এত বলি মারুতি যে হইল বিদায়।
মহামায়া মন্দিরেতে অবিলম্বে যায়।।
পক্ষীরূপে কহিলেন যোগাদ্যার কাণে।
মহী বেটা আনিয়াছে শ্রীরাম লক্ষ্মণে।।
নরবলি দিবে শুনি বেলা দ্বিপ্রহরে।
আপনি কি এই আজ্ঞা করেছে মহীরে।।
সবংশে মারিব মহী দেখিবে পশ্চাতে।
ডুবাব তোমারে জলে মন্দির সহিতে।।
রামের কিঙ্কর আমি সুগ্রীবের দাস।
এত শুনি দেবীর ঈষৎ হৈল হাস।।
মহাদেবী কহিছেন অতি সঙ্গোপনে।
পবিত্র হইল পুরী রাম-আগমনে।।
অশেষ পাপের পাপী এ মহীরাবণ।
দেব দ্বিজ ধর্ম্ম হিংসা করে অনুক্ষণ।।
নিশাচর নাশিতে শ্রীরাম-অবতার।
রামেরে আনিল মহী হইতে সংহার।।
মহী বিনাশের যুক্তি শুন হনুমান।
যখন আনিবে রামে দিতে বলিদান।।
রামেরে কহিবে কর দেবীরে প্রণাম।
প্রণাম না জানি যেন কহেন শ্রীরাম।।
রাম কহিবেন শুন হে মহীরাবণ।
দেখাইয়া দেহ দেখি প্রণাম কেমন।।
প্রণাম করিবে মহী দেখাতে রামেরে।
অষ্টাঙ্গ লোটায়ে রবে ভূমির উপরে।।
হেঁটমুণ্ডে পড়ে মহী প্রণাম করিবে।
তুমি লয়ে এই খড়্গ মহীরে কাটিবে।।
দেবী বলিছেন বাছা এই যুক্তি সার।
শ্রীরামের কর্ণে গিয়া কহ সমাচার।।
শ্রীরাম শিবের গুরু আমি তাহা জানি।
শিব রাম অভেদ কহেন শূলপাণি।।
অনাথের নাথ রাম জগতের সার।
পলকে উৎপত্তি স্থিতি জগৎ সংসার।।
যোগে যোগাধার রাম কালে মহাকাল।
রাম-আগমনে ধন্য হইল পাতাল।।
মূঢ়বুদ্ধি মহী চাহে রামে দিতে বলি।
অবশেষে হবে যাহা জানি তা সকলি।।
দেবীরে প্রণাম করি হনুমান গেল।
শ্রীরামের নিকটেতে উপনীত হৈল।।
যেখানে আছেন বন্দী শ্রীরাম লক্ষ্মণে।
কহিল দেবীর কথা দুজনার কাণে।।
উপায় কহিয়া দেবী দিলেন মন্ত্রণা।
যখন করিবে মহী দেবী-আরাধনা।।
যখন লইয়া যাবে তোমা দোঁহাকারে।
সেইক্ষণে আমি গিয়া প্রবেশিব ঘরে।।
মক্ষীরূপ হইয়া থাকিব অলক্ষিতে।
আসিবে মহীরাবণ দেবীরে পূজিতে।।
প্রণাম করিতে কবে সমাপিয়া পূজা।
প্রণাম না জানি, মোরা রাজপুত্র রাজা।।
কিরূপে প্রণাম করে কিছুই না জানি।
প্রণাম করিয়া রাজা দেখাও আপনি।।
প্রণাম করিবে রাজা দেবী-বিদ্যমান।
মুণ্ড কাটি তখনি করিব দুইখান।।
তোমাদের বাক্যে যদি না করে প্রণাম।
সবংশে বধিব বেটায় করিয়া সংগ্রাম।।
বুকে হাঁটু দিয়া মুণ্ড ফেলিব ছিঁড়িয়া।
যাইব মহীর রক্তে দেবীরে পূজিয়া।।
মারুতির বচনে হরিষ দুই ভাই।
তোমা হৈতে সঙ্কটেতে পরিত্রাণ পাই।।
এই যুক্তি করিয়া রহিল তিনজন।
দেবীরে পূজিতে মহী করিলা গমন।।
আদেশিয়া আনাইল শ্রীরাম লক্ষ্মণে।
দুজনারে রাখে এনে দেবীর দক্ষিণে।।
হেনকালে হনুমান প্রবেশিল ঘরে।
অলক্ষিতে রহিলেন দেবীর প্রান্তরে।।
পূজা করিবারে রাজা বসিল আসনে।
প্রতিমার আড়ে থাকি হনু দেখে শুনে।।
নিকট হইল কাল সে মহীরাবণে।
কৃত্তিবাস বিরচিল গীত রামায়ণে।।
০৭৯. মহীরাবণ বধ
করযোড়ে ব্রহ্মারে কহেন সুরপতি।
রাম লক্ষ্মণের কিসে হইবে নিষ্কৃতি।।
মহীরাবণ হরিয়া লয়েছে দুই ভাই।
কেমনে উদ্ধার হবে ভাবি মনে তাই।।
এতেক শুনিয়া ব্রহ্মা ইন্দ্রের বচন।
হাসিয়া বলেন শুন সর্ব্ব দেবগণ।।
শত্রুধনু নামে ছিল গন্ধর্ব্ব-সন্তান।
বিষ্ণুর সম্মুখে নিত্য করে নৃত্য গান।।
নিত্য নিত্য নৃত্য করে বিষ্ণুর সদন।
তাহাতে বড়ই তুষ্ট দেব নারায়ণ।।
বিষ্ণু-সম্ভাষিতে গেল অষ্টাবক্র-ঋষি।
বাঁকা-মূর্ত্তি দেখিয়া গন্ধর্ব্বে হৈল হাসি।।
বাঁকারূপ দেখিয়া গন্ধর্ব্ব করে ব্যঙ্গ।
মুনিরে দেখিতে তার হৈল তাল ভঙ্গ।।
মুনি কহে মোরে দেখি কর উপহাস।
সুন্দর শরীর তব হইবে বিনাশ।।
পাপী হয়ে জন্ম গিয়া রাক্ষসের কুলে।
ধরিয়া বিকট মূর্ত্তি থাকহ পাতালে।।
শুনিয়া মুনির শাপ চিন্তে বিদ্যাধর।
কি দোষে দারুণ শাপ দিলে মুনিবর।।
অজ্ঞান পাতকী আমি তোমা নাহি চিনি।
ত্রিভুবনে পূজিত আপনি মহামুনি।।
কৃপা কর ধরি আমি তোমার চরণ।
কর প্রভু এ পাপীর শাপ বিমোচন।।
শত্রুধনু-বচন শুনিয়া মুনিবর।
প্রসন্ন হইয়া তবে করেন উত্তর।।
আমার বচন কভু না হইবে আন।
পাতালে রহিবে হয়ে রাক্ষস প্রধান।।
তপঃ ফলে মহামায়া থাকিবেন ঘরে।
সুখেতে করিবে রাজ্য মহেশের বরে।।
দুরন্ত রাক্ষস-বংশ করিতে সংহার।
মনুষ্য-রূপেতে বিষ্ণু হবেন অবতার।।
সেই রাম লক্ষ্মণেরে লয়ে যাবে হরে।
পাতালে রাখিবে লয়ে আপনার পুরে।।
মুণ্ড কাটা যাবে তোর হনুমান-হাতে।
শাপমুক্ত হয়ে পুনঃ আসিবে স্বর্গেতে।।
হনুমান হাতে হবে শাপ-বিমোচন।
আমার বচন মিথ্যা নহে কদাচন।।
এতেক বলিয়া মুনি গেলেন স্বস্থানে।
সেই হৈল মহীরাবণ পাতাল ভুবনে।।
মুনির বচন কভু নহেত অন্যথা।
দেবগণ চলি গেল দুই ভাই যথা।।
ব্রহ্মা আদি করিয়া যতেক দেবগণ।
কৌতুকে দেখিতে যান মহীর মরণ।।
যতেক দেবতাগণ রহে শূন্য-পথে।
মহামায়া পূজে মহী হরিষ মনেতে।।
রাশি রাশি ফুল ফল দিয়া রাজা পূজে।
শঙ্খ ঘণ্টা ঢাক ঢোল নানা বাদ্য বাজে।।
অর্চ্চনা করিল রাজা খাণ্ডা খরশান।
প্রণাম করিতে মহী কৈল সম্বিধান।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ বলে প্রণাম না জানি।
কেমনে প্রণাম করে দেখাও আপনি।।
বিধির নির্ব্বন্ধ কভু খণ্ডাইতে নারি।
রামেরে দেখায় রাজা নমস্কার করি।।
শত দণ্ডবৎ করে দেবীর সম্মুখে।
প্রতিমার আড়ে থাকি হনুমান দেখে।।
দেবীর হাতের খড়্গ লয়ে হনুমান।
লাফ দিয়া মহীরে কৈল দুইখান।।
প্রতিমা-রূপিণী দেবী মহামায়া হাসে।
অনুচরগণ দেখে পলায় তরাসে।।
মুক্ত করিলেন হনু শ্রীরাম লক্ষ্মণে।
হনুর প্রতাপেতে হাসেন দুইজনে।।
অন্তরীক্ষে থাকিয়া বাখানে দেবগণ।
হনুমানে কোল দিলা শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
অদ্ভুত অশ্রুত কথা রাম-অবতার।
সেবক হইতে রামের হইল নিস্তার।।
মুনি-শাপে মুক্ত হৈল সে মহীরাবণ।
গন্ধর্ব্বরূপেতে গেল অমর-ভুবন।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ।
লঙ্কাকাণ্ডে গাহিলেন গীত রামায়ণ।।