৭৭তম অধ্যায়
শ্রীকৃষ্ণ কর্ত্তৃক সুভদ্রাকে সান্ত্বনাপ্রদান
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! শোকদুঃখাকুল বাসুদেব ও ধনঞ্জয় সেই রাত্রিতে নিদ্রাসুখ অনুভব করিতে পারিলেন না। তাঁহারা কেবল ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গের ন্যায় দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ নর ও নারায়ণকে জাতক্ৰোধ জানিয়া, না জানি কি দুর্ঘটনা ঘটিবে এই চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া নিতান্ত ব্যথিত হইলেন। নিদারুণ, রুক্ষ, অমঙ্গল সূচক বায়ু প্রবাহিত হইতে লাগিল; দিবাকরে কবন্ধ ও অর্গল দৃষ্ট হইল; বিনা মেঘে বজ্রাঘাত নির্ঘাত ও বিদ্যুৎপাত হইতে লাগিল; পৃথিবী শৈল ও কাননের সহিত বিকম্পিত এবং সাগর সকল ক্ষুব্ধ হইল, নদী সকল প্রতিকূলস্রোতে প্রবাহিত হইতে লাগিল; রাক্ষসগণের প্রমোদ ও যম রাজ্য সংবর্দ্ধনের নিমিত্ত রথী, অশ্ব, মনুষ্য ও মাতঙ্গগণের ওষ্ঠাধর স্ফুরিত হইতে লাগিল এবং বাহন সকল মলমূত্র পরিত্যাগ ও রোদন করিতে আরম্ভ করিল। হে মহারাজ! আপনার সৈন্যগণ এই সমস্ত লোমহর্ষণ নিদারুণ উৎপাত দর্শন ও মহাবল সব্যসাচীর কঠোর প্রতিজ্ঞা শ্রবণে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া উঠিল।
এ দিকে মহাবাহু ধনঞ্জয় বাসুদেবকে কহিলেন, “কেশব! তুমি তোমার ভগিনী সুভদ্রাকে এবং আমার পুত্রবধু ও তাহার বয়স্যাগণকে সান্ত্বনাবাক্যে আশ্বাসিত করিয়া তাঁহাদের শোকাপনোদন কর।”
তখন নিতান্ত দুৰ্ম্মনায়মান বাসুদেব অর্জ্জুনের গৃহে গমন পূর্ব্বক পুত্রশোকাকুলা ভগিনীকে আশ্বাস প্রদান করত কহিলেন, সুভদ্রে! কুমারের নিমিত্ত স্নুষার সহিত আর শোক করিও না; কাল সকল প্রাণীকেই ধ্বংস করিয়া থাকে। সৎ কুলজাত ধৈর্য্যশালী ক্ষত্রিয়ের যে রূপে প্রাণ পরিত্যাগ করা উচিত, তোমার পুত্র সেই রূপেই প্রাণ ত্যাগ করিয়াছে; অতএব আর শোক করিবার আবশ্যক নাই। মহারথ ধীর, পিতৃ তুল্য পরাক্রমশালী অভিমন্যু ভাগ্যক্রমেই বীরগণের অভিলষিত গতিপ্রাপ্ত হইয়াছে। মহাবীর অভিমন্যু ভূরি ভূরি শত্ৰু সংহার করিয়া পুণ্যজনিত সৰ্ব্বকামপ্রদ, অক্ষয় লোকে গমন করিয়াছে। সাধুগণ তপস্যা, ব্রহ্মচর্য্য, শাস্ত্র ও প্রজ্ঞা দ্বারা যেরূপ গতি অভিলাষ করেন, তোমার কুমারের সেইরূপ গতিই লাভ হইয়াছে। হে সুভদ্রে! তুমি বীর জননী, বীরপত্নী, বীরনন্দিনী ও বীর বান্ধবা; অতএব তনয়ের নিমিত্ত শোকাকুল হওয়া তোমার উচিত নহে তোমার পুত্র পরম গতি লাভ করিয়াছে। হে বরারোহে! পাপাত্মা শিশু ঘাতক সিন্ধুরাজ বন্ধুবান্ধবগণের সহিত এই গর্ব্বের প্রতিফল প্রাপ্ত হইবে। ঐ পাপকারী রজনী প্রভাত হইলে অমরাবতীতে প্রবেশ করিলেও ধনঞ্জয়ের নিকট পরিত্রাণ পাইবে না। কালি অবশ্যই তোমার শ্রবণগোচর হইবে যে, সিন্ধু রাজের মস্তক সমন্তপঞ্চকের বহিঃপ্রদেশে সমানীত হইয়াছে; অতএব শোক পরিত্যাগ কর, রোদন করিও না। শস্ত্রজীবিগণ যেরূপ গতি লাভ করিয়া থাকেন, শৌর্য্যশালী অভিমন্যু ক্ষাত্ৰধর্ম্ম অনুসারে সেই গতি প্রাপ্ত হইয়াছে। বিশালবক্ষাঃ, মহাবাহু, সমরে অপরাঙ্মুখ, রথিগণের নিহন্তা, পিতা ও মাতৃ পক্ষের অনুগত, বীর্য্যবান, শৌৰ্য্যশালী, মহারথ অভিমন্যু সহস্র সহস্র শত্রুকে সংহার করিয়া স্বর্গে গমন করিয়াছে; অতএব তুমি শোক পরিত্যাগ কর। হে ভদ্রে! পার্থ যাহা প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন; তাহা অবশ্যই সফল হইবে; কদাচ অন্যথা হইবে না। তোমার স্বামীর চিকীর্ষিত বিষয় কখনই নিষ্ফল হয় নাই। যদি সমুদায় মনুষ্য, সর্প, পিশাচ, রাক্ষস, পতঙ্গ, সুর ও অসুরগণ রণক্ষেত্রগত সিন্ধুরাজের সহিত মিলিত হন, তথাপি সিন্ধুরাজ তাঁহাদিগের সহিত বিনষ্ট হইবে।”