যাহ পঞ্চ সহোদর।
সাবধানে থাকিবা, আছয়ে তাহে ডর।।
যাহে জন্মে তাহে ভক্ষ্যে শীতল বিনাশে।
ইহার আছয়ে ভয় যাই সেই দেশে।।
এত বলি বিদুর করিল আলিঙ্গন।
স্নেহবশে শির ধরি করিল চুম্বন।।
নয়নের নীর ঝরে, ভাষে গদগদে।
যুধিষ্ঠির পঞ্চ ভাই প্রণমিল পদে।।
বাহুড়িয়া বিদুর চলিল নিজালয়।
বারণা গেলেন পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়।।
প্রবেশ করেন গিয়া নগর ভিতর।
আগুসরি নিল যত নগরের নর।।
হেনকালে পুরোচন করে নমস্কার।
ভূমিষ্ঠ হইয়া যেন রাজ-ব্যবহার।।
করযোড় করি দুষ্ট পুরোচন কহে।
হেথায় রহিয়া কেন, চল নিজ গৃহে।।
পূর্ব্ব হইতে হেথা আছে পুরীর নির্ম্মাণ।
মনোহর দিব্যস্থান স্বর্গের সমান।।
কুবের ভাস্কর জিনি পুরীর গঠন।
তাদৃশী নাহিক মর্ত্তে ইহার প্রমাণ।।
তব আগমন শুনি করিনু মণ্ডন।
বিলম্ব না কর তুমি, দিন শুভক্ষণ।।
এত শুনি হৃষ্ট হৈয়া পঞ্চ সহোদর।
জননী সহিত গিয়া প্রবেশেন ঘর।।
বিচিত্র নির্ম্মাণ মনোহর সে আলয়।
দেখি হৃষ্ট হইলেন ধর্ম্মের তনয়।।
তবে কতক্ষণে পুরী করি নিরীক্ষণ।
ভীমে দেখি যুধিষ্ঠির বলেন তখন।।
গৃহের পরীক্ষা দেখি লহ বৃকোদর।
মোর মনে বিশ্বাস না হয় এই ঘর।।
বৃকোদর নিল সেই ঘরের আঘ্রাণ।
জানিলেন ঘর জতু-ঘৃতের নির্ম্মাণ।।
বৃকোদর বিস্মিত কহেন যুধিষ্ঠিরে।
জতু-ঘৃত সরিষা তৈল গন্ধ পাই ঘরে।।
প্রত্যক্ষে অগ্নির ঘর ইথে নাহি আন।
আমা সবা দহিবারে করেছে নির্ম্মাণ।।
পথে দেখিলাম যত অনুচরগণ।
এই সব দ্রব্য এনেছিল অনুক্ষণ।।
যুধিষ্ঠির বলেন, সে প্রমাণ হইল।
আসিতে জটিল ভাষে বিদুর বলিল।।
বিশ্বাস করিয়া সবে থাকিলে এ ঘরে।
অচেতন হৈব যবে মোরা নিদ্রা ঘোরে।।
তখন অনল ইথে দিবে পুরোচন।
হেন বুদ্ধি করিয়াছে দুষ্ট দুর্য্যোধন।।
ভীম বলিলেন এই অনলের ঘর।
পুনরপি যাই চল হস্তিনা-নগর।।
যুধিষ্ঠির বলেন, এ নহে সুবিচার।
এই কথা লোকে তবে হইবে প্রচার।।
দুর্য্যোধন বিচার করিবেক নিজ চিতে।
নিশ্চয় আমার কার্য্য পারিল জানিতে।।
সৈন্যগণে সাজি দুষ্ট করিবেক রণ।
তার হাতে সর্ব্ব-সৈন্য সর্ব্ব রত্ন-ধন।।
কি কাজ বিবাদে ভাই না যাব তথায়।
নির্ধন নিঃসৈন্য আমি, নাহিক সহায়।।
সাবধান হৈয়া এই গৃহেতে বঞ্চিব।
আমরা যে জানি ইহা কারে না বলিব।।
পঞ্চ ভাই একত্র না রব কোন স্থালে।
হেথা হৈতে পলাইব কত দিন গেলে।।
অনুক্ষণ মৃগয়া করিব পঞ্চজন।
পথ ঘাট জ্ঞাত হব বন উপবন।।
সব জ্ঞাত হৈব, ইহা কেহ নাহি জানে।
হেনমত বিচার করিল ছয় জনে।।
সেথায় আকুল চিত্ত বিদুর সুমতি।
নিরন্তর অনুশোচে পাণ্ডবের প্রতি।।
কিমতে বাহির হৈবে জতুগৃহ হৈতে।
প্রেরিয়া কোন্ দূতে রক্ষিব অলক্ষিতে।।
বিচারিয়া বিদুর করিল অনুমান।
খনক আনিল, জানে সুডঙ্গ নির্ম্মাণ।।
খনক সুবুদ্ধি বড় বিদুরে বিশ্বাস।
সকল কহিয়া পাঠাইল ধর্ম্মপাশ।।
খনক করিল যুধিষ্ঠিরে নমস্কার।
ধীরে ধীরে কহে বিদুরের সমাচার।।
পাঠাইল বিদুর আমাকে তব কাছে।
ভূমি খনিবার বিদ্যা আমার যে আছে।।
একান্তে কহিল মোরে ডাকি নিজ পাশ।
বিদুরের লোক বলি না যাবে বিশ্বাস।।
অতএব, এই চিহ্ন কহিল আমারে।
আসিতে কি কূট ভাষা কহিল তোমারে।।
যুধিষ্ঠির শুনিয়া করিলেন আশ্বাস।
জানিলাম তোমারে নাহিক অবিশ্বাস।।
বিদুরের প্রিয় তুমি, তেঁই পাঠাইল।
তুমি যে বিদুর তুল্য, তাই জানা গেল।।
আমা সবাকার ভাগ্যে হৈলে উপনীত।
অবধানে দেখ দুষ্ট কৌরব-চরিত।।
শণ-জতু-ঘৃত-বাঁশ-সংযোগে রচিত।
যন্ত্রের খিলনি করি গৃহ চতুর্ভিত।।
করে চতুর্দ্দিকে গর্ত্ত গভীর বিস্তার।
অক্ষৌহিণী-বলে পুরোচন রাখে দ্বার।।
এইরূপে পড়িয়াছি বিপদ বন্ধনে।
উপায় করিয়া মুক্ত কর ছয় জনে।।
লোকে যেন নাহি জানে সব বিবরণ।
হেন বুদ্ধি কর, তুমি হও বিচক্ষণ।।
শুনিয়া খনক তবে করিল উত্তর।
খুদিতে লাগিল গর্ত্ত গৃহের ভিতর।।
সুড়ঙ্গের মুকে দিল কপাট উত্তম।
উপরে মৃত্তিকা দিয়া কৈল ভূমি সম।।
চতুর্দ্দিকে ছিল গর্ত্ত গহন গভীর।
ততোধিক তথায় খনিল মহাবীর।।
গঙ্গাতীর পর্য্যন্ত সুড়ঙ্গ খনি গেল।
সম্পূর্ণ করিয়া কার্য্য আসি নিবেদিল।।
শুনিয়া হরিষ চিত্তপঞ্চ সহোদর।
প্রণমিয়া খনক চলিল নিজ ঘর।।
পুনরপি কহে পূর্ব্ব বিদুর-বচন।
চতুর্দ্দশী-রাত্রে অগ্নি দিবে পুরোচন।।
সাবধান হইয়া থাকিবে ছয় জন।
এত বলি খনক চলিল ততক্ষণ।।
বিদুরে কহিল গিয়া সব বিবরণ।
বারণাবতেতে যত কৈল প্রকরণ।।
খনকের মুখে বার্ত্তা বিদুর পাইল।
শুনিয়া বিদুর বড় সন্তুষ্ট হইল।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।